#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৩৯ (দরজা)

0
506

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৩৯ (দরজা)
#লিখা_তানজিলা

-“ডোন্ট! ডোন্ট মেক মি হার্ট ইউ আইজা!”

বেজে চলা এলার্মের তীব্র আওয়াজে সীমান্তর ক্ষীণ অথচ করুণ কন্ঠে এক ধাপ পিছিয়ে গেলো আইজা। শেষ কবে লোকটার চোখে এতটা উষ্ণতা ছিলো মনে নেই ওর। যেন কোন ছোট্ট বাচ্চাকে ফুসলে নিজের দিকে আহবান জানাচ্ছে সে।

-“কষ্ট হচ্ছে না খুব! যার জন্য এতো ঝুঁকি নিয়ে এ পর্যন্ত এলেন সে-ই এভাবে ধোঁকা দিলো! আমার তো আপনার জন্য ভিষণ খারাপ লাগছে, স্যার!”
আসিফের ব্যঙ্গার্তক কন্ঠে টনক নড়লো আইজার। সীমান্তর মাথার পেছনের সাইডে ব*ন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে সে! এলার্মের শব্দ ইতোমধ্যে মিলিয়ে গেছে। টান টান নিরবতায় কেটে গেলো কয়েক সেকেন্ড। আসিফের সাথে সাথে বেশ কয়েকজন ঘিরে রেখেছে সীমান্তকে। প্রত্যেকের হাতেই অ*স্ত্র।

তবে সীমান্তর ভয়ংকর চোখ জোড়া একজনের দিকেই সীমাবদ্ধ। তার স্ত্রী। আজকের পর থেকে যার স্থান হয়তো অপ্রিয়তার শীর্ষ কাতারে গিয়ে পড়বে। সীমান্তর অক্ষিকোটরে থাকা ভাসমান উষ্ণ আভা আসিফের আগমনের পর পরই নিভে গেছে। ঘৃণা শব্দটাও যেন তার চাহনির রেখা বিশ্লেষণে কম পড়বে। হয়তো এরচেয়েও জঘন্য কোন অনুভূতির অস্তিত্বে আইজাকে আসন দিয়েছে সে!

-“অনেক বড় একটা কাজ করেছেন আপনি! এরা যদি আপনার ঘাড় থেকে মাথা আলাদা না করে, আমি করবো! সব সহ্য হয় আমার, কিন্তু প্রতারণা…একদম না!!”
জোড়ালো কন্ঠ ছাড়াও পর্বত সমান ক্রোধের জানান দেয়ায় সীমান্ত বেশ দক্ষ। তার গলার স্বরে বিন্দুমাত্র রুক্ষতা নেই। তবুও যেন সেই কথার ভাজ আইজার হৃদপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। এই প্রথম সীমান্তর এ চাহনিতে অস্বস্তি হচ্ছে ওর….প্রচন্ড অস্বস্তি!

-“আসিফ সাহেব, আপনার দৌড় এতোটা গভীরে হবে কল্পনাও করিনি আমি!”
আইজার থেকে দৃষ্টি সরে গেলো তার। ঘাড় ঘুড়িয়ে আসিফকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো সে। আসিফ সীমান্তর কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজের নজর আইজার ওপর রাখলো।

-“শুরু করুন ম্যাডাম।”

আসিফের বলার ভঙ্গি বুঝে উঠতে সময় লাগলো না আইজার। হাতে থাকা ব*ন্দুক টেবিলের ওপর রেখে দিলো ও। অতঃপর ধীর গতিতে সীমান্তর দিকে এগিয়ে গেলো। তার কাঁধ, বুক এবং কোমরের একাংশে আইজার হাত মুক্ত ভাবে বিচরণ করে যাচ্ছে। পুরোটা সময়ই সীমান্তর ঠান্ডা দৃষ্টি ওর ওপর নিবন্ধ। তবে আইজার কোন কাজেই বাঁধা দিচ্ছে না সে। সীমান্তর পড়নের জ্যাকেট থেকে ফোন আর একটা ভাজ করা চা*কু বের করে পুনরায় আগের জায়গায় ফিরে গেলো আইজা। বেশ শব্দ করেই বস্তুগুলো টেবিলের ওপর রাখলো ও।

আসিফ প্রফুল্ল গলায় বলে উঠলো,
-“বস্ আপনার উপর খুব সন্তুষ্ট। সে ফিরতেই আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেয়ে যাবেন।”

অতঃপর সীমান্তর দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
-“আজ রাত একটু কষ্ট করে অপেক্ষা কর্। বস্ নিজেও তোর সাথে দেখা করার জন্য ব্যকুল হয়ে আছে! কাল সকালেই তোর সামনে আসবে সে।”
সীমান্তর মাথায় ব*ন্দুক ঠেকিয়েই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। আইজার দৃষ্টি সামনেই সীমাবদ্ধ। পিছনে ফেরার ইচ্ছে কাজ করলো না মনে।

পদধ্বনির আওয়াজ ক্ষীণ হতেই দ্রুত ঐ রুমের বাম কর্ণারে থাকা ওয়াশরুমে ছুটে গেলো ও। পেটে থাকা সবকিছুই গলা বেয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মাথার দু’পাশ নিজেই চেপে ধরলো আইজা। গড়গড় করে বমি করতে শুরু করলো ও। পুরো শরীর যেন নিংড়ে মুচড়ে যাচ্ছে!

