#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৩১,৩২
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩১
খালা মনির মুখে বিয়ের কথা শুনতেই ক্ষেপে গেল অর্ষা। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে ল্যাপটপে ওর পছন্দ করা কোম্পানিগুলোর কার্যকলাপ, বার্ষিক আয়, ব্যবসায়িক অবস্থান, কাজের পরিবেশ, তৃতীয় পক্ষের মতামত দেখছিল। এরই মধ্যে খালা মনি কফি নিয়ে ওর পাশে বসে ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা বলল। পড়াশোনা শেষ এখন বিয়ে করা উচিত ব্লা ব্লা। এখনও নিজের ছেলের বউ করার প্রসঙ্গ তুলেনি।
খালা মনির কথা শুনে ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল,
“আমি কি এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি বিয়ে করে বসে থাকার জন্য? না, খালা মনি আমি পড়াশোনা করেছি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। জীবনে কিছু করতে চাই। যতদিন পর্যন্ত না জীবন নিয়ে সেটিস্ফাই হচ্ছি ততদিন বিয়ে-টিয়ে নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমাকে আর কখনো বিয়ের কথা বলিও না৷”
“কিন্তু মা, বিয়ে তো করতে হবে। আমি ছাড়া তোর আর কে আছে? আমি বেঁচে থাকতে থাকতে তোর একটা গতি করে যেতে চাই।”
“গতি? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই গতি? বিয়ে ছাড়া আমার গতি হচ্ছে না? তুমি সেকেলে কথাবার্তা কোথায় শিখলে? তোমার মাইন্ড তো এমন ছিল না। বিয়ে ছাড়াও আমার গতি হবে। প্লিজ এ-সব ইমোশনাল কথাবার্তা বলো না। বেশি বিয়ে বিয়ে করলে আমার বাসায় সিফট হয়ে যাব।”
অর্ষা ল্যাপটপ তুলে বিরক্ত মুখে রুমে চলে গেল। বিয়ে ছাড়া জীবনে কিছু নেই না-কি? বিয়ে শব্দটা শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কি করবে বিয়ে করে? যাকে বিয়ে করবে তাকে ভালোবাসতে পারবে? আর সে-ই কি ভালোবাসবে? ভালোবাসা বলে কিছু আছে? যা আছে তা হলো ভালো থাকা। সবাই নিজের মতো ভালো থাকতে চায়।
অর্ষা সকাল সকাল রেডি হয়ে গেছে। একদম ফর্মাল লুক। কালো জিন্স, সাদা শর্ট টপ, মুখে হালকা মেক আপ, হাই হিল আর সিল্কি চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা। হাতে প্রয়োজনীয় ফাইলপত্র। ডান হাতের কব্জির কিছুটা উপরে পার্স। অর্ষা শেষ বারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে নিল কোন কমতি আছে কি-না। কোনো কমতি চোখে পড়ল না। কাউকে কল করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ডাইনিং টেবিলে খালা মনি, খালু, খালাতো ভাই, খালাতো বোন নাস্তা করছিল। অর্ষাকে দেখে আয়াশ জিজ্ঞেস করল,
“কই যাস?”
“ইন্টারভিউ আছে।”
“ঠিক আছে নাস্তা করে নে। আমি অফিসে যাওয়ার সময় তোকে ড্রপ করে যাব।”
আয়াশের কথা শুনে খালা মনি খুশি হলো। আয়েশার দিকে কিছু একটা ইঙ্গিত করল।
“দরকার নেই। আমার সাথে আমার এক ফ্রেন্ড যাবে। ওকে কল করেছি।”
“আচ্ছা, তাহলে ভালো হলো। বেস্ট অফ লাক।”
ওদের কথা শুনে চুপসে গেল দুজন।
অর্ষা নাস্তা না করেই চলে যাচ্ছে। তাই খালা বলল,
“কিরে নাস্তা না করে কই যাস?”
