#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব -১

0
1704

#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব -১
#লিখা_তানজিলা

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে হাত ভর্তি চুড়ির টুংটাং আওয়াজে সীমান্তর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টায় ব্যর্থ হলো আইজা। তবে হাল ছাড়লো না। একবার প্রেম নজরে না দেখলেও অন্তত রাগ তো দেখাবে! কেন তার জরুরি ফোন কলের মাঝেও বেহায়ার মতো ডিস্টার্ব করা হচ্ছে! কিন্তু আইজার যে আশা হলো গুড়ে বালি। আজও সীমান্তর কাছ থেকে উপেক্ষাই পেলো।
-“কাল আমাদের প্ল্যানের কথা মনে আছে তো?”
-“আছে।”
সীমান্তর সোজাসাপটা জবাব। একটা বাড়তি কথা বললেই যেন মুখ খসে পড়বে! বেশ কিছুক্ষণ ঘর জুড়ে পায়চারি করার পর স্থির মুখভঙ্গি নিয়েই বারান্দায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো সে। আইজার দিকে তাকালো পর্যন্ত না! বিয়ের চার মাস হতে চললো। আজ পর্যন্ত যতবারই সীমান্তর কাছ থেকে কোন আগ্রহ বা অনুভূতি নামক বস্তুটির খোঁজ করেছে ততবারই নির্লিপ্ততা ছাড়া আর কিছু পায়নি। চুড়ি গুলো খুলে নিয়ে একপ্রকার ক্ষুব্ধ হস্তেই ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখলো আইজা। বেশ মনোযোগ সহকারে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব পর্যবেক্ষণ করছে সে।

-“লোকটা চোখ থাকতেও অন্ধ!”

খট করে আওয়াজ কানে যেতেই উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো আইজা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রুমের লাইট ও অফ হয়ে গেলো। সীমান্ত বিছানার একপাশে বসে মোবাইলে ডুব দিয়েছে। মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে যায় আইজা! লোকটা কি ওকে বিয়ে করেছে নাকি ফোনকে! বেশ শব্দ করে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উল্টো পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করলো ও। চার বা পাঁচ মিনিট হবে হয়তো, হাতের ওপর কেউ একজন তার ঠান্ডা হাত রাখতেই ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। খাঁটি পুরুষ মানুষ কি-না, এসময় ঘরে যে সে ছাড়া আরো একজন উপস্থিত আছে এখন টের পেয়েছে! আইজা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলো । সীমান্ত আর দ্বিতীয়বার ওকে স্পর্শ করলো না। যদিও খুব কাছ থেকে অনুভব করছে তাকে আইজা।

ইদানিং নিজেকে খুব অপমানিত মনে হয়। সে তো কম চেষ্টা করছে না সম্পর্কটাকে ভালো রাখার। নিজের মনের ওপর জোর খাটিয়ে হলেও হাসি মুখে সংসার করে যাচ্ছে। বৈবাহিক সম্পর্কে শুধুমাত্র একজনের প্রচেষ্টা অহেতুক মনে হয় আইজার কাছে। শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া যেন ওদের বিবাহিত জীবনে আর কিছুই নেই। আর ভাবতে পারছে না। মাথা ধরে আসছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো ও।

মধ্যরাতেই ঝুম ধারায় বৃষ্টির আভাস পেল আইজা। ঘুম ঘুম চোখটা গিয়ে পড়লো জানালার কাচে আছড়ে পড়া বৃষ্টি কণার দিকে। হঠাৎ মাথায় শীতল স্পর্শ অনুভব করতেই টনক নড়লো ওর। তবুও স্থির হয়ে পড়ে রইলো। বেশ আলতো হাতেই কেউ আইজার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে!

-” যতদিন আমি অন্ধ থাকবো ততদিন আপনার জন্য সুযোগ!”

ধীর কন্ঠে বলে উঠলো সে। আইজা শুনেও পিছনে ফিরে তাকালো না।এই মুহূর্তে আইজা কিছু জিজ্ঞেস করলে সীমান্ত নিজের কথার মানে বলবে না। পারলে উল্টো অস্বীকার করে বসবে। মাথায় আর কারও হাত অনুভব করছে না আইজা। ঘুমও যেন এইমুহুর্তে নাগালের বাইরে। আনমনেই পলক ফেলে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ঘুমের বদলে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর ভাবনার অতল গহ্বরে! মস্তিষ্কে জমে গেছে এক গাদা প্রশ্নের স্তুপ। সীমান্তর কাছ থেকে সেসকল প্রশ্নের জবাব পাওয়ার সম্ভাবনা যে নেই সে আর আইজার অজানা নয়!

