#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ১৪

0
916

#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ১৪
#লিখা_তানজিলা

চোখের সামনে সবকিছু ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। মাকে জড়িয়ে ধরে পড়ে আছে সীমান্ত। নিভু নিভু আখি জোড়া বরফ ন্যায় ঠান্ডায় শুধু কেঁপেই যাচ্ছে। পুরো শরীর অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে। মা সেই কখন থেকে নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে। কথা ও বলছে না। সে কি ঘুমিয়ে গেছে! কতক্ষণ যাবৎ এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ঘর, না ঘর বললে ভুল হবে, যেন কোন বরফের জেলখানায় বন্দী হয়ে আছে সীমান্ত আর ওর মা।

মায়ের এই নিস্তব্ধতা সহ্য হচ্ছে না সীমান্তর। মনে হচ্ছে ও যাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সে কোন মানুষ না, যেন এক বরফের চাকা। তবুও তাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। মায়ের হয়তো খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই ঘুমিয়ে পড়েছে! মা’কে ডেকে বলতে চেয়েছিলো সীমান্ত যে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মায়ের বন্ধ চোখ গুলো দেখে সে ইচ্ছে দমিয়ে রাখলো সে।

সীমান্ত নিজের ছোট শরীর টা ওর মায়ের থেকে আলাদা করতে গিয়েও পারছে না। ঠিক তখনই সেই বরফের জেলখানার দরজা টা বেশ শব্দ করে খুলে গেলো। মুক্তি পাবে ভেবেই আশা জাগ্রত হলো ওর মনে। সীমান্ত এবার ওর মা’কে ধাক্কা দিতে শুরু করলো। অস্পষ্ট চোখে দরজার ওপাশে বাচ্চা একটা মেয়েকে দেখতে পাচ্ছে সীমান্ত। ও কিছু বলতে গিয়েও পারছে না। ঠান্ডায় জমে থাকা মুখ দিয়ে কোন আওয়াজই বের হচ্ছে না। চোখ টাকেও আর খোলা রাখতে পারছে সীমান্ত। বাচ্চা মেয়েটা কিছু বলছে হয়তো। কানে ঢুকছে না ওর। হঠাৎ মনে হলো সেই ছোট্ট মেয়ের কন্ঠ কেন যেন বড়দের মতো শোনাচ্ছে।

-“কি হয়েছে আপনার?”

ধরফরিয়ে আখি জোড়া খুলে গেলো সীমান্তর । মুখের একদম সামনে আইজাকে দেখেই খানিকটা চমকে উঠলো সে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো এটা আইজাদের বাড়ি। ঘড়ি দেখে বুঝতে পারলো এক ঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে। গত এক সপ্তাহ যাবৎ এখানেই থাকছে সীমান্ত। আইজা এই মুহুর্তে অন্য কোথাও যেতে চায় না। আর সীমান্ত ওর বাবার আদেশে এখানেই আছে।

-“দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?”

আইজার প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না সীমান্ত। কিছুক্ষণ ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ফ্রেশ হয়ে পুনরায় বসে পড়লো বিছানায়। আকাশ টা আজ প্রচন্ড মেঘলা। সন্ধ্যা না হওয়া সত্বেও পরিবেশে সন্ধ্যার ছিটেফোঁটা বিদ্যমান। আইজা শুকনো মুখে ঘর গুছিয়ে যাচ্ছে। ইদানিং সীমান্তর কাছেও ঘেঁষতে চায় না সে। যেন উপেক্ষা করছে প্রতিনিয়তো। এই আইজাকে প্রচন্ড খাপছাড়া লাগছে ওর কাছে৷ যদিও তার এ ব্যবহার অস্বাভাবিক না। মায়ের মৃত্যু দেখে কেইবা আনন্দে থাকে!

-“আমাদের প্রথম দেখা কবে হয়েছিলো মনে আছে আপনার?”

সীমান্তর প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো আইজা। তবে সীমান্তর দিকে চোখ না রেখেই বলে উঠলো,
-“এতোটাও ভুলো মনা নই আমি!”