অর্ষা ভার মুখে বলল,
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
খালা মনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার উপর রাগ করেছিস? ঠিক আছে তোকে আর কখনো বিয়ের কথা বলব না। তোর যখন ইচ্ছে হবে তখন করিস।”
আয়াশ সেটা শুনে বলল,
“বিয়ে? ওর বিয়ের বয়স হয়েছে? আমি এতবড় একটা ছেলে চোখের সামনে বউ ছাড়া ঘুরছি সেটা চোখে পড়ছে না আর ওর বিয়ে দিতে পাগল হয়েছো। একটু তো আমার জন্য পাগল হও।”
আয়াশের খেয়াল হলো বাবা ওদের সাথে বসে খাচ্ছেন। তখনই হঠাৎ পিলে চমকে উঠে। বাবার দিকে আড়চোখে চেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“আমি মজা করছিলাম।”
দাঁত কেলিয়ে বলল।
অর্ষা সবার কথা শুনে স্থির হলো। তারপর বলল,
“আমি রাগ করিনি খালা মনি। তুমি আমার জন্য ভাববে স্বাভাবিক। কিন্তু আগে আমি কিছু করি। তুমি না বলো প্রতিটি মেয়ের পায়ের নিচ শক্ত করা উচিত? আমি তাই করছি।”
অর্ষার খালু বলল,
“একদম ঠিক কাজ করছো অর্ষা। আয়েশাকে দেখো, লাইফে কিছু করার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। এখন স্বামী, সংসার আর বাচ্চাদের সামলাচ্ছে। কিছু করার আর সময় পায়নি। তোমার যা ইচ্ছে হয় তাই করো। অন্যকে খুশি করার জন্য মনের বিরুদ্ধে একদম যাবে না। তাহলে আজীবন আফসোস করতে হবে।”
“জি ধন্যবাদ আংকেল। আমি তাহলে আসি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য দোয়া করবেন।”
“অবশ্যই। বেস্ট অফ লাক।”
…..
অর্ষা আর প্রিয়া অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া অফিস দেখে বলল,
“অফিসটা তো সেই সুন্দর রে অর্ষা। দেখিস এখানেই তোর জব হয়ে যাবে।”
অর্ষা মৃদু হেসে বলল,
“তোর কথায় যেন সত্যি হয়।”
“অবশ্যই হবে। তুই সিভি জমা দিলেই তোর জব হয়ে যাবে। কোন কোশ্চেন করবে না দেখিস?”
অর্ষা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“অমন জব আমার চাই না। আমি নিজেকে দেখিয়ে কিংবা সিভি দেখিয়ে আর্কষিত করে জব চাই না। আমি যোগ্যতার ভিত্তিতে জব চাই। সারারাত পড়াশোনা কেন করলাম যদি কোনো কোশ্চেন না করে?”
“ওকে, ওকে। এখন ভেতরে যাওয়া যাক।”
ওরা দু’জন ভেতরে গেল কিন্তু কোথায় ইন্টারভিউ নিচ্ছে সেটা জানা নেই। এত বড় অফিসে অর্ষা জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে পাচ্ছে না। প্রিয়া একটা ছেলেকে দেখে অর্ষাকেফিসফিস করে বলল,
“একে জিজ্ঞেস কর।”
অর্ষা প্রিয়াকে বলল,
“তুই একটু জিজ্ঞেস কর না।”
প্রিয়া ছেলেটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। ছেলেটা ওদের দেখে ভাব নিয়ে মোবাইলে মনোযোগ দিল। প্রিয়া ইতস্তত করছে জিজ্ঞেস করতে। ছেলেটা আড়চোখে ওদের দেখছে। মনে মনে ভাবছে হয়তো ওর সাথে লাইন মারতে আসবে। মনে মনে হাসছে। প্রিয়া ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“এক্সকিউজ মি….
ছেলেটা ব্যস্ততা দেখিয়ে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
” জি…!”
প্রিয়া অর্ষার দিকে একবার চেয়ে ছেলেটার দিকে চেয়ে বলল,
“কিছু মনে না করলে আপনার পরিচয়টা পেতে পারি? আসলে আপনা…
প্রিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেটা বলল,
” এখনকার মেয়েরা ছেলে দেখলেই হলো! উফফ!”
অর্ষা ওর কথা শুনে ভীষণ ক্ষেপে গেল। পায়ের জুতা খুলে ছেলেটার মুখের সামনে নিয়ে বলল,
“এখনকার মেয়েরা কী? কী এখনকার মেয়েরা?”
