#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৪৬

0
804

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৪৬
#লিখা_তানজিলা

-“আপনি কিন্তু আমাকে কিড*ন্যাপ করছেন!”
আইজার ঠান্ডা গলায় বলা কথায় সীমান্তর গম্ভীর মুখে হুট করেই স্মিথ হাসি ফুটে উঠলো।
-“ভদ্র ভাষা তো আপনার কান অব্দি পৌঁছালো না!”
-“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

কোন উত্তর দিলো না সীমান্ত। সামনে ভয়ংকর ট্রাফিক জ্যাম। সেই কখন থেকে মাঝ রাস্তায় বসে আছে ওরা। একটু পর পর পেছনে থাকা গাড়ির হর্ণের আওয়াজে কানটাই যেন পঁচে যাচ্ছে। গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলো আইজা। সেটাও লক! জানালাও ক্লোসড। অতঃপর এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সীমান্তর দিকে তাকালো ও।

-“কী চান আপনি? এতোদিন পর এভাবে আমার কাজ করার জায়গা থেকে আমাকে টেনে আনার মানে কী!!”

সীটে মাথা এলিয়ে দিয়ে আইজার চোখে চোখ রাখলো সীমান্ত। তৎক্ষনাৎ তার মুখে লেগে থাকা হাসি দ্বিগুন প্রসারিত হয়ে উঠলো।
-“মনে হচ্ছে আমাকে অনেক মিস করেছেন আপনি!”

-“একদম না!”
শক্ত গলায় বললো আইজা। মুহূর্তেই সীমান্তর চাহনি গম্ভীরতার মেঘে ছেড়ে গেলো। তবে তার ঠোঁট জোড়ায় লেগে থাকা হাসি এখনো বজায় আছে। নিজের বুকে হাত রাখলো সে। ঠান্ডা গলায় বললো,
-“খুব কষ্ট পেলাম শুনে!”

সীমান্তর কথায় বিরক্তি নিয়ে নিজের চোখ ঘুরিয়ে নিলো আইজা। রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“এখন কী এই চাকরিটাও কেড়ে নেয়া হবে!”

মৃদু হাসির ঝলক ফুটে উঠলো তার মুখে,
-“আজ আপনার হাফ ডে ছুটি। আমি পারসোনালি আপনার জন্য ছুটি নিয়েছি।”

-“কেন!!!”
আইজার কন্ঠ এবার হুট করে স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। সাথে সাথেই সীমান্ত নিজের মাথা সীট থেকে উঠিয়ে সোজা হয়ে বসলো। তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলো,
-“গলা নামিয়ে কথা বলুন। চিৎকার চেচামেচি আমার একদম পছন্দ না। কিছু জরুরি কথা ছিলো তাই আপনাকে গাড়িতে বসিয়েছি।”

-“তার জন্য ছুটি নেয়ার কোন প্রয়োজন ছিলো না।”

-“সেটা আমি বুঝবো!” আইজার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো সীমান্ত। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। চাহনি জুড়ে থাকা তীক্ষ্ণতা সরে গিয়ে সীমান্তর ঠোঁটের কোণে পুনরায় হাসি ফুটে উঠলো। ওর গালে নিজের হাত রেখে নরম গলায় বলে উঠলো,
-“আমি আমার ওয়াইফের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে চাই। প্লিজ, কোওপারেট!”

নিজের গালে অবাধে বিচরণ করতে থাকা হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো আইজা।
-“মাঝ রাস্তায় এসব কী শুরু করেছেন!”

আইজার কথায় ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো সীমান্তর। একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। ব্যস্ত রাস্তা। ঘুরে ফিরে আইজার কুঁচকে থাকা চোখে গিয়ে আটকালো সীমান্তর দৃষ্টি। ঠোঁটে ফুটে উঠলো দুষ্টু হাসি। আইজার কানের দিকে এগিয়ে গেলো সে।
-“চিন্তা করবেন না! বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না!”

আইজার ঠান্ডা দৃষ্টি উপেক্ষা করেই সরে গেলো সে। এক দৃষ্টিতে সীমান্তর কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে আইজা। কত স্বাভাবিক হয়ে হাসছে সে! সহ্য হচ্ছে না আইজার। কিচ্ছু ভালো লাগছে না ওর!

-“আপনি আমাকে কেন বিয়ে করেছেন?”

