#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ১৩

0
606

#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ১৩
#লিখা_তানজিলা

হাসপাতালের একটা আলাদা গন্ধ আছে। এই জায়গা টা কোন কালেই পছন্দ ছিলো না আইজার। বর্তমানে নিজের আশেপাশে বেশ কিছু মানুষের বুক ফাটা আহাজারি শুনতে পাচ্ছে ও। তাদের মাঝে এমন কিছু মানুষও ছিলো যারা বেঁচে থাকতে একবারো খোঁজ নেয়নি। আজ এতো কান্না কেন এদের! এই আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া স্বান্তনা কাঁটার মতো লাগছে আইজার। হাসপাতালের কর্ণারে ফ্লোরে সেই কখন থেকে বসে আছে ও।

এইতো পাঁচ মিনিট হবে, একজন ডাক্তার মাহমুদা বেগম নামের এক নারীকে মৃত ঘোষণা করলো। যে মানুষ টা সম্পর্কে ওর মা। জন্ম দিয়েছে সে। সীমান্তর মুখ টা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল আইজার। স্টেবল অবস্থা হলে এতোটা প্যানিকের সাথে ওকে ডাকতো না লোকটা। আরফানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। সিমিকে এখনো কিছু জানানো হয়নি। মেয়েটা বাসায় কোন প্রতিবেশির কাছে রয়ে গেছে।

রাতেই না-কি কোন এক অজানা কারণে আইজার মা বাইরে গিয়েছিলো। রোড ক্রস করার সময়ই চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় রাস্তার এক পাশে ছিটকে পড়ে তিনি। মাথায় প্রচন্ড রক্তক্ষরণ নিয়ে হাসপাতালে পৌছানোর পরও হালকা জ্ঞান ছিলো তার। যদিও এ পর্যন্ত এসে জীবিত অবস্থায় ওর মা’কে দেখা হলো না আইজার। সবটা এক দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। এই হয়তো ঘুম ভেঙে যাবে আর দেখবে ওর মা সামনেই বসে আছে। সারাদিন ফোনে ডুবে থাকার অপরাধে বকুনি দিচ্ছে। কিন্তু না! এ ঘুম ভাঙছে না!

ভোর হলো, দুপুর হলো, রাত টাও পেড়িয়ে যাচ্ছে। আইজার কাছে কেন যেন সব টাই একই রকম মনে হচ্ছে। সিমিকে সামলানো যাচ্ছে না। মা কোথায় মা কোথায় বলে চিৎকার চেচামেচি করছে। বয়স কতই বা হবে! এইবার সাতে পা রাখলো। মা ছাড়া থাকার অভ্যেস নেই সিমির। আরফানও কেমন জড় পদর্থের মতো এক কোণায় পড়ে আছে।

সিমিকে জড়িয়ে ধরে বসে এতোক্ষণ বসে ছিলো আইজা। চিৎকার করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল হয়নি। সীমান্ত আরফানের সাথে কথা বলছিলো। নাজিম শিকদারও এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো দুই একবার। মুখটা দেখে বেশ ব্যথিত মনে হচ্ছে। আর রইলো আইজার বাবার কথা। এ পর্যন্ত তার কোন খবর পাওয়া যায়নি। এতো মানুষের খোঁজ রাখে কিন্তু নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর খবরটা কী তার কানে যায় নি!

একটা সময় পর চেষ্টা ছেড়ে দিলো আইজা। ক্ষুব্ধ মনে পড়ে আছে মেঝেতে। কারও সাথে কথা বলার মানসিকতা কাজ করছে না আজ। মাথায় ঘুরছে শুধু মায়ের করা সেই প্রশ্ন,

-“আজ আসতে পারবি একটু!”

