অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-১২

0
347

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১২

বাবুর সাতদিনের দিন ওর আকীকা দেয়া হলো। বাবা মা ভালো নাম রাখলেন। আমি নাম দিলাম খুশবু৷

তবে তাকে আমি মনে মনে অভাগী ডাকি। মা’কে তো হারিয়েছেই, বাবা এই পর্যন্ত ওর মুখ দেখেনি। যার জন্য প্রিয়তমাকে হারিয়েছে তাকে সে মানবে না কিছুতেই। কতো বোঝানোর চেষ্টা করেছি ভাইয়াকে! সে কিছুতেই খুশবুকে কোলে নেবে না। চেয়েই দেখে না! দেখলে নিশ্চিত মায়া হবে। চোখদুটো যে একেবারে ভাবীর মতো হয়েছে!

আমি ভাবি, ভাইয়া কতো ভালোবাসে ভাবীকে। ভাবীর সাথে যা হয়েছে সেটা আমার সাথে হলেই বরং আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ খুশি হতো। সে ও হয়তো খুশি হতো। এর মাঝে সে আমাকে ফোন পর্যন্ত করেনি। মা’কে নাকি করে। আমি কোন দোষ করেছি যে কথাই বলা যাবে না। সদ্য সন্তান হারানো মায়ের কষ্ট কি সে জানে না? তার কি আমার প্রতি কোনো মায়া অবশিষ্ট নেই?

আকীকার দিন সারাদিন কাজ করে বিকেলে গোসল করতে গেলাম। খুশবু ঘুমাচ্ছিলো। আমার ঘরেই থাকে ও। এখানে দোলনা টানানো হয়েছে।

গোসল করে বের হয়ে দেখি সে বসে আছে খাটে। তার কোলে খুশবু। মেয়েটা মিটমিট করে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। ও ও মেয়েটার সাথে আপনমনে খেলছে। আমি চোখের জল অনেক কষ্টে সংবরন করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। সে বোধহয় কড়া মেজাজ নিয়ে এসেছিলো। খুশবুকে পেয়ে গলে গেছে। শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বসো।”

আমি তার থেকে একটু দূরে বসলাম। বললাম, “হঠাৎ এলে যে? কী মনে করে?”

“মা আসতে বলেছিলেন অনেকবার করে।”

“তাই এসেছ? ভালো তো!”

“হুম। কেমন আছ?”

“তা জেনে কী করবে? তুমি ভালো আছ তো?”

“দেখে ভালো মনে হয়?”

“জানি না।”

“মা বললেন পেটে নাকি ব্যথা হয় এখনো?”

“হলে তুমি কী করবে?”

“এভাবে কথা বলছ কেন?”

আমার প্রচুর রাগ উঠলো। ন্যাকা সাজছে কেন এখন? জোরেই বললাম, “তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমার জন্য চিন্তায় মারা যাচ্ছো! এদিকে আমি মরি না বাঁচি সে খবর একবারও নেয়ার চেষ্টা করোনি?”

“কে বলেছে করিনি?”

“তাই বুঝি? কবে খবর নিলে?”

“মা’কে আমি প্রতিদিন ফোন করেছি।”

“আর আমাকে?”

সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সত্যি বলব?”

“হ্যাঁ বলো।”

“ইচ্ছে হয়নি।”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হা করে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সে এটা বলতে পারলো? এমন আচমকা চেঁচামেচি আবার সব নিরব হয়ে যাওয়ায় খুশবু বোধহয় ভয় পেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো। আমি তাকে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে পারলাম না। নিজেরই মাথা আগুন হয়ে আছে, বাচ্চা কী করে সামলাবো? ছোট ভাবী কান্না শুনে এসে খুশবুকে নিয়ে গেলেন।

সে বলল, “কেন ইচ্ছে হয়নি শুনবে না?”

