#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১৮|
শেষ বিকেলের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়েছে আজ। মিতা বেগম গায়ে শীতের চাদর জড়িয়ে ঘরের সামনের বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। রাত হয়তো দশটার বেশি বাজে তখন। কিন্তু গ্রামে তো তখন মধ্যরাত বলতে গেলে। তার উপরে হালকা হালকা শীতের আমেজ। এত রাত হয়ে গেল কিন্তু ছেলেটা এখনো বাড়িতে ফেরেনি। সেই রাতের খাবার দাবারের পর্ব শেষ করেই বের হয়েছে। এখনো ফিরছে না সে। খুব চিন্তা হচ্ছে মিতা বেগমের। ইভান কে ফোন করবে তা-ও জো নেই। গ্ৰামে এসেছে পর থেকে ফোনে নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে। কায়েস কিংবা এ বাড়ির কেউ সঙ্গে গেলে হয়তো এত চিন্তা হতো না কিন্তু ইভান তো একা একা বেরিয়েছে। মিতান বেগম বারবার উৎসুক হয়ে বাড়ির সামনের রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। আরো কিছু সময় পার হওয়ার পরে, মিতা বেগমের মনে চিন্তা টা আরো তীব্র ভাবে বাসা বাঁধে। মিতা বেগম বসে থাকা অবস্থায় হাঁসফাঁস করতে শুরু করে। অস্থিরতায় মিতা বেগম বসে থাকতে না পেরে উঠে বারান্দা জুড়ে পায়চারি শুরু করে। ইভান তো বলতে গেলে গ্রামের কিছুই চিনি না কিন্তু এত রাতে সে গেল কোথায়? আবার অন্ধকারে রাস্তাট ভুল করে অন্য রাস্তায় চলে যাইনি? নাকি বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে ফেলেছে? হঠাৎ কিছু শব্দে মিতা বেগমের ভাবনা ছেদ হয়। পায়চারি থামিয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিতা বেগম। ইভান আসছে। ইভান দূর থেকে মিতা বেগমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দ্রুত পায়ে মিতা বেগমের সামনে এসে দাঁড়ায়। ইভানের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। ইভান কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মিতা বেগম কঠোর গলায় বলল,
‘ কোথায় ছিলি এতক্ষণ? এদিকে আমার যে তোর জন্য চিন্তা হয় সেদিকে কোন খেয়াল আছে তোর?’
ইভান ওর আম্মুর দিকে তাকায়। সামান্য সময়ের ব্যবধানে চিন্তায় মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। কেন যে তখন বাড়ি থেকে বের হতে গেল। নিচু গলায় বলল,
‘ সরি আম্মু আমি আর কখনো এমন করব না। আসলে ডিনার করার পরের রুমে গিয়ে দেখি লাবিদ ভাইয়ার অনেকগুলো মিস কল, নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ফোন দিলেও ফোন ঢুকছিল না। তাই বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম ভাইয়াকে ফোন করার জন্য। ভাইয়ার সাথে কথা পর পরই রাহুল ফোন করে তাই আরো দেরি হয়ে যায়।’
মিতা বেগম ইভানের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ ঠিক আছে, ভবিষ্যতে আর যেন এমন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবি। যা এবার ঘুমিয়ে পর অনেক রাত হয়েছে।’
ইভান ওর আম্মুর কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে পরে ওর হাত ঘড়ি দেখে বলল,
‘ কোথায় অনেক রাত হয়েছে আম্মু? রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে এখন, আর তুমি বলছো অনেক রাত হয়েছে।’
মিতা বেগম ধীর গলায় বলল,
‘ তোর আর আমার কাছে হয়তো এটা কোন তেমন একটা গভীর রাত না, কিন্তু গ্রামের লোকজনের কাছে এটা গভীর রাত।’
ইভান ছোট করে বলল,
‘ কিন্তু আম্মু আমার তো এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসছে না। তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি বরং এখানে বসে বাইরের প্রকৃতি দেখি।’
মিতা বেগম চেয়ারে বসে ইভান কে ইশারায় তার পাশের চেয়ারে বসতে বলে। ইভান চেয়ারে বসলে, মিতা বেগম বলল,
‘ আজ বরং আমরা গল্প করি যতক্ষন না তোর ঘুম। কী বলিস তুই?’
ইভান তার ঠোঁটে কোনে হাসি ফুটায়। মিতা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু রাত জাগলে যে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে তার কী হবে? দরকার নেই তোমার আমার সাথে রাত জাগার, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।’
মিতা বেগম হালকা হেসে বলল,
‘ তোকে কে বলল আমি রাত জেগে থাকবো। অল্প কিছুক্ষণ তোর সাথে গল্প করে ঘুমতে যাবো।’
মৃদু হাসে দু’জনে। আড্ডায় মেতে ওঠে দু’জনে। হাজারো রকমের কথা নিয়ে মেতে ওঠে দু’জনে। আড্ডার মাঝে মিতা বেগম হঠাৎ করে বলল,
‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো তোকে?’