নিভু নিভু চোখেই টাইলস লাগানো ফ্লোরে পড়ে রইলো আইজা। ঠোঁটের কোণে বিঁধে আছে তাচ্ছিল্যের হাসি। ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। জীবন এতোটাই সুখময় ছিলো যে, হঠাৎ করে আসা কষ্ট আর প্রতারণা হজম হয়নি আইজার। কতটা দূর্বল ছিলো সে! কঠিন বাস্তবতা থেকে পালাতে কী না করেছে ও! শেষপর্যন্ত নিজের চোখটাই বন্ধ করে ফেলেছে। একের পর এক মিথ্যের ছায়ায় তলিয়েছে নিজেকে।

কিন্তু আজ সে শক্তিটুকুও নেই আইজার। এভাবে বাস্তবতা থেকে বাঁচা যায় না। ক্ষনিকের জন্য মরিচীকায় গা ভাসানো হয় শুধু! অন্তত আজ নিজেকে কোন মিথ্যে বলবে না আইজা। প্রচন্ড দূর্বল মানসিকতার মানুষ ও! সামান্য আঘাতেই যে ভেঙে গুড়িয়ে যায়! অতঃপর কাপুরুষের মতো সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে সহজ উপায়টাকেই বেছে নেয় আইজা। শক্ত মনোবল নামক বস্তুটা ওর কাছে কখনো ছিলোই না!

পাঁচ কি দশ মিনিটের মতো ওভাবেই বসলো আইজা। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালো সে। চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ভেসিনের ওপর এটাচ করা আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালো ও। ওপরে লাগানো বাল্ব জ্বলজ্বল করে যাচ্ছে। ভিষণ বিরক্ত লাগছে আইজার এ আলো!

ফ্রেস হয়ে বাইরে বেরুলো ও। দূর্বল চোখের সামনে হঠাৎ আসিফ পড়তেই কিঞ্চিৎ লাফিয়ে উঠলো সে।

-“আজ আমার কলিজা ঠান্ডা হলো!”
আসিফের হাস্যজ্জোল চাহনির বিপরীতে ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। তবে এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চায় না ও। তাই চোখে গাম্ভীর্যের ভাব এনে বলে উঠলো,
-“এসব ফালতু কথার সময় নেই আমার। এক্ষুণি আমার জন্য একটা টুথব্রাশের ব্যবস্থা করুন। কুইক!!”

এবার ভ্রু আসিফের কুঁচকে এলো। হাত দুটো শক্ত করে মুঠ করে রেখেছে। বস্ যদি এর খেয়াল রাখার কথা না বলতো তাহলে হয়তো মুহুর্তেই ব*ন্দুকের এক গুলি আইজার মাথার আড়পার হয়ে যেতো!

***
-“গায়ের জোরে তো নিজের কাজ করিয়ে নিলেন। এখন আমার কী হবে! ঐ বাড়ির মালিকের পাওয়ারও কিন্তু কম না! শেষে আমাকেই না মরতে হয়!!!”

গাড়ির ব্যাক সীটে বসা সাহিলের ক্ষুব্ধ কন্ঠের কথাগুলোকে একপ্রকার উপেক্ষাই করলো রিয়াদ। গুরুগম্ভীর চোখে ল্যাপটপে নিজের কাজ সারছে সে। এতোক্ষণ যাবৎ সাহিলকে দিয়ে করানো ভিডিও-এর এডিটিং এ প্রচন্ড ব্যস্ত ও। সাহিলের ফোনে লুকায়িত ঐ বিল্ডিংয়ের কিছু সন্দেহজনক ভিডিও ফুটেজও আছে এতে। যার মাধ্যমে কালকের মধ্যে ঐ শুনশান বাড়ির বাইরে মিডিয়ার ঢল তো পড়বেই! এমনিও মানুষ রহস্যময় বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে বেশ ভালোবাসে।

-“রিয়াদ্! আমাদের মনে হয় কেউ ফলো করছে!”