আমি চুপ করে রইলাম।

সে বলল, “তোমার প্রতি প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো। তুমি কি কখনো আমার দিকটা ভেবে দেখেছ? শুধু নিজের মতো ঘটনাগুলো দেখে গেলে তো হবে না তাই না?
তুমি নিজের খেয়াল রাখতে পারোনি। যার ফলে বাচ্চাটা হারিয়েছ!”

তার গলা ধরে এলো। সে একটু চুপ থেকে বলল, “ওকে ঘিরে শুধু তোমার না, আমারও অনেক স্বপ্ন ছিল। যেদিন শুনলাম খবরটা, আমার পায়ের নিচ থেকে মনে হয়েছিলো মাটি সরে গেছে।
আমি তো তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তুমি সুস্থ ছিলে মোটামুটি। জ্ঞান ফেরার পর তোমার সাথে কথা বলতে আমার ইচ্ছে হয়নি। মনে হয়েছে তুমি আমার বাচ্চার খুনি।”

আমি হেসে বললাম, “আর কিছু?”

সে বলল, “শেষ কথাটা তখন মনে হয়েছিলো। এখন মনে হয় না। আমি তোমার দিকটাও বুঝি। তোমাকে কষ্ট দিতে আমার নিজেরও অনেক কষ্ট লাগে। আমি কী করব বলো? আমার নিজেরও একটা ভালোলাগা, মন্দলাগা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে নাকি?”

“তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি তাই না?”

“সেটা কথা না। সমস্যা হলো তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টাই করোনি কখনো। সিলেটে থাকাকালীন আমি তোমাকে বলেছিলাম আমাকে ভুল বুঝো না। অথচ তুমি আমাকে প্রতি পদে ভুল বুঝে গেছ। আমি তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি।
আমি আমার ফ্যামিলির প্রত্যেকটা মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার জন্য দিনের পর দিন তাদের কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। তোমাকে আমি আভাসও পেতে দেইনি। তোমার কাছে শুধু এতটুকুই চাওয়ার ছিলো, আমার মান সম্মানটা রক্ষা করা। আমি যে বড় মুখ করে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই মুখটা বজায় রাখা। কিন্তু তুমি সেরকম কোনো চেষ্টাই করোনি। উল্টে ভুল করে গেছ, ভুল বুঝে গেছ।”

“আমি ভুল বুঝিনি, তোমার মা তোমাকে ভুল বোঝাচ্ছে।”

“আমার মা’কে নিয়ে আর একটি কথাও বলবে না। মা তোমার জন্য শেষবার কী কী করেছে মনে নেই তোমার?”

“আছে। সেসব তার নিজের জন্য। তার নাতি নাতনির জন্য ছিল। যখন আমার বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল, তার চেহারাটাও বেরিয়ে এল। আমার খবরও উনি নেননি। একটা ফোনও করেননি, দেখতে আসা তো দূরে থাক।”

ও যেন একবোঝা কষ্ট নিয়ে আমার দিকে তাকালো। বলল, “তুমি জানো, মা খবরটা শোনার পর স্ট্রোক করেছেন? উনি আজ সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।”

আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল! হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। আমি কোনোমতে বললাম, “আমি জানতাম না।”

“আমিই তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম।”

আমি ওর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম, “মা কেমন আছেন এখন?”

“মোটামুটি।”

“আমি যাব মা’কে দেখতে।”

সে কঠিন গলায় বলল, “না৷ তোমাকে এখন মায়ের কাছে নেয়া যাবে না।”

“কেন?”

“তোমাকে দেখলে মা আরও এক্সাইটেড হয়ে পড়বে। তাকে এখন বিশ্রাম নিতে হবে। কোনোভাবে প্রেশার দেয়া যাবে না। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও পরেরবার আর বাঁচবেন না।”

আমি কেঁদে ফেললাম। তার চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে। সে বলল, “তুমি বলতে পারো এই অবস্থায় আমি কী করতাম? কোনদিকে যেতাম? কার কাছে থাকতাম?”

