#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-৫
বিয়ের দিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। সত্যি বলতে রাতে ঘুমটাই হয়েছিল বড্ড হালকা। বাড়িভর্তি মেহমান। বিছানা, ফ্লোরে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। মুরুব্বি গোছের কয়েকজন শুধু উঠে নামাজ পড়ছে। আমার গায়ে হলুদের শাড়ি তখনো। রাতে ক্লান্তিতে বদলানো হয়নি। আমি উঠে চুপিসারে ছাদে চলে গেলাম। ভোরের নতুন সূর্যের আলো গায়ে মাখব বলে।
কিন্তু সেদিন কী হলো, সূর্য্যিমামা রাগ হয়ে রইলেন আমার ওপর। পণ করেছেন যেন দেখা দেবেন না একেবারে। ঘন কালো কালো মেঘ ছেয়ে রইল পুরো আকাশজুড়ে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
আস্তে আস্তে সবাই উঠে পড়লে শুরু হলো সারা গায়ে হলুদ ডলে গোসল করানোর পর্ব৷ বাড়ি গমগম করছে লোকে। আমি তাকে ফোন করার সুযোগ একটুও পেলাম না৷ সবাই আমাকে ঘিরেই বসে আছে৷ এর মাঝে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে নিস্তার পেলাম সবার থেকে। তার সাথে কথা বললে বোধহয় একটু ভালো লাগবে৷ কিন্তু সে ফোন ধরল না৷ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরও তার সাথে কথা হলো না।
অনুষ্ঠান দুপুরে। সকাল সকাল পার্লারে রওনা দিতে হলো। মোবাইলটা ভুলে ফেলে গেলাম বাড়িতে। সাজানোর সময়টা এত অস্থিরতায় কাটলো বলার মতো না। বার বার চোখে পানি এসে সাজ নষ্ট হতে লাগলো। পার্লারের মহিলারা বিরক্ত হয়ে সাজাতে লাগলেন। এদিকে আমার বুকের কাঁপুনি বেড়ে চলেছে। ছুটে তার কাছে চলে যেতে মন চাইছে। আবার লজ্জাও লাগছে। আজ তো একেবারের মতো তার কাছে যাবই। তবে এত অস্থিরতা কিসের?
সাজগোজ শেষে পার্লার থেকে বের হয়ে দেখি বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সব। পানি জমে গেছে রাস্তায়। এত বৃষ্টি যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না চারপাশে। একটা ট্যাক্সি পেয়ে বাড়ি পৌঁছুলাম কোনোমতে। তাও বৃষ্টির ছিটেফোঁটা লেগে শাড়ির নিচটা কাদা কাদা হয়ে গেছে। বিচ্ছিরি অবস্থা।
বাড়ি পৌঁছে দেখি সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে। আয়োজন সব করা হয়েছিল বাড়ির বাইরে উঠানে। আমার দাদার আমলের বিশাল জায়গা জুড়ে আমাদের বাড়ি। তাদের পক্ষের মেহমানও এত বেশি নয়। তাই এখানেই সব আয়োজন করা হয়েছিলো। কিন্তু প্যান্ডেল ভিজে জায়গাটা কাদা হয়ে আর কিছু করার জো নেই। কিন্তু চিন্তা সেটা নয়, চিন্তার বিষয় হলো, সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বরযত্রীর দেখা নেই। তার ওপর সকাল থেকে ওবাড়ির কেউ ফোন ধরছে না।
আমি ভয়ে কাটা হয়ে তাকে কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। কারো কোনো খবর নেই। এই এত লোকের মাঝেও যে সব নিস্তব্ধ হতে পারে, প্রথমবার দেখলাম৷ সবাই চুপ। কথা হারিয়ে গেছে যেন। আমি ঠাঁয় বসে আছি, নড়তেও ভয় হচ্ছে! থেকে থেকে ঝড়ে সুপারি গাছের মাথাগুলো একটার সাথে অন্যটা বাড়ি খাওয়ার শব্দ, আর মায়ের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনে শব্দ নেই। বাচ্চাগুলোও বোধহয় বুঝেছে সব স্বাভাবিকভাবে চলছে না।
সন্ধ্যার দিকে ওবাড়ি থেকে খবর এলো। তার মা সকালবেলা হার্ট অ্যাটাক করেছেন। খুব খারাপ অবস্থা। এখনো প্রাণসংশয় আছে৷ হাসপাতালে ভর্তি তিনি৷ বিয়ের অনুষ্ঠান এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।
আমার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে এলো। মন বিষাক্ত হয়ে গেল। এমনটাই ছিল ভবিতব্য? কেন খোদা! কোন পাপের ফল এটা? এত অপমান, লজ্জা! সাধ, আকাঙ্খা সব ধুলোয় লুটিয়ে গেল কেন? তার ওপর ওই মানুষটারও কত ভোগান্তি! না জানি মা কেমন আছেন!
