#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_১১

0
620

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_১১

#মিদহাদ_আহমদ

মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকা স্বামীর মুখে আজ তিন মাসের মাঝে প্রথম শুনলাম,

‘তুমি আমার অভ্যাস হয়ে উঠেছো’

কথাটা বলেই আরেকটা সিগারেট ধরালো আসিফ। সে আর কোন কথা বলার অবস্থায় নেই এখন। আমি ধীরপায়ে নিজের খাটে এসে বসলাম। এক কোণে বসে থাকতে থাকতে কখন যে আমার চোখ গড়িয়ে পানি বের হলো বুঝতেই পারলাম না! আজ প্রথম! আজ প্রথম আমার স্বামী আমাকে বলছে যে আমি তার অভ্যাস হয়ে উঠেছি! আজ যখন আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখন?

কিছুক্ষণ পর উঠে এলো আসিফ রুমে। আমাকে বললো,

‘তুমি চলে যেতে চাইলে যেতে পারো। আই এম সরি। তোমাকে এভাবে আটকে রাখার কোন রাইট আমার নেই। তাছাড়া বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি তোমার সাথে কোন ভালো ব্যবহার করেছি বলে আমার মনে হয় না। সব সময় তোমাকে নানান কথা বলে কষ্ট দিয়ে এসেছি।’

কথা বলার ফাকে মদ বের করে গ্লাসে নিলো আসিফ। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঢলতে ঢলতে বললো,

‘আমি মানুষটা ভালো না। দিনে সিগারেট, রাতে মদ আর নারীতে মত্ত থাকা মর্দ। আমার সাথে কে বা সংসার করতে চাইবে বলো? বাসার সবার কাছে আমি এক অবাধ্য সন্তান। পরিবারের সবার সামনে বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলে। অথচ আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করানো হয়েছিলো নুপুর৷ আই এম সরি। আজ তোমাকে আটকানো আমার ঠিক হয়নি। সব মানুষ তার জীবনে মুক্ত, স্বাধীন। ‘

কিছুক্ষণ আবার চুপ করে থাকলো আসিফ। আমি শুধু তাকে দেখেই যাচ্ছি। তারপর আসিফ আবার শুরু করলো,

‘জানো, যখন আমি কলেজে ছিলাম প্রায় সময়েই আমি নাইরপুল থেকে পাখি কিনে আনতাম। এনে কী করতাম জানো? বার্ড কখনো খাচায় থাকুক এইটা আমি চাইতাম না। তাই এদের মুক্ত করে দিতাম৷ স্বাধীন করে দিতাম। সব সময়ের জন্য স্বাধীন৷ তোমাকেও স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিতে হবে৷ কোন অধিকার নেই আমার কারোর জীবনে হস্তক্ষেপ করার। কারোর জীবনকে ধ্বংস করার। তোমাকে আটকিয়েছি কেন আমি জানি না। জানি না তুমি আমার অভ্যাস কিনা। হয়তোবা মদের নেশায় এতো মত্ত হয়ে উঠেছি যে কী বলতে কী বলে ফেলেছি। তুমি চাইলে যেতে পারো নুপুর। তোমাকে আমি আটকাবো না৷ যেখানে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা ইউ আর ফ্রি। আমার কোন রাইট নাই তোমাকে বন্ধ করে রাখার। কোন রাইট নাই…

কথাগুলো বলেই আসিফ হেলে পড়লো বিছানায়। মদের গ্লাসটা ঠাস করে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গেলো। আমি আসিফের মাথায় বালিশ দিয়ে দিলাম। গ্লাসের টুকরোগুলো পরিস্কার করলাম। তারপর বিছানায় আসতেই শুনতে পেলাম মনে মনে আসিফ বিরবির করছে,

‘আই লাভ ইউ নুপুর। আই লাভ ইউ’

আমার পুরো শরীর শিহরণ দিয়ে উঠলো৷ বিদ্যুৎ যেনো ছেয়ে গেলো পুরো দেহ জুড়ে। আসিফের এই অচৈতন্য হওয়া অবসাদ শরীরে সে যে জ্ঞানহীন কথা বলছে, সে জানে না এই কথাটুকু আমাকে কত বড় ভরসা দিয়ে দিলো এই সময়ে। একদিকে যখন আমার অন্ধকার হয়ে যাওয়া পৃথিবী আমাকে তাড়িত করে বেড়াচ্ছিলো, অন্যদিকে যেনো এই মানুষটা আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে!

সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমার কিছুটা দেরি হয়ে গেলো৷ ঘড়িতে সকাল আটটা। আমি তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে গেলাম। শাশুড়ি রান্নাঘরে যেতে না যেতেই বললেন,

‘নবাবজাদি হয়ে উঠছো নাকি দিনদিন? ঘরের বউদের যে সাত সকালে উঠা লাগে এইটা মাথায় নাই নাকি?’

‘মা রাতে ঘুমাতে একটু…’

‘থাক! আমাকে আর এসব বলতে হবে না। তোমার শ্বশুর চায়ের অপেক্ষা করছেন। তাকে চা দিয়ে আসো তাড়াতাড়ি। ‘

ননদ এসে বললো,

‘আমাকে ডিম আর ব্রেড রেডি করে দাও। আর গ্রিন টি দিও। লেবু দিও দুই টুকরা। ছোট করে কেটে৷ ‘

আমি সবার ফাই ফরমায়েশ মতো নাস্তা রেডি করে দিয়ে আসিফের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এলাম রুমে। এসে দেখি আসিফ বিছানায় হেলান দিয়ে দিয়ে বই পড়ছে। এই বাড়িতে এসে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম বুক শোকেছে হাজার তিনেকের মতো বই তখন খুঁজছিলাম কে এই বই পড়ে! এখন দেখছি আসিফ নিজেই পড়ছে! আমাকে দেখে আসিফ বললো,

‘কী? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বই পড়ছি দেখে? রিডিং রুমের সব বই আমার কালেকশন করা। এই তিন বছর বই পড়িনি একদম। ইচ্ছা করেনি৷ আজ ইচ্ছা হলো, তাই নিয়ে এলাম৷ কী? এভাবে দেখছো কেন? আমি কোন ভূতটুত নাকি?’

আমার হাসি পেয়ে গেলো। হাসি চাপা দিয়ে বললাম

‘কফি’

‘হুম। রেখে দাও টেবিলে।’

আমি কফি টেবিলে রেখে দিলাম৷ ফিরে আসবো এমন সময় আসিফ বললো,

‘আলমারিতে বোতল নাই দেখলাম৷ কই গেলো?’

‘কীসের বোতল?’

‘মদের’

‘আমি সরিয়ে ফেলেছি।’

‘মানে? হুয়াই? তুমি জানো না রোজ সকালে আমার…’

‘জানি! কিন্তু আজ না৷ আজকে যখন বই দিয়ে শুরু করেছো দিনটা, তখন নাহয় বই দিয়েই দিনটা কাটুক। এসব থেকে নাহয় দূরে থাকলা আজকের দিনে!’

‘অহ মাই গড! হুয়াট আর ইউ সেয়িং? তোমার মাথা পাগল হয়েছে নাকি?’

কথাটা বলেই বারান্দার কোন এক কোণা থেকে একটা সিগনেচার হুইস্কি বের করে আনলো আসিফ। আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম এই দৃশ্য দেখে। মানুষটাকে যত করে চাইছি এসব থেকে দূরে রাখতে, মানুষটা তত এসবে যেনো জড়িয়ে যাচ্ছে!

আমি রুম থেকে বের হয়ে এলাম। এদিকে শাশুড়ি শুনলাম শ্বশুরের সাথে কথা বলছেন, আজ সন্ধ্যায় নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তামান্নাকে। তারপর শাশুড়ি আমাকে ডেকে বললেন,

‘ডেজার্ট আইটেমের কোনকিছুই সম্ভবত পারো না তুমি৷ এক কাজ করো, কাজের মেয়ে দেখিয়ে দিবে সব। ওর সাথে সাথে থেকো। সন্ধায় তামান্নাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। ছেলে লন্ডন থাকে। দেশে এসেছে এক সপ্তাহ হলো। যদি পছন্দ হয়ে যায় তাহলে বিয়ে হয়ে যাবে রোজার পর পরই। ইফতার শেষে আসবে, তাই ভালোকরে ডেজার্ট আইটেম রেডি করা লাগবে। বুঝেছো?’

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।

ইফতার শেষেই তড়িঘড়ি করে সব রেডি করলাম টেবিলে। এদিকে ননাসও ইফতারের আগে বাসায় চলে এসেছেন৷ এসেই আমাকে বলে রেখেছেন, আমি যেনো ভালো কাপড় আর গহনা পরে থাকি। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখার পাশাপাশি মেয়ের ভাইর বউয়ের চাল চলন পোশাক এসব দেখবে। এতে যেনো তারা কোন খুঁত খুঁজে না পায়। আমি বুঝলাম না কনে দেখার সাথে আমার ভালো পোশাক আর গহনা পরে থাকার কী সম্পর্ক!