আমি তার হাতদুটো ধরে আমার কপালে ঠেকিয়ে বললাম, “তুমি আমাকে মাফ করে দিও।”

সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ ধরে রাখলো। বলল, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার প্রতিটা মুহূর্ত কষ্ট হয়। আমার যেদিন সাধ্য হবে তোমাকে নিজের কাছে রাখার, সেদিন তোমাকে নিয়ে যাব। ততদিন এবাড়িতেই কষ্ট করে থাকো প্লিজ।”

সে আমাকে ছেড়ে আমার হাতে, কপালে, গলায় চুমু খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তারপর সোজা বাগান পেরিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম।

অভাগীটা কাঁদছে। ছোট ভাবী ও’কে নিয়ে এসে আমার কোলে দিয়ে বলল, “আমাদের কারো কাছে থামলোই না। তুমি চেষ্টা করো তো।”

আমি কোলে নিতেই অভাগী চুপ হয়ে গেলো। হাত দিয়ে আমার গাল ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। আমি ওর নাকে নাক ঘঁষে বললাম, “তুই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন রে। তোকে আমি অনেক যত্নে মানুষ করব দেখিস। মা বাবা কারো কথা মনেই করতে দেব না।”

অভাগী কাঁদলো না আর। তার চোখ দিয়ে জমে থাকা পানি গড়িয়ে পড়লো। আমিও তার শরীরে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকলাম। এ কান্না কত যন্ত্রণার সেটা কেউ কোনোদিন বুঝবে না।

.
খুশবুর দুই মাসের সময় আমি অনেকদিন পর কলেজে গেলাম। ফার্স্ট ইয়ার শেষ হয়েছে শুধু। সেকেন্ড ইয়ারে কয়েকদিন ক্লাস করেছি, ফাইনাল দেইনি। মাঝখানে প্রায় দুই বছরের মতো গ্যাপ হয়ে গেছে। নতুন করে সব ঠিক করে ভর্তি হয়ে এলাম। আবার পড়াশুনা শুরু করতে হবে৷ এভাবে চলবে না। পড়াশুনার সাথে সাথে অন্য সব কিছুতে মনোযোগ দিলাম। যেসব আমি করতে পারি না সেগুলো শিখতে শুরু করলাম।

একটা কম্পিউটার কোর্স আর হাতের কাজ শেখার কোর্সে ভর্তি হলাম। কলেজে ক্লাস তেমন থাকে না৷ আমি নোটগুলো জোগাড় করে বাড়িতে পড়া শুরু করলাম। আর সপ্তাহে তিনদিন করে কোচিং ক্লাস করতে যেতে শুরু করলাম।

এর মাঝে ফেসবুকে এক আপার সাথে খুব ভাব হয়ে গেলো। শেফালী আপা। মেসেঞ্জারে কল করে একদিন আমার সব কথা খুলে বললাম তাকে। উনি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, বোঝালেন অনেক কিছু। আর এগিয়ে যেতে অনেকটা শক্তি যোগালেন।

সময় ভালোই কেটে যেতে থাকলো। আপাতদৃষ্টিতে ভালো যাকে বলে। মনের ভেতরটা কতো পোড়ে তা কেউ দেখে না। আমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া নিয়ে ছোট ভাবী মাঝে মাঝে কথা শোনালোও আর কেউ কিছুই বলে না। তারা ছেড়ে দিয়েছে সব অদৃষ্টের হাতে। যা হওয়ার হবেই। বড় ভাবী মারা যাওয়ার পর বাবা অসুস্থই থাকেন বেশিরভাগ সময়। ভাইয়ারও অবস্থা যাচ্ছেতাই। অফিসে যায়, রাত করে বাড়ি ফেরে। ভালো করে কথা বলে না কারো সাথে। স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়েছে সে। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে কত সময় নেবে আল্লাহ-ই জানেন।

