অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-৩

0
444

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-৩

প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করে রইলাম, সে বুঝি ফোন করবে। তারপর মেনে নিলাম, নিজেকে বুঝিয়ে নিলাম এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল, যেটা কেটে গেছে। এখন আর এসব নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না।

ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। সারা বছর কিছু পড়িনি। এখন প্রয়োজন দিনরাত এক করে পড়াশুনা করা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বই নিয়ে বসলেই আর পড়তে ইচ্ছে করে না। মনে হয় জীবন থেকে পড়াশুনা নামক বিষয়টা টেনেহিঁচড়ে বের করে দেই। শরীরে অসম্ভব আলস্য জায়গা করে নিয়েছে।

পরীক্ষা হচ্ছে। টেনেটুনে পাশ করার মতো পরীক্ষা দিচ্ছি। প্রশ্নপত্র পেয়ে পাশ নাম্বার ওঠার মতো লিখে আর পারলেও লিখতে ইচ্ছে করে না। হাত গুটিয়ে বসে অন্যদের লেখা দেখি। শেষ পরীক্ষাটা ভয়ানক খারাপ হলো। পাশ নিয়ে সন্দেহ। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় মনে হলো, ভুল হয়ে গেছে। একটা ভুলকে পাত্তা দিতে গিয়ে নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলাটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের কাজের মধ্যে পড়ে না।

পরীক্ষা শেষে কাজ নেই। বাড়িতে শুয়ে বসে দিন কাটে। সেসব কাহিনী ভুলে গেছি মোটামুটি। অন্তত নিজেকে তাই বলে সান্ত্বনা দেই। শুধু মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কপালে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পাই। সাথে রজনীগন্ধার সুবাস!

বছরটা ঘুরে গেলো। পরের বছর শীতকাল চলে এলো। শীতকালটা আমার ভারি পছন্দ। খেয়ে-পরে-ঘুমিয়ে শান্তি। সবাই যখন মোটা জামাকাপড় গায়ে দিয়ে শীতে কাঁপে আমি পাতলা জামা পরে বাতাসের মধ্যে দৌড়ে বেড়াই। গায়ে কাটার মতো শীত বেঁধে। আমার ভেতরটা জুড়িয়ে যায়।

সকালে সবাই যখন লেপ মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমোয়, আমি তখন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি। চাদর গায়ে দিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে ঘুরি। একটু সোনালী রোদের আলো দেখা দিলে গায়ের মেখে নেই।

এক সকালে একটা বিশাল গাড়ি এসে বাড়ির বাইরে দাঁড়ালো। আমি তখন গোলাপ গাছের আগা ছেটে দিচ্ছি। কৌতুহল নিয়ে তাকালাম।এত সকালে গাড়ি করে কে এল! আমাকে অবাক করে দিয়ে গেট খুলে এক মহিলা ঢুকলেন। সুন্দর ফরসা চেহারা, গায়ে সিল্কের শাড়ি জড়ানো, গলায়-হাতে-কানে স্বর্ণের অলঙ্কার। পুরো শরীরজুড়ে আভিজাত্য উপচে পড়ছে। সকালবেলা এমন মূর্তি দেখে হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুখটা চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক চিনতে পারলান না। আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার বাবা বাড়ি আছেন?”

উনাকে ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলাম আমি। বাবা বসার ঘরেই ছিলেন। মায়ের কিছুদিন ধরে জ্বর। দুই ভাবীই এদিকে বাপের বাড়িতে গেছে। আমাকে রান্নাবান্না সব করতে হচ্ছে। আমি তার জন্য কিছু চা-নাস্তা নিয়ে গেলাম। দেখলাম বাবার সাথে কী বিষয়ে খুবই গম্ভীরভাবে আলোচনা করছেন। আমাকে দেখে চুপ হয়ে গেলেন দুজনে। আমি নাস্তার ট্রে রেখে ভিতরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম কাজে। এর মাঝে ভুলেও গেছি উনার কথা। অনেকক্ষণ পর তিনি বের হলেন বাড়ি থেকে। আমি তখন ছাদে আচার শুকোতে দিতে এসেছি। ঝিনু দৌড়ে এসে বলল, “আপি জানিস কে এসেছিলো?”

“কে?”

“মনে আছে গত বছর তোকে দেখতে এসেছিলো তাদের কথা? ওইযে অনেক মিষ্টি এনেছিলো যে..সেই ছেলের মা।”

আমাকে যেন কেউ জোরে ধাক্কা দিল। কোনোমতে বললাম, “কেন এসেছে?”

“তোর সাথে সেই ছেলেটার বিয়ের কথা বলতে।”

আমি এবার সোজা আকাশ থেকে পড়লাম। হা হয়ে যাওয়া মুখটা দেখো ঝিনু বলল, “তারা অনেক তাড়াতাড়ি বিয়ে করাবে বলেছে। তুই কি করবি নাকি পালিয়ে যাবি?”

আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, “পালাবো কেন?”

“এই মহিলা শ্বাশুড়ি হলে তোকে জ্বালিয়েই মেরে ফেলবে। কি কাটা কাটা কথা!”

