#নিভৃতে_যতনে Part_37

0
358

#নিভৃতে_যতনে Part_37

#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

নিশিরাতের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে সকলে। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। আঁধার প্রগাঢ় হওয়ার সাথে সাথেই তলিয়ে যাচ্ছে সকলে ঘুমের রাজ্যে৷ শৈত্যপ্রবাহ হওয়ায় নিশাচর পাখি ডাক শোনা যাচ্ছে প্রখরভাবে। আমি গায়ে মোলায়েম কম্বল জড়িয়ে আয়েস করে ঘুমিয়ে আছি। ঠিক এমন সময় নাকে সিগারেটের কড়া গন্ধ এসে বারি খেতেই ঘুম ছুটে যায় আমার। ক্ষণেই সিগারেটের গন্ধ তীব্রতর হয়ে আসে আমার নিকট। আমি গন্ধটা সহ্য করতে না পেরে উঠে বসি। পাশে তাকাতেই দেখি রোয়েনে নেই। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে আসে আমার। অন্ধকারের মধ্যেই বৃথা চেষ্টা করলাম তাঁকে খোঁজার। বাথরুমে লাইট অফ বলে বুঝতে পারলাম উনি সেখানে নেই। এত রাতে তিনি গেলেন কোথায়? পুনরায় সিগারেটের গন্ধ নাকে এসে বারি খেতেই আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে। গন্ধটা বারান্দা থেকে আসছে বলে এগিয়ে যাই সেইদিকেই। বারান্দার সামনে আসতেই রোয়েনকে নজরে পড়ে। সেই সাথে দৃষ্টি আটকে যায় উনার হাতে থাকা জলন্ত সিগারেটের দিকে। ক্ষণেই আমি থমকে যাই, অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে থাকি সেদিকে। এই দেড় বছরের সংসারে আমি কখনো তাকে সিগারেট খেতে দেখিনি। এমনকি সিগারেটের ধারের কাছেও যেতে দেখিনি। অথচ আজ তিনি অনায়াসে জলন্ত সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে বাতাসে দগ্ধ ধোঁয়া ওড়াচ্ছেন। কিভাবে সম্ভব এইটা? সব চোখের সামনে হওয়া সত্ত্বেও কেন যেন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। আমি বেশ কিছুক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তাঁর কাছেই আসতে সিগারেটের গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। গন্ধের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে কেশে উঠি আমি। কাশির আওয়াজ শুনে ক্ষণেই রোয়েন ঘাড় ঘুরিয়ে আমার পানে সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়। আমি বেশ কিছুটা সময় লেগে যায় নিজেকে সামলাতে। নিজেকে সামলে আমি রোয়েনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই। তাঁর মুখভঙ্গি আমার নিকট এতটা পরিষ্কার না-হলেও অনুমান করতে পারছি তিনি কিছুটা হলেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। হয়তো এইসময় আমাকে আশা করেন নি বলে। বেশ কিছুটা সময় নিরব থাকার পর রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— ঘুমাও নি?

আমি বেশ কিছুটা দূরত্ব বুজিয়ে রেখে স্বগতোক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— আপনি সিগারেট খান?

তিনি কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন। অতঃপর গমগমে গলায় বলে উঠেন,

— কেন খেতে পারি না?

কথাটা বলেই তিনি পুনরায় জলন্ত সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরলেন। সাথে সাথে আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। কোন এক অদৃশ্য কারণেই আমার বেশ খারাপ লাগতে শুরু করলো। কারণটা ঠিক আমার নিকট স্পষ্ট নয়। আমি কোনমতে নিজেকে সামলে বলি,

— আগে তো খেতেন না।

উনি অকপটে স্বীকার করলেন,

— এখন খাই।

— কিন্তু কেন? কি এমন কারণ যে আপনার এই বাজে জিনিসকে ছুঁতে হলো?