এতক্ষণ অনেকেই অপেক্ষা করে ছিল, ভাবছিলো হয়তো ঝড়ের কারনে বরপক্ষ আসতে পারছে না, সে আশা শেষ হলো। সবার মুখে কথা ফুটলো হঠাৎ। নিস্তব্ধতা ভেঙে তীব্র কোলাহলে ছেয়ে গেল পৃথিবী। আমি নিঃশব্দে উঠে গেলাম।
থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশ বিদীর্ণ করে আলোর ঝলকানিতে রাতের শহর দৃশ্যমান হচ্ছে। কালসাপের মতো ফনা তুলে ঝড়টা ছোবল মারছে সারা পৃথিবীতে। আমার জীবনেও তেমন ঝড় হয়ে গেল। বৃষ্টির পানিতে সাজ গলে পড়েছে অনেক আগেই। বিয়ের শাড়িটা ভিজে আধমনী ভারী হয়ে গেছে। ছাদের কর্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে অনন্তকাল পেরিয়ে গেছে সব ঘটনার। প্রতিটা মুহূর্ত অনেক বেশি ভারী৷
আমার খোঁজ পড়ল রাত সাড়ে দশটার দিকে। কে যে ধরে ঘরে নিয়ে গেল আমি বলতে পারব না। বড় আপা কাপড় বদলে দিলেন। শীতে তখন কাঁপছি। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে শরীর গরম হয়ে গেছে, চোখ জ্বালা করছে। আপা বললেন, “তুই চিন্তা করিস না। আজ একটা বিপদ হয়েছে বলে বিয়েটা হলো না। ওদেরও তো দোষ নেই বল? দেখিস সময়মতো বিয়ে হবে। তুই এমন করলে চলবে?”
আমি আপার দিকে তাকিয়ে বললাম, “বিয়েটা আর হবে না আপা।”
“কেন হবে না পাগলি। অবশ্যই হবে।”
“আমার কেন যেন মনে হয় হবে না।”
ছোটবেলা থেকে আমার হঠাৎ মনে হওয়া কথাগুলো সত্যি হয়ে যায়। সে ভরসায় বলছিলাম বিয়ে হবে না। ভয়টা মনে শেকড় গেড়ে বসে গেছে। কিন্তু তখনো জানি না আমার আশঙ্কা এবার ভুল।
রাত সাড়ে এগারোটায় দরজার কড়া নড়লো। মেহমানরা অনেকে শুয়ে পড়েছিল৷ আজ সবাই ক্লান্ত, বিষন্ন। কে যেন দরজা খুলল। তারপর চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করল। বাতাসের আগে আমার কানে খবর পৌঁছে গেল, বর এসেছে, বর এসেছে!
