অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-৮

0
350

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব -৮

তার বন্ধুটির নাম তানজিম। তানজিম ভাই আমাদের বাংলোর ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাংলো দেখাশুনা করে একটি লোক, নাম জহিরুল। বয়স ত্রিশের মতো হবে। কালো কুচকুচে শরীর, চাপা ভাঙা। দেখলেই ভয় ভয় লাগে। তবে গলার স্বর সুন্দর। কথা বলে শুদ্ধ ভাষায়। জহিরুল জানালো ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তাই সব অন্ধকার। আমরা ভেতরে গিয়ে বসলে মোমবাতি জ্বালিয়ে আনলো।

কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তানজিম ভাই বিদায় নিলেন। আমরা শোবার ঘরে ঢুকলাম।আমারা যে ঘরে থাকব সেটা অনেক বড়। উত্তর দিকে ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট ঝুল বারান্দা আছে।

সন্ধ্যারাতে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। সে বলল, “ঘুমিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমিও। মনে হচ্ছে শরীরের সবগুলো অস্থি কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে।”

“তুমি তো সারা রাস্তা ঘুমিয়েছ।”

“জার্নির ঘুম আর আরামের ঘুম এক হলো? তুমি কাপড় বদলে শুয়ে পড়ো, আমি আসছি।”

সে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর পর কেন যেন মনে হলো ঘরটা আরও বড় হয়ে গেছে। বেশ শীত লাগছে। ঘরে দুটো মোমবাতি জ্বলছে। মোমের অল্প আলোর তিরতির কাঁপনে ঘরে আলোছায়ার খেলা চলছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক আর দূর থেকে ভেসে আসা কোনো কোলাহলের শব্দ পরিবেশটা ভারী আর রহস্যময় করে তুলেছে৷

ভয় ভয় অনুভূতিটা পাত্তা না দিয়ে আমি জামা পাল্টে নিলাম। বাম হাতের নখের দিকে নজর পড়ল। এটা সত্যি কাটা দরকার। একটু সুন্দর হয়ে না থাকলে ভালোবাসার মানুষটিও অপছন্দ করতে শুরু করবে এটা সত্যি কথা। কিন্তু এই আঁধারে কিছুই খুঁজে পেলাম না।

আমি ফ্রেশ হয়ে কোনোরকম চুলটা বেঁধে নিয়ে বসে রইলাম, কিন্তু তার কোনো খবর নেই। মনে হলো বহুক্ষণ পর সে এলো। ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি প্রায়। শুধু দেখলাম সে পাশে এসে শুয়ে পড়ল।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো একটানা ঘ্যার ঘ্যার ধরনের শব্দে। শব্দটা কাছেই কোথাও থেকে আসছে। পুরো জায়গাটা শব্দহীন, ঝিঁঝির ডাক নেই, রাতের যে নিজস্ব শব্দ থাকে তাও নেই, শুধু ওই একটা শব্দই থেকে থেকে কানে আসছে! প্রতিবার বুক কেঁপে উঠছে আমার। ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘেমে গেছি। ঘরে একটা মোমবাতির মৃদু আলো। মনে হলো ওটা আরও অন্ধকার বাড়িয়ে দিয়েছে!

আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে আমি তার দিকে তাকালাম। সে কি শুনতে পাচ্ছে না কিছু? এবং সেই সময় আবিষ্কার করলাম শব্দটি আমার বরমশাই এর নাক ডাকার শব্দ। সে নাক ডাকে? এত ভয়ানকভাবে! ইয়া আল্লাহ!

আমি যেমন অবাক হলাম, তেমন স্বস্তিও পেলাম। আচমকা আমার প্রচন্ড হাসি পেলো। হেসেও ফেললাম খিলখিল করে। বড় ঘরে হাসির শব্দ প্রতিফলিত হতে লাগলো। এদিকে সে শব্দ শুনে হকচকিয়ে উঠে বসল। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম।

চোখ হালকা খুলে দেখলাম সে অস্থির হয়ে এদিক হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ বসে থেকে কিছু দেখতে না পেয়ে সে আমার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমায়।

আমি লজ্জায় সিটিয়ে গেলাম। এদিকে সে আরও শক্ত করে চেপে ধরছে যেন! হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “মাঝরাতে পেত্নী সেজে ভয় দেখানোর মানে কী?”