*******
নদীর পাড়ে বসে থাকা এক জোড়া কপোত-কপোতীকে দেখতেই পা থেমে গেল আইজা। তারমধ্যে একজন ওর বড্ড চেনা। সাহিলের মুখের হাসিটা কেন যেন কাটা হয়ে বিঁধছে হৃদয়ে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু টলটল করতেই নিজের প্রতি এক তীব্র বিতৃষ্ণা অনুভব হচ্ছে। নিজেকে আড়াল করে সেখান থেকে কিছুটা দূরে সরে এলো আইজা। অতীতের মায়ায় নিজের অনুভূতিগুলোকে জড়িয়ে বর্তমান জীবনটাকে বিষাক্ত করবে না সে।
একপ্রকার জোর করেই চোখ সরিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সীমান্তর নাম্বারে ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে পুনরায় সেই বিরক্তিকর মহিলার কন্ঠ শুনতে পেল আইজা। কী এমন কাজ যে নিজের স্ত্রীর জন্য সময় পর্যন্ত হয় না তার কাছে! ফোনটা পর্যন্ত বন্ধ রেখেছে!
ক্রোধের মাত্রা মুহূর্তেই যেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকছে। বুকের ভেতরটা প্রচন্ত ভারী মনে হচ্ছে। সেই পুরোনো ক্ষত মস্তিষ্কের একভাগ দখল করে নিচ্ছে! এক পা দুই পা করে মেইন রোডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আইজা। সূর্য ডোবার আগেই বাড়ি পৌঁছাতে হবে তার। তবে যাওয়ার আগে পেছনে ফিরে শেষবারের মতো পেছনে ফিরে তাকাতে ভুললো না। আকাশে ছেয়ে থাকা গাড় কমলা রঙের আভায় নদীর বুকে এক রহস্যময় সৌন্দর্য্য খুঁজে পায় ও।

সীমান্ত আর ফোন ধরেনি। টেক্সট করেছে শুধু। কোন পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে তাই আজকে সময় হবে না! ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরলো আইজা। পারলে যেন ভেঙেই ফেলে! কি এমন চেয়েছিলো ও! ছুটির দিন একটু সময়ই চেয়েছিলো!

রাত ঘনিয়ে এলো। সময়ের কোন খেয়াল নেই আইজার। সীমান্ত সেই রাত দশটায় বাড়ি এসেছে। একবারও আইজাকে সরি বলার প্রয়োজনবোধ করেনি সে! ক্লান্ত শরীরটা কোন মতে টেনে হিঁচড়ে বিছানার দিকে নিয়ে গেলো আইজা। সম্পূর্ণ রান্নাঘরের নকশাই বদলে দিয়েছে আজ। এতোক্ষণ কাজের মাঝে নিজেকে ভুলিয়ে রাখলেও চোখটা বন্ধ করতেই আবারও সেই অপ্রিয় দৃশ্য ভেসে উঠলো মস্তিষ্কে। কিছুই ভালো লাগছে না! আর কী করতে পারে সে! গল্পের বইগুলো আর বাপের বাড়ি থেকে আনা হয়নি। কতগুলো নতুন বই কিনেছিলো ও। পরীক্ষা থাকায় পড়া হয়নি। টিভি দেখতেও ইচ্ছে করছে না। ফোন অন করে ফেসবুকে লগইন করলো আইজা। মনে হচ্ছে দুনিয়ায় একমাত্র অশান্তিতে শুধু ও আছে। বাকি সবাই কত আনন্দে ঘুরে ফিরে দিন কাটাচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফোন অফ করে বিছানায় ছুড়ে মারলো আইজা। মাথার ওপরে থাকা সিলিং ফ্যানে নজর গেলো তার। ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে আছে। থাকবেই বা না কেন গতকালই তো সীমান্তর রাগ এই পাখার ওপর ঝেড়েছে! ঘর তো গোছানোই আছে। আচ্ছা, ঘরের ফার্ণিচার গুলো নতুন ভাবে সাজালে কেমন হয়! ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো রাত বারোটার কাছাকাছি। এক লাফে উঠে বসলো আইজা।

সীমান্ত বিছানায় কয়েকটা ফাইল নিয়ে বসেছে। আইজার দিকে তাকানোর সময় যেন তার নেই। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো গিফট চোখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। এতোক্ষণ তো চোখে পড়েনি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সীমান্তকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে গিফটের প্যাকেট হাতে নিয়ে খুলতে শুরু করলো। পুরোটা সময় সীমান্ত পাওয়ারফুল চশমা নিয়ে একটা কাগজ চোখের একদম সামনে ধরে রেখেছে।

আইজার এতোক্ষণ বিরক্ত লাগলেও গিফট হিসেবে রঙবেরঙের চুড়ি গুলো দেখে মনে জমে থাকা সব ক্ষোভ মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। মানুষটা যে ওর কার্যকলাপ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে তা গতকাল রাতেই বুঝতে পেরেছিলো আইজা। এক দিনের ব্যবধানে এমন পরিবর্তনে কিছুটা আশ্চর্য হলেও চেহারায় তা প্রকাশ করলো না। ক্ষনিকের জন্য আইজার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলেও মুহূর্তেই সেই হাসিমুখকে কঠোর মুখভঙ্গিতে রূপান্তর করে সীমান্তকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো,
-“কারও জন্য উপহার নিয়ে আনলে সেটা নিজ দায়িত্বে তার হাতে রাখা উচিত।”
আইজার কথা শুনে সীমান্ত মৃদু হাসলো। সেই হাসির অর্থ বুঝতে না পেরে কিছুটা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আইজা। ও কি কৌতুক বলেছে না-কি! সীমান্ত আইজার হাত থেকে প্যাকেট কেড়ে নিয়ে নরম গলায় বললো,
-“এখনও দেখা হয়নি তার সাথে। কষ্ট করে উপহারটা আগের মতো করে রাখুন। এভাবে তো আর কাউকে গিফট দেয়া যায় না।”

