#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-২
আমি ঘরদোর গুছিয়ে ভালো একটা জামা পরে নিলাম। ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। সে ফোন করেছিল চল্লিশ মিনিট আগে। তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি বড়জোর আধঘন্টার রাস্তা৷ এসে পড়ল বলে।
আমি ফোন হাতে নিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে টুল পেতে বসলাম। সময় যেন যায় না। আশেপাশে গাড়ির শব্দ শুনলে উঠে দাঁড়াই। মনে হয় যেন সে এসেছে। কিন্তু সে আর আসে না।
সন্ধ্যা হওয়ার মুখে আমি বুঝে গেলার সে আর আসবে না। জ্বরটা সম্ভবত বেড়েছে। আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। লাইট জ্বালাতেও ইচ্ছে হলো না। মুখের সাথে মনটাও তেঁতো হয়ে এসেছে। এমন কী করে করে মানুষ? কাউকে বলে কয়ে তারপর না আসাটা কোন ধরনের ফাজলামো?
মাগরিবের আজান পড়ল বলে, ঠিক এমন সময় কলিংবেল বাজলো। আমি ভাবলাম বাড়ির লোক এসেছে। অনেক কষ্টে পা টেনে টেনে গিয়ে দরজা খুলে দেখি সে এসেছে। হাতে ফুলের তোড়া। আমি ভীষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। সে বলল, “ঢুকতে দেবেন না?”
দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। সে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসল। আমি দরজা লাগিয়ে ভেতরে যেতে যেতে আবিষ্কার করলাম আমার জ্বর সেরে গেছে। একটুও খারাপ লাগছে না। কি আজব!
সে পকেট থেকে চকলেট বের করে আমায় দিল। বললাম, “আমি চকলেট খাই না।”
সে হা করে অবাক হয়ে তাকালো। “সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“এমনি।”
“আচ্ছা আপনার ছোট বোনকে দিয়ে দেবেন তাহলে। তো শরীর কেমন?”
“এখন ভালো।”
“একটা কথা বলার ছিল।”
“পরে বলবেন, আমি একটু চা বানিয়ে আনি।”
সে হাসলো। ঠোঁট ভাজ করা কি সুন্দর হাসি! বলল, “আমি চা খাই না।”
“কেন?”
“যে কারনে আপনি চকলেট খান না সে কারনে।”
আমি একটু অবাক হলাম। এ এমন রহস্য করে কথা বলছে কেন? সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাই তাহলে।”
“মাত্রই তো এলেন।”
“আমার আরেকটু বসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দেরি করে ফেলেছি আসতে। আপনার বাড়ির সবাই চলে এলে তারা খারাপ ভাবতে পারে। আপনাকে দেখতে এসেছিলাম। দেখা শেষ। এখন যেতে হবে।”
“কিছু খেয়ে যেতেন। এভাবে খালি মুখে গেলে…”
সে হেসে বলল, “আরেকদিন।”
“আর কখনো আসবেন?”
সে কপালে আঙুল দিয়ে অদৃশ্য রেখা টেনে বলল, “এখানে লেখা থাকলে আসব।”
“শুনুন…”
“বলুন।”
“আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?”
“জোগাড় করেছি। ফোন নাম্বার নিশ্চয়ই এমন কিছু নয় যেটা পাওয়া যাবে না।”
“কিন্তু কেন?”
সে পকেট থেকে ভাজ করা কাগজ দিয়ে বলল, পড়ে দেখবেন, তাহলে বুঝতে পারবেন।”
মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। চারদিকে অদ্ভূত নিরবতা। সে চলে যেতে গিয়ে ফিরে এল। আমার কাছাকাছি এসে কপালে আলতো করে হাত রাখলো। হাতটা ভীষণ ঠান্ডা। যেন ফ্রিজের পানিতে অনেকক্ষণ চুবিয়ে রেখেছিল। অদ্ভূত শীতলতা কপাল থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। আমি কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “জ্বর আছে। ঔষধ খেয়েছেন?”