আমি তখনো মটকা মেরে পড়ে আছি। লজ্জায় কথা বন্ধ। সে উঠে গিয়ে টেবিলে রাখা মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়ে এসে বলল, “অন্ধকারই ভালো!”

.
সকলে ঘুম ভাঙলে ঘরবাড়ি ঘুরে দেখতে বের হলাম। সে তখনো ঘুমিয়ে আছে। বাড়িটা রাতের বেলা রহস্যময় লাগলেও দিনে বেশ সুন্দর৷ দোতলায় তিনটা শোবার ঘর, নিচে ডাইনিং, ড্রইং আর একটা ঘর আছে তালা দেয়া। নিচতলায় বাড়িতে প্রবেশপথের সামনের টানা বারান্দাটুকুর মেঝে ডিজাইন করা। একপাশে একটা সাদা রঙ করা ছোট্ট গোল টেবিল, দুটো চেয়ার।

বাড়ি থেকে গেট পর্যন্ত পাথরের নুড়ি বিছানো রাস্তা। দু’পাশে বাহারি ফুলের বাগান।

পেছনের দিকে একটা পরিত্যক্ত পুকুর আছে। জঙ্গলাবৃত হয়ে আছে। তাছাড়া বাকি সবকিছু পরিপাটি। জহিরুল দেখলাম বাগানের গাছগুলোর আগাছা ছেটে দিচ্ছে আর গুনগুন করে আঞ্চলিক ভাষার গান গাইছে। সুন্দর গানের গলা তার। শুনতে ভালো লাগলো। আমি পেছন থেকে যাওয়ায় প্রথমটায় দেখতে পায়নি সে। দেখামাত্র গান থামিয়ে দিল। বললাম, “সুন্দর গাইছিলেন তো। থামলেন কেন?”

জহিরুল লজ্জা পেয়ে হাসলো। তবে গাইলো না আর। বললাম, “সময় পেলে আমাকে গান শোনাবেন।”

জহিরুল খুশি হয়ে বলল, “আচ্ছা ভাবী।”

.
সে ঘুম থেকে উঠে খেয়ে বেরিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে বলল পরে বলবে। একা একা থাকতে হবে শুনে সে অভয় দিয়ে বলল, “জহিরুল লোকটা ভালো, চিন্তা নেই। আমার জরুরি কাজ আছে। তোমার সমস্যা হলে ফোন করো।”

সে চলে যাওয়ার পর মনে পড়ল ফোন করব কেমন করে? কাল বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর সেই যে মোবাইল বন্ধ কারেছি আর চালু করা হয়নি। কিন্তু মোবাইল চালু করলে মা বাবা ফোন করবে। আচ্ছা তারা কি এখন আমাকে খুঁজছে। নাকি বুঝতে পরেছে আমি ওর সাথে আছি? পালিয়ে আসার উত্তেজনায় বাবা মায়ের মনের অবস্থা কী হবে সেকথা ভাবিনি তেমনভাবে। এখন ভয়ে গলা শুকিয়ে আসতে চাইলো।

মোবাইল অন করলাম। ওকে আগে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হবে কী করব। কিন্তু মোবাইল অন করার সাথে সাথে মায়ের নাম্বার থেকে ফোন এলো। ভয়ে আমার গা কাঁপতে শুরু করল। চুরি করে ধরা পড়লে এমন লাগে! ফোনটা ধরতে না চাইলেও ধরে ফেললাম। যেন সময়টা মনে হলো মায়ের সাথে এই মুহূর্তে কথা না বললে দমবন্ধ হয়ে মারা যাব।

মা ব্যকুল গলায় বললেন, “ঠিক আছিস তুই?”

“হ্যাঁ মা। তোমরা ভালো আছ?”

“আছি। কী করছিস?”

“মা, তুমি কি জানো আমি কোথায় আছি?”

“না। শুধু তোর বাবা বলল তুই জামাই বাবার সাথে আছিস।”

“বাবা জানলো কী করে?”

“জানি না!”

