#প্রবাসীর বউ,পর্ব-এক
মাহাবুবা বিথী
ভাতার খাকি,আমার পোলাটারে খাইয়া ফালাইলো।ঐ অপয়া অলক্ষীর কারণে আমার ভিটেয় ঘুঘু চড়লো।আমার কি হবে?এতো সাধনার সংসার আমার গাঙ্গের জলে ভাইসা গেলো।ঘরে বসে রহিমা সদ্য স্বামী হারানোর শোকের শরীরে শাশুড়ী সালেহা বেগমের গালমন্দ হজম করছ।
এ সংসারের সুখ স্বাচ্ছম্দের এক মাত্র অবলম্বন ছিলো ওর স্বামী।হেলালের ভাই আলালের সংসার ও ভাইয়ের টাকাতে চলে।হেলাল চলে যাওয়াতে এক লহমায় এ সংসারে সুখের পৃথিবীর কবর রচিত হলো।এবার দেশে আসার পর হেলাল আর বিদেশে যেতে চায়নি।ও দেশে থাকতেই রহিমার কনসিভ করার খবর পায়।বিয়ের সাত বছর পর হেলাল আর রহিমার জীবনে নতুন অতিথি আসছে।আট বছর প্রবাস জীবন কাঠিয়ে সব টাকা মা ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়।প্রবাসীর কষ্ট ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।প্রবাসে গিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করে আর মনটা পড়ে থাকে দেশের মাটিতে আপনজনের কাছে।প্রবাসে একজন প্রবাসীর নিত্যসঙ্গী নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব আর হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম।কতটা রক্ত পানি করে টাকা আয় করে সে খবর কেউ রাখে না কিন্তু আয় করা পুরোটাকাটার খবর সবাই রাখতে চায়।দেয়ালবিহীন কারাগারে বছরের পর বছর ধরে জীবনের রঙ্গিন সময়গুলো পার হয়ে যায়।
গতকাল রাত দশটায় হেলাল মালয়শিয়া থেকে ফোন দিয়া কত কথা কইলো,
—-হ্যালো রহিমা কেমন আছো?ঠিক মতো খাওতো।তুমি না খাইলে তোমার শরীর যে বড় হইতাছে তারও খাওন হইবো না।তার যত্নের জন্য তুমি নিজের শরীরের যত্ন নিও।মা বাবা ভাই বোন স্ত্রী সন্তান এদের সুখের জন্য আমরা প্রবাসে কাজ করতে আসি।প্রবাসের জীবন বড় কষ্টের জীবন।সারাদিন কাজ করি দিনশেষে একাকীত্ব যাপন।যাকে এক কথায় বলা যায় স্বেচ্ছা নির্বাসন।তোমারে দেখতে খুব মন চায়।সাত বছর পরে আল্লাহ আমাদের ঘরে সন্তান দিছে।
রহিমা বলে,
—-কয়দিনের জন্য বাড়ি আসেন।আমারো আপনারে দেখতে খুব মন চায়।
রহিমা যখনি হেলালের সাথে কথা বলে দরজা আড়ালে দাঁড়িয়ে এ বাড়ির মানুষগুলো ওদের কথা শুনে।স্বামীর কাছে দুইটা ভালবাসার কথাও বলতে পারে না।সারাদিন সংসারে কলুর বলদের মতো খেটে যায়। রাত হলে স্বামীর সাথে নিরিবিলিতে দুইটা কথা বলতে মন চায় অথচ রহিমা সেই সুযোগটাও পায় না।
ঘরের বাহিরে থেকে শাশুড়ি বলে উঠলেন,
—এই তো তিনমাস আগে পোলায় আমার ঘুইরা গেলো।আইতে যাইতে টাকা লাগে না।তোমার বাপে কি তোমারে তালুক কিইন্না দেছে।আমার পোলায় তালুক বেঁচবো আর খাইবো।ফোন আমারে দাও আমি পোলার লগে কথা কমু,
—-বাবা হেলাল এতো কষ্ট কইরা রোজগার করা পয়সা দিয়া ফাও খরচ করিস না বাপ।পয়সার অনেক দরকার।
হেলাল বলে,
—-মা রহিমার শরীরটা ভালো না।ওরে দেখার জন্য আসতে চাইছিলাম।
শাশুড়ী সালেহা বেগম বললো,
—ও ভালোই আছে বাপ,পোয়াতি শরীরে এক আধটু সমস্যা হইবো।এইডা গায়ে মাখন যাইবো না।মা হওয়া এতো সহজ কথা না।
হেলাল বলে,
—-মা রহিমারে ফোনটা দাও। আর একটু কথা কইয়া রাইখা দেই।
সালেহা বেগম বলে,
—-তুই আলালের লগে কথা আগে সাইরা ল
হেলাল আলালকে বলে,
—-ভাইয়া আমি খুব বিপদে আছি।এখানে অনেকে আমার কাছে টাকা ধার নিয়েছে।কেউ টাকা ফেরত দিচ্ছে না।চাইতে গেলে নানাবিধ হুমকি দিচ্ছে।আমার হাত একদম খালি।তুমি আমার টাকা থেকে কিছু টাকা পাঠাতে পারবে?