ছেলেটা ভরকে গেল। ভরকে গিয়ে অর্ষার দিকে বড়বড় চোখ করে চেয়ে রইল। অর্ষা রেগে গিয়ে ওর কলার ধরে বলল,
“কথা বলিস না কেন? নিজের চেহারা দেখেছিস? জোকার একটা। যেই ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস যেন কোম্পানির সিএ। মেয়েদের সস্তা মনে করিস? জুতা পেটা করে তোর ভাব ছুটিয়ে দেব। অশিক্ষিত বেয়াদব।”
ছেলেটা কথা বলতে ভুলে গেল।
অর্ষা ওর কলার ছেড়ে দিল। তারপর হনহন করে বের হয়ে গেল। প্রিয়া ওর পেছনে পেছনে দৌড়ে গেল।
“এই অর্ষা চলে এলি কেন? ইন্টারভিউ এটেন্ট করবি না?”
অর্ষার স্পষ্ট উত্তর,
“না।”
“না মানে? এত বড় একটা কোম্পানিতে জব করার সুযোগ ছেড়ে দিবি?”
“হ্যা দিলাম। এখানে আমার জবের প্রয়োজন নেই। করব না আমি জব এখানে।”
প্রিয়া প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। অর্ষাকে দেখে সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অর্ষা উপরে উপরে যত ম্যাচিউর ভাব নিয়েই থাকুক না কেন ও সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। ও ম্যাচিউর হলে এমন একটা কাজ করত না। ছোট একটা কারণে রাগ করে ইন্টারভিউ না দিয়ে চলে আসত না।
অর্ষা বাড়িতে ফিরে ইন্টারভিউ না দেওয়ার কথা কিছুই জানায়নি। বিকেল বেলায় গেল নিজেদের ফ্ল্যাটে। অনেক দিন ধরে ফ্ল্যাটটা বন্ধ পড়ে আছে।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে পেছনে পা রাখতেই শরীর ছমছম করে উঠল। বাড়িটায় অনেক দিন কেউ না থাকায় হন্টেট মনে হচ্ছে। চারদিকে ধুলোবালি, মাকড়সার জাল দিয়ে বুনা। জিনিসপত্রের উপরে ধুলোর স্তুপ জমে আছে। অর্ষার ভেতরে যেতে ভয় লাগছে। এক পা-ও আগাতে পারছে না। এমন মুহূর্তে মনে হচ্ছে কাউকে না এনে চরম ভুল করেছে। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। সাহস করে পা বাড়াল সামনের দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কত স্মৃতি। ছোট থেকে বড় হয়েছে এই বাড়িতে। বাবাই একমাত্র সঙ্গী ছিল ওর। চোখ ঝাপসা হয়ে এল পুরনো স্মৃতি দৃষ্টিগোচর হতে। অর্ষা চোখের পানি মুছে নিজের ঘরে গেল। দরজা খুলে ভেতরে গেল। এত যত্নের বিছানায় ধুলো জমেছে কয়েক স্তুপ। পড়ার টেবিল, বইয়ের র্যাক, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি সবকিছু চোখ বুলিয়ে নিল। বইয়ের র্যাক থেকে ডায়েরিটা বের করল। ডায়েরি হাতে নিতেই বুক ভারি হয়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। অর্ষার চোখের পানি ধুলো-ময়লাযুক্ত ডায়েরির উপরে পড়ে এক বিন্দু কাদার সৃষ্টি হলো। অর্ষার হাত কাঁপছে। হাতে রাখতে পারছে না ডায়েরিটা। র্যাকে আবারও রেখে দিল। দূর্বল হতে চায় না আর। ডায়েরি রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ফ্ল্যাটের আর কোন কিছু দেখার প্রয়োজন নেই। এখুনি চলে যাবে ও। ফ্ল্যাটের দরজা লক করে বের হয়ে গেল চুপিসারে। ফ্ল্যাটটা পরিস্কার করা দরকার।
ছ’মাস পর!
