#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১৪|
ডিসেম্বর মাসে শীতের হাড় কাঁপতে থাকার কথা থাকলেও উল্টে আরো ডিসেম্বর মাসে চৈত্র মাসের মতো ঘেমে যাচ্ছে ধারা। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের গলার মুছতে মুছতে সামনের দিকে এগোচ্ছে ধারা। মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে আছে। গিয়েছিল ভাবির সাথে একসঙ্গে বেড়াতে কিন্তু ফিরতে হয়েছে একা একা। গতকাল রাতে বড় ভাইয়া গিয়ে ভাবিকে নিয়ে রওনা হয় তার শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভাইয়ার মুখে শুনেছে ভাবির আব্বু নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই নিয়ে খারাপ লাগলেও আবার রাগ হচ্ছে তাকে একা একা এতদূরে পথ আসতে হলো। দুই মামা কাজের স্বার্থে শহরের গেছে। বাড়িতে আর কোন পুরুষ মানুষ না থাকায় ধারা একাই চলে এসেছে। অবশ্য ধরনের নানা অনেকবার বলেছিল ওকে এগিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা তাকে নিষেধ করে একাই চলে এসেছে। ধারা বিরক্ত হয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকায়। আজ সূর্যিমামা যেন ওর সাথে শত্রুতা শুরু করেছে। তা নাহলে এই শীতের দুপুরের এত উত্তাপ ছড়ানোর মানে কি। ধারা হাতের ছোট ব্যাগটা নামিয়ে রাস্তার পাশের ঘাসের উপরে রাখে। ওরনা দিয়ে মুখে লেগে থাকার ঘামের বিন্দু গুলো মুছে আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। গলাটা শুকিয়ে গেছে সেই কখন পানি তৃষ্ণা। আশেপাশে কোন দোকানও নেই। বাজার পেরিয়েছে সেই অনেক আগে। আরও কুড়ি মিনিটের মত হাঁটার পরে কার্তিক কাকার দোকান পরবে পথে। এসব ভেবে ধারা জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে। বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পরে দূরে কিছু একটা চোখে পরলো ধারার। দেখে তো মনে হচ্ছে ছোটখাটো একটা ভিড় হয়েছে। কোন ঝামেলা হয়নি তো আবার। ধারা এগিয়ে যায় দ্রুত পায়ে কি হয়েছে তা দেখার জন্য। আরে এরা তো আমাদের পাড়ার ছেলে এখানে কি করছে? ধারা ছেলেদের মধ্যে একটা ছেলেকে ডাক দিয়ে বলল,
‘ এখানে কী হয়েছে রে সজল?’
ধারার কণ্ঠস্বর শুনে সবাই ওর দিকে তাকায়। বাচ্চা ছেলেগুলো ওকে দেখে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকায়। সজল মন খারাপ করে বলল,
‘ দেখো না আপু আমরা সবাই মিলে ফুটবল খেলছিলাম তখন ভুল করে ফুটবলটা এই শহরের ভাইয়াটার গায়ে লেগে গেছে। আমরা আমাদের ভুল স্বীকার করে ফুটবলটা ফেরত চাইছে কিন্তু সে দিচ্ছে না।’
ধারা মাথা নিচু করে এক নজরে আড়চোখে তাকায়। মুখের দিকে তাকানোর ইচ্ছে তার নেই। মতিনের সাথে ওই ঘটনার পরে কেমন যেন ছেলেদের দেখে অস্বস্তি হয় ওর। জিন্স প্যান্ট আর সু জুতা পড়া। ধারা ওর মাথা নিচু অবস্থায় বলল,
‘ ওরা তো বলল ওদের ভুল হয়েছে। দিয়ে দিন না ওদের ফুটবলটা ওদের।’
পাশে ভ্যান গাড়ি চালক ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমিও তো তখন থেকে তাই বলছি কিন্তু উনি তো কিছু শুনছেন না।’
ধারা একনজরে বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকায়। সবার মুখ গুলো কালো হয়ে গেছে। ধারার কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুজে বলল,
‘ দেখুন বলছি কী ওরা তো বলছে ওদের ভুলে হয়েছে ক্ষমা করে দিন না ওদের। আমি না হয় ওদের হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি।’
ভ্যান গাড়ির বসে থাকা একটা ভদ্রমহিলা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ বাবু এবার বল টা দিয়ে দে বাচ্চাদের। অনেকক্ষণ হয়েছে মজা করছিস আর না, দেখ বাচ্চাগুলোর মুখ কেমন কালো হয়ে গেছে।’
ধারা ভ্যান গাড়ির দিকে তাকায়। একজন মহিলা বসে আছে। বয়সে হয়তো ওর আম্মার সমান কিংবা আম্মার থেকে বড় হতে পারে। পোশাকআশাক দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড় ঘরের বউ তিনি। ছেলেটা বাচ্চাগুলোকে বলটা ফেরত দিলে বাচ্চাগুলো খুশিতে হই হুল্ল করতে করতে আবার মাঠের দিকে যায়। ধারা একনজর বাচ্চা গুলোর দিকে তাকিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভ্যানগাড়ি অতিক্রম করে যাওয়ার সময় ভদ্রমহিলা ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এই মেয়ে শুনো!’
