#নিভৃতে_যতনে Part_35

0
377

#নিভৃতে_যতনে Part_35

#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

নীলাভ আকাশে একভাগ আজ হলদে-সোনালির রঙে সজ্জিত। হলদেটে সূর্যটি নিস্তেজ হয়ে ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে পশ্চিমাকাশের বুকে। পাখিদের হট্টগোল এখনো বিদ্যমান। মৃদু আলোর ঝলকানিতে আমি আড়চোখে বার বার রোয়েনকে পর্যবেক্ষণ করছি আর চুলে হাতখোপা করছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে এখন সন্ধ্যা হতে চললো অথচ রোয়েন এখনো শান্ত। সে দিব্যি ল্যাপটপ চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন এক ভাব যেনো কিছুই হয়নি। বুঝতে পারছি না এর মতিগতি। আদৌ ওইটা কোন প্রেমপত্র ছিল কি? যদি সেটা প্রেমপত্র না হয় তাহলে রোয়েন ওইটা আমায় ফেরত দিলো না কেন? আর যদি প্রেমপত্রই হয় তাহলে এই ব্যাটা শান্ত কেন? নিজের একমাত্র বউয়ের জন্য প্রেমপত্র এসেছে তা দেখামাত্র তো মাথা গরম হয়ে যাওয়া উচিৎ। জেলাসিতে জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার কথা। কাহিনী কি রে ভাই? চিঠিটাতে ছিলো টা কি? রোয়েনকে যে চিঠিটা নিয়ে প্রশ্ন করবো সেই স্পর্ধা আমার নেই।
আমি যখন আমার আপন ভাবনায় মগ্ন তখন এক পুরুষালী কন্ঠ কর্ণধরে এসে বারি খেতেই আমি সচকিত দৃষ্টিতে তাকাই।

— এইখানে এসো।

আমি একপলক রোয়েনের দিকে তাকিয়ে ভালোমত করে খোপা করে নেই। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে যাই উনার দিকে। তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি মুখ তুলে আমার দিকে তাকান। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— সেই চিঠিতে কি ছিল জানতে চাইবে না?

কথাটা শোনামাত্র আমার বুক ধক করে উঠলো। নয়নযুগল আপনা-আপনি বড় হয়ে আসে। আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটযুগলটি ভিজিয়ে নিয়ে অস্ফুটস্বরে বলি,

— না মানে হ্যাঁ…

তিনি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠেন,

— আমার জিন্সের বা সাইডের পকেটে তোমার চিঠিটা আছে। যাও সেটা নিয়ে আসো।

আমি কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে যাই বারান্দার দিকে। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে পুনরায় ফেরত আসি তাঁর কাছে। উনি ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির রেখে বলেন,

— পড়ো!

আমি বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে চিঠির ভাঁজটা খুলি। চিঠির ভাঁজ খুলতেই বুঝা গেল আসলেই এইটা একটা প্রেমপত্র। শুধু যে প্রেমপত্র তা নয়, এ যেন এক বিশাল রচনা। আগে জানতাম মানুষ খালি ‘গরুর’ রচনাই বড় করে লিখতে পারে কিন্তু এখন তো দেখছি এরা জীবন্ত মানুষকে নিয়েও ‘গরুর’ মত রচনা লিখে ফেলছে। আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে চিঠিতে চোখ বুলালাম। অতঃপর পড়তে শুরু করতাম,

