#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ২৭

0
510

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ২৭

#লিখা_তানজিলা

মাঝরাতের অন্ধকারে জনমানবহীন শহরটা বেশ অচেনা মনে হচ্ছে।এমন নয় যে এর আগে কখনো এসময় রাস্তাঘাট দেখা হয়নি আইজার। তবে পূর্বের অভিজ্ঞতার সাথে আজকের এ মুহূর্তের ভিন্নতার মাত্রাও যে প্রবল। এইতো সেদিন! না, সেদিন হবে না! প্রায় দু’বছর আগেই সপরিবারে রাঙামাটি যাওয়া হয়েছিলো ওদের। মাঝরাতের সেই ভ্রমনযাত্রা যতটা আনন্দমুখর ছিলো আজ যেন ততটাই বিভীষিকাময়!

আইজার মামা মাঝপথেই কোন এক ব্যাক্তির কাছে নিজের গাড়ির চাবি গছিয়ে এসময় উবারে চড়ে বসেছে। তার ভাষ্যমতে সীমান্ত নিশ্চয়ই তার ফ্ল্যাটে হামলা করে বসবে! যদিও আইজার এ নিয়ে তেমন চিন্তা নেই। জামিল মাহমুদ পেশায় একজন পুলিশ কমিশনার ছিলো। এই মুহুর্তে তিনি কোন কারণে ছয় মাসের জন্য সাসপেন্ড হয়ে আছে। সাসপেন্ড হওয়ার ব্যপারটা আইজা আগে জানতো না। জামিল মাহমুদ একটু আগে নিজেই সে কথা বললো। কিন্তু কারণ টা গোপন রেখেছে। সে যেই কারণ হোক, জামিল মাহমুদের সামনে থেকে অন্তত আরফান আর সিমির কোন ক্ষতি করার ঝুঁকি সীমান্ত নেবে না। আইজা যতদ্রুত সম্ভব এ শহরের বাইরে যেতে চায়। এ দুইমাসে বেশ অনেকদিন চলার মতো টাকা জমিয়েছে ও।

আইজা এর আগে ওর মায়ের কাছে জামিলের ব্যপারে বেশ ঘটনা শুনেছে। তিনি না-কি তার সত্যবাদিতার জন্য জনপ্রিয় ছিলো। শুধুমাত্র রগচটা হওয়ায় বেশ ঘৃণ্যতার কাতারেও দেখা যেতো তাকে। এতো এতো ঘটনা শুনে আইজার মনে বেশ কয়েকবার ইচ্ছে জেগেছিলো লোকটাকে একবার দেখার। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। কারণ জামিল মাহমুদ কখনো ওদের সাথে যোগাযোগ করেনি। এমনকি আইজার মা যখন তার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলো সে তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে।

একটা প্রাইভেট ক্লিনিকের সামনে গিয়ে উবার থামতেই ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। সিমি আইজার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলো। জামিল মাহমুদ সকলের প্রশ্নবোধক চাহনি উপেক্ষা করে সিমিকে আইজার কাছ থেকে নিতে গেলেই ও সিমির হাত জোরালো ভাবে ধরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-“এখানে কেন থামলেন?”

জামিল আইজার শুকনো মুখের দিকে একবার সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো মাত্র। শক্ত গলায় বললো,
-“আমি জানি, ভেতরে অনেক রাগ পুষলেও তোমরা আমাকে ভরসা করো। এ পর্যন্ত যেহেতু এসেছো আগেও ভরসা রাখো!”

-“সবকিছু কী আপনার ইচ্ছেমতোই হবে না-কি!”

-“আমি কিন্তু তোমাদের জোর করে এখানে আনিনি!”

-“এতোক্ষণ যেহেতু জোর করে আনেননি আগেও সে চেষ্টা করবেন না! আমাদের সাহায্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এরপর আমরা নিজেদের সামলাতে পারবো!”

