#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব৪

0
810

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব৪
#লিখা_তানজিলা

-“আপনার অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য আমার হাত ভাঙার তো কোন প্রয়োজন নেই! এই দূর্বল হৃদয়ের অধিকারিণী আপনার মাইন্ড গেম বুঝে উঠতে পারবে না!”
আইজার কন্ঠ জুড়ে বিদ্রুপের রেশ। ভ্রু কুঁচকে সীমান্তর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। তবে বিয়ের পর আজ নতুন করে নিজের স্বামীর এক অন্য রূপ আবিষ্কার করছে ও। লোকটাকে নিজের প্রতি আকর্ষিত করার থেকে রাগানো বেশ সহজ। সীমান্ত ওর হাত ছাড়লো না। বরং এক ভ্রু উঁচু করে আইজার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে বললে হয়তো ভুল হবে, মনে হচ্ছে সে কোন নতুন ভাবনায় মশগুল। পরক্ষনেই আইজার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,

-“এতো দূর্বল হৃদয় নিয়ে কুমির থাকা পানিতে নামতে গেলেন কেন?”

-“ডাঙায় একঘেয়েমি লাগছিলো তাই! আর কুমিরটা তো অন্ধ! সুযোগটা ছাড়তে ইচ্ছে করে নি।”

-“অন্ধ না-কি শিকারের অপেক্ষায় জানা মুশকিল। আশা করি ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবেন।”

সীমান্তর কথা শুনে তার দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনেকটা জোর দিয়েই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো আইজা। সীমান্ত কোন বাঁধা দিলো না। পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে নিজেকে সামলে নিলো আইজা। ভ্রু কুঁচকে চোখে কৃত্রিম বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
-“মনে হচ্ছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চলছে আমার সামনে। যদি খেয়াল না রাখি তো? কী করবেন আপনি!”
আইজার মুখে বিদ্রুপাত্মক কথা শুনেও সীমান্তর চোখ জুড়ে শুধুই শূন্যতা। এই বিষয়টাই ভিষণ বিস্মিত করে আইজাকে। বিয়ের আগে চক্ষুগোচরেই ছিলো এ রূপ। সীমান্ত কখনোই নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করেনি। বরং আইজাই সীমান্তকে চেনার চেষ্টা করেনি! বিয়ের পর থেকে লোকটাকে নিয়ে নিজের মাথায় যে গোলকধাঁধা বেঁধেই যাচ্ছিলো ইদানিং হয়তো তার ধীরে ধীরে সমাধান খুজে পাচ্ছে ও!

সীমান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বিছানার একপাশে বসে পড়লো।
-“দেখুন, আমি আপনার সাথে কোন বিদ্বেষমূলক সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছি না।”
আইজা কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলো। এই মুহুর্তে সীমান্ত বাদে আরও একজনের খেয়াল ওর মস্তিষ্কে বিদ্যমান। সীমান্ত ঘুমিয়ে পড়লেই বাড়ি থেকে বের হবে ও! আইজা মৃদু হেসে সীমান্তর পাশে গিয়ে বসলো। তার কাঁধে মাথা রেখে বললো,
-“রাত হয়ে গেছে। এখন আর এতো কিছু ভেবে ঘুম নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। স্টাডি রুম আমি সকালে গুছিয়ে রাখবো।”

সীমান্ত সাথে সাথেই আইজার মাথা নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
-“আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমার কথাটা মাথায় রাখবেন। আর আমার আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
সীমান্তর কথা শুনে আইজা চুপ হয়ে রইলো। সীমান্ত বাড়িতে না থাকলে বাইরে বের হওয়া ওর জন্য আরো সহজ হয়ে যাবে।

বারান্দা থেকে সীমান্ত আর রিয়াদকে গাড়িতে বসতে দেখা যাচ্ছে। সীমান্তকে সচরাচর তার বাইকেই বাইরে যেতে দেখেছে আইজা। আজ হঠাৎ বাবার গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না। তবে এ নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে চাচ্ছে না ও। রিয়াদের সাথে পরে কথা বলবে বলে মনোস্থির করলো আইজা।

ড্রয়ার থেকে সীমান্তর পুরোনো এক জ্যাকেট পরে নিলো ও।আপাদমস্তক পরিবর্তন করে নিলো নিজেকে। পুরো বাড়িতে লাইট অফ। সীমান্ত চলে আসার আগেই বাড়ি ফেরার প্ল্যান আইজার। দ্রুত মেইন ডোরের দিকে যেতেই কারো কথা বলার আওয়াজে থমকে দাঁড়ালো ও। মেইন ডোর থেকে কিছুদূর থাকা ছোট স্টোর রুম থেকে আসছে সে আওয়াজ। ধীর গতিতে স্টোর রুম পাড় করতেই ভেতর থেকে দুই জন মানুষের কন্ঠ শুনতে পেলো আইজা।

-“রাজিয়া, বাবার মন মেজাজ ইদানিং ভালো না। আরও কয়েকটা দিন যেতে দাও। আমি বলবো তো বিয়ের কথা।”

