#শখের_সাদা_শাড়ি পর্ব১৬
১৬.
সৌমেন এর বেস্টফ্রেন্ড অনুজ। হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলে ও দুই প্রান্তের দুই ব্যক্তিত্ব শুরু থেকেই মিলেমিশে ছিলো একাকার। কেউ কখনো কোনো বিষয় লুকায় নি একে অপরের থেকে। সৌমেন ও নিজের জীবনের এক এক টা খন্ড জানিয়ে রাখতো ভিন্ন ধর্মী এই বন্ধু টি কে। ইতো মধ্যেই সৌমেন এর অসুস্থতার খবর চলে গেছে অনুজের নিকট। অস্ট্রেলিয়া থাকে সে। ভালো ব্যবসা সেখানে। সব কিছু ঠিক থাকায় টিকেট পেতে বেশি বেগ পেতে হয় নি। তবে স্ত্রী কে সাথে নিয়ে আসতে পারে নি। কয়েক দিন পর সে ও চলে আসবে। বন্ধুর অসুস্থতার খবর পেয়েই ছুটে চলে এসেছে বন্ধুর নিকট। উর্মি লোক টা কে দেখে যা বুঝলো এতে করে অন্তরের মধ্য ভাগে এক রাশ ভালো লাগা কাজ করছে। মানুষ টা কতো টা উদ্বিগ্ন বন্ধুর জন্য। সত্যিই বন্ধু শব্দ টির মাঝে লুকিয়ে আছে বিশাল এক মুগ্ধতা। যা ধর্ম বর্ণ সব কিছুর থেকে বহু দূরে। যেখানে শুধু বিশ্বাস রাখা হয় সত্য কে আর গ্রহণ করা হয় মনুষ্যত্ব কে। আত্মিক বন্ধন কে আগলে রেখে তৈরি হয় সম্পর্ক। বেডে শুয়ে থাকা সৌমেন কে দেখে সবাই অনেক টাই স্তব্ধ। তাকে আনা হয়েছে কেবিনে। একে একে সবাই ভীড় করছে দরজার নিকট। সবাই এক ঝলক দেখছে ছেলে টা কে। সবল দেহের জন্য প্রায় সময় কলেজ কিংবা ভারসিটির এনাউল ফাংশন গুলো তে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সৌমেন। আজ সেই মানুষ টা হসপিটালের বেডে! মাহফুজ সাহেব কে বিশেষ ব্যস্ত দেখাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় টা তে বোধহয় নিজেকে খাপ খাইয়ে ফেলেছেন। স্ত্রী কে এখনো জাগ্রত করা হয় নি। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। অনুজ কে দেখে সৌজন্যতার হাসি দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলেন। পরক্ষণেই সেই হাসি টা অশ্রু তে পরিণত হলো। উর্মি এক বার নিশ্বাস ফেললো। প্রতি টা বাবা মা ই চান সন্তান দের ভালো হোক। অনুজ উর্মি কে দেখে চিকন চোখে তাকালো। মেয়েটি কে এর আগে দেখেছে বলে মনে হয় না। ভাবনার মাঝেই ডাক্তার বের হলেন। উর্মি এগিয়ে এলো তবে কিছু বললো না। অনুজ মাহফুজ সাহেব এর কাধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলো কিছুক্ষণ। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো হাতেই কিছু নেই। ডাক্তারের সাথে কথা বলে সে। সব শুনে অনুজ শুধালো
” ব্রেন হেমারেজ হয়েছে কি? ”
” এখনো সিউর করে বলা যাচ্ছে না। কথা বললে বোঝা যাবে। ”
” রিপোর্ট কি বলে? ”
চুপচাপ দেখালো ডাক্তার কে। তিনি অনুজ কে সাথে নিয়ে একটু দূরে এলেন। উর্মি নজর ফিরিয়ে নিলো। মাহফুজ সাহেব বসে ছিলেন। সুস্মিতা বেগমের চিৎকারে ছুটে গেলেন। তিনি চেতনা ফিরে পেয়েছেন। ছেলের জন্য এখন পাগলামি শুরু করেছেন। জাপটে ধরলো উর্মি।সোফা তে বসে পরলেন মাহফুজ সাহেব। মস্তিষ্ক চলে না আর। মুখ ঢেকে ফেললেন হাতের তালু তে। উর্মি কোনো মতে মিথ্যে বুঝ দিচ্ছে তবে আদৌ কি সুস্থ হয়েছে সৌমেন?
