#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৩৪

0
564

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৩৪
#লিখা_তানজিলা

বাহাত্তর ঘন্টা! এইটুকু সময়ই এ ক্লাবে সুরক্ষিত থাকার গ্যারান্টি পেয়েছে আইজা। এরপর ওর সাথে কী হবে জানা নেই। তবে লোকটার মুখভঙ্গি দেখে যা বুঝলো সে অন্তত আইজার খুন না করে ক্ষান্ত হবে না। ওকে যে ঘরে রাখা হয়েছে তাতে আলো নেই বললেই চলে। শুধু মাথার ওপর একটা নামমাত্র ড্রিম লাইট জ্বলজ্বল করছে। পাখা তো যেন কচ্ছপের গতিকেও হার মানাবে!

আধো আলো আধো অন্ধকারে ঘেরা রুমের বাম সাইডে দেয়ালের সাথে লাগানো ছোট বিছানায় চুপচাপ বসে আছে আইজা। কপাল বেয়ে গলা অব্দি ঘাম ঝরে যাচ্ছে। পুরো শরীর গরমে অস্থির হয়ে পড়ছে! মস্তিষ্কের ঘূর্ণিপাকে ওলট-পালট হয়ে যাওয়া সকল ভাবনা আপাতত উপেক্ষা নামক ডায়েরিতে বন্দী করে রেখেছে আইজা। নইলে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে ও!

এই মুহুর্তে রাগ অথবা ক্ষোভ নিয়ে পড়ে থাকার মতো বিলাসিতা করার সময় নেই আইজার কাছে। খুব ইচ্ছে করছে চিৎকার করতে। গলা ফাটানো চিৎকার। যাতে আশেপাশে থাকা সকল প্রাণির কানের পর্দা ফেটে যায়! কিন্তু পারছে না আইজা! চোখের সামনে থাকা সবকিছুই মরিচীকা মনে হচ্ছে ওর কাছে!

হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে ক্লিক করে একটা শব্দ ভেসে আসায় বিছানা থেকে পা নামিয়ে বসলো আইজা। নীল কোর্ট গায়ে জড়ানো ভদ্রবেশী সেই লোক সটানভাবে আইজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার পিছু পিছু লম্বা করে এক লোক এসে আইজার সামনে ভাজ করা একটা টেবিল খুলে রাখলো। তার-ও পিছু আরো দু’জন এসে সেই টেবিলে খাবার রেখে দিলো।

নিজের পেটের ভেতর থেকে আসা গুড়গুড় আওয়াজের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে আইজা। তবুও খাবার স্পর্শ করলো না ও। স্থির চোখে লোকটার গতিবিধি লক্ষ্য করতে শুরু করলো। আইজার এ চাহনি হয়তো ধরতে পেরেছে সে। তবে কিছু বললো না। স্মিথ হেসে দরজা মুখী হতেই আইজা বলে উঠলো,

-“এতোকিছু আমি একা কী করে খাবো! আপনিও বসুন না!”

আইজার কন্ঠ শুনতেই থেমে গেলো সে। পেছনে ফিরে আইজার মুখ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো। পরক্ষনেই লম্বা লোকটাকে কিছু একটা ইশারা করতেই বাইরে চলে গেলো সে। এই মুহুর্তে রুমে আইজা আর ঐ নীল কোর্ট পরিহিত ব্যাক্তি ছাড়া কারো উপস্থিতি নেই।
-“সুন্দরী নারীদের প্রস্তাবে না করতে আমার আবার ভিষণ কষ্ট হয়! তাই তোমার কথাটা ফেললাম না।”
এই মন্তব্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না আইজা। ততক্ষণে সেই লম্বা করে লোকটা এসে একটা এক্সট্রা চেয়ার আইজার সামনে বরাবর রেখে দিলো। সাথে বাড়তি প্লেটও রাখা হলো টেবিলে।

লোকটা নিজের কোর্টের বাটন খুলে চেয়ারে বসতেই আইজা তার সামনে থাকা প্লেটে একে একে সকল আইটেমেরই কিছু অংশ তুলে দিলো।
-“আমি যখন বলেছি বাহাত্তর ঘন্টার আগে তোমার গায়ে কোন আঁচড় পড়বে না মানে পড়বে না। এমনকি খাবারে বিষও মেশানো হবে না!”