-“আমি আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি!”
কিছুটা জোর দিয়েই বলে উঠলো সীমান্ত। আইজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানার একপাশে বসে পড়লো। কন্ঠে বিরক্তির রেশ এনে জিজ্ঞেস করলো,
-” হঠাৎ এই প্রশ্ন করছেন কেন?”
সীমান্তর মুখভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন এলো না। আগের মতোই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আইজার দিকে সে।

-“আমাদের বিয়ের দিন। খুশি!”
আইজার ঝটপট কথায় মৃদু হেঁসে উঠে দাঁড়ালো সীমান্ত। আইজা এখনো ভ্রু কুঁচকে আছে। কিঞ্চিৎ সন্দেহর রেশও তাতে বিদ্যমান। সীমান্ত জানালার বাইরে একবার চোখ রেখে বলে উঠলো,

-“আমার আসতে দেরি হতে পারে।”

শার্টের হাতার বোতাম লাগাতে লাগাতে জানালার বাইরে কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে দেখে যাচ্ছে সীমান্ত। তার চোখের দিশা ফলো করে সেদিকে তাকালো আইজা। তেমন কিছু দেখলো না। কিন্তু এই মুহুর্তে সীমান্তর হাবভাব ভিষণ ভাবাচ্ছে আইজাকে।

-“কেন? আজ তো আপনার কোন কাজ নেই?”
জিজ্ঞেস করলো আইজা। যদিও সীমান্ত আইজার প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না। হনহন করে রুমের বাইরে চলে গেলো।

আইজা সীমান্তকে বাইকে বসতে দেখেই পিছু পিছু বেরিয়ে এলো। সীমান্ত একটু সামনে যেতেই সাইডে থাকা একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলো আইজা সীমান্তকে ফলো করবে বলে।

সীমান্তর সেই এক বদ অভ্যেস। বাইকের স্পিড এমন যেন প্লেন চালাচ্ছে। এক সময় তো ট্যাক্সি ড্রাইভার দাঁত কেলিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলো,
-“ভাই সাহেব কী অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখে না-কি?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আইজা। এমন ভাবে কথা বলছে যেন পূর্ব পরিচিত!
-“আপনি নিজের কাজে মন দিন!”

আইজার ক্ষুব্ধ কন্ঠ শুনে লোকটা কথা বন্ধ করলেও দাঁত কেলানো বন্ধ করলো না। যেন কোন সার্কাস দেখছে। এই মুহুর্তে প্রচন্দ বিরক্তি নিয়েই ট্যাক্সিতে বসে আছে আইজা। এই ট্যাক্সি ছেড়ে অন্য ট্যাক্সি ধরতে সময় লেগে যাবে। সীমান্তর এই কয়েক দিন পর পর বাইরে সময় কাটানোকে আগে সেরকম পাত্তা দিতো না আইজা। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন!

***

একটু আগে আকাশে থাকা মেঘের ছায়া এখন আর নেই। সেগুলো যেন কোন ধোঁয়াশা ছিলো। ক্ষীণ রোদ যেন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। পরিত্যক্ত সেই গোডাউনের সামনে গিয়ে বাইক থামিয়ে নেমে পড়লো সীমান্ত। ফোন টা বের করে একজনের নাম্বারে ডায়াল করে বলে উঠলো,

-“আইজাকে বলবেন আমি অফিস রুমে। সেখানে এসেই যেন দেখা করে। আর লোকটাকে সরিয়ে রাখুন। আইজা আমাকে ফলো করে এখানেই আসছে।”

ফোন কেটে মুখে মিহি হাসি নিয়ে গোডাউনে প্রবেশ করলো সীমান্ত। কিছুদূর যেতেই দেখলো কাঠের চেয়ার টা খালি পড়ে আছে। তবে দড়ি গুলো এখনো মেঝেতেই। রিয়াদ আসতেই সেগুলো উঠিয়ে রিয়াদের দিকে ছুড়ে মারলো সীমান্ত।
-“কাজ সম্পূর্ণ শেষ করবেন! আইজা এসব দেখে ফেললে কী হতো!”

-“আপনি সবটা বুঝে আইজা ভাবিকে এ পর্যন্ত নিয়ে এলেন কেন? এসব এতো কম সময়ে কীভাবে সামলাবো আমি!”

