#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ৭
শ্বাশুড়ি মা মোবাইলে একটা ভিডিও বের করে দেখালেন। একটা বাইশ তেইশ বছর বয়সী মেয়ে। লং ফ্রক পরা। কাঁধ পর্যন্ত সিল্কি, মেরুন রঙ করা চুল। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে পান্না সবুজ লেন্স৷ ফর্সা, তীক্ষ্ণ নাক আর চমৎকার ফিগার। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সুন্দর করে হাসছে, কথা বলছে গুছিয়ে। সোফায় বসে মোবাইলে কী একটা বের করে পাশের জনকে দেখাচ্ছে। পাশের জনটি আমার সে। সে ও বেশ আন্তরিকভাবে হেসে কথা বলছে মেয়েটির সাথে। মনে হলো তারা খুব ভালো বন্ধু।
শ্বাশুড়ি মা বললেন, “মেয়েটি নোরা। আমার দূরসম্পর্কের বোনের মেয়ে। দেখেছ কেমন? আমাদের ফ্যামিলির স্ট্যান্ডার্ডের সাথে একদম মানিয়ে যায়। যে কোনো সময় যার সাথে প্রয়োজন মিশে যেতে পারে। আমি ও’কে কখনোই অগোছালো অবস্থায় দেখিনি। পড়াশুনাতেও খুব ভালো। নর্থ সাউথে পড়ছে। ইচ্ছে আছে হায়ার স্টাডিজের জন্য ইংল্যান্ড যাবে। তুমিই আমাকে বলোতো এই মেয়েটা আমার ছেলের জন্য পারফেক্ট নয় কি?”
আমি চুপ। চোখের জলধারা অতি সন্তর্পনে মুছে নিলাম ওড়না দিয়ে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মন চাইলো ছুটে পালিয়ে যাই এখান থেকে। বৃষ্টির সাথে মিশিয়ে দেই সব কান্না।
উনি বললেন, “তুমি নিজেকে আয়নায় ভালোভাবে দেখো? বামহাতের একটা নখ বড় হয়ে ভেঙে আছে, জামাকাপড় যেমন তেমন পরো, চুলের যত্নও নাও না বোধহয়। তুমি আমার ছেলের পাশে দাঁড়ালে ভালো লাগবে?
আমি তোমার ভালোর জন্যও বলছি, তুমি আমার ছেলের সাথে হয়তোবা মানিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু আমাদের বাড়ির অন্য কারো সাথে পারবে না। মূলত তুমি ওই পরিবেশের সাথে মানানসই নও। আমার ছেলে এখন ঘোরে আছে, সে যখন বুঝে যাবে তার সঙ্গীটিকে তার সাথে যায় না, তখন সেও আগ্রহ হারাবে। তখন তুমি নিজে কত কষ্ট পাবে ভেবেছ? আমি জানি তোমাদের মধ্যে তেমন কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক হয়নি৷ তাই এখনই আলাদা হয়ে যাও। কষ্ট কম হবে।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷ কেউ এত ভয়ানক কথা এত সহজে বলে ফেলতে পারে? গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে বললাম, “আপনি নিজেই তো তখন বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ। তবে এ বিষয়ে অনেক কিছু ক্লিয়ার করার আছে। মনে করে দেখো তো, আমি বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তোমার সাথে কোনো কথা বলেছি?”
“না মা।” প্রথমবার উনাকে মা ডাকলাম। আশঙ্কা ছিল হয়তো উনি রাগ করবেন, ডাকতে নিষেধ করবেন। তবে উনি সেটা গায়েও মাখলেন না। বললেন,
“আমার ছেলে আমার কতটা আদরের তুমি হয়তো শুনেছ। একবারও মনে হয়নি সেই ছেলের হবু বউ এর সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলিনি কেন? ছেলের প্রচুর জেদের জন্য আমি রাজি হয়েছিলাম। রাগ করে বিয়ের কথাও বলেছিলাম। কিন্তু আদতে রাজি ছিলাম না। চেষ্টাও করেছিলাম বিয়েটা আটকাতে তবু পারিনি।
হার্ট অ্যাটাকটাও এমনি এমনি হয়নি। অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারনে হয়েছে। তাহলে বোঝো ছেলের মর্ম আমার কাছে কী!”