সীমান্তর মুখে লেগে থাকা হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। তার চোখে অনুভূতির কোন রেশ নেই। আইজা প্রশ্নটা করেই নিস্তব্ধ ভঙ্গিতে সীমান্তর দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। মিনিট কয়েক ওদের মধ্যে কেউই কিছু বললো না। এতক্ষণ প্রফুল্ল হয়ে থাকা লোকটার কাছে কী আইজাকে ওর করা প্রশ্নের উত্তর দেয়া এতোই কঠিন মনে হচ্ছে! এই শুনশান পরিস্থিতি আর সহ্য হলো না আইজার। সীটে মাথা এলিয়ে দিলো ও। কঠোর গলায় বলে উঠলো,

-“আপনি বলেছিলেন আপনি আপনার বাবার ভরসা পাওয়ার জন্য তার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু সত্যি তো এটাই যে নাজিম শিকদার কখনোই চাননি সেদিন আমাদের বিয়ে হোক। মানে সেদিন আমাকে মিথ্যা বলেছিলেন আপনি! কেন? আমি আপনার মুখে সত্যিটা জানতে চাই।”

-“বাবা ভেবেছিলো আপনি সাহিলের সাথে পালিয়ে তাকেই বিয়ে করবেন। কিন্তু সেটা তো হলো না। আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলেন। সত্যি বলতে তখন আমার মাথায়ও জেদ চেপে ছিলো আপনার বাবাকে ট্র্যাপে ফেলার।”
সীমান্তর কন্ঠে ধীরতার রেশ। আইজা নিজের আঁখি জোড়া সামনের দিকে স্থির করলো। আশেপাশে চলতে থাকা এতো কোলাহল কেন যেন হুট করে ওর কানে আর প্রবেশ করছে না।
-“মিথ্যে কেন বলেছিলেন আমাকে? এই যে আপনার বাবার ভরসা জেতা! তার ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ে!”

-“কারণ আমি কখনোই শত্রুপক্ষকে পুরোপুরি সত্যিটা বলি না। তাদের ধোঁয়াশায় রাখার মধ্যে একটা আলাদাই মজা!”
সীমান্তর দৃষ্টিও সামনে স্থির। ভিষণ শান্ত গলায় বলে উঠলো সে। আইজা আর না হেসে পারলো না। ওর এ কৃত্রিম হাস্যোজ্জ্বল চাহনিতে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সীমান্ত।
-“তখন আপনি আপনার বাবার সত্যিটা জানতেন না আইজা। সে সময় আপনাকে আমার নিজের শত্রুর থেকেও কম মনে হয়নি।”

-“কথাগুলো আপনার মুখ থেকে এতো স্বাভাবিক ভাবে বের হয় কী করে!”

-“আমি আপনাকে এসব বলতে চাইনি। আপনিই জোর করেছেন।”
সীমান্তর কন্ঠে ক্ষুব্ধতার রেশ। পরিবেশটা মুহূর্তেই গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।

আইজা নিজ দৃষ্টি সামনে থেকে সরিয়ে সীমান্তর দিকে স্থির করে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
-“আপনি সত্যিই চমৎকার অভিনয় করতে জানেন! নইলে আপনার কান্ড কারখানা দেখে আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”

-“আপনি ভুল ভাবেননি।”

এবার বেশ শব্দ করেই হেঁসে উঠলো আইজা।
-“সীমান্ত, আপনি আগে ঠিক করুন আমি আপনার জন্য কী! একটু আগে নিজের মুখেই বললেন আমাকে আপনার শত্রুর থেকে কম মনে হয় না। আমি এমন একটা মানুষের সাথে কেন থাকবো যে আমাকে শত্রু মনে করে!”

মুহূর্তেই আইজার গাল চেপে ধরলো সীমান্ত। জোরালো কন্ঠে গর্জে উঠলো সে,
-“বেশ ভয়ংকর শত্রু আপনি আমার। আজ পর্যন্ত শত্রুদের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করিনি আমি। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে…! আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কতটা ছটফট করেছি আমি। আপনাকে ঘৃণা করার হাজার কারণ খুঁজে পেলেও নিজেকে আপনার থেকে দূরে রাখতে পারিনি। আর না ঘৃণা করতে পেরেছি! আমি জানি আমি ভুল ছিলাম। কিন্তু এর জন্য যে এতোটা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাবো আমি; বুঝতে পারিনি! এমন একজনের প্রেমে পরেছি যার মনে আমার জন্য বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই!”

-“এতো কষ্ট করছেন কেন আপনি? আমাকে ডিভো…!”

