অদ্ভুত প্রেমবিলাস পর্ব-৫০

0
1044

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-৫০|

ধারা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছে কিনা। গতকাল পরীক্ষা দিয়ে এসে ধারা ওর আম্মা কে ইভানের কথা জানায়। সব শুনে ধারার আম্মার কান্না থামছে না। তার আদরের একমাত্র মেয়ে সে তাদের সবাইকে ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমাবে। এসব কথা ভেবে ধারা আম্মা বারবার হু হু করে কেঁদে ওঠে। একে একে বাড়ির সবাই যখন জানতে পারে ধারা চলে যাবে তখন বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। ধারার আব্বাজান আর চাচা জান বাদে বাড়ির সবাই জানে আজ ধারা চলে যাবে। জোনাকি তো কালকে রাতে ধারার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে আর কান্না করেছে। ধারার আম্মা, চাচি জান, দাদি আম্মা সবাই অল্প সময়ের মধ্যে যে যা পেরেছে ধারার জন্য শুকনো খাবার তৈরি করে দিয়েছে। কাল পরিক্ষা দিয়ে আসার সময় ধারা জান্নাত কে জানিয়েছে ধারা আজ চলে যাবে। সব শুনে জান্নাত সারা রাস্তা কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরেছে। সম্রাট ধারার চলে যাবার কথা শুনে কেমন গম্ভীর মুখ করে আছে। জোনাকি ধারার ঘরে এসে দেখে ধারা তৈরি হয়ে গেছে। ধারা জোনাকি ভাবি কে দেখে স্মিত হেসে বলল,

‘ চলে এসেছো ভাবি, ভালো হয়েছে আমি এখনই বেরিয়ে যাব।’

জোনাকি ভাবি ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ খেয়ে যাবি না?’

ধারা ছোট করে বলল,

‘ না।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধারা আবার বলল,

‘ ভাইয়া কোথায় ভাবি?’

জোনাকি ভাবি মলিন মুখে বলল,

‘ তোর ভাইয়া কাল থেকে গম্ভীর হয়ে আছে। কারো সাথে কোন কথা বলছে না। রাতে আমি কী হয়েছে তা জানার জন্য জোর করায় আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিল। ও তোর এইভাবে চলে যাওয়া কিছুই মেনে নিতে পারছে না। সারারাত ঘুমাই নি মানুষ টা। কান্না করে গেছে। তোর চলে যাওয়া দেখতে পারবে না বলে ভোরবেলা উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।’

ধারার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ধারা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল,

‘ ভাবি তুমি ভাইয়াকে ফোন করে আসতে বল। আমি যাওয়ার আগে ভাইয়া কে একবার দেখে যেতে চাই।’

জোনাকি হালকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ধারা আবার বলল,

‘ আব্বাজান কোথায়?’

জোনাকি ধীর গলায় বলল,

‘ আসার সময় উঠোনে দেখে এসেছি, এখন বোধহয় খাবার ঘরে।’

ধারা ওর হাতে ট্রলি নিয়ে জোনাকির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ চলি ভাবি, সাবধানে থেকো। বাড়ির সবার খেয়াল রেখো। আমার ভাইয়া টাকে দেখে রেখো ভাবি। লাবিদ ভাইয়া মেসেজ পাঠিয়েছে সে দশ মিনিটের মধ্যে আমাদের বাড়ির সামনে থাকবে।’

এইটুকু বলে ধারা আর দাঁড়ায় না দ্রুত বের হয়ে ঘর থেকে। ধারার পিছন পিছন জোনাকি ও বড় বড় পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়।

ধারার আব্বাজান মাত্র রুটি ছিঁড়ে মুখে দিয়েছে। এরমধ্যে ধারা কে হাতের ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেবে তিনি হকচকিয়ে ওঠেন। তিনি ভুরু কুঁচকে বলল,

‘ আম্মাজান আপনি এই সাত সকালবেলা ব্যাগ হাতে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?’

ধারার আব্বাজানের কথা শুনে ধারার আম্মা, চাচি জান, দাদি আম্মা সবাই এদিকে চলে এসেছে। ধারা ওর হাতের ব্যাগটা উঠানে রেখে ওর আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,

‘ চলে যাচ্ছি আমি।’

ধারার আব্বাজান অবাক গলায় বলল,

‘ চলে যাচ্ছি মানে? কোথায় চলে যাচ্ছেন আপনি?’