-“আপনার এ কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই আমার কাছে।”

-“সেটা তোমার ব্যাপার আইজা!”
নির্লিপ্ত ভাব তার কন্ঠে। আইজা খাওয়া শুরু না করলেও লোকটা ইতোমধ্যে খাবারে ডুব দিয়ে ফেলেছে।

ক্ষিদে থাকা স্বত্বেও টেবিলে রাখা বেশির ভাগ কিছুই মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না আইজার। শুধুমাত্র ফ্রাইড চিকেনটাই নিজের প্লেটে নিলো সে।
-“ফ্রাইড চিকেনটা বেশ। রাতে আমি এটাই খাবো।
লম্বা লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো আইজা। আইজার ফরমায়েশে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো সে।
-“আর কোন অর্ডার!”
-“না, আপাতত এতটুকুই।”
আইজার এ কথায় যেন আরো চটে গেলো লম্বা লোকটা। হয়তো আরো কিছু বলতো কিন্তু খেতে থাকা লোকের ইশারায় নিঃশব্দেই দাঁড়িয়ে রইলো সে।

-“এসব করে লাভ নেই! এদের কথার জালে ফাসিয়ে বোকা বানিয়ে এখান থেকে বের হওয়া সহজ হবে না।”
নীল কোর্ট পড়া অভদ্রলোকের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলে উঠলো,
-“পালিয়ে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য না। আসলে আমি আপনার সামনে একটা অফার রাখতে চাই।”

-“অফার?”

-“এতে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন আর আমি আপনাকে। দু’জনেরই কাজ সহজ হয়ে যাবে! এমনিও আমাকে মেরে কোন লাভ হবে না আপনার।”

-“এইটুকু পুঁচকে মেয়ে আমার সাথে সওদাবাজী করতে চাও! বাপের থেকেই শিখেছো না এসব!”

-“আমি কার থেকে কী শিখেছি তাতে কিছুই যায় আসে না। মূল কথায় আসি। দেখুন, ছয় মাসের বিবাহিত জীবনে যা বুঝেছি, সীমান্ত অভিনয়ে ভিষণ দক্ষ। আপনার চোখে ধুলো দিয়েছে সে। আমাকে বিয়ে করেও যখন পাপাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো তখনই সে তার নতুন জাল ফেলে। আমার প্রতি দূর্বল হওয়ার অভিনয় শুরু করে। হয়তো সে বুঝে গেছিলো আপনি তার ফেলা ফাঁদে নিশ্চয়ই ফেঁসে যাবেন। আর এখন সেটাই হলো। সীমান্ত যেভাবেই হোক আমার ওপর নজর রেখেছে। ক্লিনিকের আশেপাশেও তার ভাড়া করা লোকদের দল ছিলো। তাদের মধ্যে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আপনার পাঠানো লোকদের দেখেছে। সীমান্ত প্ল্যান ছাড়া কিছুই করে না। আর সিসিটিভি ফুটেজ বের করা কোন ব্যপারই না ওর কাছে। এ ক্লাবের কোন খোঁজ পেলে ওর কাছে আমার সুরক্ষার আগে নিজের প্রতিশোধই প্রাধান্য পাবে। আপনি আমাকে মারুন আর কাটুন তাতে ওর কিছুই আসবে যাবে না। উল্টো আমাকে এখানে আনতে গিয়ে আপনি গুহা থেকে বেরিয়েছেন। নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন!”

-“আমি এতোটাও কাঁচা খেলোয়াড় নই। তোমাকে কিন্তু এখানে একা আনা হয়নি। সাথে সীমান্তর বাচ্চাকেও আনা হয়েছে।”

লোকটার কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আইজা। এতোক্ষণ যেন এই কথারই অপেক্ষা করছিলো ও।
-“সন্দেহ এমন এক বীজ যা একবার বুনলে আর সম্পূর্ণরূপে কখনোই যেতে চায় না। এতো বয়স হলো আপনার! এটাও জানেন না! আপনিও দেখছি কম বোকা নন!”