একমাত্র ননদ হিসাবে তামান্নাকে সাজানোর দায়িত্ব আমার হওয়ার ছিলো৷ সেই সুযোগ আমি পেলাম না আর। ননাস তাকে সাজিয়ে দিলেন। ঘন্টাখানের মধ্যেই পাত্রপক্ষ চলে এলো। একজন দুইজন না। পুরোপুরি এগারো জন। আমি খাবার রেডি করতে লাগলাম৷ চা বসালাম। খাবার টেবিলে থেকে শুনতে পেলাম পাত্রের মা বলছেন,

‘আমার বোনজির বিয়ে হয়েছে গত সপ্তাহে। আর জানেন আপা, কোন কমতি আমরা রাখিনি৷ আমার বোনেরও একমাত্র মেয়ে তো! বিয়েতে কী দেয়নি বলেন? কাঁঠালের কাঠের ফার্ণিচার, দুই দরজার ফ্রিজ, দেড় টনের এসি, বত্রিশ ইঞ্চি টেলিভিশন, আর মেয়ে নিজেই বাড়ি থেকে নিয়েছে ভরি সাতেক স্বর্ণ। আমরা আমাদের মেয়ের বিয়েতে কোন কমতি রাখিনি। সব দিয়েছি। মেয়েদের তো সব দিতেই হয়৷ আমার বোনের একমাত্র মেয়ে বলে কথা! আর জানেন, আমিও মনে করি মেয়ে আনতে হলে বড় ঘর থেকে আনা ভালো। কী বলেন?’

আমি শুনতে পেলাম আমার শাশুড়ি হেসে হেসে জবাব দিচ্ছেন,

‘হ্যাঁ আপা। ঠিক ই বলেছেন। মেয়ে বিয়ে দিতে কোন বাপ মা কম দেয় নাকি বলেন? আমারও শেষ মেয়ে। যদি আল্লাহর রহমতে বিয়ে ঠিক হয় তাহলে দিতে দেখবেন কোন কমতি রাখবো না।’

ওপাশ থেকে পাত্রের মা বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাদের আত্মীয় স্বজনের লিস্ট আবার লম্বা। ওই গত সপ্তাহে আমার বোনের মেয়ের বিয়েতে জামাই বাড়ির বরযাত্রী ছিলো দুই হাজার। আমাদেরও দুই হাজারের কম হবে না।’

আমার শাশুড়ি বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। তা কি আর বলতে বলেন? কনভেনশন হলে আয়োজন হবে৷ এখানে আমাদের কোন আপত্তি নেই। যা যা করার, যত হাজার লোকই আসুক সব হবে। সব। আর জানেন আপা, আমার ছেলের বিয়ে করালাম তিন মাস হলো। আমার বড় মেয়েরও বিয়ের হয়ে যাচ্ছে চার বছর। চার বছর আগে আমার বড় মেয়ের বিয়ের কাবিন ছিলো পনেরো লাখ টাকা। ছেলের বউকেও দিয়েছি কাবিনে লিখে সতেরো লাখ টাকা।’

আমি তাজ্জব বনে গেলাম আমার শাশুড়ির মিথ্যাচারে! আমার বিয়ের কাবিন ছিলো মাত্র এক লাখ টাকা। সেই জায়গায় তিনি কী অবলীলায় মিথ্যা বলছেন যে কাবিন সতেরো লাখ টাকা ছিলো!

শাশুড়ি আবার বলা শুরু করলেন,

‘এখন আপা আমার ছোট মেয়ে, বুঝেন ই তো। কাবিন যদি কম হয়, তার পরও আমি পঁচিশ লাখ টাকার নিচে দিবো না।’

পাত্রের মা বললেন,

‘সে আসলে সময়, সুযোগ, আয়োজন বেধে বাড়ে কমে আরকি! আমরা মেয়ে দেখতে পারি এবার?’

শাশুড়ি আমাকে ডাক দিলেন। বললেন,

‘নুপুর বউমা! তামান্নাকে নিয়ে চলে এসো তো ড্রইংরুমে…’

আমি তামান্নাকে নিয়ে গেলাম। বুঝতে বাকি রইলো না এই দরদামে কোন মেয়ের বিয়ে নয়, বিক্রি হতে চলেছে। বড়লোকি বিয়েতে কোন মেয়ের বিয়ে হয় না, হয় বিক্রি।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here