সিমি ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে। ঘুম ঘুম চোখে একবার আইজা আর একবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখে যাচ্ছে। দু’জনই একে অপরের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। এরমধ্যে আরফান বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

-“কিসব ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে পড়ে আছে এরা! মামা সাহেব আমরা শুধু আজকের রাতের জন্যই আপনার কাছে আশ্রয় চেয়েছি। ভোর হতেই চলে যাবো! আপনি আমাদের এই ক্লিনিকে কেন এসেছেন? আমরা কেউই অসুস্থ নই, আপু ছাড়া!”
শেষের কথাটা বিড়বিড় করে বললো আরফান।

আরফানের কন্ঠে ফুঁসতে থাকা দু’জনের চোখ ওর দিকে গিয়ে ঠেকলো। জামিল মাহমুদ কপালে জমে থাকা ঘাম উল্টো হাতে মুছে নিলো। ইতিমধ্যে একজন বাচ্চা আর দু’জন বড়দের রূপে থাকা বাচ্চাদের সামলিয়ে ভিষণ ক্লান্ত সে! আঁখি যে কী করে এই অবাধ্য অকৃতজ্ঞ বিচ্ছুদের নিয়ে থাকতো ভেবে পায় না ও! হঠাৎ নিজের মৃত বোনের কথা মনে পড়তেই মূর্ছ হৃদয়ে চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো। ক্লান্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো জামিল।
-“দেখো এই মুহুর্তে তোমাদের এই জায়গা থেকে সুরক্ষিত কোথাও আর নিয়ে যেতে পারবো না আমি।”

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো আইজা। জায়গাটা বেশ জনমানবহীন। সামনে রাস্তার অবস্থা একদমই ভালো না। কিন্তু ক্লিনিক! কেন যেন জামিল মাহমুদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটা লুকোচ্ছে! জামিল হয়তো আইজার এ সন্দেহ জড়ানো চাহনি বুঝতে পেরেছে। তাই নিজেই বলে বসলো,
-“এ ক্লিনিক আমার স্ত্রীর। এখানে তোমাদের কোন সমস্যা হবে না! সীমান্ত এখানে তোমাদের খুঁজে পাবে না! আর আমার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে তোমাদের এখানে আনার। সেটা আমি কাল সকালেই বলবো।”

জামিল মাহমুদের কথায় দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লো আইজা। কিছু বলবে বলে তার দিকে আগাতেই হুট করে থমকে গেলো ও। মনে হচ্ছে কানের দিকে কেউ ভনভন করছে। সেই ভনভনের মাঝেই আরফানের কন্ঠ, সিমির কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে ও। যদিও তা বেশ মৃদু! কেন যেন পৃথিবীটা ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয়ে আসছে ওর চোখে!

***

জামিল মাহমুদের ফ্ল্যাটের ঠিক বামদিকের সিঁড়ির একপাশে বসে ফোনে গেম খেলছে সীমান্ত। আর তার দেয়ালে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ।

-“স্যার, ভাবী হয়তো আপনাকে আবারও উল্টো দিকে ঘুড়িয়েছে!”
-“জানি।”
রিয়াদের অধৈর্য্য মাখা কন্ঠের বিপরীতে সীমান্তর সোজাসাপটা জবাব।

-“আমি জানি স্যার, প্রেমিক পুরুষ হওয়া এতোটাও সহজ না। এই যে ভাবী আপনাকে আপনারই বাড়ির ড্রইংরুমে বেঁধে আসলো! একবার না বরং দুইবার এদিক ওদিক ঘুরালো। আর আপনি এখানে সব ফেলে মনের দুঃখে মোবাইলে গেমস খেলছেন!”

এবার মাথা তুলে তাকালো সীমান্ত। হুট করে উঠে দাঁড়ালো ও। ফোন পকেটে রেখে বুকে দুই হাত ভাজ করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“শত্রুপক্ষকে জেতার অনুভূতি করিয়ে একদম শেষমুহুর্তে হারানোর মজাই আলাদা! সে আপনি বুঝবেন না।”

রিয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পরক্ষনেই শান্ত গলায় বলে উঠলো,
-“আপনার জন্য একটা সুসংবাদ আছে!”

-“জামিল মাহমুদের পরিবারের সব ইনফরমেশন বের করেছেন আপনি?”
সীমান্তর এ প্রশ্নে কিছুটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে দাঁড়ালো রিয়াদ। মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
-“একটু আগেই পেয়েছি।”

-“তো বলেননি কেন?”