“ধুর! যা তো!”

“ভালো বুদ্ধি দিলাম…”

“বাবা কী বলেছে শুনেছিস?”

ঝিনু ঠোঁট উল্টে বলল, “জানি না, বাবাকে জিজ্ঞেস করো।”

আমার মাথায় তখন একশো একটা লাল নীল বাতি জ্বলছে, নিভছে। একদৌড়ে আমি ঘরে চলে এলাম। তক্ষুনি ফোন বাজলো। সেই নম্বরটা। হাজারখানেক বার পড়ে পড়ে মুখস্থ নম্বর!

“হ্যালো!”

“ভালো আছেন?”

বহুদিন পর আমার শ্রবণযন্ত্রের শুষ্ক মরুভূমিতে দু’ফোঁটা বৃষ্টিপাত হলো। ভয়ানক তৃষ্ণার্তের মতো ফোঁটাদুটো গিলে নিলাম। চোখ বুঝে অতিকষ্টে কান্না চেপে বললাম, “এতদিন পর কী মনে করে?”

“আমার মা যায়নি আপনাদের বাড়িতে?”

“এসেছিলেন।”

“তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন!”

হঠাৎ খুব রাগ হলো। এটা কেমন কথা? বললাম, “আমি কী বুঝব? আপনাদের কাজকর্ম কোনোটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা না। আমি আপনাকে বিয়ে করব না৷ অনেক ফাজলামো করেছেন। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলেই ভালো হবে।”

“আপনি শুনুন তো আগে!”

“কী শুনব?”

“সমস্যা এটাই তো যে আমি নাম্বার বন্ধ রেখেছিলাম? এর ব্যাখ্যা আছে..”

“কী ব্যাখ্যা?”

“অস্থিরতা বাড়াতে চাইনি তাই।”

“কিসের অস্থিরতা?

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল সে। আমিও এদিকে চুপ। কিছু না বলেও সব বুঝিয়ে দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চলল। অভিমানের পাহাড় ঠেলে মনের যোজন যোজন দূরত্ব পেরিয়ে সেই না বলা কথাগুলো যখন বোঝা গেল না তখন সে বলল, “সেদিন নাম্বারটা ইচ্ছে করে বন্ধ করিনি, হাত থেকে পড়ে মোবাইল ভেঙে গিয়েছিল। আমার একটাই মোবাইল। তাই সেটা ঠিক করা পর্যন্ত কথা বলতে পারছিলাম না। পরদিন সকালবেলা মোবাইল ঠিক করে আনার মাঝখানের সময়টুকু পাগলের মতো কেটেছে। রাতে একফোটা ঘুম হয়নি। সকালে সিমটা চালু করার সময় মনে হলো আপনার সাথে কথা বলাটা উচিত হবে না। আগে সবকিছু ঠিক করব, তারপর বাকি কাজ।”

তার কথার কিছুই আমি বুঝলাম না। বললাম, “যা বলার ভালো করে বলুন।”

“বুঝিলে বলতে গেলে সময় করে বলতে হবে৷ শুধু এতটুকু জানুন, সেদিন রাতে কেমন করে যেন বুঝে গিয়েছিলাম আপনাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। তাই চাচ্ছিলাম আপনাকে পুরোপুরি পেতে, অন্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে আবার কষ্ট না পেতে। আর সেটার ব্যবস্থা করতেই এতদিন লেগে গেল।”

“মানে আপনার মা’কে রাজি করাতে?”

“হ্যাঁ, যেটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।”

আমি কিছু বললাম না। সে বলল, “আমি মায়ের অবাধ্য হতে পারি না। সে যত কাটাছেঁড়াই করুক না কেন আমার জীবনের সাথে। একটা ঘটনা বলি, আমি যখন মায়ের গর্ভে এসেছিলাম, তখন আমার মায়ের বিয়ের বয়স মাত্র চার মাস। মায়ের বয়সও কম। আঠারো বছর। কেউই চায়নি বাচ্চাটা রাখতে। মায়ের বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি প্রত্যেকেই বাচ্চা নেয়ার বিরুদ্ধে ছিল। মা তাদের বিপক্ষে গিয়ে একপ্রকার যুদ্ধ করে আমাকে জন্ম দিয়েছে। আমার জন্মের পর মায়ের শরীরে রক্তশূন্যতা, শরীর ব্যথাসহ আরও নানা রকমের রোগ স্থায়ী বাসা বানিয়ে নিয়েছে। এই বয়সেই বুড়ো মানুষের চেয়ে বেশি ব্যাধি নিয়ে বাস করেন তিনি৷ তবুও বাকি দুই ভাইবোনের চেয়ে আমাকে বেশি ভালেবাসেন। তার জীবনের সমস্ত ত্যাগ-তিতিক্ষার সিংহভাগই করেছেন এই আমার জন্য। আমার থেকে আশাও করেন অনেক বেশি। তার জীবনের সবচেয়ে দামী সময়টা আমার জন্য উৎসর্গ করা। তাই বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই ব্যাপারটা!”