মায়ের শেষ আবদার পূরণ করাও ওর হলো না! দম বন্ধ হয়ে আসছে। খালি খালি লাগছে সবকিছু। কয়েক মাস যাবৎ এ বাড়িতে ছিলো। কত স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্কে। চাইলেও তা মুছতে পারবে না ও! হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণের মাঝেই পড়ে থাকবে আইজা। তবুও এই মুহুর্তে দূর্বল হওয়া অন্তত ওর চলবে না। আরও দুই জন আছে যাদের আইজাকেই সামলাতে হবে! এক্সিডেন্টের জায়গায় কোন সিসি ক্যামেরা ছিলো না। তাই গাড়ির নাম্বার অথবা ড্রাইভার কোন কিছুই স্পষ্ট ভাবে জানা যায়নি।

সিমিকে বিছানায় রেখে বাইরে বেরিয়ে এলো আইজা। সীমান্ত বাইরে থেকে খাবার এনেছে। আরফান আবারও বেরিয়েছে। ঘরভর্তি থাকা মানুষের ঢল এখন আর নেই। সীমান্ত কিছুটা ইতস্ততভাবেই আইজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এই মুহুর্তে তার মুখে গম্ভীর ভাবটা নেই। আইজা সীমান্তর দিকে এক নজর দেখে প্রশ্ন করে উঠলো,

-“কিছু বলবেন?”

সীমান্ত কিছু বললো না। আইজার দুই বাহুতে হাতে রেখে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললো ওকে। আইজা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই সীমান্ত বলে উঠলো,

-“কেউ দেখবে না!”

অস্বস্তি আর বিরক্তিতে গা গুলিয়ে এলো আইজার। কড়া গলায় বলে উঠলো,

-“এখন আমার এসব ভাল্লাগছে না সীমান্ত প্লিজ!”

-“আ.. মানে মা’কে দেখার পর আপনার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি। মুখটা ভিষণ ভার হয়ে আছে। আপনি এখানে চোখের পানি ফেললে কেউ দেখবে না!”

আইজা ক্রমাগত নিজেকে সীমান্তর বাঁধন থেকে ছাড়ানোর জন্য বেশ কয়েক সেকেন্ড চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। অতঃপর ওভাবেই পড়ে রইলো ও। চোখ গুলো অসম্ভব ফুলে আছে। যেন কোন যুদ্ধে আটকা পড়েছে। জমে থাকা অশ্রুকণাগুলো এবার হুট করে ঝরে পড়তে শুরু করলো। ক্লান্ত হয়ে গেছে আইজা। সীমান্তর হাতের আঙ্গুল গুলো বেশ যত্ন সহকারে আইজায় মাথায় বিচরণ করছে। বিষাক্ত এক অনুভূতিতে আটকে গেছে আইজা। যেখানে নেই কোন স্বস্তি। যতই পা ফেলছে ততই যেন পায়ের তলায় বিধে যাওয়া কাঁটার উপস্থিতি টের পাচ্ছে ও!

-“শক্ত হতে গিয়ে নিজের দূর্বলতাকে অস্বীকার করতে যাবেন না। কষ্ট বেশি হবে!”
সীমান্তর শেষের কথা গুলো কানে যেতেই তার বুক থেকে নিজের মাথা সরিয়ে নিলো আইজা। এতোক্ষণ গায়ে জড়িয়ে থাকা উষ্ণতা মুহুর্তেই মিলিয়ে গেলো,

-“যত কান্না করার ছিলো করে নিয়েছি আমি।”

সীমান্ত হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা আইজার চোখের নিয়ে বয়ে যাওয়া পানি মুছে মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,
-“যেমন টা আপনার ইচ্ছে। কিছু খেয়ে নিন। কাল রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।

-“আমার ক্ষিদে নেই। আপনি খেয়ে নিন।”

আইজা ঠান্ডা গলায় কথাটা বলতেই কিঞ্চিৎ ক্রোধ নিয়ে তাকালো সীমান্ত। যদিও তা স্থায়ী হলো না। বরং নরম গলায় বলে উঠলো,

-“আপনার যখন ক্ষিদে পাবে খেয়ে নিবেন। আমি একটু আসছি।”