-“আপনি তো প্রেম বিরহে গেমস খেলছিলেন!”
কয়েক সেকেন্ডের মতো সাপের মতো ফোঁস ফোঁস ভঙ্গিতে রিয়াদের দিকে তাকালো সীমান্ত। ঠান্ডা গলায় বললো,
-“আপনার এসব ফালতু কথার সময় আমার নেই!”

রিয়াদ থমথমে মুখে বললো,
-“ওসব ইনফরমেশনে তেমন কিছু নেই। তবে আপনাকে না জানিয়েই আমি কিছুদিন ঐ জামিল মাহমুদকে ফলো করেছিলাম। তিনি প্রায় কয়েকদিন পর পরই “ই এন” নামক ক্লিনিকে যান!”

রিয়াদের এ কথায় যেন সীমান্তর রাগ তরতর করে বেড়ে উঠলো। কর্কশ গলায় বললো,
-“কারণ ক্লিনিকটা তার স্ত্রীর। কাজের কথা বলুন!”

-“আমি অনেক কষ্টে জামিল মাহমুদের বিগত তিন মাসের কল রেকর্ড বের করেছি! ভাবির মায়ের এক্সিডেন্টের আগে বেশ কয়েকবার টেলিফোন বুথ আর প্রাইভেট নাম্বার থেকে তার কাছে কল এসেছিলো। আমার ধারণা এটা আরমান হতে পারে!”

সীমান্ত একটু সতর্ক হয়ে উঠলো। রিয়াদের হাতে থাকা ট্যাব নিয়ে নিলো সে। এক ভ্রু উচু করে ধীর কন্ঠে বললো,
-“আপনি কল রেকর্ড বের করেছেন!”

রিয়াদ নিজের মুখে গর্বিত ভাব এনে বললো,
-“এ আর এমন কী! আপনি তো জানেন আমি কতটা বন্ধুত্বপূর্ণ। আমার এক পরিচিত…!”

-“থাক! আর বলতে হবে না! আপনি বরং যান এখন। যে কাজ দিয়েছিলাম সেটা যেন কাল সকাল দশটার মধ্যেই হয়।”

রিয়াদ প্রথমে বিভ্রান্তির ভঙ্গিতে তাকালেও পরক্ষণেই বলে উঠলো,
-“এখন একজন মেয়ে মানুষকে কিডন্যাপ করবো! বিষয়টা আমার কেমন যেন লাগছে।”
-“একজন না দুইজন। পাখিও আছে সাথে!”
পাখির কথা শুনতেই কিঞ্চিৎ ভয়ের রেখা ফুটে উঠলো রিয়াদের চোখে। সীমান্ত তাকে উপেক্ষা করেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। আশ্চর্যজনক হলেও এই মুহুর্তে ওর মধ্যে ক্রোধের ছিটেফোঁটাও নেই। সীমান্ত যেন আইজার কাছ থেকে এটাই এক্সপেক্ট করেছিলো।

-“স্যার ওদের খুঁজে পেলেও বা কী হবে! জামিল মাহমুদের তত্বাবধানে জোর তো করতে পারবেন না!”

-“কে বলেছে পারবো না। আইজাকে নিয়ে আসতে কারও অনুমতির প্রয়োজন নেই আমার!”
রিয়াদের কথার জবাব কিছুটা তীক্ষ্ণস্বরে দিলো সীমান্ত। ওর রক্তচক্ষু দেখে শেষমেশ নিজের মুখে তালা লাগিয়েই নিলো সে!

***

ভোর হয়েছে সেই কবেই। পাখির কিচিরমিচির শুনতে পাচ্ছে আইজা। ছোট্ট একটা কেবিনে এক সাইডে রাখা বিছানায় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে ও। মাথাটা এখনো ঘুরছে। আরফান তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে ওর দিকে। আর সিমি ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে আছে আইজার পেটের দিকে। সামনেই একটা রিপোর্ট হাতে বিস্মিত চোখে আইজাকে দেখে যাচ্ছে এক মহিলা। যে সম্পর্কে আইজার মামী।

-“তোমার প্রেগনেন্সির প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে। আর তুমি জানো না! নিজের মধ্যে কোন পরিবর্তন নজর পড়েনি তোমার?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here