#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১৩
ঘোরের মাথায় হাতের কব্জি ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে ফেললাম। অবাক হয়ে নিজেই তাকিয়ে রইলাম বিন্দু বিন্দু থেকে আস্তে আস্তে হওয়া রক্তের বন্যার দিকে। আমি এই কাজ করলাম? আমি তো একফোঁটা রক্ত দেখলেই কেঁদে ফেলতাম! এখন দেখো, আমি কাঁদছি না।
মাথা ঘুরছে। আমি কি মারা যাচ্ছি? চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। আমার ভীষণ ইচ্ছে হলো একবার খুশবুকে দেখতে, একবার মাকে দেখতে, ওকে দেখতে…মারা গেলে ওদের কি আর কোনোদিন দেখতে পাব না? আমি কি জাহান্নামে যাব? আত্মহত্যা করলে তো সবাই জাহান্নামেই যায়…আমি মরতে চাই না। কষ্ট পেলেও বাঁচতে চাই। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে গেছে। আমি দরজা খোলার চেষ্টা করলাম, শরীরে শক্তি নেই। ধাক্কা দেয়ারও শক্তি নেই…
প্রচন্ড তৃষ্ণা, ভয়, অস্বস্তি আর যন্ত্রণা নিয়ে আমি পড়ে গেলাম মেঝেতে। সাদা মোজাইকের ফ্লোর রক্তে ভিজে আছে। কি ভয়ানক দৃশ্য! সব আমার রক্ত….আমার….আমি মারা যাচ্ছি! পৃথিবী…তুমি ভালো থেকো.…
.
মনে হলো বহু বছর পর চোখ মেলে তাকালাম। চারপাশে শুধু সাদা। পাশে তাকালে দেখতে পেলাম একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে, তবে চিনতে পারছি না। উনি কি জীবিত মানুষ? আমি কি পৃথিবীতেই আছি? মানুষটা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “কেমন আছ?”
আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, “আমি কি বেঁচে আছি?”
মহিলাটি হেসে বললেন, “হ্যাঁ।”
“আমি কোথায়?”
“হাসপাতালে।”
“আমার মা..খুশবু…”
“সবাই আছে। তুমি কেমন আছ বলো।”
“ভালো। আপনি কে?”
“চিনতে পারোনি আমায়?” মহিলাটি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন।
আমি তাকে চিনে ফেললাম। শেফালী আপা। ফেসবুকে ছবি দেখেছিলাম। বাস্তবে কখনো দেখা হয়নি। খুশি হলাম তাকে চিনতে পেরে। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম তার সাহায্য নিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, “আপা আপনি এখানে কী করে এলেন?”
“তোমার বোন রক্ত চেয়ে ফেসবুকে তোমাকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছিল। সেটা দেখে এসেছি।”
“ওরা কোথায়?”
“কারা? তোমার বাড়ির লোক?”
“হ্যাঁ।”
“তারা কেউ এই মুহূর্তে হাসপাতালে নেই। চলে আসবে। তোমার এখন সত্যি ভালো লাগছে?”
“জ্বি।”
“তাহলে আমাকে বলো তো তুমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলে কেন? আর হ্যাঁ, যদি তোমার ইচ্ছে হয় তাহলেই বলো, নইলে বলো না।”
আমি খানিকটা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না৷ বললাম, “পরে বলব।”
আপা বললেন, “তাহলে বলো না। রেস্ট নাও।”
“খুশবু…”
“আসবে!”
শেফালী আপা চলে গেলেন।
আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম৷ ঘুম ভাঙলে মা’কে দেখতে পেলাম। কোলে খুশবু। মা কাঁদতে কাঁদতে খুশবুকে আমার কোলে দিয়ে বললেন, “তুই এই কাজ করলি কেন? আমার মাথা খারাপ হয়েছিল তখন মা মরা বাচ্চাটার কান্না দেখে। তাই ভুলভাল বলেছি। তুই সেই বকা শুনে মরতে যাবি? মরা এত সহজ?”