-“আর কত অপেক্ষা করবো ছোট সাহেব! আমারে বোকা পাইছেন! সীমান্ত ভাইও তো ফিহা আপারে কতো ভালোবাসতো। পরে ঠিকই বাপের কথায় একটা অকামের নমুনা বিয়া কইরা আনছে। আপনাদের দুই ভাইয়ের স্বভাব তো একই। বাপের অনুমতি ছাড়া কিচ্ছু করার সাহস নাই।”

হাত দুটো শক্ত করে মুঠ করেই ধীর গতিতে দরজার বাইরে চলে গেলো আইজা। আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো রাজিয়ার সবগুলো চুল মাথা থেকে আলাদা করা থেকে নিজেকে আটকাতে পারতো না! রাজিয়া আর রায়হানের বিয়ে হলে তো এই মেয়ে আরও সাহস পেয়ে যাবে! যদিও নিজের শ্বশুরকে যতটুকু চিনেছে মনে হয় না তিনি এ বিষয়টা মেনে নেবেন।

আর বাকি রইলো ফিহা, এই মেয়ে কে জানা নেই আইজার। তবে সীমান্ত আর ওর মাঝে তৃতীয় পক্ষকে আসার সুযোগ কখনোই দেবে না আইজা! ঐদিন সীমান্ত যে চুড়ি গুলো এনেছিলো সবগুলো ভেঙে ফেলেছে ও। বিয়ের আগে যাই হোক না কেন, সীমান্তর ওপর অধিকার এইমুহুর্তে শুধু আইজার! মনে হয় না সীমান্তকে নিয়ে নতুন কিছু শুনলে অবাক হবে ও।
মেইন রোডের দিকে গিয়ে দুই তিনবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে রাস্তার একপাশে উবারের জন্য অপেক্ষা করছে আইজা। দূর থেকে মেঘের গর্জন উপলব্ধি করতেই ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। ছাতাটা আনতে ভুলে গেছে ও!

***
রাতের নিস্তব্ধতায় ভূমিতে আছড়ে পড়া বৃষ্টিকণার ধ্বণি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। রাস্তায় মাত্র দুই একটা গাড়ির দেখা মিলছে মাত্র। কিছুক্ষণ পর পর দুই একটা ট্রাকও পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পরিবেশটা মন্দ লাগছে না সীমান্তর কাছে। ছোটবেলা থেকেই নিরবতার সাথে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব অনুভব করতে পারে ও। গাড়ির পেছনের সীটে বসে ছোট্ট বন্ধ করে সেই অনুভূতিকে উপলব্ধি করছে ও। গাড়িটা একপর্যায়ে থেমে গেলে বন্ধ আঁখি জোড়া খুলে সোজা হয়ে বসতেই রিয়াদ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে সীমান্তর সাইডে গিয়ে দরজা খুললো। সীমান্ত গাড়ি থেকে নামলে ওর মাথার ওপর ছাতা তুলে ধরলো রিয়াদ। সামনে পরিত্যক্ত এক গোডাউন। ঠোঁটের এককোণে অদ্ভুত এক হাসি বজায় রেখে সেই গোডাউনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত।

থরথর করে কাঁপতে ব্যাক্তির সামনে রাখা চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে পড়লো সীমান্ত। জীর্ণশীর্ণ শরীরে ক্লান্তির ছাপ। নিভু নিভু চোখে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে মুখে ফুটে উঠলো ভয়ের রেখা।
-“প্লিজ, প্রিয়াকে মারবেন না! ওর কোন ক্ষতি করবেন না!”
দূর্বল কন্ঠে বলা বাক্য সীমান্তর কান অব্দি পৌছতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো ও। পরক্ষনেই উঠে গিয়ে ঠান্ডা দৃষ্টি নিয়ে সেই ব্যাক্তির কলার চেপে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

-“কে বলেছে প্রিয়াকে মেরে ফেলবো? আমি তো কোন খুনি নই। এতোদিনেও চিনতে পারলেন না আমাকে আসিফ সাহেব! আপনার কথা শুনে ভিষণ কষ্ট পেলাম। প্রথমত যে কোম্পানিতে কাজ করছেন তারই রাইভাল কোম্পানির সাথে হাত মিলিয়েছেন এখন আবার অপবাদও দিচ্ছেন যে আমি আপনার গার্লফ্রেন্ডকে মারতে চাই!”

হুট করে চোখে কৃত্রিম ব্যাথাতুর চাহনি এনে আসিফকে ছেড়ে দিতেই কাশতে কাশতে পুনরায় সেই চেয়ারে পড়লো সে। সীমান্তর কাছে দুনিয়াতে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজের একটি হলো প্রতারণা। কেউ ওকে ধোঁকা দেয়ার সাহস দেখিয়েছে ভাবলেই মনে হয় কাটা ঘায়ে মরিচের প্রলেপ দেয়ার মতো কিছু। আসিফের ফোনটা বের করে তার সামনে তুলে ধরলো সীমান্ত।
-“নিন আপনার ফোন। কেউ হয়তো আপনার জন্য চিন্তা করছে! কি জানি কেমন পরিস্থিতিতে আছে!”