রোয়েন একপলক আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

— ইচ্ছে হয়েছে তাই ছুঁয়েছি। আবার ইচ্ছে ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলবো। নট এ বিগ ডিল।

আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি,

— আপনি এখনই ফেলবেন এইটা৷ এমন বাজে জিনিস খাওয়ার মানে হয়না। এখনই ফেলুন বলছি।

উনি রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে উঠেন,

— সেটা আমার ইচ্ছা আর আমি কি করবো না করবো তা বলার তুমি কে?

আমি বিস্ময়ের সুরে বলি,

— আমি কে মানে? আমি আপনার স্ত্রী।

— তো তাই বলে কি এখন তোমার সব কথা শুনতে হবে?

আমি নরম স্বরে জিজ্ঞেস করি,

— আপনি ঠিক আছেন তো? এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছেন?

রোয়েন বিশুদ্ধ হাওয়ায় নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে বলেন,

— আ’ম ফাইন।

— কিন্তু..

রোয়েন আমার কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— এই নিয়ে আমি কথা বাড়াতে চাই না। যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো৷

আমি অস্ফুটস্বরে বলি,

— এমন…

রোয়েন আবারও আমায় বলতে না দিয়ে কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠেন,

— বলছি না ঘুমাতে যেতে তোমায়? একা থাকতে চাচ্ছি আমি। একা থাকতে দাও আমায়।

রোয়েন এই কথার পৃষ্ঠে আর কথা বলার ক্ষমতা থাকলো না আমার। বাক্যহারা হয়ে গেলাম যেন। নয়ন দু’টি হয়ে উঠলো সিক্ত। আমি আর কিছু না বলে নিঃশব্দে চলে আসি রুমে। ক্ষণেই গা এলিয়ে দেই বিছানায়। চোখের পাতা দুইটি বন্ধ করতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। রোয়েনের এমন ব্যবহার আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। গলাটা বার বার ধরে আসছে। নিজেকে বার বার বুঝ দিচ্ছি, তাঁর এমন আচরণের পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। তিনি এইভাবেই একরোখা মানুষ। নিজের সমস্যার ব্যাপারে কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেন না। এইবারও হতে পারছেন না যার দরুন তিক্ত হয়ে এমন রুদ্ধ আচরণ করছে।
নিজেকে এতটা বুঝ দেওয়ার পরও শেষে এসে সব ছন্নছাড়া হয়েই যাচ্ছে। পারছি না মানতে আমার প্রতি মানুষটা এমন আচরণ। না চাইতেও ক্ষণে ক্ষণে দেখা দিচ্ছে অশ্রুজল। কিছুক্ষণের মাঝে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নিজের অশ্রুসিক্ত নয়ন দুটি মুছে নেই। অন্যপাশে কাত হয়ে গায়ে কম্বল জড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি। নীরবে অপেক্ষা করতে থাকি রোয়েনের ভিতরে আসার। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়ি তা বুঝে উঠতে পারলাম না।

______________________

নিকষ কালো আধার ভেদ করে সূর্যি উঁকি দিয়েছে পৃথিবীর বুক চিরে।সোনালি রৌদ্দুরের আভা গাছের পাতায় পাতায় নুইয়ে পড়ছে আদর মাখা পরাশে। সদ্য ঘুম ভাঙা পাখির কলতান মুখরিত হচ্ছে ব্যস্ত শহরের গাড়ির হর্ণের সাথে।শুভ্র প্রহরের রেশ আকাশের কোল জুড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। এক ফালি রোদের ঝলকানি চোখে এসে বিঁধতেই আমার ঘুম হালকা হয়ে আসে। ঘুম চোখেই একটু নড়েচড়ে উঠতে নিলেই বুঝতে পারি আমি কারো উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আমি একটু ঘাড় কাত করে পাশে তাকাতেই রোয়েনের ঘুমন্ত মুখখানি ভেসে উঠে। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠে সরু হাসির রেখা। মনের মাঝে ছেঁয়ে যায় একরাশ মুগ্ধতা। প্রতিদিন সকালেই তার আলিঙ্গনে নিজেকে আবিষ্কার করা যেন এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। কিন্তু তাও প্রত্যেকবারই এক আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই পেরুতেই হঠাৎ আমার কালকের কথাটা মস্তিষ্কে টনক নাড়ে। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠা হাসিটা মিইয়ে যায়৷ চোখ মুখে ছেঁয়ে যায় এক রাশ অভিমান। আমি নিজেকে রোয়েনের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসি। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যাই ফ্রেশ হতে।

