#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ৯

0
680

#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ৯
#লিখা_তানজিলা

গাড়ো ধুসর রঙের লং ড্রেস পড়ুয়া মেয়েটা আইজার কিছু বলার অপেক্ষা না করেই চেয়ারে বসে পড়লো। হাসিতে ভরপুর মুখটা দেখে আইজার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। সকাল সকাল অফিস করতে বুঝি এতো মজা! আইজার ঘুমভর্তি চোখজোড়া কিঞ্চিৎ লাল হয়ে আছে। সীমান্তর কেবিন থেকে কিছুদূর পর পাঁচ টা ছোট ছোট টেবিল। ইতিমধ্যে ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। মেয়েটার পাশের চেয়ারে গিয়েই বসে পড়লো আইজা।
-“আপনি তো আমাকে অলরেডি চেনেন। তাই নিজের পরিচয় বলে সময় নষ্ট করবো না। আপনার পরিচয় টা জানতে পারি মিস?”

আইজার নির্লিপ্ত কণ্ঠে করা প্রশ্নে নিজের শরীরটা চেয়ার সহ আইজার দিকে ঘুরিয়ে নিলো মেয়েটা। মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,
-“ফিহা শিকদার। আমি আপনার কাজিন ননদ।”
ফিহা নাম টা শুনেই এক ভ্রু উঁচু করে তাকালো আইজা। চেহারার সাথে সাথে নামটাও পরিচিত! যদিও মুখে কিছুই প্রকাশ করলো না।

“কাজিন ননদ! খুবই বাজে শোনায় কথাটা।”
আইজার তীক্ষ্ণ কন্ঠ কানে যেতেও ফিহার মুখ থেকে হাসির রেখা মুখে যায়নি। সে তার মতো নিজের ব্যাগ থেকে একটা বিস্কিটের প্যাকেট বের করে খাওয়া শুরু করলো।

আইজা সীমান্তর টেবিলে রাখা ফাইল গুলো এক এক করে দেখছে। এর মধ্যে একটা ফাইলে প্রজেক্ট বালুচর লেখা থাকলে তাতে গিয়েই আটকে গেলো ও। আঁড়চোখে ফিহাকে দেখলো একবার। সে তো নিজের খাওয়া দাওয়াতেই ব্যস্ত। বাইরে কারও পায়ের শব্দ বুঝতে পেরে দ্রুত ফাইল টা নিজের ব্যগে রেখে দিলো ও।
গতকালই শপিং এ সীমান্ত আইজাকে এই ডিজাইনার ব্যাগটা কিনে দিয়েছে। সীমান্ত এতো ধৈর্য নিয়ে শপিং করতে পারে তা আগে জানা ছিলো না আইজার।

-“কাজের সময় খাওয়া আমি একদম পছন্দ করি না। এর জন্য দুপুরে লাঞ্চটাইম আছে!”
হঠাৎ সীমান্তর কন্ঠ কানে যেতেই ফিহা দ্রুততার সাথে বিস্কিটের প্যাকেট নিজের ব্যাগে ভরে ফেললো। হাত দিয়েই মুখে লেগে থাকা বিস্কিটের গুড়ো গুলো ঝেড়ে ফেলছে। আইজা নিজের মতোই গালে হাত দিয়ে বসে আছে। যেন এই মুহুর্তে এখানে বসে থাকার চেয়ে একঘেয়ে কিছু আর হতে পারে না। সীমান্তর দৃষ্টি একবার টেবিল থেকে সরে গিয়ে আইজার দিকে গিয়ে পড়লো।

সীমান্তর সাথে আসা আরেকজন সীমান্তর কেবিন থেকে বেশ দূরে রাখা ছোট কেবিনেট থেকে কয়েক স্তুপ ফাইল বের করে এক ভাগ তুলে ফিহার হাতে ধরিয়ে দিলো। হাত ভেঙে যেন ফাইল গুলো পড়ে যায় এমন অবস্থা। যদিও মুখ বন্ধ করে রেখেছে মেয়েটা। ভ্রু কুঁচকে একবার সীমান্তর দিকে তাকিয়ে পরক্ষনেই নিজের হাতে রাখা বস্তা সমান ফাইলগুলোর দিকে তাকালো ফিহা।