আমি জবাব না দিয়ে খুশবুকে কোলে নিলাম। কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে ওর ভার সইতে পারছে না হাত। তবু যথাসম্ভব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে নিলাম বুকে। কি শান্তি! যেন সব সুখ জড়ো হয়ে আছে খুশবুর মাঝে।
মা আরও অনেক কান্নাকাটি করলেন। আমি তাকে বোঝালাম তার জন্য কিছু হয়নি। আমি এমনিতেই ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম৷ মা বুঝলেন না। তার ধারনা তার বকার জন্যই এমন হয়েছে। উনি আবার তাড়াতাড়ি চলেও গেলেন। এক হাজার রাকাত নামাজ মানত করে রেখেছেন, আমার জ্ঞান ফিরলে আদায় করবেন বলে।
খুশবুকেও নিয়ে গেলেন৷ আমার কাছে রয়ে গেল ঝিনু। সন্ধ্যার পরপর শেফালী আপা আবার এলেন একজন মহিলাকে নিয়ে আমার কাউন্সেলিং এর জন্য। মহিলা না বলে মেয়ে বলাই ভালো। নাম সানজিদা আফরোজ। ত্রিশের ওপর হয়তো বয়স। দেখতে বেশ সুন্দরী আর স্মার্ট। শেফালী আপার বান্ধবী। মেয়েটি সাইকোলজিতে পড়াশুনা করেছে, কিন্তু ডাক্তার নন।
প্রথমেই আমাকে দেখে বিস্তৃত হেসে বললেন, “তোমার ঠোঁটদুটো ভারি সুন্দর! হাসো তো একটু।”
আমার তার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল। প্রশংসা আমি জীবনে কমই পেয়েছি। কখনো পরিপাটি হয়ে থাকলে, শাড়ি পরলে, হালকা সাজগোজ করলে কেউ সুন্দর বলেছে, মায়াবতীও বলেছে। তবে সেটা ক্ষুদ্রার্থে।
এই মেয়ের চোখ দেখে মনে হলো সত্যি তার আমার ঠোঁট পছন্দ হয়েছে। আমি হাসলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, “শরীর ভালো?”
“জ্বি আপা।”
“আমার ডাকনাম মিতা। আমাকে মিতা বলেই ডেকো। বয়সে বড় আমি, তবে আমাকে বন্ধু ভাববে কেমন?”
“আচ্ছা।”
“এখন বলো তোমার মন ভালো?”
আমি চুপ করে রইলাম। মিতা বললেন, “তোমার এখন কী করতে ইচ্ছে করছে বলো তো?”
“জানি না।”
“তোমার জীবনে কোনো শখ আছে? মানে যেমন ধরো দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, অনেকের যেমন ইচ্ছে, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা ঘোরার, ফিলিপাইলের কোনো দ্বীপে হারিয়ে যাওয়ার। নেই তেমন স্বপ্ন?”
আমি হেসে বললাম, “আছে। আমার একসময় খুব ইচ্ছে ছিল কাশ্মীর যাওয়ার।”
“গেলে না কেন?”
“সুযোগই পাইনি।”
“সুযোগ পাওয়া যায় ঠিকমতো চাইলে। তুমি কখনো চেষ্টা করেছ যাওয়ার?”
“নাহ। বাড়ি থেকে এতদূরে যেতে দিতো না, কখনো বলিনি। ভাবতাম বিয়ে হলে বরের সাথে যাব…”
“উনাকে বলেছিলে?”
আমি হাসলাম। উনি বললেন, “বুঝেছি। বিয়ের পর তোমার ঝামেলার কথা আমি শেফালীর কাছে শুনেছি। তা এখন তুমি কী করছ?”
“তেমন কিছু না।”
“পড়াশুনা?”
“হ্যাঁ শুরু করেছি।”
“গুড। তোমাকে আমি এখন ছোট্ট একটা গল্প বলবো। মনোযোগ দিয়ে শুনবে ঠিক আছে?”
“শুনব৷ আপনি বলুন।”
“সুরমা নদীর নাম শুনেছ নিশ্চয়ই? সুন্দর না নামটা? অনেকদিন আগে সুরমার তীরে এক পরিবারে ছোট্ট একটা মেয়ে জন্ম হয়েছিল, যার চোখদুটো ছিল কাজল পরানো। বাবা নাম রেখেছিলেন সুরমা৷ খুব সুন্দর মেয়েটির জীবনটা অত সুন্দর হলো না। সে স্কুলে ক্লাস টেনে থাকাকালীন এক বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে গেল।
জানোই তো, স্কুলের একটা মেয়ে ঝোঁকের বসে কেমন ছেলে পছন্দ করে। তারপর শুরু হলো স্বামী, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার। আধমরা মেয়েটা যখন ডিভোর্সি হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরলো, তখন তার বয়স পঁচিশ। কোলে একটা দুই বছরের বাচ্চা।
এটা ছিলো বাংলাদেশের কমন কাহিনী। এবার আনকমন কাহিনীটুকু শোনো। সেই মেয়েও তোমার মতো মরতে চেয়েছিল। একবার নয়, বহুবার। তারপর একসময় নিজেই ঘুরে দাঁড়ালো। তাকে রোড এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচাতে গিয়ে এক তরুণ যখন নিজের জীবন বলি দিলো, তখন মেয়েটা উপলব্ধি করতে পারলো প্রতিটা মানুষের জীবন প্রকৃতপক্ষে অনেক দামী হয়ে ওঠে যদি সে সেটা অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারে। নিজেকে, নিজের ভেতরের শক্তিটাকে, মেধাটাকে কাজে লাগিয়ে যদি সে অন্যের সামান্য একটা উপকারও করতে পারে, দেশের জন্য, দশের জন্য অল্প কিছুও করতে পারে, তবে তার মানুষ হয়ে জন্ম নেয়া সার্থক।
সুরমা তখন শুরু করলো নার্সের কাজ করা। ট্রেনিং নিয়ে হাসপাতালে কাজ করতে শুরু করলো। মনপ্রাণ ঢেলে সে রোগীর সেবা করতে থাকে। প্রতিদিন তার প্রার্থনায় থাকে সে যেন অসুস্থ মানুষগুলোর জীবনে আশির্বাদ হয়ে আসতে পারে।
চারটা বছর এমনি পার করার পর এক ধনী নিঃসন্তান বৃদ্ধ মারা যাওয়ার আগে সুরমার নামে তার অনেকগুলো সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেল। প্রায় এক বছর এই বৃদ্ধকে সুরমা প্রাণপণ চেষ্টায় সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
তারপর জানো কী হলো? সুরমা সেই সম্পত্তির টাকা দিয়ে হাসপাতাল বানালো, দরিদ্র লোকদের ফ্রিতে সেবা দিতে শুরু করলো। হাসপাতালের সবকিছু সে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে দক্ষ হাতে পারিচালনা করতে লাগলো। অনেক চেনাজানা হয়েছিল তার। বিশ্বাসী, কর্মঠ লোক বেছে বেছে হাসপাতালে আনলো। যেন সবাই পর্যাপ্ত সেবা পায় সেটা নিশ্চিত করলো। মজার বিষয় কী জানো? সে নিজে কিন্তু নার্সই রয়ে গেল। সব সামলে যে সময় পেতো, নার্সের পোশাক পরে রোগীর সেবা করতো। টাকাও নিতো নার্সেরর বেতনের টাকাই।
এই দিয়ে সে ছেলে মানুষ করেছে, ভালো স্কুল কলেজে পড়িয়েছে। নিজেকেও ভুলে যায়নি। নিজের শখ পূরণ করেছে। তার বাড়ি কুকুর বিড়ালে ভর্তি। রাস্তা থেকে ধরে এনে তাদের আশ্রয় দেয়। ও ভালো আছে এখন। মানুষের দোয়ায়, ভালোবাসায় অন্য সংসারী দশটা মোয়েমানুষের চেয়ে অনেক বেশি ভালো আছে।”
মিতা কথা শেষ করে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। আমি এতক্ষণ তার কথা হা করে শুনছিলাম। চোখের সামনে সুরমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম।
মিতা বললেন, “আমি জানি তুমি ডিপ্রেশনে আছ। ডিপ্রেসড মানুষের মোটিভেশনাল গল্প শুনে কতটুকু প্রভাবিত হয় আমি জানি না। আমি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নই। তবে কথা বলে নাকি জটিল সমস্যা সলভ করতে পারি। হা হা। শেফালী তাই আমায় নিয়ে এলো।”
কিছক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আমি অনেকটা প্রভাবিত হয়েছি! আমার এখন আফসোস হচ্ছে এই কাজটার জন্য। এমনকি আমার হাত কাটার পর এটাও মনে হয়েছিল যে আমি মরতে চাই না। মরা অনেক যন্ত্রণার মিতা!”
“তাহলে মরতে গেলে কেন? এতই কি কষ্ট ছিল তোমার? নাকি ঝোঁকের মাথায় শুধু?”
“কারন আমি অপয়া। আমার কাছের মানুষ শুধু কষ্টই পেয়ে গেছে সবসময়। তাই মরে গিয়ে পৃথিবী থেকে জঞ্জাল দূর করতে চেয়েছি।”
“এখনো তাই মনে হয়? অপয়া, অশুভ এসব বিশ্বাস করে কেউ? একজন সুস্থ মানুষ হয়েও কেউ এই কথা বলতে পারে? সৃষ্টিকর্তা কি তোমাকে এতটা আলো- বাতাস দিয়ে, খাবার দিয়ে, সুন্দর পৃথিবীতে শুধু শুধুই রেখেছেন?”
“আমি আর এসব ভাবব না।”
“এখন তাহলে তুমি কী করতে চাও?”
“বাঁচতে চাই, পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য!”
(চলবে)