ধারা পা থামায়। একটু ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ জ্বি বলুন।’
তিনি ধারাতে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলল,
‘ নাম কি তোমার? বাড়ি কোথায়?’
ধারা মৃদু স্বরে বলল,
‘ সিদ্রাতুল ধারা। সবাই আমাকে ধারা বলে ডাকে। এখন থেকে একটু সামনেই আমাদের বাড়ি।’
তিনি মৃদু হেসে বলল,
‘ বাহ, খুব সুন্দর নাম তো। আমাদের একটা সাহায্য করবে।’
ধারা ছোট করে বলল,
‘ কী সাহায্য?’
তিনি মৃদু স্বরে বলল,
‘ তুমি শাহেদা বানুর বাড়ি চেনো?’
ধারা কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কোন শাহেদা কথা বলছেন আপনি? এই গ্রামে তো অনেক শাহেদা আছে।’
তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘ তার বড় ছেলের নাম আফজাল। এই গ্রামেরই বাসিন্দা তারা। আসলে অনেক বছর পরে এসেছি তো তাই রাস্তাঘাট ঠিকভাবে চিনতে পারছিনা।’
ধারা হালকা হেসে বলল,
‘ ও আপনি শাহেদা দাদির কথা বলছেন। আমি চিনি তাদের বাড়ি, চিন্তা করবেন না আপনারা আমার পিছন পিছন আসেন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি পথ।’
তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধারা কে বলল,
‘ তুমিও আমাদের সঙ্গে ভ্যানে চড়ে বসে।’
ধারার মনে পড়ে তার সঙ্গে একটা ছেলে আছে। ধারা দ্রুত বলল,
‘ না না আমি হেঁটে যেতে পারবো।’
ধারা ভ্যান চালকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ চাচা আপনি আমাকে অনুসরণ করুন।’
এইটুকু বলে ধারা আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। দাঁড়ালে হয়তো তার কথার সঙ্গে না পেরে তাকে হয়তো ভ্যানে চড়ে বসতে হবে। সে চায়না এমন কাজ করতে। সে এখন আর কোন ছেলের ছায়া মারাতে ও চায়না। এখন কেমন অসস্থি লাগে কোনো অপরিচিত ছেলে আশেপাশে থাকলে। কয়েক কদম হেঁটে গিয়ে কার্তিক কাকার দোকানের সামনে দাঁড়ায় ধারা। ধারা কে দেখে কার্তিক একা দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
‘ কী রে ধারা মা তোর বেড়ানো শেষ এরমধ্যে? আর তোর ভাবী কোথায়?’
ধারা ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
‘ তা শেষ বেড়ানো। ভাবি তার বাবার বাড়িতে গেলে। পরে তুমি তোমার অন্য প্রশ্নগুলো করো আগে আমাকে এক গ্লাস পানি দাও বড্ড পানি পিপাসা পেয়েছে।’
কার্তিক দোকানের ভিতরে গিয়ে তাড়াতাড়ি ধারা কে পানি দিয়ে বলল,
‘ এই আগে বসে পানি খা।’
ধারা পানির গ্লাস শেষ করে মৃদু স্বরে বলল,
‘ বাঁচালে তুমি আমাকে কার্তিক কাকা। আজ যা গরম পড়েছে তাতে জান যায় যায় অবস্থা আমার। এখন জলদি বলো তোমার আর কি কি প্রশ্ন বাকি আছে?’
কার্তিক কাকা ছোট করে বলল,
‘ বলছি তোর ভাবি মানে আমাদের বৌমা কোথায়? সেও তো তোর সঙ্গে গিয়েছিল।’
ধারা মৃদু স্বরে বলল,
‘ ভাবির বাবা কাল হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভাইয়া গিয়ে ভাবিকে নিয়ে তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছে। আমার ওখানে ভালো লাগছিলো না তাই আমি সকালেই চলে এসেছি।’
কার্তিক কাকা চিন্তিত গলায় বলল,
‘ সে কী এখন কেমন আছে বৌমার বাবা।’
ধারা হাতের ব্যাগটা নিয়ে বলল,
‘ সে এখন আগে থেকে ভালো আছে। চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি এখন যাই ওদিকে রাস্তায় একজনকে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি।’
ধারা কার্তিক কাকার উত্তরের অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি রাস্তায় এসে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ দুঃখিত, আমি আপনাদের বলে যায়নি আমার বলে যাওয়া উচিত ছিল। আসলে খুব পানি পিপাসা পেয়েছিল তাই তাড়াতাড়ি করে চলে গেছে কার্তিক কাকার দোকানে।’
ভদ্রমহিলা হালকা হেসে বলল,
‘ আমি বুঝতে পেরেছি তখন তোমাকে দেখে। এত সরি বা দুঃখিত বলার কিছু হয়নি।’
ধারা হেসে দিয়ে বলল,
‘ চলুন তাহলে এবার যাওয়া যাক।’
ভদ্রমহিলার পাশে বসে থাকা ছেলের দিকে এক নজর তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোধক সম্মতি জানায়।
চলবে….