ধারা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমার স্বামীর কাছে।’

ধারার আব্বাজান চেয়ার থেকে উঠে খানিকটা রাগী গলায় বলল,

‘ কোথাও যেতে পারবেন না আপনি। ঘরে যান। আপনার সঙ্গে আমি মতিনের বিয়ে ঠিক করেছি।’

ধারা ওর আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,

‘ তোমার কথা শুনতে আমি বাধ্য নই আব্বাজান।’

ধারার আব্বাজান রেগে চিৎকারের সুরে বলল,

‘ আমি আপনার আব্বাজান! আপনি আমার কথা শুনবেন না তো আর কারো কথা শুনবেন? আমি যা বলব ঠিক আপনাকে তাই করতে হবে। এখন ভাল মেয়ের মত আপনি আপনার ঘরে যান আম্মাজান।’

ধারা মলিন হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

‘ তুমি আমার আব্বাজান। তাই তোমার সব কথা আমাকে শুনতে হবে। তাই না? তাতে যদি তুমি ভুল হও তাও তোমার কথা শুনে হবে? আমাকে কী তোমার মাটির খেলনা পুতুল মনে হয় আব্বাজান? যে নিজের মনের মত করে খেলবে আমাকে নিয়ে! আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো মূল্যে নেই তোমার কাছে? যখন তোমার যা মর্জি হবে তাই করবে আমার সাথে? আমি নাবালিকা অবস্থায় তুমি আমার বিয়ে ঠিক করো একটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষের সঙ্গে। তখন তুমি আমার কাছে জিজ্ঞেস করনি বিয়েতে আমার মত আছে কিনা। এরপরে কয়েকমাসে ঘুরতে না ঘুরতে তুমি আবার আমার বিয়ে ঠিক করো। তখনো জিজ্ঞেস করোনি আমার এই বিয়েতে মত আছে কিনা। আমি যখন বিয়েটাকে মেনে নিয়েছি তখন তুমি উঠে পড়ে লেগেছ আমাদের বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য। কেনো? আমার কী মন বলতে কিছু নেই? সব সময় তুমি তোমার ইচ্ছে মতো কাজ করে যাবে আর তার খেসারত আমাকে দিতে হবে। কেনো তুমি বলতে পারো? আমি হয়তো আগের জন্মে হয়তো কোন ভাল কাজ করেছিলাম তার জন্য এমন ভালো শ্বশুরবাড়ি আমার কপালে জুটেছে। পেয়েছি ইভান এর মত একজন জীবনসঙ্গী। যে তার থেকেও বেশি আমাকে ভালোবাসে। আর তুমি তার থেকে আমাকে আলাদা করতে চাইছিলো? একবারও কী তোমার মনে হয়নি আমার জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত গুলোর নেওয়ার আগে আমার সঙ্গে একবার অন্তত তোমার কথা বলা দরকার ছিল? হয়তো মনে হয়েছিল আবার হয়তো না। তুমি শুধু আমার উপরে না তুমি বাড়ির সকলের উপরে তোমার ইচ্ছেটা চাপিয়ে দাও তাতে তার মত থাকুক কিংবা না থাকুক। বড় ভাইয়া কে অল্প বয়েসে তুমি তোমার সঙ্গে নিয়ে দোকানে বসিয়েছো, তুমি ভাইয়াকে দোকানে নেওয়ার আগে একবার জিজ্ঞেস করেছিলে তাতে ভাইয়ার মত আছে কিনা? এমন তো নয় যে ভাইয়ের লেখাপড়ায় খারাপ ছিল। ভাইয়া তো লেখাপড়াই দুর্ধর্ষ ভালো ছিল। আমাদের হাই স্কুলের স্যার ম্যাডামরা এখনো ভাইয়ার কথা বলে। তারা আফসোসের সুরে বলে ভাইয়া যদি লেখাপড়া করতো তাহলে আজ দেশের দশ জনের মধ্যে একজন হত ভাইয়া। আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি আব্বাজান তাই কখনো তোমার মুখের উপর কথা বলিনি। কিন্তু আজ আর চুপ থাকতে পারছি না। তুমি আমার থেকে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে চাইছো। আমার স্বামী বেঁচে থাকবে তুমি আমার দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন করছো। পাপ জেনেও ধরলাম তুমি আমার সঙ্গে মতিনের বিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন পরে যখন আবার তোমার নতুন করে ইচ্ছে হবে তখন তুমি আবার আমার অন্যত্র বিয়ে দিতে চাইবে। আমি আর তোমার স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে থাকতে পারছি না। চলে যাচ্ছি তোমার স্বেচ্ছাচারিতার রাজ্য থেকে। কালকে আমার ফ্লাইট চলে যাচ্ছি ইতালি বরাবরের মতো আমার স্বামীর কাছে। আমার তেতো কথায় তুমি যদি কষ্ট পেয়ে থাকো তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিও না আব্বাজান। চলি আমি। ভালো থেকো।’

ধারার কথা শুনে ধারার আব্বাজানের মুখ থমথমে হয়ে যায়। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে ধারার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধারা ছলছল দৃষ্টিতে একনজরে ওর পরিবারের সকলের দিকে তাকায়। সবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ধারার আম্মা তো মুখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ধারার দাদি আম্মা কে ওর চাচি জান ধরে কান্না করছে। জোনাকি ভাবি বারবার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুচছে। ধারার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই ধারা ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। লাবিদ ভাইয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে সম্রাট ভাইয়া কথা বলতে। ধারা গিয়ে আর ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। সম্রাট পরম যত্নে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ সম্রাটের সঙ্গে কথা বলে ধারা গাড়িতে উঠে বসে। একটু একটু করে গাড়ির গতি বাড়তে শুরু করে আর ধারার কান্নাও একটু একটু করে বাড়তে শুরু করে।

