অদ্ভুত প্রেমবিলাস পর্ব-৩১

0
1011

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-৩১|

নিস্তব্ধতা! গভীর রাতে পাতার গায়ে নিশির পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাশে কদম গাছের পাতার গায় থেকে টিপটিপ করে নিশির পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শীতের গভীর রাতে মৃদু বাতাসে কদম গাছের দোলনাটা হালকা দুলছে। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরেও জোনাকি কিছু না বলায় ইভান মৃদু স্বরে বলল,

‘ ভাবি তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে আমাকে!’

জোনাকি আমতা আমতা করতে করতে বলল,

‘ আমি জানি না তুমি কথাগুলো কিভাবে নিবে? কিন্তু এই কথাগুলো তোমার জানা দরকার। ধারার আগে একবার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বিয়ের আসর থেকে বিয়ে ভেঙে যায়। পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কারণ হলো ধারার হাতের আঙ্গুলের একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা ওর জন্মগত নয়। আমার দাদা শ্বশুর যে বছর মারা যায় সে বছর থেকে ওর হাতে সমস্যা দেখা দেয়। আমরা চেয়েছিলাম ওর হাতের জন্য বড় ডাক্তার দেখাতে কিন্তু ও এইসবে ভিশন ভয় পায়। ওকে ডাক্তারের কাছে যাওয়া আগের দিন সে কী কান্না ওর। কিছুই যাবে না ও ডাক্তারের কাছে। ওর কান্না দেখে আমার শশুর আব্বা ডাক্তারের কাছে যাওয়া আর্জেন্ট ক্যানসেল করে। এরপর থেকে কেউ ওর হাত বা হাতের আঙ্গুল নিয়ে কথা বলবে ও মন খারাপ করে থাকে। মাঝেমধ্যে তো সবার আড়ালে কাঁদে ও। কাউকে বুঝতে না দিলে হবে কি, অতিরিক্ত ফর্সার কারণে কান্না করলে চোখ মুখ ফুলে ওঠে। তখন আমরা বাড়ির সবাই বুঝে যাই। আমি জানি…

জোনাকি আর কিছু বলার আগে ইভান জোনাকি কে থামিয়ে মৃদু হেসে বলল,

‘ ভাবি আমি এসব কথা জানি। নতুন কিছু থাকলে তা বলতে পারো।’

জোনাকি অবাক চোখে তাকায় ইভানের দিকে। ইভান তা বুঝতে পেরে আবারো ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,

‘ ধারা সম্পর্কে সম্পূর্ণ খোঁজখবর নিয়েই আম্মু আমার সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছে। ওর বিয়ে ঠিক হওয়া, বিয়ে ভাঙ্গা, এভরিথিং আমি আর আম্মু জানি। তুমি এগুলো নিয়ে চিন্তা করো না ভাবি। আমি তোমার ননদকে সামলে নিবো।’

ইভানের কথা শুনে জোনাকি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ভাই আর একটা কথা, ধারা মেয়েটা ভীষণ দুষ্টু, কিন্তু তার থেকেও বেশি আবেগী। ওকে কখনো অবহেলা করো না। ও যদি কখনো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে তুমি ওকে অবহেলা করছো, তাহলে তোমার থেকে দূরে যেতে এক মিনিটও সময় নিবে না ধারা। বড্ড আবেগি মেয়েটা। তাই ভাই তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আমার ননদটাকে কখনো কষ্ট দিও না। তোমার ভালোবাসা দিয়ে ওকে একদম আগলে রেখো।’

রুমি এসে জোনাকির হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘ ভাবি তুমি চিন্তা করো না। আমাদের ইভান এমন ছেলে না যে ও ধারা কে কষ্ট দেবে। ও কাউকে ভালোবাসলে ওর সবটা দিয়ে ভালোবাসবে। কিন্তু ওর ভালোবাসার ধরনটাই আলাদা। তাছাড়া যেখানে আমার শাশুড়ি আম্মু ধারা কে ইভানের বউ হিসেবে নির্বাচন করেছে। সেখানে ইভানের কি সাধ্য আছে ওকে কষ্ট দেওয়ার। তাহলে কি আমার শাশুড়ি আম্মুকে ছেড়ে দেবে ভেবেছো, উঁহু, কখনো না। পিঠের ছাল তুলে নিবে।’

শেষের কথাটুকু বলে রুমি খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করে। রুমির সঙ্গ দিতে জোনাকি ও খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করে।

দরজা ঠেলে হুরমুড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ইভান। পিছন থেকে তার গুণধর দুই ভাবি তাকে ধাক্কা দিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের কিছু বলার আগেই ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয় তারা। ইভান ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকায়। এতক্ষণ তাকে নিয়ে বাইরে দুজন ভাবি খুব মজা করছিলো। ইনিয়ে বিনিয়ে বারবার লজ্জায় ফেলতে চেয়েছিল ইভান কে। কিন্তু ইভান উল্টো তাদের দুই একটা কথা শুনিয়ে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। এসব ভেবে মৃদু হাসে ইভান। দরজা বন্ধ করে পিছন ঘুরে তাকায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় ইভানের। সরল চোখ দুটো অবস্থান করছে বিছানায়। ছোট কোনো পরী ঘুমিয়ে আছে গায়ে লেপ জড়িয়ে। ইভান সে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। ইভান নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একা একা বিড়বিড় করে বলল,

‘ প্রিয়সি, প্রিয়তমা, না কী ধারা কী বলে ডাকবো এই লিটিল এঞ্জেল কে?’

