#শখের_সাদা_শাড়ি পর্ব১৩
১৩.
ব্যস্ততা মানুষ কে ভোগায়। ব্যস্ততা মানুষ কে কাঁদায়। সমীর উর্মি দুজনেই ব্যস্ত। যখন একজনের ফ্রি টাইম আসে তখন আবার অপরজন ব্যস্ত থাকে। এই করে করে দশ টা দিন পেরিয়ে গেল। শুধু হাই হ্যালো ছাড়া আর কিছুই বলা হয় নি। উর্মি আজকাল চটপটে ভাব হারিয়ে ফেলে। প্রায় সময় ক্লান্ত হয়ে বসে থাকে। যখন সৌমেন এর কল আসে তখন হুরমুরিয়ে উঠে কাজে নামে। এমন করে তিন দিন সিডিউল এর গড়মিল করেছে। সৌমেন খুব বকেছে ও। উর্মির খারাপ লাগে নি। সে নির্বিঘ্নে চলে এসেছে। আজকাল আবার সৌমেন এর ব্যবসা খারাপ যায়। সে ব্যস্ত হয়ে মিটিং বসায় হুটহাট। সবাই কে খুব কাজ করতে হচ্ছে। এই নিয়ে উর্মি পরেছে যন্ত্রণায়। লাঞ্চ টাইমে নিয়ম করে কল করে সমীর কে। সমীর বলে ব্যস্ত আছি উর্মি। পরে কল করছি। হুম বলে কেঁটে দেয় উর্মি। যখন সমীর কল করে তখন আবার উর্মির মাথায় কাজ। রিসিভ করেই বলে কাজ করছি। দুজনেই দু প্রান্তে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সব কিছু সময়ের সাথে সাথে কেমন যেন তিক্ত হয়ে আসে। ভালো লাগে না এই কাজ। কর্ম কে নিকৃষ্ট মনে হয়। তবে এই কর্মেই পেট চলে। চলে কারো সংসার। দুদিন আগেই মেঘনার ব্যথা উঠেছিল। উর্মি এতো কাজের চাপে যেতেই পারে নি। আজ যাবে বলে স্থির করলো। হাতে সময় মাত্র দেড় ঘন্টা। তড়ি ঘড়ি করে ফোন দেয়। মেঘনা জানায় সে এখন ঠিক আছে। আর কোথায় নাকি ঘুরতে এসেছে। উর্মি ব্যস্ত হয়। এই সময় টা ঘুরাঘুরির না সেটা বোঝায়। তবে মেঘনা বলে নয়ন আছে পাশে। কিছু হবে না তাঁর। উর্মি স্থির থাকে। কথা শেষে আবার কাজে নেমে পরে। প্রচুর কাজ। একবার কল করে সমীর এর নাম্বারে। সুইচ অফ বলে। হয়তো কাজের মাঝে আছে। উর্মি কাজ করে তবে মন নেই একটু ও। হাত মুখে পানি দিয়ে আসে। সৌমেন এর রুমে গিয়ে মিটিং করে। সৌমেন কে কেমন রুগ্ন দেখায়। গলার কাছ টা কেমন বার বার উঠা নামা করে। ফর্সা গাল টা রক্তিম।
” আপনি কি অসুস্থ স্যার? ”
” কিছু টা। ঠান্ডা লেগেছ। ”
” ওও। ”
উর্মি আবার কাজে ফিরে। মাইশা আসে। হাতে কিছু ফাইল। উর্মি কাজ শেষ করে চলে আসে নিজ কেবিনে। এক মনে তাকিয়ে থাকে জানালা দিয়ে। বাসায় কল করে। অন্তু জানায় তার মা চাচি আবার ঝগড়ায় নেমেছে। আগে কখনোই এমন টা হয় নি। ইদানিং দুজনেই খুব ঝগড়া করছে। চিন্তিত হয় উর্মি। মাথা ঘুরায়। মেঘনা কে কল করলে মেঘনা খুব সুন্দর করে মিথ্যে বলে। তবে উর্মি জানে মেয়ে টা ভালো নেই। মন কে চেপে ধরে উর্মি। আজ যাবে মেঘনার শশুর বাড়ি। গিয়ে দেখবে কেমন ভালো আছে তাঁর আপা।