দর্শন দেশে ফিরেছে। ওর পরিবার আর বন্ধুরা ওকে এয়ারপোর্টে থেকে পিক করতে গিয়েছিল। দর্শন আর ওর বন্ধুরা এক গাড়িতে। দর্শন কেমন গম্ভীর আর চুপচাপ বসে আছে। কারো সাথে কথা বলছে না। চোখের ওই কালো সানগ্লাসটা ওকে আড়াল করে রেখেছে। দর্শন যখন দেশ ছাড়ে তখন ওকে তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বীকার আর ভাঙা হৃদয় নিয়ে যেতে হয়েছিল। আজ এতবছর পর দেশে ফিরে ঠিক সেই জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে সবকিছু। কেমন দমবন্ধ লাগছে। ভালো লাগছে না কিছু। রুশান ওকে চুপচাপ দেখে বলল,
“কিরে তুই এত চুপচাপ কেন? এতদিন পরে দেখা হলো।”
দর্শন গম্ভীরমুখে উত্তর দিল,
“ভালো লাগছে না কিছু। কেমন অস্থির লাগছে। যে ক্ষত নিয়ে দেশ ছেড়েছিলাম সেটা একটুও শুকায়নি। এখনো দগদগে। কেমন বিশ্রী যন্ত্রণা করছে।”
রুশান আর কথা বাড়ালো না। একটা মিউজিক অন করতে বলল ড্রাইভারকে।
“আমার কল্পনা জুড়ে যে গল্পেরা ছিল
আড়ালে সব লুকনো।
সেই গল্পেরা সব রঙিন হলো পলকে
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন।
প্রেম তুমি আসবে এভাবে
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি।
আজও আছে সেই পথ শুধু নেই তুমি
বলো কোথায় আছো অভিমানী?”
দর্শনের গাড়ি চলছে কলেজের রাস্তা ধরে। এয়ারপোর্টে থেকে বাড়িতে যেতে হলে এই রাস্তা ধরেই যেতে হয়। দর্শন অপলক সেই রাস্তা দেখছে। যত এগুচ্ছে বুক ভারি হয়ে আসছে।
“সব থেকেও কি যেন নেই
তোমাকে তাই খুঁজে যাই প্রতিক্ষণে…..
…….
দর্শন বিভোর হয়ে গেছে রাস্তার ধারে। হঠাৎ হুশ ফিরল এই লাইনে…..
” চেয়ে থাকা দূর-বহুদূর
যে পথে আজো রয়ে গেছো স্মৃতির পাতায়
এসোনা আর একটি বার
স্বপ্ন যত সাজাতে আবার শুনছো কি আমায়?”
দর্শনের মনে হচ্ছে এই গানটা ওর জন্য। ওর প্রতি উপহাস করছে গানের প্রতিটি লাইন। এমন দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে এত বছরে কখনো পড়েনি। একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিল, সেই মেয়ে ওকে ছেড়ে চলে গেছে এই সাড়ে সাত বছরে এর কিছু ভুলেনি। তবে কাউকে বুঝতে দেয়নি। কারো সাথে এ নিয়ে এক লাইন আলোচনা পর্যন্ত করেনি।
দর্শন চেঁচিয়ে বলল,
“স্টপ দ্যা সং।”
সবাই ওর চিৎকারে হকচকিয়ে গেল।
চলবে……
#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩২
দর্শনের নিজের ঘরটা কেমন অস্বস্তিকর লাগছে। মনে হচ্ছে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে পারছে না। অপরিচিত কারো ঘরে এসে পড়েছে। চারদিকে দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো তবুও ভালো লাগছে না। দর্শন দরজা জানালা সব খুলে দিল। ছোট থেকেই নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে বেশ সময় লাগে দর্শনের। গতকাল অবধি বেডরুম অন্য রকম ছিল আর আজ সম্পূর্ণ আলাদা। নতুন ঘর, নতুন আসবাবপত্র, নতুন ডেকোরেশন সব মিলিয়ে বেশ অস্বস্তি লাগছে। দর্শনরা যে ফ্ল্যাটে থাকত সেটা দর্শন ইউএসএ যাওয়ার পর চেঞ্জ করে ফেলেছে। বাবা-মায়ের জমানো টাকায় জমি কিনে নিজেদের দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন। তাই এ বাড়ির সাথে দর্শনের কস্মিনকালেও সম্পর্ক ছিল না উপরন্তু ও একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের। ঘরের ডেকোরেশনের কিছু চেঞ্জ দরকার কিন্তু এখন এনার্জি