ইভানের হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। আহ্! নিজের ডান হাতে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে ইভান। বিধাতা কী আজ তাকে মেরে ফেলতে চাইছে! ইভান ধীর পায়ে গিয়ে খাটের কোনায় দাঁড়ায়। ঘুমের মধ্যে ও ঠোঁটের কোণে সেই মায়াবী হাসি রয়েছে তার। তার টানা টানা চোখে কাজল পড়ানো। উফ কি নিদারুন দৃশ্য। ইভান সে দিশেহারা। ভীষণ ভাবে দিশেহারা। অনেকটা পাগলের মত হয়ে ধারার পাশে বিছানায় বসে ইভান। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার ছোট্ট পরীর দিকে। ইভান সে ধীরে ধীরে নিজের হাতে থাকা কালো পাথরের আংটি টা খুলে ধারার বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে আংটি টা পড়িয়ে দেয়। খুব ধীরে যত্ন করে চুমু দেয় হাতে। কাঁপা কাঁপা হাতে ধারার মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগলো। ইভান চোখের পলক ফেলছে না। যদি সব স্বপ্ন হয়? ধোঁয়াশা হয় সবকিছু উড়ে যায়। তখন? তখন কী হবে তার? দম বন্ধ হয়ে তো মরেই যাবে সে। ধারা ঘুম কাতুরে হয়ে ইভানের ওর মাথায় দেওয়া হাতটা হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরে ধারা। পুরো শরীর কাঁপছে তার। অনুভূতিতে ভেসে যাচ্ছে ইভান। আজ রাতে বোধহয় না ইভান ঘুমাতে পারবে। আরো একটি রাত নির্ঘুম কাটবে তার।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ইভান এখনো তাকিয়ে আছে তার বুকে থাকা প্রিয়সির দিকে। সারারাত না ঘুমিয়ে তাকিয়ে ছিল তার প্রিয়সির দিকে। ঘুমের ঘোরে ধারা বারবার ইভান কে জাপটে ধরেছে। ধারার এমন নিদারুণ অত্যাচারে দিশেহারা হওয়ার জোগাড় ইভানের। ইভানের হাত সারা রাত ধারার মাথায় হাত বুলিয়ে গেছে। ধারা ঘুমের ঘোরে দুই একবার ইভান কে জাপটে ধরা অবস্থায় ওর ঠোঁট জোড়া ওর ঘাড়ে ছুঁয়েছে। ইভান সে কাঁপা কাঁপা শরীরের শুধু তার প্রিয়সি কে জাপটে ধরে জড়িয়ে ছিল। ইভান ঘুম কাতুরে কন্ঠে বলল,

‘ তুমি এত অত্যাচারী কেনো? সারারাত তো আমাকে এক ফোটাও ঘুমোতে দেও নি। কেনো এমন করলে তুমি? তুমি তো স্বার্থপরের মত আমার বুকে ঘুমিয়ে ছিলে। স্বার্থপর তুমি। ভীষণ স্বার্থপর। এমন বিড়ালের ছানার মতো ঘুমিয়ে আছো। কী কিউট দেখতে তুমি। একদম সাদা বিড়াল ছানার মতো।’

এইটুকু বলে ইভান ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসে। ধারার মুখে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আবার বলল,

‘ তুমি স্বার্থপর হও, আর যাই হও, তুমি শুধু আমার।’

ইভান ছোট নিঃশ্বাস নিতে আবারো বলল,

‘ এই মেয়ে তুমি এত নিষ্ঠুর কেনো? সেই প্রথম দিন থেকে তুমি আমার দিকে এক নজরও তাকাওনি। আমি সেই কবে থেকে তোমার চোখের গভীরতা মাপার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছি। কাল রাতে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়েছো। খুব বড় ভুল করেছো তুমি! এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। কঠিন শাস্তি! কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি। আচ্ছা তুমি কি আমাকে কখনো বুঝবে? নাকি তোমার থেকে আমার বয়স বেশি দেখে তুমি আবার আমাকে দূরে ঠেলে দিবে না তো। তাহলে আমার কী হবে? এমন যদি কখনো হয় তাহলে আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাব তোমাকে ছাড়া। না না তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলেই কী আর আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে দিবো। উঁহু, কখনো না। যেতে চাইলে আমি তোমার পায়ে ভালোবাসার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবো। তখন তুমি চাইলেও আর যেতে পারবে না। আমাকে বুঝবে কখনো? তুমি কী কখনো আমাকে বুঝবে না মেয়ে?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here