” প্রিয় প্রেয়সী,

আজ তোমায় কিছু কথা বলতে চাই। কথাগুলো কিন্তু তোমার জানা অতিব জরুরি। জানি না এরপর তোমার রিয়েকশন কি হবে? আদৌ তুমি আমার অনুভূতির গভীরতা বুঝবে কি-না। কিন্তু আমি আর কথা লুকিয়ে রাখতে পারি না। তাই সরাসরি ভাবেই বলছি।
মাস খানিক হলো তোমার মায়াতে পড়ে আটকে গিয়েছি আমি। তোমার কথার মায়াজালে বাজে ভাবে ফেঁসে গিয়েছি আমি। তোমার হাসির ঝংকার কেড়ে নিয়েছে আমার ঘুম। তোমার চোখ দুইটির গভীরতায় ডুবে গিয়েছি আমি৷ সারাক্ষণ মন আমার এখন তোমার কিনারাতেই থাকে। জানি না কেন, তোমার সাথে কথা বলতে মন চায় বার বার। তোমাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয় বারংবার। তোমার এক ঝলকই যথেষ্ট আমার মুখে হাসি ফুটাতে। তোমার জন্য আমার মনে রয়েছে এক অন্যরকম অনুভূতি। যা কখনো কোন মেয়ের জন্য হয়নি। জানি না কিভাবে কেমনে তোমার মায়াতে নিজেকে জড়িয়ে গিয়েছি আমি আর সেই মায়া যে কখন ভালবাসায় পরিনত হয় তা বুঝতে পারিনি। হ্যাঁ ভালবেসে ফেলেছি আমি তোমায়। বড্ড বেশি ভালবেসে ফেলেছি। জানি না, তুমি বিষয়টা কিভাবে নিবে, কিন্তু তোমার হাত ধরে নদীর তিরে হাটতে চাই, তোমায় নিয়ে চন্দ্রবিলাস করতে চাই, রাতের পর রাত জেগে কাটাতে চাই, তোমার সাথে সারাজীবনের জন্য তোমার এই হাতটি ধরে পারি দিতে পুরো জীবন। দেবে কি অনুমতি আমায়, তোমার হাতটি ধরার? গ্রহণ করবে কি আমার ভালোবাসা? কথা দিচ্ছি কখনো তোমায় নিরাশ করবো না। সবসময় নিজের ভালোবাসার চাদরে তোমায় মুড়িয়ে রাখবো। শুধু একবার ভরসা করে হাতটি ধরো।

তোমার উত্তরে অপেক্ষায় রইলাম। চিন্তা নেই তোমায় আমায় খুঁজতে হবে না, আমি নিজেই এসে তোমার সামনে ধরা দিব।

ইতি
তোমারই কাছের একজন ”

চিঠিটা পড়ে আমার বিষম খাওয়ার মত অবস্থা। ভনভন করে মাথা ঘোরাচ্ছে। ভাই রে ভাই! এইটা চিঠি ছিল নাকি বস্তা ভরা অনুভূতির দোকান? আর কিসব থার্ডক্লাশ মার্কা ডায়লগ দেওয়া। আর কথার কি শ্রী। ছিহ! মানে আমাকে কি বাংলা সিনেমার সাবনূর পেয়েছি নাকি যে এমন থার্ডক্লাশ মার্কা চিঠি পেয়ে আমি গলে টলে বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দৌড়ে যাব চিঠির পিঠে হ্যাঁ বলতে? হাস্যকর! মানে লাইফে ফাস্ট প্রেমপত্র পেলাম তাও নাকি এমন থার্ডক্লাশ মার্কা? তার উপর চিঠিটা রোয়েন আগেই পড়েছে। না জানি উনি কি ভাবছেন আমাকে নিয়ে। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার। ইশশ! রোয়েনের হাতেই এই বাকওয়াস চিঠিটা পড়তে হলো? সিয়াশা এই মুখ তুই এখন তাঁকে কিভাবে দেখাবি? তোর উচিৎ এখনই এক গ্লাস পানিতে ডুবে মরার।

আমি যখন এইসব আকাশ-পাতাল চিন্তা-ভাবন করছি তখন রোয়েন গলা ঝেড়ে বলে উঠে,

— পড়া শেষ?

সাথে সাথে আমি আমার স্তম্ভিত ফিরে পাই। চকিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। তারপর স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে বলি,

— আমি জানি না এইটা কে দিয়েছে। সত্যি বিশ্বাস করুন।

রোয়েন নিজের কোল থেকে ল্যাপটপটা রাখতে রাখতে বলেন,

— তো আমি কখন বললাম তুমি জানো?

মুহূর্তেই আমি মূর্ছা যাই। মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও চিঠি প্রেরকের উপর আমার এখন আকাশ সমান রাগ হচ্ছে। সামনে পেলে পুরো বাঁশবাগানের বাঁশ ওই ব্যাটার মাথার উপর ফাটিয়ে দিতাম। বেয়াদব একটা! ক্ষোভে কখন যে হাতের মুষ্টির তলে চিঠিটা বিষিয়ে ফেলি বুঝে উঠতে পারি না। হঠাৎ রোয়েন আমার ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠেন,

— ইশশ! চিঠির কি হাল করেছ। বেচারার শত অনুভূতি এইভাবেই হাতের মুঠোয় বিষিয়ে দিলে?

তৎক্ষনাৎ আমি ভড়কে উঠে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রোয়েনের মুখ পানে। কোনমতে জিহ্বা দিতে ঠোঁটযুগল ভিজিয়ে নিয়ে মেকি হাসি দিয়ে বলি,

— তো কি করবো? মনের সিন্দুকে যত্নসহকারে তুলে রাখবো?