উর্মি বাসায় ফিরলো রাত একটায়। এই মাঝ রাত্রি তে ফিরতে দিতে চান নি মাহফুজ সাহেব। তবে কাল সকালে কোর্ট এর ডেট পরেছে। নয়ন ডিভোর্স ফাইল করার জন্য কেস করেছে। উর্মি কে কেমন যেন রুক্ষ দেখায়। এপাশ ওপাশ করলে ও ঘুমায় নি মেঘনা। উর্মির মুখের অবস্থা দেখে উঠে পরে। উর্মি সেটা খেয়াল করে নি। ওর মন অন্য স্থানে। ধীর কন্ঠে ডাকে মেঘনা। উর্মি সচকিত হয়ে মেঘনা কে জাপটে ধরে। হাত পা কেমন নিশ্চল দেখায়। মেঘনা বুঝে না কি হয়েছে। উর্মি ফুপিয়ে কাঁদে।
” ছোট ভাইয়ার সাথে ভাবির খুব ঝগড়া হয়েছে রে আপা। ”
” এ আর নতুন কি। এটা তো প্রায় ই হচ্ছে এখন। ঘুমিয়ে পর। ”
” না রে আপা। নিত্য দিনের ঝগড়া না রে। এটা অনেক বড় ইস্যু। ”
” তাতে তোর কি? মনে আছে সেদিন কি বলেছিল ওরা। আমাদের সংসার আমরা বুঝবো। শোন বোন, বড় ভাবি লোভী হতে পারে তবে কখনো অহংকার করে না। ”
একটু থামে মেঘনা। পা টা মেলে দিয়ে আবার বলে–
” তবে ছোট ভাবি অহংকারী। সাথে সাথে আমাদের ভাই টা কে অহংকারী বানিয়ে তুলেছে। আমি ওর সম্পর্কে কিছু শুনতেই চাই না। ”
মেঘনা রাগ করে ঘুমিয়ে পরলো। উর্মি চুপ চাপ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মন টা বড্ড খারাপ। চারদিকে ঝামেলা। সুখ, শখ, আল্লাদ সব কিছু কেমন মলিন। সমীর এর কথা ভীষণ মনে পরে। কল করে উর্মি। সমীর ঘুমিয়ে ছিল। উর্মির নাম দেখেই ধরমরিয়ে উঠে।
” ভালো লাগছে না সমীর। ”
” কি হয়েছে উর্মি? ”
” জানি না। শুধু জানি ভালো লাগছে না। ”
” তুমি ঠিক আছো তো। এমন লাগে কেন কন্ঠ টা? ”
সমীর এর কন্ঠ টা ও চিন্তিত। উর্মি শিউরে উঠে। ব্যথা হয় বুকে। বিশেষ আয়োজন নেই আজ। কোনো রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই বলে উঠে
” আমি তোমাকে ভালোবাসি সমীর। আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”
ওপাশের মানুষ টি বোধহয় বিস্মিত। কেঁপে উঠেছে প্রতি টা শিরা। সমীর এর চোখ দুটো ঝাপসা হতে শুরু করলো। উর্মি উত্তরের অপেক্ষায়। সমীর চুপচাপ থেকে মৌনতা ভেঙে বলল–
” আমার একটু সময় প্রয়োজন উর্মি। ”
উর্মি এবার স্তম্ভিত। তবে কি সমীর তাকে ভালোবাসে না? এ কি করে হয়! দুজনের চোখে চোখে বহু বার প্রেম নিবেদন হয়ে গেছে। ভরকায় উর্মি।ভালোবাসার সংকটে হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। সমীর এর কন্ঠ শোনা যায় না। উর্মি বলে–
” আমি এখন তবে রাখছি? ”
” হুম। ”
ফোন হাতে রেখে উর্মি ব্যস্ত হয়ে যায়। কেমন অশান্ত লাগে বুক। চোখ দুটো জ্বালা করছে।
নয়নের সাথে কোর্টে মুখোমুখি মেঘনা। উঁচু পেট টা নিয়ে চলতে কষ্ট হয় খুব। যতো দিন এই বাচ্চা টা পেটে আছে ততো দিন ডিভোর্স দিতে পারবে না নয়ন। সেই জন্যই ছিলো এতো নাটক। তাচ্ছিল্য হাসে মেঘনা। উর্মি কেবল তাকিয়ে থাকে। নয়ন কে দেখলে এখন ঘৃনা হয়। আপার বিয়ের শুরুর দিকে উর্মি মনে মনে গর্ব করতো, এমন একজন ভাই কে পাওয়া তে। তবে কে জানতো সময় স্রোতে ভালোবাসা উঠে যায়।আচানাক সমীর এর কথা মনে পরে উর্মির। অসুস্থ বোধ হয় হুটহাট।
