#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব ৪৫

0
555

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব ৪৫

#লিখা_তানজিলা

দেখতে দেখতে জীবন থেকে ছয় ছয়টা মাস চলে গেলো। চোখের পলকেই যেন সবকিছু বদলে যাচ্ছে। গত ছয় মাস যাবৎ দুই রুমের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকছে আইজা আর ওর ভাই বোন। ফ্ল্যাটটা ওদের মায়ের নামে ছিলো। যদিও এ ব্যপারে আইজা জানতো না। জামিল এখানে এনেছে ওদের।

সে রাতের পর থেকে সীমান্তর সাথে আর দেখা হয়নি আইজার। না সীমান্ত ওর সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছে আর না ও। তবে সীমান্তর খবর নিয়েছিলো দূর থেকে। সত্যি বলতে লোকটার প্রতি ওর মনে কোন খারাপ অনুভূতি বা ঘৃ*ণা কোনটাই নেই। তবুও কোথাও যেন একটা অদৃশ্য জড়তা রয়েই গেছে। আইজা আর কোনকিছুতেই নিজেকে জড়াতে চায় না। জীবনের এ পর্যায়ে এসে নিজের ভেতরের সমস্ত অনুভূতি গুলোকেই ইদানিং বেশ অযথা মনে হয় ওর।

আইজার বাবা এখনো কোমায়। সে এই মুহুর্তে পুলিশের তত্বাবধানে আছে। ঐ ক্লাব থেকে শুধু ফাহাদ না ওর বাবার বিরুদ্ধেও অনেক প্রমান বেরিয়ে এসেছে। জ্ঞান ফিরলেও তাকে জেলেই যেতে হবে। ফাহাদ এখনো ধরা পড়েনি। লোকটা আইজার বাবার বিরুদ্ধে সকল প্রমান ক্লাবে ফেলে গেলেও জাফর আর নাজিমের বিরুদ্ধে কোন প্রমান রেখে যায়নি। পুলিশ শুধু আসিফের লা*শ উদ্ধার করেছে।

ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো আইজা। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব চোখে পড়তেই ওর দৃষ্টি হুট করে নিজের পেটের দিকে চলে গেলো। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো ও। মস্তিষ্ক ক্রমশ খালি হয়ে আসছে। মনে হয়েছিলো মরেই যাবে ও। কিন্তু না; ভাগ্যে মৃ*ত্যু ছিলো না! তাই এখনো অব্দি নিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছে আইজা। যে নিশ্বাস প্রচন্ড ভারী। আর ইচ্ছে করে না ওর এ ভার বহন করতে।

-“আপু, আমার চিপস্!!!!”

হঠাৎ সিমির গলা ফাটানো চিৎকারে টনক নড়লো আইজার। তড়িঘড়ি করে রুমের বাইরে গেলো ও। মেয়েটা একবার চিৎকার শুরু করলে পাড়া প্রতিবেশিদের কান না ফাটিয়ে থামে না।

-“ধ্যাত! আরফান তোকে কতবার বলেছি ওর চিপসে হাত দিবি না!”

আইজার ধমকে আরফান সাথে সাথে নিজের মুখে কয়েকটা চিপস পুরে নিয়ে প্যাকেটটা সিমির সামনে তুলে ধরে কর্কশ গলায় বলে উঠলো,

-“বেয়াদব একটা! যেন কেউ মে*রে ফেলছে একে!!”

সিমি আরফানের এরূপ কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। উল্টো চিপস নিয়ে এক দৌড়ে আইজার পেছনে গিয়ে লুকোলো।

-“সকাল সকাল এসব খাওয়া চলবে না। আগে নাস্তা কর্!”

রক্ষা পেলো না সিমি। আরফানের কাছ থেকে নিজ মূল্যবান চিপসের প্যাকেট বাঁচাতে পারলেও আইজার কাছ থেকে পারলো না। ছো মেরে সিমির হাত থেকে প্যাকেট টা কেড়ে নিলো আইজা। আর বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করলে দেরিই হবে ওর। এই এক মাস হলো, আইজা একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জব করছে।

-“আজকেও কী লেট হবে? আগেই বল, আমি নিতে আসবো তোকে।”
ভ্রু জোড়া উঁচু করে বলে উঠলো আরফান। গতকাল বাড়ি ফিরতে একটু বেশি লেট হয়ে গেছিলো।

-“তার প্রয়োজন হবে না!”
আইজা জানে গতরাত ও একা ছিলো না। সীমান্ত সামনে না এলেও কাল যে লোকটা ওর পিছু পিছু এ বাড়ি পর্যন্ত এসেছে টের পেয়েছে সে।

-“বুঝেছি।”
আরফানের কন্ঠে ব্যঙ্গার্ত্বক রেশ। আইজার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলেও এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না ও।
-“মনে করে সিমিকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে আসবি। ওকে একা ছাড়বি না কিন্তু!”

