অদ্ভুত প্রেমবিলাস পর্ব-৫৬

0
679

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-৫৬|

ধারার দাদি আম্মা দুপুরের পর থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে লাঠি ভর দিয়ে বসার ঘরের সোফায় বসে আছে। খুব ক্ষেপে আছেন তিনি আজ একটা ফয়সালা করে তার পরে তিনি ছাড়বেন। ধারার আম্মা চাচি জান ভয়ে কাটা হয়ে আছে। তাদের শাশুড়ির এমন রূপ তারা কমই দেখেছেন। তার আদরের নাতনি মেয়ে হয়েছে অথচ তিনি জানেন না। তাকে এসব কথা শুনতে হলো কায়েসের মুখে। তার নাতনি নাত জামাই দেশে ফিরেছে। কায়েস আজ সকালে এসেছিল এ বাড়িতে। কায়েস এ বাড়িতে এসে সোজা দাদি আম্মার ঘরে চলে যায়। কাল কায়েসের সঙ্গে তার নাতনি নাত জামাইয়ের দেখা হয়েছে। কায়েসের মুখে সব কথা শুনে তিনি ভয়ঙ্কর রকম রেগে যান। ধারার দাদি আম্মা বসার ঘর থেকে তার বৌমা দের উদ্দেশ্যে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,

‘ এই হতচ্ছাড়া দুটো এখনো বাড়িতে আসে না কেন? ফোন লাগাও বৌমা রা জলদি বাড়িতে আসতে বলো। অন্য দিন তো বেলা একটা বাজার আগেই বাড়িতে এসে হাজির হয়, আর আজ আড়াইটা বেজে গেছে এখনো বাড়িতে আসছে না কেন হতচ্ছাড়া দুইটা? নাতবৌ দুটো কোথায় গেল? কাজের সময় কাউকে পাওয়া যায় না।’

রান্না ঘরে বসে ধারার চাচি জান ধারার আম্মা কে মৃদু স্বরে বলল,

‘ আপা আম্মা তো আজ খুব ক্ষেপে আছে, মনে হয় আজ দক্ষযজ্ঞ হয়ে যাবে।’

ধারার আম্মা রাগ দেখিয়ে বলল,

‘ হলে হোক আমিও তাই চাই। একমাত্র আম্মা ই পারবে ওই লোকটার ত্যাড়ামি বের করতে। ওই লোকটার জন্য আমার সাজানো গোছানো সংসার টা ছন্নছাড়া। আমার মেয়ে টা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর তিন ভাইয়ের মুখের হাসি ও চলে গেছে। তোর ভাইজানের ভিম রতি জন্য আজ আমাদের এই অবস্থা। আমাদের কপাল দেখ, মেয়ে জামাই দেশে ফিরেছে আর আমরা কেউ জানিনা। এসব কিছু হয়েছে ওই লোকটার জন্য।’

ধারার চাচি জান ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ তা তুমি ভুল কিছু বলনি আপা। কাল বড় বৌমার ফোনে আমাদের ধারার মেয়ের ছবি দেখে তো আমার খুব ইচ্ছে করছিল তখনই ওকে কোলে নিয়ে খুব আদর করি। কী মিষ্টি দেখতে মেয়েটা।’

ধারার আম্মা কল্পনার জগতে থেকে আনমনে বলল,

‘ হুম।’

এর মধ্যে বাইরে পরিচিত গলার স্বর শুনতে পায়, ধারার আব্বাজান আর চাচা জান চলে এসেছে। দুজনে তাড়াতাড়ি হাতের কাজ রেখে বসার ঘরে আসে। ধারার দাদি আম্মা তার ছেলেদের বাড়িতে ঢুকতে দেখে খানিকটা রাগি গলায় বলল,

‘ ওই ওইখানে দাঁড়া তোরা।’

দুজনে চমকে ওঠে তার আম্মার দিকে তাকায়। তাদের আম্মা এখন এই সময় এখানে বসে আছে। ধারার চাচা জান চিন্তিত গলায় বলল,

‘ আম্মা তুমি এখন এখানে বসে আছো? কিছু কী হয়েছে আর আমরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে কেনো বলেছো?’