আর দাঁড়ালো না সীমান্ত। হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেলো সে। আইজাও ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। অন্তর টা ভিষণ জ্বলছে। গলা টা আটকে আসছে ক্ষনে ক্ষনে। আজ কোন খাবারই গলা দিয়ে নামবে না।

আরফান বাইরে থেকে এসেই চুপচাপ আইজার পাশে বসে পড়লো।কারও মুখে কোন কথা নেই। ঘর জুড়ে বয়ে যাচ্ছে এক ভয়ংকর নিস্তব্ধতা। আরফানের শুকনো মুখটা দেখে উঠে দাঁড়ালো আইজা। আরফানের সামনে খাবারের প্লেট রেখে নিজেও খেতে বসে পড়লো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে খাবারের এক লোকমা পুরে বললো,

-“খাবার গরম আছে। খেয়ে নে। পরে ঠান্ডা হলে ভালো লাগবে না।”

গড়গড় করে বলে গেলো আইজা। আরফান নিস্তব্ধ হয়ে সবটা দেখে যাচ্ছে। পরক্ষণেই খাবারের দিকে তাকিয়ে অকপটে বলে উঠলো,

-“কালও মা এভাবেই সামনে খাবার রেখেছিলো। বলেছিলো ঠান্ডা হলে ভালো লাগবে না। তখনও জানতাম না এই ইহকালে সে সুযোগ আর পাওয়া হবে না।”

খাবারের প্লেটে বিচরণ করতে থাকা আইজার হাত সাথে সাথেই থেমে গেলো। মনে হচ্ছে যে খাবার টা গিলেছে সবটাই পেট থেকে বেরিয়ে আসবে!

***

নাজিম শিকদার গাড়ি নিয়ে আইজার বাড়ির বাইরের দাঁড়িয়ে ছিলো। সীমান্ত গাড়িতে চড়ে বসতেই চড় অনুভব করলো গালে। পাশে বসে থাকা ব্যাক্তি কর্কশ গলায় প্রশ্ন করলো,
-“সাহিলকে মেরেছিস কেন?”

-“বাবা এই মুহুর্তে এসব…!”

আরও কিছু বলার আগে পুনরায় চড় পড়লো গালে। মুহুর্তেই নড়েচড়ে বসলো সীমান্ত। মুখ থেকে আর কোন শব্দ বের হলো না।

-“ঐ মেয়ের জন্য এখন আমার অফিসের এমপ্লয়ির ওপর হাত উঠাস তুই! ভবিষ্যতে এই সাহস দেখাবি না। আইজার ওপর দূর্বল হয়ে আমার প্ল্যান মাটিতে মেশানোর চেষ্টা করলে আগে ঐ মেয়েকে মারবো তারপর তোকে মাটিতে পুতে ফেলবো!”

সীমান্ত দুই হাত শক্ত করে মুঠ রেখে সব টা শুনে গেলো। নাজিম কয়েকবার শুকনো কেশে পুনরায় বলে উঠলো,
-“আইজার ওপর নজর রাখবি। আরমান ওর সাথে হয়তো যে কোন দিন যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে! এখন যা।”

সীমান্ত কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সাথে সাথেই ওর সামনে থেকে দ্রুত গতিতে চলে গেলো গাড়িটা। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সিড়ি বেয়ে উঠলো ও। দরজা সেই কখন থেকে খোলা। ভ্রু কুঁচকে এলো সীমান্তর। এতটা নিশ্চিন্তে থাকলে চলবে কি করে! ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো আইজা পরম যত্নে আরফান আর সিমিকে খাইয়ে দিচ্ছে। কেন যেন এই মুহুর্তে ওদের মাঝে প্রবেশ করতে ইচ্ছে করছে না। পুনরায় উল্টো ঘুরে সিঁড়ি ঘরের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ও। মনের মধ্যে বারবার শুধু একটা কথাই ঘুরছে,

এটা কোন এক্সিডেন্ট ছিলো না!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here