#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-৫২|
ওই ঘটনার পরে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। পুরান হয়েছে অনেকগুলো ক্যালেন্ডারের পাতা। ইভানের ভালোবাসার সাত রঙা রংধনুতে রাঙিয়ে নিয়েছে ধারা কে। ধারার সেবা যত্নে ইভান সাড়ে তিন মাসের বেশি সময় মধ্যে একদম সুস্থ হয়ে ওঠে। সুস্থ হয়ে ওঠার পরে ইভান বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে একটা ছোট ব্যবসা চালু করে। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই সফল হয়। ইভান নিজের নতুন ব্যবসা অন্যদিকে ধারার মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং, বাড়িতে গাইড করা সবকিছু ইভান একহাতে সামলেছে। ইভান অসুস্থ থাকা অবস্থায় একদিন ধারা রুমি ভাবির সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়, কথার ছলে জানতে পারে ওর আব্বাজানের কসম কাটার কথা। সেই থেকে ধারা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে পরিবারের কাছ থেকে। ধারা চায় না ওর জন্য পরিবারের লোকজনের কোন ক্ষতি হোক। ইভান ধারার যথেষ্ট খেয়াল রাখেছে। সব সময় আগলে রেখেছে।
ধারা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা টেডি বিয়ার জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ধারার ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে বাচ্চা টার পাশে বসে। ইভান আর ধারার কলিজার টুকরা আদরের একমাত্র মেয়ে ইহিতা। ইহিতার আজ জন্মদিন ছিল। ইহিতার পাঁচ বছরের জন্মদিন উপলক্ষে ইভান আর বন্ধুরা মিলে বিশাল আয়োজন করেছিল। এতক্ষণ হই হুল্ল করে একটু আগে মেয়েটা ঘুমিয়েছে। ধারা ইহিতার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে অতীতের কিছু কথা চিন্তা করে। মেডিকেলে চান্স পাওয়ার কিছুদিন পরে জানতে পারে ধারা আর ইভান বাবা মা হতে চলেছে। খবরটা শোনার পরে খুশির অন্ত ছিল না দুজনের মাঝে। ইভান তো হসপিটালে সবার সামনে ওকে পাঁজাকোলে করে কোলে তুলে নিয়েছিল। নতুন অতিথির আগমন এর কথা শুনে ইভানের যত্ন হাজার গুণ বেড়ে যায় ধারার প্রতি। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় নতুন অতিথির জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো ইভান। ধারার খুব মনে আছে ইহিতাতা জন্মবারে সময় ধারা কী জালান না জ্বালিয়েছে ইভান কে। আর ওই বেচারা হাসিমুখে সবকিছু মেনে নিয়েছে। রোজা, মিহু প্রতিদিন এসে বসে থাকতো ধারার কাছে। ইহিতা পৃথিবীতে আসলেই কে কী করবে তাও ওকে গল্প করে শোনাতো। রোজা আর হেরির দুজনের আম্মু কিছুদিন পরপর ধারার জন্য নতুন নতুন পদের রান্না করে নিয়ে আসতো। ইহিতা যেদিন পৃথিবীতে আসে সেদিন ইভান সব থেকে বেশি কান্না করেছিল। অপারেশন থিয়েটারে ধারা কে নেওয়ার পরে ডক্টর এসে ইভান কে জানায় ধারার অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল, ভালো-মন্দ যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। ব্যস্ত, ডক্টরের কথা শোনার পরে ইভান বাচ্চা ছেলেদের মত কান্না শুরু করে দেয়। হেরি বা রাহুল কেউ ওকে সামলে রাখতে পারেনি। ইভানের ভালোবাসার জোরেই হয়তো ধারা সে যাত্রায় বেঁচে গেছিলো। এসব কথা ধারা সুস্থ হওয়ার পরে রোজা আর মিহু ভিডিও করে রেখেছিল সেই ভিডিও দেখে ধারা দেখেছে। ধারা আর ইভানের মেয়ের নাম রেখেছে ধারা, ইভানের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘ইহিতা’। ইভানের অদ্ভুত ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে ধারার দিনগুলো ভালোই কেটেছে। মেয়ের দেখাশোনা বউয়ের লেখাপড়া সমস্ত কিছু দক্ষ হাতে সামলিয়েছে ইভান। ধারা কে কখনো অভিযোগ করার সুযোগ করতে