আমি শুয়েছিলাম। ঝট করে উঠে বসলাম। মাথা দপদপ করে উঠল ব্যথায়। স্বপ্ন দেখছি না তো? বার কয়েক শরীরে চিমটি কাটার পরও যখন বর এসেছে রব কানে আসতে থাকলো তখন বিশ্বাস হলো সত্যি সে এসেছে। ভাবীরা আমাকে নিয়ে গেল নিচে। সে সত্যি এসেছে। মনে হলো অনন্তকাল পর তাকে দেখছি! তার চেহারা দেখে বোঝা যায় সত্যিকার ঝড় তার ওপর দিয়েই গেছে। একদিনে চেহারা শুকনো পাতার মতো হয়ে গেছে। আমাকে দেখে একটু হাসলো। আমার কান্না পেয়ে গেল। সে এখন কেন এসেছে?
বাবা বললেন, “এতরাতে শুধু শুধু আসতে গেলে কেন বাবা? আমরা বুঝতে পারছি তোমাদের অবস্থা। না এলেও হতো।”
সে বলল, “আমি শুধু দেখা করতে আসিনি। বিয়ে করতে এসেছি।”
ঘরের মাঝে একটা বজ্রপাত হলো যেন। সবাই চুপ হয়ে গেল আবার। সে তৈরি হয়েই এসেছে। সাথে কাজি নিয়ে এসেছে। বাবা, মা, বাড়ির লোক কেউই ঠিক রাজি হতে পারল না এভাবে বিয়ের জন্য। তাকে বোঝাতে লাগলো। কিন্তু তার এক কথা, “আমি কথা দিয়েছি, আজ বিয়ে করব, আজই বিয়ে হবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। তাছাড়া মা এখন মোটামুটি ভালো। আমার বাড়িতে এসময় বিয়ের কথা না জানালেও চলবে। সব স্বাভাবিক হলে তখন বলব। একটা মেয়েকে বিয়ের কথা বলে এভাবে ফেলে রাখতে আমি পারব না।”
বাড়ির সবাই যখন দ্বিধায় ভুগছে, আমি তখন দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলাম, “আমি এখনই বিয়ে করব।”
মিয়া বিবি রাজি হলে বাকিদের আর অমত চলল না। বিয়ে পরানো হয়ে গেল৷ ঝড় বাদলার ভেতর প্রায় মধ্যরাতে আমি লেখাপড়া করে তার হয়ে গেলাম।
বিয়ের শেষে মিষ্টিমুখ হলো। আমার মনে হচ্ছে এসব নেশার ঘোরে হচ্ছে। কেউ হয়তে কড়া ডোজের ড্রাগ দিয়েছে, আমার হ্যলুসিনেশন হচ্ছে!
বিয়ের কাজ শেষ হবার পর সে চলে যাওয়ার আগে আমার সাথে পাঁচ মিনিট আলাদা কথা বলতে চাইলো। একটা ঘরে কথা বলতে দেয়া হলো আমাদের। আমি দরজা বন্ধ করে এসে তার পাশে বসলাম। দু’জনের কারো মুখে কথা নেই। কী বলব? আমি লজ্জায় মাথা তুলতে পারছি না, এদিকে ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হলো তার হাত থরথর করে কাঁপছে। মুখটা স্বাভাবিক, তবে শরীর ঠিক থেকেও ঠিক নেই। আমি তার হাত ধরলাম। সে আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। আদ্র গলায় বলে উঠল, “জানো, আজ অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
তার কথায় কেঁদে ফেললাম আমি। সে আমার জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। দু’জনের শরীর কাঁপছে। সেও আমার সাথে কাঁদছে নিঃশব্দে। হয়তো ভরসা চাচ্ছে। আমি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম, “কিচ্ছু হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সে পাঁচ মিনিটই আমার সাথে রইল। তারপর চলে গেল। যাওয়ার আগে একবার পেছনে ফিরে আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “ভালো থেকো তুমি। আমাদের ভবিষ্যত কী হবে জানি না, তবে জেনে রাখো, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
তার মুখে প্রথমবার ভালোবাসার কথা শুনে আমি সারারাত কাঁদলাম। ভোর হলো একসময়। আজকের ভোরটা গতদিনের মতো মন খারাপ করানো না, ঝকঝকে রৌদ্রজ্বল একটি দিন শুরু হলো।
(চলবে)