-“হ্যাঁ! আমার কলেজ তো এই ম্যাডাম পাড় করে দেবে তাই না!”
বিরক্তিমিশ্রিত গলায় বলে উঠলো আরফান।

আইজা নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে দুই ভাইবোনের ঝগড়া দেখে যাচ্ছে। আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না ওর। কোনমতে নাস্তা খেয়ে উঠে পড়লো ও। ঘড়ির কাটায় নজর দিচ্ছে একটু পর পর। আজও না আবার দেরি হয়ে যায়!

****

থাই গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা ছোট চিরকুটটা মনোযোগ সহকারে দেখে যাচ্ছে নাজিম শিকদার। অফিসের এ অংশে কাউকেই প্রবেশ করতে দেয় না নাজিম; এমনকি সীমান্তকেও না। এই বছরও কালো প্যাকেটে মোড়ানো বক্স পাঠানো হয়েছে নাজিমের উদ্দেশ্যে।

কেউ তো আছে যে ওর রহস্য জানে। রিয়াদ, রাজিয়া অথবা পাখি যেই হোক না কেন যতক্ষণ না তারা নিজেদের মুখ খুলছে ততক্ষণ অব্দি তারা নাজিমের জন্য কোন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না। সত্যি বলতে এখন আর কোন খু*নের ঝামেলায় জড়াতে চায় না নাজিম। ফাহাদ আর আরমানের করূণ পরিণতি ওর স্বস্তির জন্য যথেষ্ট। জাফরের বিরুদ্ধে যে প্রমান ফাহাদের কাছে ছিলো সেটা নাজিম ইতোমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে। যদিও জামিল মাহমুদ এখনো হাল ছাড়েনি। কিন্তু জাফর অলরেডি দেশের বাইরে চলে গেছে। মনে হয় না সে আর ফেরত আসবে!

থাই গ্লাসের পাশে থাকা বাটনে চাপ দিতেই খুলে গেলো সেটা। নাজিম বেড়িয়ে সোজা সীমান্তর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। যেমনটা আশা করেছিলো, ছেলেটা কাজেই ডুবে আছে। আশেপাশে চোখ রাখার সময় নেই তার।

-“বাবা, কিছু বলবেন?”
নাজিম সীমান্তর সামনের চেয়ারটা টেনে বসতেই প্রশ্ন করলো সে।

-“আইজার ব্যপারে কী ভেবেছিস! ডিভোর্স দিবি ওকে?”

নাজিমের প্রশ্নে কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সীমান্ত। পরক্ষণেই দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
-“ডিভোর্স দেয়ার থাকলে আগেই দিতাম।”

-“তাহলে তোর ইচ্ছেটা কী? সারাজীবন এভাবেই একা কাটাবি? যা সিদ্ধান্ত নেয়ার দ্রুত নে। হয় আইজাকে বাড়িতে নিয়ে আয় নয়তো ডিভোর্স দিয়ে আমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে কর!”
নাজিমের কথার ভাজে জমে থাকা ক্ষুব্ধতা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সীমান্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। নরম গলায় বললো,
-“আমি চাইনা আইজা আপনাকে তার মায়ের খু*নি ভেবে বাড়িতে আসুক।”

-“তুই এখন ওর মায়ের খু*নিকে খুঁজবি?”

-“আচ্ছা বাবা, জাফর আঙ্কেল দেশে কবে আসবে?”
নাজিমের প্রশ্নের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো সীমান্ত। ও এইটুকু তো জানে যে জাফরই শেষবার আইজার মায়ের সাথে দেখা করেছিলো।

-“জাফর ভাই এখন খুব ব্যস্ত। এ বছর দেশে আসবে না সে। তুই এসব কেন জিজ্ঞেস করছিস? জাফর ভাইকে দিয়ে তোর কী কাজ?”