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চোখের পলক ফেললো আইজা। বাক্যগুলো সহ সহজেই বলে দিলো ওর সামনে! এমুহূর্তে নিজেকে ক্রোধের সমুদ্রে ভাসমান দেখছে পাচ্ছে আইজা। ইচ্ছে করছিলো চুড়ি গুলো ফ্লোরে আছাড় মেরে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতে। একবারে কাজ না হলে পঞ্চাশ বার আছাড় মারবে তাও না হলে একশোবার! সম্ভব হলে এই হৃদয়হীন মানুষটাকেও ফ্লোরে ছুড়ে মারতো! নিঃশব্দে ক্রমশ ফুঁসতে থাকা মানবীকে উপেক্ষা করেই ফোন কানের কাছে ধরে বারান্দায় পা বাড়ালো সীমান্ত!

-“আমি কিন্তু প্রচন্ড হিংসুটে! আমাকে ধোঁকা দেয়ার চিন্তা মাথায় থাকলে ঝেড়ে ফেলুন। আপনার লাইফ বরবাদ করতে এক মিনিটও লাগবে না আমার!”

আইজার তীক্ষ্ণ কন্ঠ শুনে থেমে গেল সীমান্ত। আইজার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিঃশব্দে হেসে উঠলো। এতো স্বচ্ছ হাসিতেও কেন যেন নিষ্ঠুরতার ছাপ দেখতে পাচ্ছে ও! মনে হচ্ছে লোকটা ওর অবস্থার ওপর হাসছে! ওকে ব্যাঙ্গ করছে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আইজা। নিজের মুখেও ফুটিয়ে তুললো হাসি। সীমান্তর জীবনে আসার সিদ্ধান্ত যখন ও নিয়েছে ওকে একটু ধৈর্য তো রাখতেই হবে! আইজার কোমল রূপ দেখেই হয়তো সীমান্ত এতো সহজে তাচ্ছিল্য করতে পারে আইজাকে। আজ পর্যন্ত একবারও উঁচু গলায় কথা বলেনি সীমান্ত। তবুও তার কারণে ওর আত্মসম্মান প্রতিনিয়ত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে থাকে!

***
কাঠফাটা রোদের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা বেশ কষ্টকর মনে হচ্ছিলো। সূর্যের তীব্র তাপ মুখে লাগায় আইজার পুরো মুখ লাল বর্ণে রূপ নিয়েছে। তবুও আসতে হলো আজ। সীমান্তর অফিস দেখার বাহানায় যদি ওর কাছাকাছি যাওয়া যায়! আইজা একটা ঠান্ডা কোক কিনেই সাথে সাথে বিল্ডিং এর ভিতর ঢুকে পড়লো। এতক্ষণে যেন গলাটা শুকিয়ে কাঠ হচ্ছিল।

আজ আর ফোন করলো না সীমান্তকে। সেকেন্ড ফ্লোরের ক্যান্টিনের সামনেই সীমান্তকে ফোনালাপে ব্যস্ত দেখে ওখানেই দাঁড়ালো আইজা। দেখে মনে হচ্ছে যেন ফোনটা কানের সাথে সুপার গ্লু দিয়ে না আটকে রাখলে চাকরি থাকবে না! নাক মুখ কুঁচকে এলো আইজার। সাথে সন্দেহ তো আছেই। কই, আইজাকে তো একবারও ফোন দেয়া হয় না। যার জন্য উপহার এনেছে তার সাথে কথা বলছে না তো! ক্ষুব্ধ চোখে সীমান্তর দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ সাহিলকে সামনে থেকে আসতে দেখলো ও।

মানুষটাকে এখানে দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড পর সাহিলের চোখ আইজার ওপর পড়তেই কিঞ্চিৎ শিউরে উঠলো ও। তবে চাহনিতে তা প্রকাশ করলো না। সীমান্তকে নিজের পাশে অনুভব করতেই মুখে হাসি নিয়ে সাথে সাথে তার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরলো আইজা। নিজের ওপর পড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই সীমান্তর হাত ধরে অফিসের ক্যান্টিনে প্রবেশ করলো ও। আইজা নিজের জীবনে ভিষণ খুশি! কাউকে এক তরফা ভালোবেসেই সারাজীবন একা কাটিয়ে দেয়ার মতো মেয়ে ও না। সাহিলকে কতটা দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলো কথাগুলো। হঠাৎ সীমান্তর ঠান্ডা কন্ঠে ওর ভাবনার জগতে ব্যাঘাত ঘটতেই ভ্রু কুঁচকে এলো ওর,

-“আপনি কতটা ইমম্যাচিউর সেটা কি জানা আছে আপনার!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here