সীমান্ত আর ফিহার দৃষ্টি আদান প্রদান দেখতেই মনের ভেতর এক প্রকার তীক্ষ্ণতা অনুভব করলো আইজা। খেয়ালই হলো না কখন থেকে আরো এক গাদা ফাইলের বস্তা আইজার চোখের সামনে ধরে রেখেছে সেই লোক। নিজের হাতে ভার অনুভব করতেই টনক নড়লো ওর।

-“সব গুলোর দুটো করে কপি করে নিয়ে আসুন।”

চোখে চশমা টা সেট করেই চেয়ারে বসে পড়লো সীমান্ত। ফিহা দ্রুত পায়ে ফাইলগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সাথে ঐ লোকটাও। আইজা চারদিকে চোখ বুলিয়ে কী যেন ভেবে ঠাস করে সীমান্তর সামনে থাকা টেবিলের ওপর ফাইল গুলো রেখে দিলো। যদিও ওর উদ্দেশ্য ওতটা আওয়াজ করা ছিলো না। ফাইল গুলোর ওজনই এতো বেশি! কিন্তু এই মুহুর্তে সীমান্তর চোখ দেখে মনে হচ্ছে আইজা এখানে এসেছেই শুধুমাত্র সীমান্তর টেবিল ভেঙে চুরমার করতে।

-“সরি সরি! এখন চোখ দিয়ে আমাকে গিলে ফেলবেন না-কি!”

কন্ঠে ব্যাঙ্গাত্বক ভাব এনে বললো আইজা। কেবিনেট টা হয়তো অনেক দিন পরিষ্কার করা হয়নি। ফাইলগুলো টেবিলে রাখতেই দুই একটা গুড়ো গুড়ো তেলাপোকারা ফাইল থেকে নেমে টেবিলে ঘুরাঘুরি করছে।

-“মাথা ঠিক আছে আপনার!”

সীমান্ত এক লাফে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের ওপর থাকা ল্যান্ড লাইনে ফোন করে কাউকে আসতে বলতেই দরজা থেকে হুরমুরিয়ে এক লোক এসে হাজির। পুরোটা সময় সীমান্তর কার্যকলাপ বেশ মনোযোগ সহকারে দেখে যাচ্ছিলো আইজা। নিজের কোন কিছুতেই কারও দখল দেয়া সহ্য করতে পারে না সে। সেখানে পুরোটাই যেন তার মোতাবেক থাকা চাই। এর আগে আইজা সীমান্তর স্টাডি রুমে হামলা চালিয়েছিলো বলে রেগে গেছিলো সে। আর আজ এই বিন্দু বিন্দু সাইজের তেলাপোকাদের রাজত্বেও হয়তো মাথা ফেটে যাচ্ছে লোকটার।

সীমান্ত ফাইলের বস্তা উঠিয়ে পুনরায় আইজার হাতে রাখলো। রাখলে বললে ভুল হবে পারলে নিক্ষেপ করলো। চোখ মুখ কুঁচকে এলো আইজার। গা ঘিনঘিন করছে। এসব নিয়ে কি করে ঘুরবে ও!!
এবার আইজা একটা চেয়ারেই রেখে দিলো ফাইল গুলো। গুটিকয়েক হাতে নিয়ে সীমান্তর দিকে না তাকিয়েই হনহন করে বেরিয়ে এলো ও।

ফিহা ডাস্টবিনের ওপর একের পর এক ফাইল ঝেড়ে পরিষ্কার করে যাচ্ছে। আইজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে কাজে লেগে পড়লো।বিরক্ত লাগছে ওর। ডাস্টবিনের সাথে বন্ধুত্ব করতে হচ্ছে ওকে! কপি গুলো নিজের টেবিলে নিয়ে গিয়ে সেই টেবিলের ওপর বাকি ফাইলগুলো পড়ে থাকতে দেখলো আইজা। একটু আগে থাকা পরিষ্কার টেবিল টা এইমুহুর্তে পোকামাকরের দখলে!