-“না, এমনিই। আমার সাথে দেখা না করেই চলে গেলো ; তাই জানতে ইচ্ছে হলো।”

নাজিম এক দৃষ্টিতে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। ও জানে সীমান্ত এই মুহুর্তে জাফরকেই সন্দেহ করছে। আর সীমান্তর এ সন্দেহ অহেতুক না।

জাফর শিকদারের প্রথম স্ত্রী ছিলো আঁখি মাহমুদ। জামিল মাহমুদের একমাত্র বোন নিজের বিয়ের দিন পালিয়ে জাফরের কাছে এসেছিলো। পরবর্তীতে আঁখির বাবা নিজের মানসম্মান বাঁচাতে ওদের বিয়ে দিলেও সে বিয়ে এক বছরের বেশি টেকেনি জাফরের পর*কীয়ার কারণে।

আরমানের নজর আগে থেকেই আঁখির ওপর ছিলো। জাফরের সাথে ডিভোর্সের পর সে সুযোগ পেয়ে আঁখিকে বিয়ে করে। নাজিম সেসময় এটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। এমনিও আঁখি নাজিমকে বেশ সম্মান করতো। কিন্তু জাফর ভিষণ ক্ষেপে ছিলো আরমানের ওপর।

আঁখি আর আরমানের বিয়ের দুই বছরের মাথায়ই আইজার জন্ম হয়। জাফরও ততদিনে আরেকটা বিয়ে করে। নাজিম ভেবেছিলো জাফর হয়তো এ নিয়ে মনে আর কোন রাগ রাখেনি। ভুল ভেবেছিলো নাজিম। এবার দেশে এসে প্রথমেই জাফর আঁখির সাথে দেখা করতে যায়। অতঃপর রাগের মাথায় আঁখিকে খু*ন করে বসে ও।

-“বাবা!”
সীমান্তর ডাকে টনক নড়ে নাজিমের। এক হাতে মাথা চুলকাচ্ছে সে। পরক্ষনেই সীমান্ত নাজিমের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ রেখে বলে উঠলো,
-“কয়েকদিন আগে সাইফ এন্টারপ্রাইজের সাথে আপনি যে প্রজেক্ট সাইন করেছেন সেটা আমি হ্যান্ডেল করতে চাই। আপনার তো আরো কাজ আছে!”

-“সোজাসুজি বললেই হয়, আইজার ওপর নজর রাখতে চাস!”
নাজিমের স্পষ্ট বিবৃতিতে সীমান্ত তৎক্ষনাৎ নিজের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলো। ওর হতবুদ্ধি চাহনি দেখে নাজিম আরো বলে উঠলো,

-“যাই করিস, আমার কাজে যেন কোন সমস্যা না হয়! আর পারলে আইজাকে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসিস!”
সীমান্তকে আর কিছু বলতে না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো নাজিম। ও নিজের ভেবাচেকা চাহনি সামলে নিয়ে ঠান্ডা চোখে ফোন হাতে তুলে নিলো। আজ এমনিও সাইফ এন্টারপ্রাইজে যাওয়ার কথা সীমান্তর। বেলা এগারোটার দিকে জরুরি মিটিং আছে।

***

লাঞ্চ টাইমে নিজের ব্যাগের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আইজা। সকালে আরফান আর সিমির ঝামেলায় মাথাটাই ঘুরে গেছিলো ওর। ফলে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে লাঞ্চবক্স বাড়িতে ফেলে এসেছে।

এই মুহুর্তে সিমির সেই প্রিয় চিপসের প্যাকেট আইজার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। আরফান প্যাকেটটা খুলে ফেলেছিলো বলে সিমি নিজ হাতে সেটা স্ট্যাপলারের মাধ্যমে আটকে দিয়েছিলো। শুধু শুধু আর বাড়তি খরচ কেন করবে আইজা! সিমিকে পরে সামলে নেয়া যাবে। শেষমেশ আইজা ব্যাগ থেকে চিপসের প্যাকেটটা বের করে নিলো।

হঠাৎ কে যেন ছো মেরে ওর হাত থেকে সেটা কেড়ে নিলো। দীর্ঘ ছয় মাস পর কানে বেজে উঠলো সেই পরিচিত গম্ভীর কন্ঠ,

-“এসব হাবিজাবি খেয়ে দিন পার করেন আপনি?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here