আমার মন সবসময়ই অশান্ত থাকে। মনে হয় কিছু করা দরকার যেটা পারছি না, যেটা হওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না। মাঝে মাঝে অর্না ফোন করে আমাকে। কান্নাকাটি করে। ওবাড়িতে ফিরতেও বলে কখনো সখনো। তবে জোর দিয়ে বলে না। শ্বাশুড়ি মা নাকি বলে দিয়েছেন আমার মুখদর্শন করতে চান না।

ও কখনো হঠাৎ একবার আসে। আধঘন্টার মতো থেকে চলে যায়।

ওরও সেই করুন অবস্থা। সব থেকেও নেই। আমার কাছে তবু সুখের একটা উপাদান আছে- খুশবু। ওর তাও নেই। একাকী রাতগুলো কী করে কাটায় সে? ঘুম হয়? আমার তো হয় না। মোবাইল হাতে রোজ রাতে কতবার ভাবি তাকে ফোন করব। করা হয়ে ওঠে না। সব খাপছাড়া এলোমেলো হয়ে গেছে। উচ্ছল প্রেমের সময়গুলোর মতো এখন আর অনেক কথা জমে থাকে না। ফোন করলেও কয়েক মিনিট কথার পর আর কথা থাকে না। অধিকারের কথা, ভালোবাসার কথা, কষ্টের কথা গলায় আটকে আসে। বলতে পারি না।

.
শীতের শেষভাগ। হালকা গরম পড়ে গেছে। আমি বাইরে থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে মায়ের কাছ থেকে খুশবুকে নিয়ে এলাম। বিকেলবেলা তখন। ছাদে মিষ্টি রোদ উঁচু গাছের মাথায় ঝুলে আছে। ঝিনু কয়েকটা কবুতর পালতে শুরু করেছে ছাদে। মনে হলো একটু গিয়ে বসে থাকি ছাদে। ভালো লাগবে হয়তো। আমি খুশবুকে কোলে নিয়ে ওঠার হঠাৎ পা পিছলে গেল। পানি ছিল না কী কে জানে! আমিও পড়ে গেলাম, খুশবু আমার ওপর পড়লো। চিৎকার করে উঠলাম দুজনেই। মা, বাবা, ভাবী ছুটে এলেন।

আমি কোমরে ব্যথা পেয়েছি, খুশবুর তেমন কিছু হয়নি। তবে সে ভয় পেয়েছে ভীষণ। এমন কান্না যে আর থামেই না। বাড়ির সবাই কতো চেষ্টা করলেন কান্না থামাতে। শেষে রাতে বাবা মসজিদের হুজুরের কাছে নিয়ে গেলেন। উনি দোয়া পড়ে ফু দেয়ার পর একটু ঠান্ডা হয়েছে মেয়েটা। বাবা যখন খুশবুকে নিয়ে ফিরলেন, আমি কোলে নিতে চাইলাম ওকে। মা নিতে দিলেন না। নিজে কেড়ে নিয়ে গেলেন। বললেন, “তোর ওকে রাখতে হবে না। আজকে থেকে ওর কাছেও আসবি না। তোর সাথে থাকলে এই মেয়েও জানি কখন মরবে!”

আমি কিচ্ছু বললাম না। চুপ করে চলে এলাম নিজের ঘরে। অন্ধকারে শুয়ে রইলাম একা। ঝিনু পড়াশুনা শেষ করে এসে শুয়ে পড়লো। আমি গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম। ঘড়ি যখন তিনটার কাটা ছুঁই ছুঁই, তখন নিঃশব্দে উঠে গিয়ে একটা ব্লেড নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। ভেবে দেখেছি, আমার কাছের মানুষগুলো শুধু কষ্টই পেয়ে যায়। আমার অস্তিত্ব না থাকলে অনেক মানুষের জীবন নতুন করে শুরু হতে পারে। এই অপয়া জীবন রেখে কী লাভ?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here