আলাল বলে,
—টাকা তো নাই।সংসারের পিছনে সব টাকা খরচ হয়ে গেছে।
হেলাল বলে,
—এটা তুমি কি বলছ ভাইয়া।আমি কত কষ্ট করে পয়সা উপার্জন করে দেশে পাঠাই আর তোমাদের খরচ করতে এক মূহুর্ত লাগে না।
আলাল বলে,
—-কিছু টাকা ছিলো আমার জন্য একটা হুন্ডা কিনছি।এখানে সেখানে গেলে হাইটা যাইতে ভালো লাগে না তাই একটা হুন্ডা কিনছি।তখন তো জানতাম না। তর টাকা লাগবো।
আলাল আর কথা না বাড়িয়ে রহিমার হাতে ফোন দিয়ে চলে যায়,
হেলাল বলে,
—-বউ ফোনটা এখন রাখি।নিজের শরীরের যত্ন নিস।আমি বাঁচি কি মরি আমাগো সন্তানটারে মানুষের মতো মানুষ করিস।
ফোনটা রাখার পর রহিমা সারারাত ঘুমাতে পারেনি।মনটা শুধু কু ডাকলো।তারপর ভোরবেলা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো।কে বা কারা ওরে খুন করে টুকরো করে রেখেছে।
রহিমার বুকটা হু হু করে উঠলো।কথায় আছে না অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর।রহিমা পাথর হয়ে আছে।দু চোখ যেন শুস্ক মরুভূমি।
এমন সময় রহিমার জা জরিনা এসে রহিমাকে একটা সাদা শাড়ি দিয়ে বললো,
—-গোসল কইরা রঙ্গিন শাড়ি খুইলা সাদা শাড়ি পর।এতে তোমার মরা স্বামীর আত্মা শান্তি পাইব।
রহিমা জানে না ধর্মে এ কথা কোথায় লিখা আছে?রহিমা জানে, মৃত্যুর পর শান্তি আসে তার আমলনামায়।রহিমা এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করছে।
আর নাকের ফুলটা ওর জা জরিনা এমন ভাবে হ্যঁাচকা টানে খুললো যে নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগলো।সেই ব্যথাতেও রহিমার কোন বিকার হলো না।পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকলো।হাতের সোনার চুড়ি দুখানাও খুলে নিলো।হেলাল এইবার দেশে আসার সময় ওর জন্য চুড়ি দুখানা কিনেছিলো।
রহিমার মা আর ভাই ও আসলো।রহিমার মা রহিমাকে কাঁদানোর চেষ্টা করছে।রহিমা খুব শান্ত ভাবে ওর মাকে বলে,
—-মা ওর টুকরা করা শরীরটা দেশে আনা যাবে না? আমার মতো দুর্ভাগা কেউ নাই। আমি আমার স্বামীর লাশটাও দেখতে পারলাম না।আমি আসলেই অলক্ষী।অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।বলে রহিমা বালিশের উপর উপুর হয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো।এইবার আলাল বিদেশে ফেরত যেতে চায়নি।দেশেই ব্যবসা করতে চেয়েছিলো।কিন্ত ব্যাংকে কোনো টাকাছিলো না।হেলালের বাবাও বেঁচে নাই।তাই টাকা আলালের কাছেই পাঠাতে হতো। অথচ ওর ভাই আলাল বললো সব টাকা নাকি সংসারের পিছনে খরচ হয়ে গেছে।আবার বিদেশে অনেকে ওর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলো।সেই টাকা উঠাইতে আরও কিছু টাকা ব্যাংকে জমানোর উদ্দেশ্যে হেলাল আবার বিদেশে পাড়ি জমালো। তারপর দেশে ফিরে ব্যবসা করার ইচ্ছা ছিলো।
রহিমার ও হেলালরে ছাড়া একা থাকতে আর ভালো লাগে না।ওর মনে হতো,একটা রিকশাওয়ালার বউ ও ওর থেকে অনেক সুখী।দিনশেষে ও ওর স্বামীর আদর সোহাগ পায়।ওর মতো নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় না।আবার মাঝে মাঝে নিজেরে সান্তনা দেয়,বাবার বাড়িতে তিনবেলা ভাত জুটতো না আর এখানে কাজের বুয়ার মতো খেটে তিনবেলা ভাত কাপড়ের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।একবার গার্মেন্টসে চাকরি করতে গিয়েছিলো।মানুষরুপী হায়নাগুলো ওরে ছিড়ে কুঁড়ে খেতে চায়।অবশেষে বাপ মরা মেয়েটার বিয়েটাকে ওর সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হয়।স্বামী হিসাবে হেলালকে পেয়ে নিজেকে সুখী মনে হয়েছিলো।সেই সুখটাও অমানিশার অতলে আজ হারিয়ে গেলো।
রহিমার মা সখিনা বেগম শ্বশুর বাড়িতে রহিমার অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লো।এখানে তার মেয়ে কিভাবে থাকবে।আবার নিজের কাছে রাখবেন তারও উপায় নাই।রহিমার বাচ্চা হতে এখনও ছয়মাস দেরী আছে।বাচ্চা হওয়ার জন্য টাকার দরকার।রহিমার ভাইদের ই সংসার চালাতে কষ্ট হয়।সেখানে রহিমার খরচ উনি কিভাবে চালাবেন?
চলবে