ধারার দাদি আম্মা মৃদু চিৎকারের সুরে বলল,

‘ তোরা আর হওয়ার কী বাকি রেখেছি শুনি? অনেক তোদের ত্যাড়ামি অনেক সহ্য করেছি আর না। তোর বড় ভাইকে ভালো করে বলে দে। দুই দিন। মাত্র দুই দিন এরমধ্যে আমার নাতনি, নাত জামাই আর সোনামনি কে আমি যেন এই বাড়িতে দেখতে পাই। আমার এই কথার যদি অন্যথা হয় তাহলে তোদের দুজনকে ঘাড় ধরে এ বাড়ি থেকে বের করে দেবো।’

ধারার চাচা জান মিনমিন করে বলল,

‘ আম্মা তা কিভাবে সম্ভব? ওরা তো ইতালিতে আছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে কী হবে?’

ধারার দাদি আম্মা ধমক দিয়ে বলল,

‘ আগে আমার সব কথা না শুনে, কথার মাঝে কথা বলিস কেন? তিন-চারদিন হয়েছে ওরা দেশে ফিরেছে। এখন কিভাবে ওদের বাড়িতে আনবি তা আমি জানিনা কিন্তু দুই দিনের মধ্যে যদি আমি ওদের আমার বাড়িতে দেখতে পাই। আর যদি তা না করিস তাহলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি তোদের দুজনকেই ঘাড় ধরে আমার বাড়ি থেকে আমি বের করে দেব। তখন দুই ভাইয়ের গলা ধরে গিয়ে গাছ তলায় রাত কাটাবি।’

ধারার দাদি আম্মার ধমক শুনে ধারার আম্মা আর চাচি জান মুখ টিপে হেসে দেয়, আর দুই ভাই শুকনো গলায় ঢোক গিলে।

ইহিতা, ধারার ভাসুরদের দুই ছেলে, জান্নাত মিলে সমস্ত বাড়িময় দৌড়াদৌড়ি করছে। ইহিতার খুশির অন্ত নেই। সে আজ আর খালামনি কে পেয়েছে। এতদিন শুধু তার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছে দুষ্টুমি করেছে আর আজ সামনা সামনি দুষ্টুমি করছে। জান্নাত কাল রাতের ঢাকায় এসেছে। আজ সকাল সকাল চলে এসেছে সে তার বেস্ট ফ্রেন্ড এর সঙ্গে দেখা করতে। তবে এখন পর্যন্ত সে তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে পারিনি। তার আগেই ইহিতা তার কোলে উঠে দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছে। ইভান ওর বড় ভাইয়াদের এদের সঙ্গে আজ ওদের অফিসে গেছে। বড় ভাইয়ারা এক প্রকার জোর করে তাকে নিয়ে গেছে। ধারা ভাবিদের সঙ্গে রান্না করে তাদের সাহায্য করছে। অবশ্য তারা ধারা কে বার বার বলেছে জান্নাতের সঙ্গে গিয়ে গল্প করতে। আর ধারা হাসি মুখে উত্তর দিয়েছে, ‘ওরা তো এখন খেলছে। খেলা শেষ হলে ওর সঙ্গে জমিয়ে বসে আড্ডা দিব। ততক্ষণ তোমাদের সঙ্গে থাকি।’ তারপরে ওরা তিন জা মিলে গল্প করতে করতে রান্না শেষ করে ফেলে। অতিরিক্ত দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করার ফলে তিন বিচ্ছু ক্লান্ত হয়ে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা জান্নাত কে ওর রুমে বসিয়ে রেখে নিচে এসেছে কফি বানাতে। কফি নিয়ে বসে পরে দুজনে আড্ডা দিতে। কথার শেষ নেই। কখনো হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে উপর পড়ছে আবার কখনো একজন আর একজনকে মারতে শুরু করে। ওদের কথার মাঝে হঠাৎ করে ধারা জান্নাতের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ আর কতদিন এইভাবে থাকবি জীবন টাকে আর একবার সুযোগ দিবি না? দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা না তোর প্রথম ভালোবাসা। যে মানুষটা তোকে বুঝে নিন তার জন্য তুই কেন কষ্ট পাবি? নতুন করে সাজিয়ে নিয়ে জীবনটাকে। ভুলে যা তাকে।’