আমি মৃদু স্বরে বললাম, “বুঝেছি। আপনার মা এখন রাজি হয়েছে?”

“হ্যাঁ। আমি তাকে বোঝাতে পেরেছি।”

“আপনি কেমন আছেন?”

সে হেসে বলল, “এইতো ভালোই। আপনি এত শুকিয়ে গেছেন কেন? মনে হয় দিন দিন ছোট হচ্ছেন।”

“আপনি আমাকে দেখলেন কোথায়?”

“কথা বন্ধ করেছি বলে দেখাও বন্ধ করব এমন কোনো কথা আছে নাকি?”

আমি ঢোক গিললাম। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী কাঁপছে। পায়ের তলায় সুড়সুড়ির মতো অনুভূতি! সেও বোধহয় কথা খুঁজে পাচ্ছিলো না আর। শুধু চুপচাপ মোবাইল কানে দিয়ে বসে থাকা। কতক্ষণ কেটেছে জানা নেই, আমার ডাক পড়লো। ফোন কেটে দিলাম।

ডেকেছেন বাবা। বসার ঘরে পত্রিকা হতে বেশ গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আমি যেতেই বললেন, “বসো। তোমার সাথে জরুরি আলাপ আছে।”

“বলো বাবা।”

“তুমি নিশ্চয়ই জেনেছ সকালে ভদ্রমহিলা কেন এসেছিলেন?”

“হ্যাঁ বাবা।”

“সম্বন্ধটা এনেছিলেন তোমার আফজাল চাচা৷ জানোই তো তার মাঝে লুকোছাপা কিছু নেই। সোজাসুজি সব বলে দেয়। তারা যখন তোমাকে দেখে গিয়েছিল, আমার স্পষ্ট মনে আছে তার দু’দিন পর সন্ধ্যায় আফজাল আমাকে ফোন করে বলেছিল, তারা বলেছে তোমার মেয়ে দেখতে ভালো নয়, পড়াশুনায় ভালো নয়, সাজগোজের বালাই নেই তাই তাদের পছন্দ নয়। মেয়ে তাদের ছেলের যোগ্য নয়।
আমি সেদিন কতটা কষ্ট পেয়েছি তুমি হয়তো জানো না। আমার পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে তুমি আমার সবচেয়ে লক্ষী মেয়ে। তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না। শুধুমাত্র বাহ্যিক কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে কাউকে রিজেক্ট করে দিয়ে আবার তার সাথে সম্বন্ধ করতে যাওয়ার কারনটা আমাকে ভদ্রমহিলা সোজাসুজি বলেননি। তুমি নিশ্চয়ই আশা করো না আমি তাদের সাথে সম্পর্ক করব।”

বাবার কথা শুনে শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। কী বলছে এসব!

বাবা বলে গেলেন, “আমি উনাকে সোজা না করে দিয়েছি। অনেকভাবে বুঝিয়েছেন, আমি মানিনি। প্রয়োজন নেই সম্পর্কের৷”

আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। চোখে পানি চলে এসেছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। বাবাকে কী করে মুখ ফুটে বলব, আমি এখানেই বিয়ে করতে চাই। তাই কি বলা যায়? বললে তো সবটা বলতে হবে!

বাবা উঠে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা, তোমার অনেক ভালো বিয়ে হবে। এই সম্বন্ধটা নিঃসন্দেহে ভালো ছিল। যে কেউ শুনলে বলবে এমন জিনিস না করে জীবনের বিরাট ভুল করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো মা, আল্লাহ যার সাথে যার জুটি ঠিক করেছেন, বিয়ে তার সাথেই হবে। তুমি এই ছেলের চেয়ে লক্ষগুণ ভালো ছেলে পাবে। বলে দিলাম আমি।”

বাবা চলে গেলেন। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। সব তো চুকেবুকে গিয়েছিল। তবে নতুন করে পুরানো ক্ষত খুঁচিয়ে ঘা করা কেন? আচ্ছা সে তো এতক্ষণে জেনে গেছে কী হয়েছে। তবে সে কী ভাববে? কষ্ট পাবে খুব? আমাকে ভুল বুঝবে না তো? কত কত চিন্তারা মাথায় শুঁয়োপোকার মতো কিলবিল করতে শুরু করলো। বের হয়ে এলাম ঘর থেকে। শীতের মধ্যদুপুরে কড়া রোদের নিচে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। জ্ঞান হারালাম আমি।

জ্ঞান ফিরলো বিকেলে। তাকিয়েই প্রথম যে মুখটা দেখলাম তাতে চমকে উঠে বসতে গেলাম। কিন্তু শরীরে বল পেলাম না। শুধু চমৎকার সুন্দর গোলাপ পাপড়ির মতো দুটো চোখকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। সে হয়তো জোরেই কথা বলছে। কিন্তু আমার কানে আসছে খুব ধীরে…মনে হচ্ছে যেন বহুদূর থেকে কেউ টেনে টেনে কথা বলছে। শব্দগুলো ভেঙে ভেঙে কানে প্রবেশ করছে…

“এই…মেয়ে…এত… অল্পতে… জ্ঞান… হারালে… চলে…?”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here