দরজা খুলতেই চমকালো মেঘনা। কপাল বেয়ে নেমে আসা ঘাম আর শরীরে মলিন কাপড়। সব মিলিয়ে বাড়ির কাজের লোক টার ও বোধহয় এমন হাল হয় না। উর্মির গলা টা ধরে আসে। খেই হারিয়ে ফেলে। এটা তার আপা? মাত্র কয়েক দিনে কি হাল করে ফেলেছে অমানুষ গুলো! উর্মি স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনে। মেঘনা বৃথা হাসার চেষ্টা করলো। তবে চোখ গুলো যেন হাজার খানেক অভিযোগ দাঁড় করায়। মেঘনা লুকাতে চায় সেসব। চোখের পানি আড়ালে নিতে বোন কে জড়িয়ে ধরে। কুশলাদি করার চেষ্টা চালায়। পাশেই বালতি ভর্তি নোংরা জল। বোঝা যায় ঘর মুছছিল মেঘনা। উর্মি চুপ করে থাকে।আশ পাশে তাকায়। ওম্নি করে উর্মির শাশুড়ির হাক ডাক ” মেঘনা মেঘনা কি করো এতো সময় ধরে। কখন বলেছি চা করে দিতে। ঘর ঝাড়ু দিয়ে মুছতে এতো টাইম লাগে। ”
মেঘনা চুপ করে থাকে। লজ্জায় মাথা কাঁটা যায় যেন। উর্মি তাকায় আপার নিকট। মেয়েটা কাঁদতে চাইছে না। তবে বেহায়া চোখ থামে না। ফুপিয়ে উঠে সে। মেঘনার চোখের একেক বিন্দু উর্মির উপর বিষ ঢেলে দেওয়ার মত যন্ত্রণা দেয়। এরা মানুষ?
” মেঘনা, এই মেঘনা কথার উত্তর দেও না কেন। একটু কাজ সেটা ও এত লেট। মেঘনা — ”
মেঘনার শাশুড়ি ড্রয়িং রুমে এসে থেমে যান। উর্মি সৌজন্য বোধ থেকে সালাম টুকু দেয় আর তারপর ই আপার হাত ধরে বের করে নিয়ে আসে এক কাপড়ে। নয়ন ভাই এর সাথে বোঝাপড়া টা না হয় পরেই হবে।
সৌমেন টেবিলে মাথা গুজে আছে। সব কিছু তে অদ্ভুত তিক্ততা নেমে এসেছে। বিজনেস যাচ্ছে রসাতলে। প্রায় সময় ই অসুস্থ বোধ করে। সৌমেন এর বাবা মাহফুজ সাহেব ছেলের এই অবস্থা দেখে চিন্তিত। মা বাবার যত্নের ছেলে সৌমেন। বড্ড বেশি ভালোবাসেন। অবশ্য অতি দরদের কারণ বিয়ের নয় বছর পর এই সন্তান লাভ। খুব ছোট বয়সে বিয়ে করেন মাহফুজ সাহেব। বিয়ের নয় বছরে ও সন্তান হচ্ছিল না। অবশেষে আল্লাহর দয়া তে পেলেন চাঁদের টুকরো কে। সেই চাঁদের টুকরো আবার অসুস্থ। তিনি ষাট বছরে পা রেখে ও যতো টা সুস্থ ছেলেটা যেন আজকাল ততোটাই অসুস্থ। স্থবির ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন স্ত্রীর সাথে এই বিষয়ে গম্ভীর এক আলোচনায় বসতে হচ্ছে। ছেলেটা আবার কোনো রোগে পরে নি তো। কি যে চেকাপ করালো সেদিন কে জানে। সব সুস্থ থাকলে এতো ক্লান্ত হয়ে পরে কেন?