-“কী বলতে চাচ্ছো তুমি?”
লোকটার গলায় কিঞ্চিত ক্রোধ ফুটে উঠেছে। মুখে লেগে থাকা শান্ত ভাবটা এখন আর নেই।

এক ঢোক পানি গিলে নিলো আইজা। গ্লাসটা টেবিলে রেখে ঠান্ডা চোখে তাকালো ঐ লোকের দিকে।
-“সীমান্তর মনে হয় আমার আর সাহিলের মধ্যে বিয়ের পরেও রিলেশন আছে। ও কী এই বাচ্চাটাকে নিয়ে কোন সন্দেহ করবে না! শুনতে আর বলতে খারাপ লাগলেও সীমান্ত কিন্তু এই বাচ্চাকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হবেই! ভুলে যাবেন না, সীমান্তর মনে সন্দেহের বীজ আপনিই বুনেছেন!”

সামনে বসে থাকা ব্যাক্তির কপালের সুক্ষ্ম ভাজটা মুহূর্তেই সোজা হয়ে গেলো। দেখে মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত সে। ডোজটা কাজে দিচ্ছে হয়তো। হয়তোবা না!

আইজাও আর কিছু বললো না। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিলো শুধু। গলাটা প্রচন্ড শুকিয়ে যাচ্ছে। হৃদপিণ্ডে যেন রীতিমতো হামলা শুরু হয়েছে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে খাবারে মনোনিবেশ করলো আইজা। সীমান্তর ওকে খুজে বের করতে কতক্ষণ সময় লাগবে জানা নেই আইজার। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে সীমান্তর অপেক্ষাতে পুরো বাহাত্তর ঘন্টা চোখ বন্ধ করে এখানে চুপচাপ ও কখনোই বসে থাকবে না! সে সামর্থ্য নেই আইজার!

******

গত পাঁচ মিনিট যাবৎ কলিং বেলের আওয়াজে কানটা পঁচে যাচ্ছে সাহিলের। আরে কেউ যখন এতো বেল বাজানোর পরও দরজা খুলছে না, এর মনে সে দরজা খুলতে চায় না! এতোটুকু কমন সেন্সও নেই তার মাথায়! ঐদিন সেই বজ্জাত বুড়োর গুন্ডাগুলো ওকে নিজ দায়িত্বে এপার্টমেন্টে কিছু টাকা সহ ফেলে যায়। একে তো শুধু শুধু পেটালো তার ওপর টাকাও কম দিয়েছে শা*লা!

বুকে হাত রেখে কোনমতে উঠে দাঁড়ালো সে। টিপ টিপ পায়ে বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললো সাহিল।
-“কী দারুণ! এই সাইকো পরিবার দেখি আমাকে মাটির নিচে না পুঁতে বিশ্রাম নেবে না!”
দরজার ওপাশে বৃষ্টিভেজা সীমান্তকে দেখতেই মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো কথাটা ওর মুখ থেকে।

সাহিলের পুরো গঠনে চোখ বুলাতেই ভ্রু কুঁচকে এলো সীমান্তর। তবে এ নিয়ে কোন মন্তব্য না করে সোজা সাহিলের এপার্টমেন্টে ঢুকে পড়লো ও।

-“দেখুন আমি কিন্তু আপনাকে এখানে আসার অনুমতি দেইনি। আপনি বিনা অনুমতিতে এখানে আসতে পারেন না। আমি কিন্তু পুলিশ কল করবো!”

-“করুন।”
সীমান্ত নিজের মতো করে পুরো এপার্টমেন্টটা ঘুরে ঘুরে দেখছে।

-“কী চান আপনি? এখানে কেন এসেছেন?”

সাহিলের প্রশ্নে মৃদু হাসলো সীমান্ত। ঠান্ডা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“এই ফ্ল্যাটের যা আসল ভাড়া সেটা দেয়ার সামর্থ্য আপনার নেই। আপনার ভাড়ার একাংশ অন্য কেউ দিচ্ছে। কে সে?”

একঘেয়ে চাহনিতে তাকালো সাহিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
-“এই জানতে এখানে এসেছেন আপনি?”
সীমান্তর মুখভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন এলো না। শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“হ্যাঁ!”

-“এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ইনফরমেশন ফ্রিতেই পেয়ে যাবেন না-কি!”
ব্যাঙ্গাত্বক স্বর উপস্থিত সাহিলের কন্ঠে।

মুহূর্তেই সাহিলের কলার চেপে ধরলো সীমান্ত। গলায় কাঠিন্যের ছাপ ফুটিয়ে বললো,
-“সময় নষ্ট না করে যা জানতে চাইছি তার উত্তর দিন। নইলে এরপর হেঁটে এসে দরজা খোলার অবস্থায়ও থাকবেন না!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here