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সে অবশ্য বলেছিল তারা নাকি আমাকে খুঁজবে না। হয়তো সে বাবাকে বলেছিলো। আসলে জিজ্ঞেস করতে হবে। মায়ের সাথে কথা শেষে তাকে ফোন করলাম। সে ধরলো না।

.
ফিরতে ফিরতে তার দুপুর হলো। আমায় দেখে হেসে বলল, “আছ কেমন?”

আমি হাসলাম। তার জ্বলজ্বলে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বললাম, “ভালো আছি। তোমার সাথে থাকলে আমি ভালোই থাকব।”

সে ভুরু নাচিয়ে বলল, “সিরিয়াসলি? এত বিশ্বাস করো কেন?”

“এসব বাদ দাও। আগে খাবে চলো।”

আমি প্রথম তার জন্য রান্না করেছি। তার পছন্দের আইটেম কোনগুলো তাও জানা নেই। নিজের আন্দাজে যা ভালো মনে হয়েছে করেছি৷ সে খাবার মুখে না দিয়েই বলল, “মজা হয়েছে। ভালো রান্না পারো।”

“না খেয়েই আন্দাজে প্রশংসা আমি নেই না।”

সে কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, “নিও না!”

খেয়ে আর ভালো খারাপ কিছু বলল না। আজব লোক!

সারাদিন কোথায় ছিল জানতে চাইলে খুলে বলল সব৷ তানজিম ভাই তার বন্ধুর পাশাপাশি বিজনেস পার্টনার। সিলেটে তাদের বিরাট ফ্যাশন হাউজ আছে। সে টাকা ইনভেস্ট করলেও স্বশরীরে এখানে ছিল না। তানজিম ভাই একাই দেখাশোনা করতো। এখন সে নিজেও কাজ করবে। সে টাকা দিয়ে আর তানজিম ভাই শ্রম দিয়ে ব্যবসাটা শুরু করেছে। এখন ব্যবসার অবস্থা ভালো চলছে। তানজিম ভাই কাজের মানুষ। শ্রম দিয়ে অল্প সময়ে ফ্যাশন হাউজটাকে ছোট থেকে এতবড় করেছে।

প্রশ্ন করলাম, “তানজিম ভাইয়েরটা বুঝলাম, কিন্তু তুমি তোমার বাবার ব্যবসা রেখে এটা শুরু করতে গিয়েছিলে কেন?”

“মূলত আমি তানজিমকে সাহায্য করছিলাম। বেচারা চাকরি পাচ্ছিলো না। আমি আইডিয়া দিয়েছিলাম ব্যবসা করতে। তবে তার মূলধন ছিল না। আমি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে এমনিতে টাকা নেবে না বলে পার্টনার হিসেবে দিতে হয়েছে।”

“কিন্তু ঢাকা রেখে এখানে কেন?”

“যেহেতু ও কাজটা করছে, ওর বাড়ি, চেনাজানা সবই এদিকে, তাই এখানটাই পারফেক্ট জায়গা ছিল। ঢাকায় হলেও আমি সময় দিতে পারতাম না। আর ওরও অসুবিধা হয়ে যেতো।”

“আর এখন যে তার সাথে কাজ করতে এসেছ হুট করে, এটা সে মেনে নেবে?”

সে হেসে বলল, “কেন মানবে না? তাছাড়া আগেই বলে রেখেছিলাম আসতে পারি।”

“তার মানে তুমি সব আগে থেকে ঠিক করে এসেছিলে?”

“নাহ। তবে ভেবেছিলাম এমন কিছু হতে পারে। তাই ব্যাকআপ প্ল্যান ছিলো এটা।”

“আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কী হবে বলোতো?”

“চিন্তা করো না, মন দিয়ে সংসার করো। মনে করো এটাই তোমার শ্বশুরবাড়ি। তেমন করে থাকো।”

আমার মন বলছে এসব ঠিক হচ্ছে না। এদিকে আমরা আমাদের মতো সব গুছিয়ে নিচ্ছি, ওদিকে না জানি কী হচ্ছে! শ্বাশুড়ি মা নিশ্চয়ই ভাববেন আমি তাকে তার ছেলের থেকে আলাদা করে দিয়েছি! জীবনে কেনোদিন মেনে তো নেবেনই না,উল্টে অভিশাপ দেবেন! অভিশাপের সংসার কি সুখী হবে?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here