ইভান ধীর গলায় বলল,
‘ আম্মু তুমি আমার মা, তুমি আমার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করবে তারজন্য পারমিশন নেওয়ার কি আছে?’
মিতা বেগম মৃদু হেসে বলল,
‘ তা ঠিক, কিন্তু একটা সময়ের পর সবার মধ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার আসে। সেটা ভেবেই কথাটা বলেছি আমি।’
ইভান ছোট করে বলল,
‘ সেটা অবশ্য মায়ের বেলায় প্রযোজ্য নয়। তুমি বলো কি বলবে?’
মিতা বেগম বাড়ির সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ দুপুর বেলা খাবার টেবিলে তুই ধারার কথা শুনে একা একা হাসছিলি কেন?’
কথা শেষ করে মিতা বেগম ইভানের মুখের দিকে তাকায়। অল্পস্বল্প অবাকের ছাপ মুখে। তারপর মৃদু হেসে বলল,
‘ আমি তোমাকে বলতে পারি কিন্তু তুমি প্রমিস কর আমার কথা শুনে তুমি হাসবে না।’
মিতা বেগম কৌতুহলী গলায় বলল,
‘ আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো তুই বল।’
ইভান উদাসীন গলায় বলল,
‘ হেসেছি তার কারণ আছে। আজ পর্যন্ত আমার কম মেয়েদের সাথে উঠাবসা হয়নি, কিন্তু ধারার মতো একটা মেয়েও আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ মেয়েরাই আমার সঙ্গে যেচে কথা বলতে আসে। নানা অজুহাতে কথা বলার সুযোগ খোঁজে। কেউ একনজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেনি আমার থেকে দ্বিতীয় বার অবস্যই তাকিয়েছে। কিন্তু এই মেয়ে, আমার দিকে তাকানোর তো দূরের কথা, ঐদিন তো ভালো করে কথাও বলেনি। হয়তো বাচ্চাদের জন্য ওইটুকু কথা বলেছিল আমার সঙ্গে না হলে হয়তো সেটাও বলত না। ধারা নামের মেয়েটা অন্য সব মেয়েদের থেকে একদম আলাদা। তাইতো এসব কথা ভেবে দুপুর বেলা খাবার টেবিলে একা একাই হেসে ছিলাম।’
মিতা বেগম ইভানের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয়। ইভান চোখগুলো ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায়। মিতা বেগম হাসি থামানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ কোন অজোপাড়া গায়ের একটা মেয়ে আমার ছেলের দিকে তাকায় নি বলে কি আমারে ছেলের মন খারাপ?’
ইভান করুন গলায় বলল,
‘ এর জন্য আমি তোমাকে বলতে চাই নি, এখন তুমিও আমার সঙ্গে মজা করছো!’
মিতা বেগম হাসি থামিয়ে বলল,
‘ না বাবা আমি তোর সঙ্গে মজা করছি না আমি আসলে তোর কথা শুনে হাসি থামিয়ে রাখতে পারিনি রে।’
ইভান মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। মিতা বেগম এক নজর ইভানের দিকে তাকায়। কেমন ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। মিতা বেগম হাসে তা দেখে। মিতা বেগম মৃদু স্বরে বলল,
‘ শোন না বাবু আমি ভাবছি কী জানিস?’
ইভান প্রশ্নবোধক চোখে মিতা বেগমের দিকে তাকায়। তা দেখে মিতা বেগম মৃদু হেসে বলল,
‘ ভাবছি এবার তোর একটা বিয়ে দেবো। তুই কবে না কবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করবি ততদিন আমি বসে থাকতে পারবো না।’
ইভান হা হয়ে তাকায় ওর আম্মুর দিকে। কি কথার মধ্যে কি কথা বলছে আম্মু! বিয়ে? তাও আবার ওর? ইভান অবাক গলায় বলল,
‘ কী বলছো কী আম্মু? বিয়ে করবো আমি? তাও আবার এত তাড়াতাড়ি?’
মিতা বেগম ধীর গলায় বলল,
‘ হ্যাঁ তোর বিয়ে, আমার জানা মতে তোর পছন্দের মানুষ কিংবা কোন গার্লফ্রেন্ড নেই তাহলে তোর তো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। ভাবছি এই গ্রামেরই কোন একটা ভালো মেয়ে দেখে তোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবো। যাইহোক শোন আমি ঘুমোতে যাচ্ছি এখন। তুই ও বেশি রাত জাগিস না গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।’
এই বলে মিতা বেগম উঠে চলে যায়। ইভান ওর আম্মুর কোন কথা বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে আছে ওর আম্মুর যাওয়ার দিকে।
চলবে….