সীমান্তর মুখের কথা শুনে নিজের সামনে ফোন দেখতেই একপ্রকার লাফিয়ে সেটা কেড়ে নিলো আসিফ। তবে তা ওপেন করার আগে সীমান্তর দিকে একবার সন্দেহ আর ক্রোধ দৃষ্টিতে তাকালো সে। আসিফের এ চাহনি বুঝতে বেগ পেতে হলো না সীমান্তর। তবে এতে তার মুখভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন এলো না। বরাবরের মতো মৃদু হেসে চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো।

আসিফ কিছুক্ষণ চারদিকে চোখ বুলিয়ে ফোনে কিছু একটা ডায়েল করে কানের কাছে তুলে ধরতেই সীমান্ত বলে উঠলো,
-“লাউডস্পিকারে কথা বলুন!”
আসিফের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝ বয়সী লোকটা জোরপূর্বক ফোনের লাউডস্পিকার অন করে দিলো। আসিফ দ্রুত ফোন কেটে দেয়ার আগেই ওপাশ থেকে পরিচিত এক মেয়ের কর্কশ গলা শুনে থমকে গেলো ও।

-“তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা আর আমার পক্ষে সম্ভব না। সামনের সপ্তাহে আমার বিয়ে। তোমার নাম্বারটা ব্লক লিস্টে থাকবে!”

ফোনটা ওপাশ থেকেই কাট হয়ে রইলো। আসিফ হয়তো কোন ঘোরের মধ্যে আছে। সীমান্ত উঠে গিয়ে আসিফের কাঁধ চাপরে বলতে শুরু করলো,
-“ছোট বেলা থেকেই পরিবার ছাড়া বড় হয়েছেন। একজনকে ভালোবাসলেন সে-ও আপনাকে ছেড়ে দিলো। কষ্ট তো কম পাচ্ছেন না। চিন্তা করবেন না। এই লোক গুলো আপনাকে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দেবে।”

আসিফ সীমান্তর কথা কানে নিলো না। সে পুনরায় ফোনে কারও নাম্বারে ডায়াল করে যাচ্ছে। প্রত্যেকবারই মুখে ভেসে উঠছে নিরাশা। সীমান্ত একবার আসিফের দিকে তাকিয়ে রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-“আসিফ যত টাকার বিনিময়ে আমার সাথে প্রতারণা করেছে তার দ্বিগুণ পরিমান টাকা আসিফের এক্স গার্লফ্রেন্ডের একাউন্টে জমা করে দিন।”

আসিফ নিঃশব্দে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে থাকা লোকগুলো টেনে আসিফকে বাইরে নিয়ে গেলো। মানুষের দূর্বলতা জানতে পারলে তাকে হারানো বেশ সহজ হয়ে যায়। সীমান্ত অনেক আগেই জানতে পেরেছিলো আসিফের কারসাজি। কিন্তু কিছু বলেনি। এতো ব্রিলিয়ান্ট একজন এমপ্লয়ি এভাবে ওকে ঠকাবে মানতে পারছিলো না ও। আসিফে প্রমোশন পেতে হয়তো কিছু সময় লাগতো। ততদিনে প্রিয়ার বিয়ে হয়ে যাবে এই ভয়ে প্রতারণার সুযোগ নিলো ও। কোম্পানির গোপন ইনফরমেশন লিক করে শুধুমাত্র টাকার জন্য!

-“আমি কি সত্যি প্রিয়ার একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করবো?”
রিয়াদের করা প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সীমান্ত।
-“পাগল না-কি! আমি কালই আসিফের বিরুদ্ধে যা প্রমান ছিলো সব নিয়ে থানায় রিপোর্ট করবো!”
রিয়াদ কিছুটা সংকোচ চোখেই ট্যাবে কিছু একটা দেখে যাচ্ছে। রিয়াদের এ দৃষ্টি সীমান্তর বেশ ভালো করেই জানা।

-“কি হয়েছে আবার?”
কন্ঠে বিরক্তির ছাপ এনে জিজ্ঞেস করলো সীমান্ত। মাথাটাও ধরে এসেছে। কপালে আঙুল বুলিয়ে ক্লান্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরের পরিবেশটা দেখে যাচ্ছে ও। রিয়াদ নিজের হাত থেকে ট্যাব টা সীমান্তর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
-“ঝড় বৃষ্টির জন্য নেটওয়ার্ক তেমন ভালো না। তাই ভালো ভাবে বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে ভাবীই হবে!”

সীমান্ত মুখে কিছু বললো না। নিস্তব্ধ হয়ে আইজাকে ট্যাক্সিতে বসে পড়তে দেখলো। যদিও ইন্টারনেট ডিস্টার্ব করায় ট্যাক্সির নাম্বারটা দেখতে পারলো না ও। ট্যাব টা শক্ত করে চেপে ধরে রিয়াদের দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-“আপনি ট্যাক্সি করে নিন। আমি আসছি।”

রিয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হনহন করে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো সীমান্ত। আনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
-“আসিফের সাথে সাক্ষাৎ তো হয়েই গেলো। এবার সাহিলের পালা!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here