জান্নাত জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ রে তোর কথাই ঠিক। আমার উচিত জীবনটা কে আরেকবার সুযোগ দেওয়া। এতগুলো বছর আমি শুধু তাকে একতরফা ভালোবেসে গেছি এর পরিবর্তে আমি কী পেয়েছি? অবহেলা, অবহেলা আর অবহেলা। তুই ইতালিতে চলে যাওয়ার পরে আমি অনেক চেষ্টা করেছি আমার একতরফা ভালোবাসা কে একটা নাম দিতে। কিন্তু তার দিক থেকে কোন আগ্রহ ছিল না। দিনে হাজার বার ফোন দিতাম তার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলার জন্য কিন্তু সে আমার ফোনটা রিসিভ পর্যন্ত করতো না। পরে হয়তো আমার পাগলামিতে বিরক্ত হয়ে ফোন নাম্বার টা পর্যন্ত চেঞ্জ করে ফেলেছে। আমি বিহীন তার জীবন খুব সুখে আছে। আমি তার জীবনে থাকি কিন্তু বা না থাকি তাতে তার বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই।’

ধারা চোখ গুলো ছোট ছোট করে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তোর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে তুই ভাইয়ার খোঁজ খবর রাখিস। কিন্তু তুই তো বলেছিস আমি ইতালি চলে যাওয়ার পর থেকে তোর সঙ্গে ভাইয়ার আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।’

জান্নাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহত গলায় বলল,

‘ গতকাল রাতে সিলেট থেকে ফেরার সময় তার সঙ্গে আমার বাসে দেখা হয়েছে। সে কেন সিলেট গেছিলো তা আমি জানিনা? কিন্তু কালকের বাসের অধিকাংশ লোকজনই কোন কোম্পানি কিংবা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমপ্লয়ী ছিল। সিলেট একটা বিদেশী কোম্পানী এসেছিল। তাদের সঙ্গে ডিলের জন্য অধিকাংশ কোম্পানির এমপ্লয়ীদের সিলেটে পাঠানো হয়েছিল। সেও হয়তো সেই কারণে সিলেট শহরে গেছিল। আবার এটাও হতে পারে সে তার জীবন সঙ্গীকে নিয়ে ঘুরতে গেছিলো সিলেট শহরে। সে আমাকে দেখেনি আমি তাকে দেখেছি। আমার মুখের হিজাব দিয়ে ঢেকে রাখার কারণে সে আমাকে চিনতে পারেনি। তার মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সে বেশ সুখে আছে। তার পাশের সিটে একটা মেয়ে বসে ছিলো। বেশ সুন্দরী মেয়েটা। কথা বলার মাঝে মেয়েটা তার হাত ধরেছে বার কয়েক। খুব মানিয়েছে তাদের দুজনকে। আমি আর এসব ভেবে কষ্ট পাবো না। আজ সকালে আম্মু বলেছে আমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। শুক্রবার আমাকে দেখতে আসবে। পছন্দ হয়ে গেলে এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ে। আম্মুর মুখে শুনেছি আমার চাকরি নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। ভাবছি আবার বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দেবো। এভাবে তো আর জীবন চলে না। নতুন করে ভালো থাকার চেষ্টা করব।’

জান্নাতের চোখে পানি দেখে ধারা জান্নাত কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। জান্নাত আর নিজের সামলাতে না পেরে ধারা বুকে মুখ লুকিয়ে শব্দ করে কেঁদে দেয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here