দেয়নি মানুষটা। দুই বছর আগে ধারা ডাক্তারী পাশ করেছে, দুই বছর যাবত ধারা অন্যান্য কোর্স করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। রাহুল আর মিহু বিয়ে করে নিয়েছে তিন বছর হলো। বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান ইন্ডিয়াতে হয়েছে। ইহিতা তখন খুব ছোট থাকায় ধারা আর ইভান ওদের বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে পারেনি। হেরি রোজা কে ভালোবাসতো, কিন্তু রোজার গুন্ডামির জন্য ওকে ভালোবাসার কথা বলতে সাহস পায়নি বেচারা। একদিন অফিস শেষ করে হেরি বিজনেস ক্লায়েন্টের মেয়ের সঙ্গে ক্লাবে গেছিলো রোজার সামনে দিয়ে। রোজা রেগে বাড়ি ফিরে ঘরের সমস্ত জিনিস ভাঙচুর করে ওর পাপা কে বলে দুই দিনের মধ্যে ওর আর হেরির বিয়ে দিতে না পারলে রোজা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। ওই ঘটনার পনের দিন পরেই পারিবারিকভাবে ওদের বিয়ে হয়ে যায়। এতগুলো বছর এ ধারার ওর পরিবারের কথা খুব মনে পড়েছে। বিশেষ করে ইহিতা পৃথিবীতে আসার সময়। কিন্তু ধারা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেনি ওর আব্বাজান এর কথা চিন্তা করে। ধারা ইতালিতে এসেছে পর আর একবারও দেশের মাটিতে পা রাখে নি সে। শুধুমাত্র জান্নাতের ধারার যোগাযোগ আছে। জান্নাতে সেও এখন আর গ্রামে থাকে না। ধারা গ্রাম থেকে চলে আসার পরে, জান্নাত তার দাদার বাড়িতে চলে গেছিলো। জান্নাতের বড় চাচা জান্নাত এবং ওর একটা চাচাতো বোনের সাথে জন্য মালয়েশিয়া একটা ইউনিভার্সিটি তে এপ্লাই করেছিল। ভাগ্যের জোরে দু’জনেই চান্স পেয়ে যায় সেই ইউনিভার্সিটিতে। এক বছর হয়েছে তারা লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরেছে। জান্নাতের সঙ্গে অভির কোনো যোগাযোগ নেই। প্রথম দিকে জান্নাত অনেক চেষ্টা করেছিল অভির সঙ্গে যোগাযোগ করতে, কিন্তু উল্টো দিক দিয়ে কোন সাড়া না পাওয়ায় জান্নাত পিছিয়ে এসেছে। জান্নাত বর্তমানে দেশে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ পদে চাকরি করে। জান্নাত যখনই ফোন করবে ইহিতা কে দিয়ে পাগলামি শুরু করে দেবে। কবে তার ইহিতা কে নিয়ে তারা দেশে যাবে তা জিজ্ঞেস করে ধারা আর ইভানের মাথা খেয়ে ফেলে জান্নাত। ইহিতা কে তার বড় দুই চাচা ও ভীষণ ভালোবাসে। তিন ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে বলে কথা। আর ইহিতা ও হয়েছে তেমন টোল পড়া গালে হাসি দিয়ে সবার মন জয় করার অধিকারীনি সে। মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে একটু ঝুঁকে চুমু দেয় মেয়ের কপালে ধারা।
ধারা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ইভান তাকে অনেকক্ষণ আগে বেলকুনিতে ডেকেছিল। ধারা ইভান কে যেতে বলে ও ফ্রেশ হতে গেছিলো। ধারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এক নজর দেখে পা বাড়ায় বেলকুনির দিকে। বেলকুনিতে রাখা বিছানায় শুয়ে ইভান খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বেলকুনিতে ছাদ না থাকায় সহজে খোলা আকাশে সৌন্দর্যতা উপভোগ করা যায়। ধারা হেঁটে গিয়ে ইভানের পাশে বসলে ইভান ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ফ্রেশ হতে এত সময় লাগে? সেই কখন থেকে ওয়েট করছি তোমার সঙ্গে প্রেম বিলাস করবো বলে।’
ইভানের কথা শুনে ধারা মুচকি হেসে বলল,
‘ তুমি এমন কেন বলবে আমায়? আকাশে যখন চাঁদ থাকবে না তখন তুমি আমাকে নিয়ে হয় বেলকুনিতে না হয় ছাদে গিয়ে তোমার প্রেম বিলাস করবে। তোমার এই অদ্ভুত ধরনের কাজ দেখে আমার মনে হয় তুমি শুধু প্রেম বিলাস করার জন্য নয় অদ্ভুত প্রেম বিলাস করার জন্য আমাকে তোমার কাছে নিয়ে আসো।’