“তাহলে আমি এখন কী করব?”
“যেমন গোপনে বিয়েটা হয়েছে তেমন গোপনে যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমার আত্মীয়রা এখনো কেউ জানে না। আমি চাই না জানাজানি হোক।”
“আপনি যেটা বলছেন সেটা সম্ভব নয়।”
“তুমি সম্ভব করবে। আমি তোমাকে বলে দেব কীভাবে কী করতে হবে। আর করতে না চাইলে মনে রেখো, আমার বাড়িতে যদি ঢোকো, একটা দিনও শান্তিতে থাকতে পারবে না।”
উনি চলে গেলেন। কি নির্লিপ্ত কন্ঠে হুমকি দিয়ে গেলেন! বাহ!
বাড়ির কেউ এখনো কিছুই জানে না। বাবা মা তাদের বেয়াইনের খুব খাতির করেছেন। এখনো জানেন না কি বিপদটাই না অপেক্ষা করছে!
.
সারারাত তুমুল ঝড় হলো। শুয়ে গড়াগড়ি করলাম শুধু। ঘুম এলো না। কান্নাও পেলো না৷ বিষ্ময়বোধটা কেটে গেলে হয়তো কান্না পাবে! খেই হারা অথৈ সমূদ্রে পড়ে যাওয়া মানুষের মতো লাগছে নিজেকে। বুকের ব্যথাটা ভয়ংকর তীব্র! লজ্জায় ইচ্ছে করছে কচ্ছপের মতো লুকিয়ে যাই খোলসে। এই সম্পর্কের শুরু থেকে অপমান ছাড়া কিছুই পাইনি।
অনেক চিন্তা করেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। সাধে কি আর বলে, অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়!
শেষরাতে বৃষ্টি কমে এলো। নামাজ পড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মেঘ কেটে সকালের সূ্র্য উঁকি দিলো। অথচ আমার মনে হতে লাগলো অন্ধকার অতল সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি।
ভোরের দিকে সে আচমকা ফোন করে বলল, “দরজা খোলো৷ আমি তোমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
তখনো বাড়ির কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি চুপি চুপি দরজা খুলে দিলাম৷ আজ ঝিনু নেই, বেড়াতে গেছে। তাকে নিয়ে আমার ঘরে চলে গেলাম। খাটে বসে সে মাথা নিচু করে রইল। ক্লান্ত সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাত জেগেছে। চুলগুলো বড় হয়ে ঘাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে। এই ছেলে যত্ন নেয় না নিজের? এই অবস্থাতেও কি মায়া হচ্ছে! আমি তার সামনে গিয়ে আলতো করে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিলাম। সে আমার দিকে তাকালো। গর্তে বসা চোখদুটোর মায়াভরা দৃষ্টি। বুকে সূক্ষ্ণ পিনের মতো বিঁধে যায়। সে বলল, “আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি তাই না? আমার দোষ সব। অথচ শাস্তি পেতে হচ্ছে তোমাকে।”
“তোমার কোনো দোষ নেই। সব ভাগ্য।”
“ভাগ্য এবার বদলাতে হবে।”
“কী করে?”
“মা তোমাকে বলেছে না আমাকে ডিভের্স দিতে?”
আমি ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখলাম। কী বলব?
সে বলল, “আমি আমার মতো অনেক চেষ্টা করেছি উনাকে মানিয়ে নেয়ার। উনি যদি না বোঝেন আমার কিচ্ছু করার নেই। আমি উনার অবাধ্য হইনি। ভালোভাবেই চেয়েছিলাম। এখন বেশি বাড়াবাড়ির ফলও পাবেন।”
বুঝলাম মায়ের ওপর অনেক রাগ হয়েছে। কিন্তু ওর মা’ও তো সব ছেলের জন্যই করছে। কথাটা বলতেই সে কপাল কুঁচকে বলল, “মাদার তেরেসা সাজার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজেরটা বোঝো।”
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “প্যাকিং করো। যা যা দরকারি জিনিস আছে সব নিয়ে নাও, আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাব, তোমার কাছে আধঘন্টা সময়। কুইক!”