তুলির সাথে সৌজন্যের ঝগড়া চলছে।
নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে ছোট ভাবি। সহসা এদের বিষয়ে নাক গলায় না উর্মি। তবু ও আজ সহ্য হচ্ছে না। ছোট ভাইয়ের রুমের কাছে এসে দাঁড়ালো। তুলি তখন বলছে–
” বউ পালা না পারলে বিয়ে করেছো কেন? সংসারে টাকা ঢেলেই সব টাকা শেষ হয়ে যায় তাই না। আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি? সাজ গোজ করতে ইচ্ছে করে না আমার। ”
” পাঁচ হাজার টাকা তে ও তোমার হচ্ছেনা তুলি। জানোই তো সেদিন জব টায় ধরা খেলাম। দেখলে তো কতো গুলো টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হলো। এখন তুমিই বলো আমি কি করবো। এই সময়ে দশ হাজার টাকা করে দেওয়া কি করে সম্ভব? ”
” কেন সম্ভব না। নতুন চাকরির বেতন তো ত্রিশ হাজার টাকা। সংসার খরচ কেন বেশি দিচ্ছো? সেখান থেকে হাজার দুয়েক টাকা কমিয়ে নাও। তোমার বোন ও তো কম করেই দেয়। ”
” আহ তুলি। তুমি তো জানোই ”
” সরো সামনে থেকে। ”
সৌজন্য কে ধাক্কা দিয়ে সরে আসে তুলি। দশ হাজার টাকা সংসার খরচ কেন দেয় এটা তুলি জানে ঠিক ই। তবু ও তুলি বেশি কথা বলছে। এই যে রাত দিন চব্বিশ টা ঘন্টা এসি অন করে বসে থাকে তুলি এই কারনে বিল আসে তিন হাজারের ও উপরে। রোজ নিয়ম করে যে পানির কল ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হাত পা পরিষ্কার করে। এসবের খরচা তো কম হচ্ছে না। তবু ও সেই খরচা নিয়ে প্রশ্ন করে তুলি। অন্য কারো ঘরে তো এসি নেই যে সমান ভাগ তুলবে। সৌজন্য চিন্তায় বসে থাকে। সেভিং এর টাকা টা কোনো মতে চালাতে হচ্ছে। না হলে বছর শেষে যে লাভ টা পাওয়ার কথা সেটা আর পাবে না। উর্মি দরজার কাছ থেকে সরে আসে। নক করার ইচ্ছে হয় না। সে মনে মনে এক সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তুর জন্য সেভিং এর টাকা টা যেমন দিয়েছে ঠিক তেমনি ভাবে ছোট ভাবির জন্য ভাইয়ার হাতে কিছু টাকা গুজে দিবে। তুলির আবার সম্মানবোধ খুব। টাকার জন্য জ্বলবে ঠিক তবে উর্মি নিজ হাতে দিলে ফিরিয়ে দিবে। বলবে আমি কি ফকির নাকি?
পনেরো টা দিন পর আজকের দিন টা ফ্রি পেল সমীর। লোকে বলে ব্যস্ততা নাকি গুরুত্বের উপর ডিপেন্ড করে। তবে এ কথা টা শতভাগ সত্য নয়। উর্মি তার নিকট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবুও ব্যস্ততার জন্য উর্মির সাথে ঠিক ঠাক কথা হয় নি। সোশ্যাল সাইট গুলো তে যাওয়া হয় নি অনেক গুলো দিন। আবার সেভাবে দেখতে গেলে ব্যস্ততা সত্যিই গুরুত্বের উপর ডিপেন্ড করে। সে যাই হোক না কেন সমীর আজ উর্মি কি কল করেছে। গভীর রাতে কল করায় ব্যলকনিতে এলো উর্মি। ধীরে ধীরে ঘুম জড়ানো কন্ঠ টা খোলসা করলো।
” কেমন আছো তুমি? ”
” ভালোই। ”
” বেশি ভালো না? ”
” উহু। কি করে বেশি ভালো থাকি বলো উর্মি। এই সব কিছু ফেলে চলে আসতে ইচ্ছে করে। ”
” চলে আসো তাহলে। ”
” সত্যিই চলে আসবো? ”
” আরে পাগল নাকি। কাজে গেছো। কত টা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেটি ভেবেছো? ”
” বাট তোমার থেকে তো নয়। ”
নিশব্দে হাসলো উর্মি। সমীর হঠাৎ ই আবেগঘন হয়ে পরলো। ভীষণ ভাবে আকর্ষিত কন্ঠে বলল–
” আমি তোমায় ভালোবাসি উর্মি। ভীষণ ভালোবাসি। নিজের থেকে ও বেশি। আমার শখের মানুষ তুমি। যাকে পেলে আমার জীবনের সব থেকে সুন্দর শখ টি পূর্ণতা পাবে। আমার শখের প্রণয়িনী। ”
চলবে…….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
পর্ব ১৪
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/156396640254572/