ধারা আগের মত ইভান কে আপনি আজ্ঞে করে না। ইভানের জোরাজুরিতে ধারা ইভান কে তুমি বলে সম্মোধন করে। ধারার কথা শুনে ইভান ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘ জানো যখন তাহলে বারবার কথা টা জিজ্ঞেস করো কেন বিল্লু রানী? তুমি তো জানো আমি অদ্ভুত। আমার ভালোবাসার ধরন অদ্ভুত।’
ধারা বিড় বিড় করে বলল,
‘ আর আমি এই অদ্ভুত মানুষ টাকেই নিজের থেকে বেশি ভালোবাসি। এই দুইটি মানুষকে ঘিরে আমার বেঁচে থাকা। আমি ভালোবাসি দু’জনকে, ভীষণভাবে ভালোবাসি।’
ইভান শোয়া থেকে উঠে ধারার দিকে ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
‘ তা আমি জানি। নতুন করে বিড় বিড় করে বলতে হবে না। স্পষ্ট ভাবে বললেই তো পারো।’
ধারা ইভানের দিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
‘ তোমার এই রোমান্টিক কথাবার্তা বলার অনেক টাইম পাবে, আগে ডিসাইড করো কাল সকালে তোমার মেয়েকে কিভাবে সামলাবে? জুয়েল ভাইয়ার কথা শুনে একটু আগে তোমার মেয়ে কেমন এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিল মনে আছে? এখন কাল সকালে কিভাবে ওকে সামলাবে তাই চিন্তা করো।’
ইভান চিন্তিত গলায় বলল,
‘ ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ভাইয়া আমাদের দেশে নেওয়ার জন্য এখন আমার মেয়েটা কে উস্কে দিচ্ছে।’
ধারা মৃদু হেসে বলল,
‘ তা আর কী করবে? আমি ইতালি এসেছি পরে তুমি একবারও দেশে গিয়েছো? উল্টে ভাইয়ারা, ভাবিরা, বাচ্চারা সবাই তিনবার এসে ইতালি থেকে ঘুরে গেছে। তোমার অফিস, আমার লেখাপড়া, ইহিতার স্কুল সব মিলিয়ে আমাদের যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমার কোর্স ও শেষ হয়ে গেছে, এই সুযোগে চলো না আমরা দেশে থেকে কিছুদিনের জন্য ঘুরে আসি। আমাদের মেয়েটা ওর দাদার বাড়ি দেখতে পারবে।’
ইহিতার জন্মদিন উইশ করে জুয়েল ইহিতা কে বলেছিল, ইহিতা এবার দেশে আসলে জুয়েল নিজে ইহিতা কে কক্সবাজার, সাজেক, রাঙ্গামাটি ঘুরতে নিয়ে যাবে। জুয়েল তার উপরে চালাকি করে কক্সবাজার আর সাজেকের কয়েকটা ভিডিও পাঠিয়ে দিয়েছে। তা দেখে ইহিতার উত্তেজনার শেষ নেই। এত সুন্দর জায়গা সে এখনি যাবে ঘুরতে। পরে ধারা ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। ইভান এসব কথা চিন্তা করে বলল,
‘ কথাটা তুমি ভুল বল নি। মেয়েটা জন্মের পর থেকে একবারও দেশে যায়নি। তার উপরে দুই ভাইয়ার জান ইহিতা। আমি এটিকের কাজ গুছিয়ে নিয়ে সামনের সপ্তাহে আমরা দেশে যাব কেমন!’
ধারা হঠাৎ করে ইভানের বুকে মাথা রেখে বলল,
‘ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি কী জানো? তুমি, তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। কিছু বলার আগেই তুমি আমার মনের কথা বুঝে নেয়।’
ইভান ধারার পিঠে হাত রেখে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে। হঠাৎ কারো কথা শুনে দুজনে চমকে উঠে বেলকুনির দরজার দিকে তাকায় ইহিতা ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। তা দেখে দুজনে হেসে দেয়। এটা নতুন কিছু নয় ইভান আর ধারা যখন বেলকুনিতে বা ছাদে বসে রাত জাগে তখন ইহিতা ঘুম থেকে উঠে গুটি গুটি পায় ওদের কাছে চলে যায়। ইহিতা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
‘ পাপা, হোয়াট আর ইউ ডুইং হেয়ার? ইটস মাম্মা পাপা টেলিং হার ওয়েইর্ড ওয়েইর্ড স্টরি এগেইন?’
ধারা ইভানের বুকে মাথা রাখা অবস্থায় হেসে বলল,
‘ ইয়েস মাম্মা।’
ইভান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ পাপা, ইউ কাম টু আস।’
ইহিতা দৌড়ে গিয়ে ধারার কোলে বসে ইভানের গলা জড়িয়ে ধরে। ইহিতার এমন কান্ড দেখে ধারা আর ইভান দুজনে শব্দ করে হেসে দেয়।
চলবে….