“হুম।”
“নিজের খেয়াল রাখবেন।”
আমার ভেতর থেকে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বললাম, “রাখব।”
সে চলে যাওয়ার পর দরজা লাগাতে গিয়ে মনে হলো সে কী যেন বলতে চেয়েছিল। বলল না কেন? জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। ততক্ষণে গাড়িটা চলে গেছে ধোঁয়া উড়িয়ে। সন্ধ্যের ম্লান আলোটা তখনো ঝুলে আছে। নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। চাঁদকে বললাম, “দেখো তো ঠিক করে পৌঁছুলো কি না?”
চাঁদ যেন আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে লজ্জা পেয়ে পাতার আড়ালে লুকিয়ে গেল।
সে বের হওয়ার দশ মিনিটের মাথায় বাড়ির সবাই চলে এলো। মেলা থেকে গাদা গাদা জিনিস কিনে এনেছে। হুট করেই নিরবতা থেকে ভয়ানক চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। ঝিনু বড় আপার ছেলের সাথে ঝগড়া করছে, কী নিয়ে যেন দু’জন টানাটানি করছে। ছোট ভাবী কোথায় কী করেছে সেসব ফিরিস্তি দিচ্ছে। বাবা চড়া গলায় ধমকাচ্ছেন সবাইকে। আমার এসব সহ্য হলো না। গা গুলিয়ে উঠল হঠাৎ। মাথাটা ঘুরে গেল। চোখের সামনেটা আলো থেকে আস্তে আস্তে আবছা হয়ে এল।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আমি আমার ঘরে। অল্প পাওয়ারের নীল আলো জ্বলছে। ঘরে আর কেউ নেই। উঠে বসলাম আস্তে আস্তে। দুর্বল লাগছে এখনো। মোবাইলটা পাশেই আছে। হাতে নিয়ে দেখি সাড়ে নয়টা বাজে। তার চিঠিটা মোবাইলের কভারের ভেতর রেখে দিয়েছিলাম। সেটা বের করে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে পড়তে শুরু করলাম।
কিন্তু তখুনি মা চলে এলেন। লুকিয়ে ফেলতে হলো চিঠি৷ মায়ের হাতে ভাতের প্লেট৷ মনে পড়ল সারাদিন কিচ্ছু খাইনি। এভাবে না খাওয়ার অভ্যাস আমার আছে, তবে আজ তার আসার ধাক্কাটা সহ্য করতে পারিনি। কোনোরকম কথাবার্তা না বলে খেয়ে নিলাম। মা অবাক হয়ে গেলেন। কিছু বুঝলেন নাকি! মা’কে দ্রুত বিদায় করে চিঠি নিয়ে বসলাম।
সুন্দর টানা হাতের লেখা। বলপয়েন্ট দিয়ে লেখা হয়েছে, তবে কিছু লাইনের নিচে নীল রঙের জেলপেন দিয়ে দাগ দেয়া। লেখায় কোনো সম্বোধন নেই। সরাসরি কাহিনী।
“আমি যখন ইন্টারে পড়ি, তখন ক্লাসে একটা মেয়ে পড়তো। নাম ধ্রুপদী সরকার। আমি একপ্রকার পাগল ছিলাম ওর জন্য। ওকে দেখার জন্য কলেজে যেতাম, ওর চোখে পড়তে এহেন হাস্যকর কাজ নেই যা করিনি। কিন্তু ধর্ম ভিন্ন বলে পাত্তা পাইনি কোনোদিন। খুবই রেস্ট্রিকটেড ফ্যামিলির মেয়ে ছিল। ইন্টার শেষ হওয়ার পরপর ওর বিয়ে হয়ে যায়। এখন ও ইংল্যান্ড থাকে। দুটো ছেলে আছে। তবুও আমি ওকে ভুলতে পারিনি। কখনো কোনো নারীকে নিজের জীবনে কল্পনা করতে গেলে শুধু ধ্রুপদীর মুখটাই ভাসতো। হাসছেন নিশ্চয়ই, আপনাকে আমি বলে বোঝাতে পারব না প্রথম প্রেম বিষয়টা ঠিক কেমন। বিশ্বাস করবেন, আমি এখনো যখন কলেজের দিনগুলোর কথা মনে করি, আমার বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করতে থাকে। মনে হয় একটা বার যদি ফিরে যেতে পারতাম!