ড্রাইভিং সীটে বসা ব্যাক্তির কথায় রিয়াদ আর সাহিল দু’জনই সতর্ক হয়ে পড়লো। খেয়াল করলো একটা কালো গাড়ি ওদের ফলো করে যাচ্ছে।

-“আমি আগেই বলেছিলাম!!!!!”
চিৎকার সহকারে বলে উঠলো সাহিল। রিয়াদ একটু ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণেই সীমান্তর বলা একটা কথা মনে পড়ায় শান্ত হয়ে উঠলো ও। শক্ত গলায় বললো,

-“গাড়ির স্পিড বাড়াও!”

****
শিকলের আওয়াজে চারিদিক মুখোরিত। ময়লা ফ্লোরে হাতে পায়ে শিকল নিয়ে বসে আছে সীমান্ত। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে আছে ও। দরজার পাশেই পার্টি মাস্ক পরিহিত এক ব্যাক্তি অস্ত্র হাতে পাহাড়া দিচ্ছে।

-“একটু পানি হবে?”
চোখ খুলে মৃদুস্বরে বলে উঠলো সীমান্ত। তবে সেই লোকটা এক পা-ও নড়লো না। নিজ স্থানে অটল সে।

-“দেখুন ভাই, আপনার সাথে আমার কোন দুশমনি নেই। একটু পানি তো খাওয়াতেই পারেন!”

লোকটার মুখভঙ্গি তেমন স্পষ্ট না। তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে বাইরে থেকে এক গ্লাস পানি এনে ওর সামনে রেখে দিলো।

-“ধন্যবাদ, গলাটা খুব শুকিয়ে গেছিলো!”
সীমান্তর কন্ঠস্বর ঘোলাটে। পানির গ্লাসের দিকে ধীর ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে ওর হাত। লোকটা উঠে দাঁড়াতে গেলেই সীমান্ত সাথে সাথে নিজের হাত পানির গ্লাস থেকে সরিয়ে শিকলের চেইন তার গলায় পেচিয়ে ধরলো,

-“সরি! আমার স্ত্রী আমার জন্য অপেক্ষা করছে! তার মাধ্যমেই আজ লাইফের প্রথম খুন করবো আমি!”
কিছু সময়ের মধ্যেই জ্ঞান হারালো লোকটা। ফ্লোরেই পড়ে রইলো দেহ। সীমান্ত তার পকেট চেক করতে ব্যস্ত। হঠাৎ তখনই হুট করে ওর চোখের সামনে থাকা সবকিছু অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। মৃদু হেসে উঠলো সীমান্ত। এখানেও পাওয়ার অফ হয় বুঝি!

***
আইজার মনে হচ্ছে ও ফাইনালি অন্ধ হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার বললেও যেন এ অন্ধকারের পরিপূর্ণ সংজ্ঞা হবে না। টর্চটার ব্যাটারিও শেষ। একবার চেক করে নিলে ভালো হতো। ধ্যাত! নল থেকে পানি পড়ার টিপ টিপ শব্দ কানে এসে লাগছে ক্রমাগত। অনুমান অনুযায়ী সামনে সিঁড়ি আর ডান দিকে কয়েকটা ভিআইপি রুম। আর এখন সিঁড়ির কাছে যাওয়ার ইচ্ছে একদমই নেই আইজার। হয়তো সেই ভিআইপি রুমে কোন যোগার করতে পারবে!

এই মুহুর্তে নিজের ইচ্ছেমতো চলায় কোন বাঁধা দেয়া হচ্ছে না ওকে। কোনমনে হাত দিয়ে চাপড়ে ভিআইপি রুম গুলোর দরজা খোলার চেষ্টা করছে ও। নিচ থেকে হৈচৈ-এর আওয়াজ ভেসে আসছে। আজ রাত কোন মাস্ক পার্টি ছিলো হয়তো। টর্চ আর ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে আছে তারা।

বেশির ভাগ ভিআইপি রুম এই মুহুর্তে খালি। আইজাকে ভিআইপি রুমের পাশের ছোট্ট একটা রুমে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু সীমান্তকে কোথায় রাখা হয়েছে জানা নেই। শেষমেশ ওকে যে রুমে রাখা হয়েছিলো সেখানেই ফেরত গেলো আইজা। এই মুহুর্তে আলোর উৎস খোঁজা ওর জন্য বেশ প্রয়োজন!

হঠাৎ পেছনে দরজা আটকানোর শব্দে আঁতকে উঠলো ও। কানে ভেসে এলো পরিচিত সেই হাড় কাঁপানো শীতল কন্ঠ,
-“আগেই বলেছিলাম, যেখানেই যান না কেন দরজা লক করতে ভুলবেন না! আফসোস! নিজের হাসবেন্ডের কোন কথাতেই গুরুত্ব দেন না আপনি!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here