রোয়েন আমার দিকে এক কদম এগিয়ে আসতেই আমি দুই কদম পিছিয়ে যাই। রোয়েন আমার দিকে আরেক কদম এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,

— রাখতে ইচ্ছে করলে রাখো। মানা করেছি নাকি?

আমি পিছনে যেতে যেতে বলি,

— নিজের স্ত্রীকে বলছেন পরপুরুষকে নিজের মনে জায়গায় দিতে?

— কেন বলতে পারি না?

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই আমি পিছাতে পিছাতে কাবার্ডের সাথে লেপ্টে যাই। কিছু বুঝে উঠার আগেই, রোয়েন আমার দুইপাশে হাত রেখে আমাকে তার বাহুদ্বয়ের মাঝে আবদ্ধ করে নেন। আমি একপলক তাঁর দিকে মাথা নুইয়ে ফেলি৷ মিনমিনে গলায় বলি,

— অদ্ভুত তো আপনি। আপনার জায়গায় এখন অন্য যে কেউ হলে কেলেংকারী লাগিয়ে দিত। জেলাস হতো। আর আপনি কি-না..

রোয়েন আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলেন,

— সবাই আর আদনাফ জুহায়র রোয়েন এক না। বুঝলে!

আমি এইবার স্বগতোক্তি গলায় বলে উঠি,

— সিরিয়াসলি! আপনি জেলাস না? একটুও খারাপ লাগেনি আপনার? অন্যের কথা বাদই দেন, আপনার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো….

কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি৷ মুখ ফোসকে যে কি বলে ফেলেছি তা ভাবতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি। ভাগ্যিস পুরো বাক্যটা শেষ করার আগেই ফুলস্টপ লাগিয়েছি নাহলে আজ লজ্জায় আমি নির্ঘাত ইন্তেকাল করতাম। আমায় চুপ করে যেতে রোয়েন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,

— হয়তো কি?

আমি নতজানু হয়ে বলি,

— কিছু না।

— ওকে! কিন্তু তোমার কেন মনে হলো আমার এইসব দেখে জেলাস বা কষ্ট পাওয়া উচিৎ?

আমি অস্ফুটস্বরে বলি,

— এইভাবেই।

উনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— তুমি কি পালিয়ে গিয়েছ নাকি অন্যের বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছ যে আমি জেলাস ফিল করবো অথবা কষ্ট পাবো?

আমি আঁতকে উঠে বলি,

— আস্তাগফিরুল্লাহ! কিসব কথা।

রোয়েন পুনরায় আমার কানের সামনে এসে ফিসফিসিয়ে বলেন,

— আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার উপর শুধু আমার অধিকারের দলিল লিখিত,যা আছে,থাকবে এবং সম্পূর্ণ রুপে আমার’ই থাকবে। তার প্রতিটা শ্বাস আমার জন্যই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বলবে,আমি তোমার,আমি তোমার! তাই,আমার জেলাস ফিল করার প্রশ্নই উঠে না,গোট ইট।

কথাটা বলেই তিনি সটান হয়ে দাঁড়ান। মুহূর্তেই আমার গাল দুইটির মাঝে ছেঁয়ে যায় রক্তিম লালাভ আভা। মানুষটা প্রত্যেকবার অপ্রকাশ্যভাবেই নিজের অধিকারটা বুঝিয়ে দেয়। আমার প্রতি তাঁর অনাগত অনুভূতির গভীরতা নিমিষেই বুঝিয়ে দেন তিনি। রোয়েন বিছানার কাছে যেতে যেতে বলেন,

— বউ যাদের সুন্দর তাদের নিকট হাজার হাজার প্রেমপত্র আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়,বরং না আসাটাই অস্বাভাবিক।

কথাটা শোনা মাত্র আমার কান গরম হয়ে আসে। দুই গালের মাঝে বিদ্যমান লালাভ আভা প্রগাঢ় হয়ে আসে৷ লজ্জায় মিইয়ে যাই আমি। বিয়ের পর এই প্রথম রোয়েন আমার প্রশংসা করলো। কথার ছলে বুঝিয়ে দিল আমি সুন্দর। আজ নিজেকে এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী মনে হচ্ছে। প্রচন্ড রকমের প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে মনের দুয়ারে।আসলেই, প্রিয় মানুষটির প্রশংসায় যে প্রশান্তি মিলে তা আর কোথাও মিলে না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here