ডিভোর্স শব্দটা পুরোপুরি আইজার মুখনিঃসৃত হওয়ার আগেই ওর ওষ্ঠদ্বয়ে হামলা করে বসলো সে। তার শিরায় উপশিরায় বয়ে চলা ক্রোধ বেশ স্পষ্ট ভাবেই টের পাচ্ছে আইজা। তবুও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো ও। অদ্ভুদ নিষ্প্রভ ক্লান্তি ভর করেছে মস্তিষ্ক জুড়ে! হঠাৎ নিজ অধরে কিঞ্চিত ব্যথা অনুভব হতেই টনক নড়লো আইজার। এক হাতে সীমান্তর বুকে ধাক্কা দিতেই খানিকটা সরে গেলো সে। তবে আইজাকে ছাড়লো না। তার ঠোঁট জোড়া আইজার কানের কাছে গিয়ে থামলো। কন্ঠস্বরে ভর করলো কঠোর তীক্ষ্ণতা,

-“এরপর থেকে যেন এই শব্দটা আপনার মুখ থেকে না বেরোয়!আপনাকে কেউ জোর করেনি আমাকে বিয়ে করতে। আপনি স্বেচ্ছায় বিয়েটা করেছেন। আপনাকে কয়েক মাস নিজের মতো থাকতে দিয়েছি; নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য। আমি জানি আপনার মনে আমাকে নিয়ে অনেক অভিযোগ। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবেন, মানুষ হিসেবে আমি ভালো-খারাপ যেমনই হই না কেন; প্রেমিক হিসেবে কিন্তু আমি অনেক জঘন্য! বেশি তিরিং বিরিং করলে একদম ঠ্যাঙ ভেঙে শিকল পড়িয়ে ঘরে আটকে রাখবো!”

কথাটা বলেই আইজার গাল ছেড়ে দিলো সীমান্ত। সাথে সাথেই নিজের আঁখি জোড়া সরিয়ে নিলো আইজা। ট্রাফিকের অবস্থা এখনো ভয়ানক। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাইকে নজর পড়লো ওর। এক দম্পতি বসে আছে তাতে। মেয়েটার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। তিন কী চার মাসের হবে হয়তো। বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছে। আর তার মা বিভিন্ন ভাবে কান্না থামানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। হৃদপিণ্ডটা কেন যেন ঝল*সে যাচ্ছে আইজার। অবাধ্য আঁখি জোড়া তবুও সরতে চাইছে না ওখান থেকে।

-“চাইলেই কী সবাইকে আটকে রাখা যায়!”

***

পাখির পাশ ঘেঁষে ছোট্ট একটা রুমে বসে আছে রাজিয়া। এই ঘরেই না-কি পাখির সাথে আরো চারজন থাকতো। এখন রাজিয়াকে মিলিয়ে ঐ রুমে মোট ছয়জন। পাখির হাতে একটা ল্যাপটপ। ওদেরই একজন রুমমেটের সেটা। সবাই ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে এই ল্যাপটপ।

-“সেদিন তোর কথায় রায়হানকে ছেড়ে দিছিলাম আমি!”

পাখির গম্ভীর কন্ঠে টনক নড়লো রাজিয়ার।
-“এহন যেই মজা হইবো সেইটা তো তহন হইতো না!”

রাজিয়ার কথায় মৃদু হেঁসে উঠলো পাখি। সে অনেক মাস আগের ঘটনা। একদিনের জন্য লুকিয়ে ল্যাপটপটা শিকদার বাড়িতে নিয়ে গেছিলো ও। কৌশলে আইজার ব্যাগ থেকে পেনড্রাইভ বের করে তার কাছে থাকা ফুটেজ নিয়ে নিয়েছিলো। নাজিম, সীমান্ত, রায়হান কেউই বাড়ি ছিলো না। আইজা যখন ওয়াশরুমে ছিলো তখনই নিজের কাজ সেরেছে পাখি।

ওদের ছেড়ে দেয়ার পর শিকদার বাড়িতে আর কাজ করতে যায়নি ওরা। আশেপাশেই অন্য বাড়িতে কাজ করছে। ঐ সময় পাখি ফুটেজ টা ফাঁস করতে গিয়েও করেনি। পরিস্থিতি তখন গরম ছিলো। সাথে রাজিয়ার আপত্তি। রাজিয়ার ইচ্ছে রায়হানের বিয়ের আগে এ ফুটেজ ফাঁস করবে।

রাজিয়ার মত হাওয়ায় উড়াতে ইচ্ছে করেনি পাখির। শুনেছে দুই সপ্তাহ পর রায়হানের আকদ। আর এতে পাখির ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম। কারণ রায়হানকে ব্ল্যাক*মেইল আইজা করতো। তাই এই ফুটেজের কারণে আইজার দিকেই আঙুল তুলবে শিকদার বাড়ির সবাই!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here