নয়নের সাথে কথা বলে না মেঘনা। শুধুই উঁচু পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলে ” বেবি এই দেখ তোর পাপা কে। যে তোকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায় নি। ”
নয়ন চুপ করে শুনলো কথা টা। কেন যেন ভেতর টা ইষৎ আর্তনাদ করে। চরম বিরক্তি প্রকাশ করে মেঘনা। উর্মির হাত ধরে এগিয়ে যায়। খোলা চোখে তাকিয়ে থাকে নয়ন। মেঘনা কে আগে এমন তেজস্বী লাগে নি। খেয়াল করা হয় নি নয় মাসের উঁচু পেটে ঠিক কতো টা সুন্দর লাগে মেয়েটি কে। মায়েরা বোধহয় এমনি সুন্দর হয়।
অন্তু ছুটে এলো মেঘনার কাছে। উর্মি তখন সাওয়ার নিতে গেছে। মেঘনা স্থির চোখে দেখছে অন্তু কে। আজকাল শরীর টা এতো ভারী হয়ে গেছে যে কথা বলতে গেলে ও কষ্ট হয়। অন্তু চার দিকে চোখ বুলায়।
” বড় ফুপি ছোট ফুপি কোথায়?”
” সাওয়ারে গেছে বাবা। কি হয়েছে? ”
” একটু দরকার। ”
কথা শেষ না করেই বাথরুমের দরজায় নক করে অন্তু। ভেতর থেকে উর্মি বলে–
” কি হয়েছে? ”
অন্তু কথা বলার পূর্বেই বিকট শব্দ শোনা যায়। মেঘনার বুক টা ছ্যত করে উঠে। অন্তু শুধু বলে–
” তাড়াতাড়ি আসো ফুপি। ”
অন্তু দৌড়ে যেতে থাকে। মেঘনা বলে
” আমায় ধরে নিয়ে যা তো। ”
তুলির চুল গুলো এলোমেলো। সৌজন্য খুব বেশিই রেগেই আছে। তুলির গায়ে হাত ও তুলে ফেললো। তুলি তখনি জিনিস পত্র ভাঙচুর করতে লাগলো। মেঘনা যেন কিছুই বুঝে না। অন্তু ছোট হলে ও চেহারা টা কেমন বড় দের মতো করে রেখেছে। অমর বাসায় নেই। এদিকে জোৎস্নার কোনো হেলদোল নেই। সে এই ভেজালে যাবে না বলেই স্থির।
” কি হচ্ছে কি এসব? ছোট ভাইয়া। ”
” বোঝা ওরে, অসভ্য হয়ে গেছে। সংসার করে আমার সাথে, আর প্রেম চালায় আরেক জনের সাথে। ”
” কি বলছো কি এসব? ”
” বে ‘ শ্যা হয়ে গেছে। ”
সৌজন্যের গলা চেপে ধরে তুলি। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় সৌজন্য। তুলি আর্তনাদ করে উঠে। উর্মি তখনি ছুটে এসেছে। তুলি কে টেনে তুলে।
” কি হচ্ছে কি ভাইয়া? ভাবির গায়ে হাত তুলতে বারণ করেছি না। ”
” কি হবে। নাটক শুরু হয়েছে। যেই নাটকের শেষ নেই।”
তুলি অশ্রু ফেলে। সৌজন্যের কথা গুলো শুনতে থাকে নিরবের সহিত। সৌজন্য রাগে ফুসতে ফুসতে বের হয় বাসা থেকে। তুলির হাতের কব্জি তে কেটে গেছে। উর্মির বুকে হাহাকার। অন্তু যেন মৌনতা তে সব বুজতে পারে। ব্যান্ডেজ এনে দেয় দ্রুত। উর্মি ব্যান্ডেজ করে দেয় ঠিক ই তবে তুলি কে কোনো প্রশ্ন করে না। কেবল বুক চিরে বের হয় দীর্ঘ নিশ্বাস। মায়ের বানানো শখের সংসার আজ হুমকির মুখে।
চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
পর্ব ১৭
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=158699086690994&id=100076527090739