রুমি ভাবি আর লাবিদ ভাইয়া একে একে ধারা কে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে কী করতে হবে। তাও ধারার মনে মনে ভয় করছে প্রথমবার সে ফ্লাইটে উঠবে তাও আবার একা। অভি ভাইয়া ফোন করে জানিয়েছে সে এয়ারপোর্টে আসবে ধারার সঙ্গে দেখা করতে। রুমি ভাবি ধারার জন্য অনলাইন শপিং করে লেডিস জিন্স, টি-শার্ট,‌ জ্যাকেট আনিয়েছে। ধারা এইসব দেখে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায়। সে আগে কখনো এসব ড্রেস পড়িনি। কিন্তু রুমি ভাবির জেদের কারণে এসব ড্রেস পড়ে ওকে ফ্লাইটে উঠতে হবে।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ইভান কে খোঁজার জন্য ধারা আশেপাশে তাকাচ্ছে। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ধারা দেখতে পায় তার নাম একটা বড় কাগজে লিখে একজন দাঁড়িয়ে আছে। ধারা সেদিকে গিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ওই লোকটা দৌড়ে এসে ধারার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ ভাবিজি আমি হেরি, তোমার দেওর। ইভান আমাকে তোমাকে নিতে পাঠিয়েছে।’

ধারা সামনে থেকে দেখে হেরি কে চিনতে পারে। ধারা চিন্তিত গলায় বলল,

‘ উনি আমাকে দিতে আসেনি কেন ভাইয়া? কোথায় উনি? কেমন আছেন উনি? আজ কতদিন হয়ে গেছে আমি তাকে দেখি না! ঠিক আছেন তো উনি?’

হেরি মলিন গলায় বলল,

‘ চলো ভাবিজি, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি ইভানের কাছে।’

ধারা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ চলুন ভাইয়া।’

গাড়ি এসে থামায় মস্ত বড় একটা বিল্ডিং এর সামনে। ধারার অসুবিধা হয়নি এটা যে একটা হসপিটাল। ধারা ভুরু কুঁচকে হেরির দিকে তাকালে, হেরি আমতা আমতা করে ধারা কে তাড়া দিয়ে হসপিটালের ভিতরে নিয়ে যায়। লিফটে করে ছয় নম্বর ফ্লোরে যাওয়ার পরে ধারা দেখতে পায় একটা রুমের সামনে অনেকগুলো লোক বসে আছে। হেরির সঙ্গে ধারা আর একটু এগিয়ে গেলে লোক গুলো সবাই ওদের দিকে তাকায়। ধারা সেদিকে না তাকিয়ে হেরি কে সমানে ইভানের কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। এরমধ্যে একটা মেয়ে এসে হেরির সামনে দাঁড়িয়ে আহত গলায় বলল,

‘ হু ইজ দ্যা গার্ল উইথ ইউ? আই হ্যাভ নেভার সিন হার বিফোর।’

হেরি মৃদু স্বরে বলল,

‘ আই উইল টেল ইউ লেটার, রোজা।’

রোজা নামটা শুনে ধারা মেয়েটা দিকে তাকায়। ছবিতে দেখেছি ইভানের সব বন্ধুদের। তাহলে এই মেয়েটা ইভানের বন্ধু রোজা আপু। হেরি ধারা কে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে। ওদের পিছন পিছন ইভানের অন্য সব বন্ধুরাও এসেছে। রুমে ঢুকেই থমকে যায় ধারা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তীব্রভাবে বুকের ধুক ধুক শব্দটার শুনতে পাচ্ছে ধারা। ছলছল চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে ধারা। ইভান হসপিটালের বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মাথা, বাম হাত, বাম পায়ে ব্যান্ডেজ করা। ধারা বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ইভানের দিকে। আলতো হাতে ইভানের বাম পায়ে হাতে রাখে। কারো স্পর্শ পেয়ে ইভান চোখ খুলে তাকায়। ইভান চোখের সামনে তার প্রিয়সি কে দেখতে পেয়ে একগাল হেসে বলল,

‘ বিল্লু রানী।’

ধারা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না, দৌড়ে গিয়ে ইভান কে জাপটে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। ধারা কান্নার মাঝে পাগলের মত ইভানের সমস্ত মুখের চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিতে শুরু করে। ইভান ধারা কে শান্ত করার জন্য বলল,

‘ কান্না করছো কেন? আমি তো একদম ঠিক। কান্না করো না।’

ধারা সে কোন কথা স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। ইভানের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ইভান আলতো হাতে ধারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। এদিকে রুমে উপস্থিত হেরি বাদে সবাই বিস্ময়কর দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভানের মত একটা রাগী ছেলেকে কেউ এইভাবে জড়িয়ে ধরে আছে ভেবেই আতংকে উঠছে সবাই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here