নাস্তার টেবিলে বসে রুটি আর ভাজি চিবুচ্ছি আর আড়চোখে দেখছি রোয়েনকে। তিনি এক হাতে কফির কাপটা আর অন্য হাতে মুঠোফোন। খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছেন মুঠোফোনে। আমি কোন রকম শব্দ না করে নাস্তা করতে থাকি। রোয়েন কফিটা শেষ করেই উঠে পড়েন। আমি তা দেখে চট জলদি জিজ্ঞেস করি,

— নাস্তা করবেন না?

রোয়েন আমার কথায় স্থির হয়ে দাঁড়ান। নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠেন,

— না।

— নাস্তাটা করে নিন। নাহলে পড়ে শরীর খারাপ করবে।

তিনি তিক্ত কন্ঠে বলে উঠেন,

— সেটা আমি বুঝে নিব।

কথাটা বলেই তিনি রুমে চলে যান আর আমি ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে বসে থাকি। কেন যেন, এই রোয়েনকে আমার বড্ড অচেনা লাগছে। মানতে পারছি না তাঁর এমন খাপছাড়া ব্যবহার। ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকলো অভিমানে পাল্লা। আমি কোনেমতে নিজের সামলে নাস্তাটা সেড়ে উঠে পড়ি। ভার্সিটি যাব বলে রেডি হওয়ার জন্য রুমের দিকে এগিয়ে যাই। রুমে আসতেই পুনরায় সেই দগ্ধ পোড়া গন্ধ নাকে এসে বারি খায়। আমি বারান্দায় উঁকি দিতেই দেখি রোয়েন সেখানে এবং হাতে তাঁর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস। সিগারেট। আমি হতাশাজনক নিঃশ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যাই। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি রোয়েন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন। আমি একপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রোয়েনের তো অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে তাহলে উনি অফিসের জন্য রেডি হচ্ছেন না কেন? তিনি কি আজ অফিস যাবেন না? তিনি তো কখনো অফিস কামাই দেন না। কাজের প্রতি তিনি প্রচুর সিরিয়াস। আচ্ছা তাঁর আবার শরীর খারাপ করেনি তো? নাকি অন্য কোন সমস্যা? নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করে উঠি,

— আপনি আজ অফিস যাবেন না? সময় চলে যাচ্ছে তো।

রোয়েন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,

— আজ যাব না।

আমি তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বলি,

— আপনার শরীর খারাপ করছে? কোন সমস্যা? বললেন না তো কিছু।

রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— তেমন কিছুই না।

আমি প্রশ্নবোধক কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— তাহলে?

— বললাম তো কিছুই না। আর আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না, তুমি ভার্সিটির জন্য রেডি হও। দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার৷

কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র আমি স্থির হয়ে যাই। ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে থাকি তাঁর পানে। মনে মনে প্রশ্ন করে উঠি, ” আপনাকে নিয়ে চিন্তা করবো না তো কার জন্য চিন্তা করবো? আমার আপন বলতে আছে কে আর? যদি কোন সমস্যা থাকে তাহলে আমাকে কি তা বলা যায়না?
কেন করছেন এমন ব্যবহার আমার সাথে? কেন?” কিন্তু মুখ ফুটে আর কিছু বলা হলো না আমার। আরও ভারী হয়ে আসলো অভিমানের পাল্লা। কিছুক্ষণ রোয়েনের পানে তাকিয়ে থেকে আমি নীরবে রেডি হয়ে বেরিয়ে আসলাম বাসা থেকে।

#চলবে
রাতে আরেকটা পর্ব দিব। আর সকলের নিকট গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।

বিঃদ্রঃ আমাকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য সকলের জন্য অসীম ভালোবাসা রইলো।❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here