-“যেভাবে এতোদিন সামলেছেন। আর এই রক্তের দাগ গুলো ঢেকে ফেলুন!”

ফ্লোরে লেগে থাকা ছোপ ছোপ শুকনো রক্তের দাগগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো সীমান্ত। সীমান্তর কন্ঠ শুনে ওর দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না রিয়াদ। তবে তার বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো কানে যেতেই কপাল কুঁচকে তাকালো সীমান্ত।

-“বউরে দেখলেই হাওয়া ফুস!”

সীমান্তর তীর্যক দৃষ্টি উপেক্ষা করেই দড়ি গুলো নিয়ে চলে গেলো সে। সীমান্ত এক ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ছেড়ে গোডাউনের এক পাশে থাকা সিঁড়ি চড়ে সেকেন্ড ফ্লোরের শেষ প্রান্তে গিয়ে কাঠের শক্ত দরজা টা খুলে ফেললো। রুমটা প্রথম দেখায় কোন সাধারণ রুম মনে হয়। সেভাবেই সাজিয়েছে ও। চোখে চশমা টা ভালো করে ফিট করে নিলো সীমান্ত। এক সাইডে থাকা ছোট খাটো জানালার দিকে তাকিয়ে আইজাকে ভ্রু কুঁচকে জায়গা টা পর্যবেক্ষণ করতে দেখছে ও। মেয়েটাকে এ পর্যন্ত কতবার ভ্রু কুঁচকাতে দেখছে হিসাব নেই। হয়তো সীমান্তর ওপর প্রচন্ড বিরক্ত সে! ভ্রু কুঁচকেই ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে গোডাউনের কাছে এগিয়ে আসছে আইজা। সীমান্ত চশমা টা খুলে একটা তাকে রেখে দিলো। ট্যাব টা হাতে নিয়ে আইজাকে গোডাউনের ভেতরের অংশে বিচরণ করতে দেখছে সে।

গোডাউনের এক অংশে রাখা চশমা আকারের ক্যামেরা গুলোতে চোখ গেলো আইজার। আইজার সেই দৃষ্টি ট্যাবের স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সীমান্ত। কিন্তু এর পরবর্তী ঘটনার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না সে। চশমা টা হাতে নিয়েই ভেঙে ফেললো আইজা। ভিষণ রেগে আছে মনে হচ্ছে। সীমান্ত কিঞ্চিৎ ব্যথিত চোখে তাকালো। চশমা গুলো বেশ প্রিয় সীমান্তর কাছে। আইজা না হয়ে অন্য কেউ হলে হয়তো হাতটাই ভেঙে গুড়িয়ে দিতো! চুইংগাম খেতে খেতে গোডাউনে রাখা অন্য হিডেন ক্যামেরা গুলো দ্বারা আইজার কর্মকান্ড দেখছে সীমান্ত। আজ তাকে দেখতে একদম আগের মতো মনে হচ্ছে। এই কয়েক দিন তো চেহারা জুড়ে এক ধরনের শূন্যতার আভাস ছিলো।

আইজা হয়তো আরও কিছু খুঁজছে। হয়তো ক্যামেরা গুলো নয়তো সীমান্তকে। রিয়াদ আইজাকে অফিস রুমের দিক বলে দিলেও তাতে হেলদোল নেই আইজার।

একে একে পাঁচ টা চশমা অর্থাৎ হিডেন ক্যামেরা গুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিলো আইজা। এইবার ভিষণ রাগ হচ্ছে ওর। এভাবে জিনিসপত্র ভাঙার কোন মানে আছে! সীমান্ত সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালো। হনহন করে গোডাউনের নিচের অংশে যেতেই চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রিয়াদ আর নিজের কর্মকান্ডে মুখে সন্তুষ্টির ছাপ নিয়ে থাকা আইজাকে দেখতে পেলো ও। সীমান্তর গম্ভীর মুখটা দেখেই আইজা ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,

-“কান টানলে মাথাও আসবে। তাই আমিও কষ্ট করে সিঁড়ি চড়তে গেলাম না। এখন বলুন যাকে এখানে বেঁধে রেখেছেন সেই লোকটা কোথায়?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here