সীমান্ত নিজের টেবিল ইতিমধ্যে পরিষ্কার করিয়ে নিচ্ছে। আর তার সাথে আইজার টেবিলের সর্বনাশ ও করে রেখেছে। ধুলোবালি কোনকালেই পছন্দ ছিলো না আইজার। নিজের ব্যাগটা আগে থেকেই হাতে ঝুলিয়ে রেখেছিলো ও। এটাকে যেখানে সেখানে রাখলে ফেঁসে যেতো!

টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটা টেনে দূরে সরিয়ে রাখলো আইজা যাতে এটাও পোকামাকরের আড্ডাখানায় পরিণত না হয়। পরিষ্কার কপিগুলো চেয়ারের ওপর রাখতেই হঠাৎ ফিহার টেবিলে চোখ গেলো আইজার। ফিহা এখনো ফটোকপি মেশিনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আইজার পাপা যে প্রজেক্টে শেষ বিনিয়োগ করেছিলো, বালুচর প্রজেক্ট লেখা ছিলো তাতে! এই ফাইলগুলো সীমান্ত ফিহাকে দিয়েছে! আইজা আড়চোখে ফিহার দিকে তাকিয়ে এক কপি নিজের কাছে রেখে দিলো। বালুচর প্রজেক্টের ফিন্যান্সিয়াল তথ্যের ব্যপারে জানতে এই ফাইল গুলো কালেক্ট করছে ও। সীমান্তর টেবিল থেকে যে ফাইল টা নিয়েছে সেটা পরবর্তীতে জায়গা মতো রেখে আসবে।

সীমান্তর কেবিনের নোংরা টেবিলে এখনও জীবাণুনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাকা হাসলো আইজা। সে সময় সুযোগ বুঝে ইচ্ছে করেই ফাইল গুলো সীমান্তর টেবিলে রেখেছিলো ও। আইজা জানে সীমান্ত নিজের জিনিসপত্র কতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতেই পছন্দ করে। এই সুযোগ! বেশ কিছু সময় কেবিনের ধারে কাছেও আসবে না সে। সীমান্তর কেবিনে কোন সিসিটিভি ক্যামেরা পর্যন্ত নেই।
এই মানুষটার এসিতে এলার্জি, লিফট পছন্দ না এখন আবার সিসিটিভি ক্যামেরা নামক বস্তুর সাথেও কোন সম্পর্ক নেই! কী এক জটিল প্রাণি বিয়ে করলো ও!

*****

দরজার সামনে নেমপ্লেটে বড় বড় অক্ষরে লেখা নাজিম শিকদার। সীমান্ত সে রুমের বাইরে থেকে কাউকে ফোন করতেই দরজাটা খট করে খুলে গেলো। ভেতর থেকে গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো,

-“এসি অফ আছে। ভেতরে আয়।”

এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেই সে কেবিনে প্রবেশ করলো সীমান্ত। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ফাইলের স্তুপ দেখে মাথা নাড়া দিয়ে উঠলো ওর। শরীরের ভেতর টা গুলিয়ে আসছে। সীমান্তর বাবা সেটা আন্দাজ করতে পারলো হয়তো। দ্রুত টেবিলে রাখা সবকিছু নিচের এক ড্রয়ারে রেখে সীমান্তকে বসতে বললো। এতোক্ষণ যাবৎ লাল হয়ে থাকা মুখে ক্রমশ স্বস্তির রেখা ফুটে উঠলো। নিজেকে সামলে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো সীমান্ত।
-“আইজার মূল উদ্দ্যেশ্যই প্রজেক্ট বালুচর। আপনি কেন ওকে এখানে কাজ করার অনুমতি দিলেন বুঝতে পারছি না আমি।”

সীমান্ত কথায় সামনে বসে থাকা ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললো,
-“আইজার দূর্বলতা কী জানিস! ওর পরিবার। আইজার বাবা ওকে যা বুঝিয়েছে তাতেই চোখ বন্ধ করে উঠে পড়ে লেগেছে ও। নিজের বাবার প্রতি প্রচন্ড ভরসা ওর। তাই আমিও আইজাকে আর বাঁধা দিচ্ছিনা। মেয়েটা বাস্তবতা থেকে ঢের দূরে। দেখি কতদূর যেতে পারে নিজের পাপার প্ররোচনায়! আরমান হয়তো ভুলে গেছে তার মেয়ে এখন আমার বাড়িতে!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here