আমি বেকুব হয়ে গেলাম। “কোথায় যাব?”
“কোথায় যেতে পারি?”
“তোমার বাড়িতে?”
“নো মিসেস, আমরা পালাচ্ছি।”
“মানে? কোথায় পালাবো?”
“তা জানি না।”
.
ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা একটা বাসে উঠে সিলেটের দিকে রওনা দিলাম। এতক্ষণ কী হয়েছে কেউ বলতে বললেও পারব না। যেন রকেটের গতিতে সব হয়ে গেল! সে গোছগাছ করতে সাহায্য করল। তারপর আমায় নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। আমি আবারও তার ওপর ভরসা করে পা বাড়ালাম নতুন রাস্তায়। সেটা ভুলে ভরা নাকি সঠিক পথ জানা নেই, শুধু এতটুকু জানলাম, ভাগ্যবিধাতা তার সঙ্গে আমাকে জুড়ে দিয়েছেন। এখন সে আমার সাথে যা করবে, তাই আমার জন্য সঠিক।
সকাল মাত্র। লোকজনের ভিড়, গরম সবই কম। বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ। হাইওয়ে ধরে চমৎকার রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল। শীতল বাতাস শরীরে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেলো। রাস্তার দু’ধারের বৃষ্টিজলে ধৌত হওয়া গাঢ় সবুজ গাছগাছালি চোখ জুড়িয়ে দেয়। পাশে বসে আসে জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্খিত মানুষটি!
বাসে ওঠার পরপর তাকে দেখে মনে হলো সে সব দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছে। আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। দু’ঘন্টা আগেও যে জীবনটা ব্যর্থ মনে হচ্ছিলো, এখন সেই জীবনটাই হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে। যদিও ভবিষ্যতের কথা ভাবলে মাথা ভার হয়ে আসে, তবে আমি সেসব চিন্তা আপাতত ছুটি দিলাম। এতটুকু অবশ্য বুঝে গেছি, যত যাই হোক, সে আমাকে ছেড়ে যাবে না।
আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। সে একবার ঘুমের মাঝে অস্পষ্ট কিছু বলে উঠল। আবার ঘুমিয়ে গেল। আমার হাতটা এখন তার হাতের মুঠোয়। আমারও চোখ বুজে এলো। ঘুমে নয়, আহ্লাদে!
একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “পালিয়ে তো যাচ্ছি তারপর কী হবে?”
সে হাই তুলে বলল, “দেখা যাক। কিছু ভেবে করিনি। আমরা এডাল্ট। বিবাহিত। যা খুশি করার স্বাধীনতা আছে। শেকল পরিয়ে রাখতে চাইলেই হবে নাকি?”
“কিন্তু কাউকে না বলে…”
“আমার মায়ের আমাকে ট্রেস করতে একদিনও লাগবে না৷ সবাই জানবে। তবে ধরতে পারবে না।”
বিকেলের দিকে পৌঁছুলাম মৌলভীবাজার। সেখানে তার এক বন্ধুর বাংলো বাড়িতে উঠলাম। বাড়িটা ভাড়া দেয়া হয় ভ্রমণকারীদের জন্য। সেখানে ওঠার আগে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সেখানে খেয়েদেয়ে এলাম৷ ভালোই লাগলো তাদের সাথে কথা বলে৷
বাংলোতে পৌঁছুলাম সন্ধ্যায়। দোতলা বাড়ি। ভেতরে আলো জ্বলছে না। চারপাশে অনেক গাছপালা, ঝোপঝাড়। অন্ধকার জমে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।
এদিকে নাকি এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ অবশ্য কম। ঘন ঘন মেঘ ডাকছে। বাতাসের সাথে হালকা বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। হঠাৎ আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। ছোটবেলায় পড়া রহস্য গল্পগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কে জানতো আমার সাদাসিধা জীবনটা হুট করে এমন রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে?
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু