#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব -৪০ (সারপ্রাইজ)
#লিখা_তানজিলা
টর্চের আলোয় সীমান্তর অনুভূতিহীন চাহনি আইজার সামনে স্পষ্ট হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে পায়ের নিচে গ্রেভেটি ছাড়াও কোন এক অদৃশ্য চুম্বকীয় বস্তুর উপস্থিতি আছে। এক পা..দুই পা করে ক্রমাগত এগিয়ে আসছে সে। যেন লোকটার হাতে অজস্র সময়। তার আঁখি জোড়ায় কেন যেন চোখ রাখতে পারছে না আইজা। কারণ কী হতে পারে! হয়তো সীমান্তর চোখে রাগ অথবা নির্লিপ্ততা ছাড়া আর কিছুই হজম করার অভ্যেস নেই আইজার!
সীমান্তর পা যত এগোচ্ছে ততই তার অনুভূতিহীন চোখে অদ্ভুত হিংস্রতা ফুটে উঠছে। আইজার সাহসী মনটাও সেই সাথে পাল্লা দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র সাইজে পরিণত হচ্ছে। সে চাহনি ওর মনে প্রচন্ড অস্বস্তি জাগিয়ে তুলছে। তবুও আইজা নিজের জায়গায় অটল। জোরপূর্বক সেই ভয়ানক আঁখি জোড়ায় স্থির ভাবে দৃষ্টি বজায় রাখলো ও।
-“এতো কাঁপছেন কেন আপনি!”
সীমান্তর কথার কোন প্রতিউত্তর দিলো না আইজা। তাতেই যেন সীমান্তর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ঝলক ফুটে উঠলো। কোন স্বাভাবিক হাসি নয়। সেই বিখ্যাত হাসি যা আইজার মন বিষিয়ে দিতে সক্ষম। ক্ষুব্ধ মুখে বিছানা হাতড়ে বালিশের নিচে থাকা ব*ন্দুকটা সীমান্তর দিকে তাক করলো আইজা। সাথে সাথেই তার পায়ের গতি যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। ওর হাতে থাকা ব*ন্দুকে ঠেকে গেলো সীমান্তর বুক। সে আইজার হাত চেপে ধরে অধৈর্য্য ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-“এভাবে সময় নষ্ট করলে সামনের জন আরো বাজে ভাবে হা*মলা করার সুযোগ পেয়ে যাবে! আমি তিন পর্যন্ত গুনবো, এরপরও যদি আপনি এভাবে চুপচাপ খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে পরবর্তী হা*মলা কিন্তু আমি করবো!”
আইজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিঃশব্দে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখে যাচ্ছে। সীমান্ত নিজ কথা অনুযায়ী কাউন্টডাউন শুরু করলো,
-“এক!”
আইজার আঙুলের অবস্থান ট্রি*গারে পূর্বের তুলনায় আরো জোরালো হয়ে এলো।
-“দুই!”
সীমান্তর ঠান্ডা চোখ জোড়া জ্বলন্ত লাভার ন্যায় হয়ে উঠলো। এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল সে। যেন সতর্ক হওয়ার শেষ সুযোগ দেয়া হচ্ছে আইজাকে। পরক্ষনেই ওর হাতে থাকা ব*ন্দুকের অস্তিত্বকে উপেক্ষা করেই লোকটার মুখমণ্ডল ভয়ংকর গতিতে এগিয়ে এলো। আইজার কম্পিত ঠোঁট জোড়ায় দৃষ্টি গেলো তার। তৎক্ষনাৎ ওর গলা আলতো ভাবে চেপে ধরলো সে। সীমান্তর ঠান্ডা চাহনির আড়ালে তীক্ষ্ণ রেখার আর্বিভাবে শিউরে উঠলো আইজা। তবে এবার কিছু বলতে গিয়েও সে সুযোগ আর পেলো না ও।
-“তিন!”
শব্দটা সীমান্তর মুখনিঃসৃত হতে না হতেই তার ওষ্ঠদ্বয়ের আক্রমনে স্তব্ধতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলো আইজা। হাতে থাকা ব*ন্দুকের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকলো সেটা দেখার সময়ও পায়নি ও।
নিজ ওষ্ঠদ্বয় অত্যন্ত নি*ষ্ঠুরভাবে তার দখলে চলে গেলেও নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো আইজা। পায়ে জমে থাকা সমস্ত শক্তি যেন অচল প্রায়। সীমান্তর এক হাত যদি ওর কোমরে জড়ানো না থাকতো তাহলে হয়তো পড়েই যেতো ও। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতেই থামলো সে।
-“এতো সেলফিশ কেন আপনি! এখন যদি ওরা আপনার কোন ক্ষতি করতো! এসব মাতব্বরি কে করতে বলেছে আপনাকে??”
সীমান্তর কন্ঠে অস্থিরতার ছাপ। সাথে চাপা রাগ। তার বৃদ্ধাঙ্গুল আইজার অধর জুড়ে বেহায়া ভঙ্গিতে বিচরণে ব্যস্ত।
-“ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করার স্টাইলটা বেশ ইন্টারেস্টিং!”
এতক্ষণে মুখ খুললো আইজা। কন্ঠে স্পষ্ট ব্যঙ্গ ভাব। সীমান্তর বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উঠলো ও।
-“সরুন, আমার দম বন্ধ হচ্ছে!”
-“হোক! সবসময় নিজের চিন্তা আপনার। আর কারো তো কোন পরোয়াই নেই!”
রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো সে। সীমান্তর চাহনি দেখে মনে হচ্ছে আইজার মুখনিঃসৃত প্রতিটি বাক্যই যেন তাকে প্রচন্ড রকম বিরক্ত করে যাচ্ছে।
-“হ্যাঁ! আমি সেলফিশ। নিজেকে ছাড়া কাউকেই চিনি না। তো আপনি এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে কী করছেন! মারবেন না আমাকে!”
মুহূর্তের আইজার গাল শক্ত করে চেপে ধরলো সীমান্ত। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“আপনাকে মারবো বলেই এতো কষ্ট করে এ পর্যন্ত চলে এলাম। কিন্তু আপনি তো আমার চা*কুটাই নিয়ে গেলেন। ওটা ছাড়া আপনার ঘাড় শরীর থেকে আলাদা করবো কিভাবে!”
সীমান্তর মুখমণ্ডলে কোন অনুভূতির রেশ নেই। না ব্যঙ্গার্ত্বক ভাব আছে আর না ধ্বংসাত্মক। বোঝার উপায় নেই যে সে কথাটা সম্পূর্ণ অন্তর থেকে বললো না-কি ঠাট্টার ছলে! তবে সীমান্ত আইজার এ বিভ্রান্ত মুহূর্তকে পাত্তা না দিয়ে সোজা ওর হাত ধরে বলে উঠলো,
-“আর একটা কথাও না আইজা। আপনি আমাকে যতটা চেনেন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আমি জানি আপনার ব্যপারে। আপনার শিরা উপশিরা পর্যন্ত চেনা আমার!”
-“ঐ চা*কু দিয়ে তো গোটা একটা আঙুল হাত থেকে আলাদা করতে মোটামোটি সময় লাগবে! ঘাড় তো বহু দূর! স্যা*ডিস্ট কোথাকার!”
ফিসফিসিয়ে উঠলো আইজা। সীমান্ত ইতোমধ্যে ওকে টেনে বাইরে নিয়ে গেলো। জায়গাটা বিদঘুটে অন্ধকার। টর্চেও যেন কাজ হচ্ছে না। আগের বার যে ছোট সিঁড়িঘর পেড়িয়ে নিচের হলে গিয়েছিলো সেই সিঁড়ি ঘরে গিয়েই স্বল্প শব্দে দরজা আটকে দিলো সীমান্ত। আরেকটু সামনে থাকলে হয়তো ধরাই পড়তো।
-“কেউ আপনাকে খুঁজছে না কেন!”
আইজার কথায় সীমান্ত মৃদু হাসলো শুধু। তবে আওয়াজ ছাড়া। সীমান্ত ঐ লোকটাকে নিজ পরিহিত জামা পড়িয়ে তার পরনের বস্ত্র নিজে পড়ে লোকটার মুখ ঢেকে এসেছে। তারপর তার ফোন থেকে আরেকজনকে মেসেজ করেছে যে সে ওয়াশরুমে যাচ্ছে। হয়তো এই অন্ধকারে কেউ চেক করেনি। আজ দু’জন মানুষের সাথে বস্ত্র আদান প্রদান হলো ওর। ভাবতেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে লম্বা দীর্ঘশ্বাস।
-“সর্বোচ্চ এক ঘন্টা আছে আমাদের কাছে!”
মিহি কন্ঠে বলে উঠলো আইজা।
-“আপনি এসব করলেন কী করে!”
সীমান্তর কথায় কিঞ্চিত থতমত খেয়ে উঠলো আইজা। মানুষটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
-“আগেই বলেছি, এ ক্লাব সম্পর্কে ভালো জানা আছে আমার!”
নিজের কাঁধ নিজেই চাপড়ে দিলো আইজা। মেইন তারেই গন্ডগোল বাঁধিয়ে এসেছে ও। উদ্দেশ্য ছিলো সীমান্তকে আগে খুঁজবে, তারপর যা করার। এই ক্লাবের সদস্যদের মনোযোগ অন্যদিকে করারও প্রয়োজন ছিলো। ফাহাদ লোকটা প্রচন্ড ধূর্ত। সাথে সাইকোও! তার আসল উদ্দেশ্য বুঝে উঠতে এখনো অক্ষম আইজা।
ঘন্টা কয়েক আগে
——————————-
-“কী করতে বলছেন আপনি আমাকে?”
আইজার প্রশ্নে টেবিলে রাখা ব*ন্দুক হাতের সাহায্যে ঘুরাতে শুরু করলো ফাহাদ। ঠোঁটে মৃদু হাসি বজায় রেখে বলে উঠলো,
-“বেশি কিছু না! যদি সীমান্ত এ পর্যন্ত চলেও আসে, তুমি ওকে ধোকা দেবে। তাহলেই তোমাকে এখান থেকে জীবিত অবস্থায় ফেরত যেতে দেয়া হবে আর জাফর শিকদারের বিরুদ্ধে আমার কাছে যে প্রমান আছে সেটাও পাবে! কিন্তু তুমি যদি অন্য অপশন বেছে নাও, আর সীমান্তর সাথে ধরা পরো তাহলে বাহাত্তর ঘন্টা শেষ হওয়ার পর তোমাদের দু’জনকেই মেরে শিকদার বাড়ি পাঠানো হবে!”
-“বাহাত্তর ঘন্টাই কেন?”
জোরপূর্বক কন্ঠে স্বাভাবিকতা এনে প্রশ্ন করলো আইজা।
-“আমি কিন্তু এখনো তোমাকে ভরসা করিনা আইজা।”
শক্ত চোখে বলে উঠলো ফাহাদ। পরক্ষণেই হো হো করে হেসে উঠলো সে।
-“আমার ইচ্ছে। এই লুকোচুরি খেলার মেয়াদ আমি বাহাত্তর ঘন্টা রেখেছি। এর আগে যদি সীমান্ত আমার কাছে পৌঁছাতে পারে তবেই মুক্তি পাবে ও!”
-“হয় আপনি মজা করছেন, নয়তো আপনার মাথার স্ক্রু ঢিলা!”
অনিচ্ছাকৃত ভাবেই মুখ ফসলে বলে উঠলো আইজা। তবে ওর এ কথার বিপরীতে ফাহাদের মুখে ক্রোধের কোন রেখা দেখা গেলো না। বরং গর্ববোধের মুখভঙ্গি তার চাহনিতে। যেন আইজা মাত্র তার প্রশংসা করলো!
বর্তমান
—————–
লোকটার কথা উদ্ভট মনে হলেও ব্যপারটাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিলো আইজা। সীমান্তর এখানে এতো সহজ প্রবেশ দেখে ওর সন্দেহ আরো তীক্ষ্ণ হলো। পুরো হল জুড়ে লোকগুলো ছুটোছুটি করলেও তারা একবারও স্টোর রুম চেক করেনি। অর্থাৎ তারা জানতো আইজা আর সীমান্ত কোথায় আছে।
সেই মুহূর্তে আইজার মাথা ঘুরপাক দিতে শুরু করলো। সীমান্তকে কিছু বলতেও মস্তিষ্কে বাধছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো ওদের ওপর কেউ নজর রাখছে। নিজেদের জন্য কিছুটা হলেও সময় জোগাড় করতে এ বিশ্রি উপায় অবলম্বন করে বসলো ও!
তখনও ফাহাদ নিজে ওদের সামনে আসেনি। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। আইজার ধারনা অনুযায়ী কাল সকালেও ফাহাদ সীমান্তর সাথে দেখা করবে না। বরং নিজেকে আড়াল করে রাখবে। বাহাত্তর ঘন্টা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সীমান্তর সামনে আসবে না সে।
অন্ধকারে পরিপূর্ণ চারিদিক। দূর থেকে একজনের পায়ের আওয়াজ টের পেতেই টর্চ অফ করেছিলো সীমান্ত। আইজাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে সে। যেন ভয়ে আছে, ও কোন গন্ডগোল না করে বসে আবার! পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই আইজা বলে উঠলো,
-“আমি কোন বাচ্চা না!”
-“কোন বাচ্চার থেকে কমও না!”
তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলে উঠলো সীমান্ত। এমনিও বাজে গরম। তার ওপর সীমান্তর এভাবে ওকে পিষে ফেলার প্রচেষ্টায় ভিষণ অস্থির হয়ে উঠেছে সে। অতঃপর আইজার মুখ থেকে যে কথাগুলো বের হলো সেগুলো পুরোটাই ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
-“গত তিন মাস ধরে আমার পেট আপনার বাচ্চার দখলে! আর আপনি আমাকে বাচ্চা বলছেন!”
মুহূর্তেই নিজেকে মুক্ত অনুভব করলো ও। হুট করে অন হলো টর্চ।
সীমান্তর মুখে থমথমে ভাব। ব্যপারটা সীমান্তর কাছ থেকে লুকোনোর কোন উদ্দেশ্য ছিলো না আইজার। ও তো শুধু একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতির অপেক্ষা করছিলো মাত্র! সীমান্তর এ চাহনির বিপরীতে কী বলবে বুঝতে না পেরে ঠোঁট প্রসারিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বসলো আইজা। ভ্রু জোড়া উঁচু করে নিষ্প্রভ গলায় বলে উঠলো,
-“সারপ্রাইজ….!”
চলবে…