নেই। তাই ফ্রেশ হওয়ার চিন্তা করল। বাথরুমে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় সব কিছু ঠিকঠাক জায়গায় পেল। এগুলো ওর বোন দিশার কাজ। দর্শন মুচকি হেসে শাওয়ার নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। শাওয়ার নিয়ে পাতলা একটা টিশার্ট পরে বাগানে গেল। ছোট্ট একটা বাগান। সেখানে ফুটে আছে হরেক রকমের ফুল। বাগান থেকে দোতলা বাড়ির দিকে তাকাল। ভিডিও কল ও পিকে অনেকবার দেখেছে কিন্তু সামনাসামনি এই প্রথম বার। বাড়িটা বেশ সুন্দর। বাবা-মায়ের পছন্দ আছে। বেশ খরচা করেছেন এ বাড়িটি দাঁড় করাতে। দর্শনের সব সময় স্বপ্ন ছিল নিরিবিলিতে ওর নিজের ছোট একটা বাড়ি হবে, সামনে ছোট একটা বাগান থাকবে। বাগানে ফুলের রাজ্যের পাশাপাশি ফলের গাছ রাজত্ব করবে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে সব সময় মুখরিত থাকবে। সেখানে ছুটির দিন বিকেলে বসে কফি খেতে খেতে গিটার বাজাবে। সেই স্বপ্নটা ঠিক পূরণ হলো। কিন্তু এখন আর গিটার বাজাতে ইচ্ছে করে না। গিটার রেখেই ইউএসএ গিয়েছিল সেখানে গিয়ে গিটার আর কেনেনি। এক সময় কত গিটার বাজাত। মুগ্ধ হয়ে অর্ষার গান শুনত। নাহ! আবারও অতীত নাড়া দিয়ে উঠে। দর্শনের অস্থির লাগতে শুরু করল।
দর্শন গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেল। গাড়ি চালাচ্ছে আনমনে। ওর চোখদুটো পথে-প্রান্তরে কাকে যেন খুঁজে ফিরে৷ মনে হয় এই বুঝি দেখবে। দর্শন বারবার রাস্তার এপাশ-ওপাশ দেখছে। এভাবে কাউকে পাওয়া যায় না তবুও মন মানে না যদি পেয়ে যায়। অর্ষা কোথায় আছে সেটাই জানে না, কারো কাছে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করে না। তবুও খুঁজছে।
অর্ষা ছ’মাস ধরে জব করছে। মোটা অংকের স্যালারির সাথে ঝুড়িতে বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে। ওর মেধা, সততা, দায়িত্বশীলতা, পরিশ্রম, একাগ্রতা দেখে কোম্পানির ডিরেক্টর ওকে আরো উচ্চপর্যায়ের সম্মান দিতে চায় কিন্তু এসবের জন্য অর্ষার সময় প্রয়োজন। তাই আগ্রহ নেই। অফিস আর বাড়িতে বসে সারাদিন কাজ এই করে কেটে যাচ্ছে সময়। আর কোনদিকে মন নেই ওর। অফিসের সময়গুলো ভালো যাচ্ছে। অনেক কিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছে। এত চাপে শপিং পার্লার কিছুই হচ্ছে না। ছুটির দিন কাজ শেষ করে হাই তুলতে তুলতে দিন চলে যায়। কিন্তু নিজের জন্য সময় বের করা জরুরি মনে করছে। তাই প্রথমে শপিংয়ে যাবে, শপিং শেষ করে পার্লারে যাবে। নিজের যত্ন নেওয়া উচিত। দর্শন রুশানকে নিয়ে শপিং করতে গিয়েছে। ইউএসএ থেকে এসেছে দশ-বারো দিন হয়ে গেছে। কিছু কেনাকাটা করা প্রয়োজন। একা যেতে ভালো লাগছে না তাই সময় বের করে রুশানকে নিয়ে গেল। অর্ষা শপিং শেষ করে কতগুলো ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে। দর্শন নিজের জন্য টিশার্ট দেখছিল হ্যাংগার থেকে নেড়েচেড়ে। হঠাৎ সামনের আয়নায় পরিচিত একটা মুখ দেখে চমকে উঠে। সাথে সাথে ঘুরে যায়। সেখানে কেউ নেই। দর্শন টিশার্ট দেখা রেখে শপ থেকে বের হলো। ডান পাশে কয়েকজন মহিলা, দুটো ছেলে আর কিশোরী তিনটা মেয়ে আর যুবতি একটা মেয়ে যেতে দেখল। সম্ভবত ওই মেয়েটাকে দেখেছে৷ রুশান ওকে এভাবে আসতে দেখে ও নিজেও বের হয়ে গেল।
দর্শনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কিরে?”