এতদিন এত মেয়ে দেখতে গিয়েছি, কাউকেই ভালো লাগেনি৷ সবার মধ্যে আমি ধ্রুপদীকে খুঁজতাম। তবে আশ্চর্যের কথা শুনবেন, ধ্রুপদীর জায়গাটা কেউ নাড়িয়ে দিয়ে থাকলে সেটা আপনি। কেন আমি বলতে পারব না৷ ধ্রুপদীর সাথে আপনার বাহ্যিক কোনো মিল নেই। সে দেখতে গ্রীক দেবীদের মতো ছিল। নিঁখুত আর চোখ ধাঁধানো সুন্দর। আপনি অন্যরকম৷ হয়তো খুব সাধারণ, তবে সবার নতো নন।
সেদিন আপনাকে দেখার সময় প্রথমবার আমার ধ্রুপদীর সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে হয়নি। শুধু আপনার সাথেই সময়টা কেটেছে৷ অন্যকেউ মনের মধ্যে উঁকি দেয়নি।
আপনাকে এসব কেন বললাম জানি না। শুধু জানিয়ে রাখতে চাইছিলাম। আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তোবা পেয়ে গেছেন। কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করে নেবেন।
আপনার কাছে একটা প্রশ্ন রইল, চোখের দেখার ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে কতটুকু তফাৎ? ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা হওয়া যায়? নাকি দুটো ভিন্ন জগতের শব্দ? একটার সাথ অন্যটার সম্পর্ক নেই?”
চিঠি পড়ে পাক্কা দশ মিনিট আমি স্ট্যাচু হয়ে বসে রইলাম। বুঝতেও পারলাম না কী হচ্ছে এসব। তবে বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শুরু হলো। নিঃশ্বাস আটকে আসতে থাকলো।
আমি আর ঝিনু এক ঘরে ঘুমাই। বড় আপা এলে আমাদের সাথেই শোয়। আপার ছেলে আয়াশটা ভীষণ দুষ্টু৷ ঘুমানোর আগে ইচ্ছেমতো চেঁচামেচি লাফালাফি করতে থাকে। ঝিনু যোগ দেয় তার সাথে। আমি আজ এসবের মধ্যে থাকতেই পারলাম না। উঠে নিঃশব্দে চলে গেলাম ছাদে। অস্থিরতায় টিকতে পারছি না একদম।
ঠান্ডা বাতাস বইছে। রেলিং ঘেঁষে লাগানো গাছের পাতাগুলো কাঁপছে। বাতাসে মাটির ঘ্রাণ। আকাশে ঘন করে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে বুঝি!
একটু পরেই সে ফোন করলো। ধরতেই প্রথম কথাটা বলল, “চিঠিটা পড়েছেন?”
আমি উত্তর দেয়ার আগেই কে যেন মোবাইলটা কান থেকে টেনে নিয়ে গেল। পেছনে ঘুরে দেখি মা। তিনি মোবাইল কানে দিয়ে বললেন, “কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে সম্ভবত কিছু বলল না সে। মা কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে রেখে দিলেন। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কার সাথে কথা বলছিলি লুকিয়ে ছাদে এসে?”
আমি ফট করে বলে দিলাম, “রং নাম্বার।”
মা বিশ্বাস করলেন কি না কে জানে! ভাগ্যিস তার নাম্বার সেভ করিনি। মা বললেন, “জ্বর নিয়ে বাতাসের মধ্যে ছাদে এসেছিস কেন? যা নিচে।”
আমি নিচে চলে গেলাম। নিচে যেতে যেতে তার নাম্বারে মেসেজ করলাম, “স্যরি। মা চলে এসেছিল।”
মেসেজের ডেলিভারি রিপোর্ট এলো না। তখনো আমি জানতাম না সেদিনের কথোপকথন টুকুই তার সাথে আমার শেষ কথা। সেদিনের পর থেকে তার নাম্বারটায় না ফোন ঢুকলো, না কোনো ফোন এলো। মেসেজও যেতো না৷ প্রথমে ভেবেছিলাম ব্লক করেছে৷ পরে অন্য নাম্বার দিয়ে চেষ্টা করে বুঝলাম, সে আসলে নাম্বারটা ব্যবহার করছে না।
(চলবে)