দর্শন ওর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“তুই একটু ভেতরে অপেক্ষা কর আমি আসছি।”
সবুজ ড্রেস পরা মেয়েটাকে পেছনে থেকে দেখেও পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও অর্ষা। যে অর্ষাকে চিনে সে অর্ষা। বদলায়নি একদম। লম্বা পাতলা সেই শারিরীক কাঠামো। দর্শন শিওর হওয়ার জন্য পেছনে পেছনে গেল। যদি অর্ষা হয় তবে ওকে জিজ্ঞেস করবে, অনেক প্রশ্ন করার আছে ওকে। দর্শন দ্রুত পায়ে হাঁটছে কিন্তু তাকে আর দেখতে পাচ্ছে না। এদিক সেদিক পাগলের মতো খুঁজছে। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে। ভীড়ের মধ্যে সেই মেয়েটাকে আর খুঁজে পেল না। দর্শন দ্রুত মার্কেট থেকে বাইরে গেল। পার্কিং লটে গিয়ে দাঁড়াল কিন্তু সেই মেয়েকে দেখতে পেল না। দর্শন আবারও মলে ঢুকল। অশান্ত মন নিয়ে আশেপাশের লেডিস্ শপগুলোয় উঁকি মারছে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। রুশানের কল আসায় দাঁড়িয়ে গেল। কল রিসিভ করে আসছি বলে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশে চোখ বুলালো। নিজের চুলগুলো সজোরে চেপে ধরে বলল,
“শিট! হারিয়ে ফেললাম।”
রুশানের কাছে বিধ্বস্ত অবস্থায় গেল। রুশান ওর এই অবস্থা দেখে বলল,
“কিরে তোকে এমন লাগছে কেন? আর কোথাও গিয়েছিলি?”
“একজনকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। পেয়েও হারিয়ে ফেললাম। ভাগ্যটাই খারাপ।”
দর্শন আনমনে বলে ফেলল।
রুশান বুঝতে না পেরে বলল,
“কাকে? কি বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না।”
দর্শনের হুশ হলো। হকচকিয়ে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“মামাকে। ছোট মামাকে। মনে হলো তাকে দেখলাম কিন্তু পরবর্তীতে আর খুঁজে পেলাম না। বাদ দে চল শপিং সেরে নেই।”
রুশান আর দর্শন শপিং করছে কিন্তু পুরোটা সময় দর্শন বেখেয়ালি ছিল। রুশান সবটাই খেয়াল করল কিন্তু কিছু বলল না।
অর্পা দেশে ফিরেছে। সে খবর বন্ধুমহলে ছড়িয়ে পড়ল। অর্পা গেট টুগেদারের আয়োজন করল। রুশানকে বলতেও ভুলেনি। যতই হোক রুশান ওদের ফ্রেন্ড সার্কেলের একজন। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা কেন সকলের সামনে আনবে? আর তাছাড়া ওর প্রতি কোন অভিযোগ নেই। দুজনের সম্মতিতেই ব্রেক আপ হয়েছে। এবং পরবর্তী সময়ে ওরা ফ্রেন্ড থাকবে এটাও বলা ছিল। তাই এটাকে পার্সোনালি নিতে চায় না। রুশানও পুরনো কথা মনে না রেখে অর্পার গেট টুগেদারে যায়৷ দর্শনও সুযোগ মিস করেনি। এতবছর পর সবার সাথে দেখা হবে, সে সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? দর্শন গিয়ে গেট টুগেদারে উপস্থিত হলো। দর্শনকে দেখে অর্পার চোখে পানি চলে এল। ওদের শেষ সাক্ষাৎ খুব একটা সুন্দর ছিল না। দর্শন তখন বিধ্বস্ত ছিল। অর্পা আবিষ্কার করল যে দর্শন আগের চেয়ে চুপচাপ গম্ভীর হয়ে গেছে। হাসে খুব কম। যতটুকু কথা বলে সেটা একদম প্রয়োজনীয়। ওদের আলাপচারিতার মধ্যে রুশান চলে এল। ওর গায়ে অফিসের পোশাক। অফিস শেষ করেই চলে এসেছে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশও হয়নি। ফর্মাল লুকে রুশানকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে। অর্পা ওকে এক পলক দেখে চোখ সরিয়ে নিল। রুশান সবার সাথে স্বাভাবিক ও হেসে হেসে কথা বলছে। অর্পা আড়চোখে বারবার ওকে দেখছে। সেই হাসোজ্জল মুখটা। ঠোঁটের কোনে এক ফালি হাসি লেগেই আছে। একদম বদলায়নি। অর্পা আর রুশান নিজেদের স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও বাকিরা কেন জানি অদ্ভুত আচরণ করছে। ওদের দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে। এতে ওদের মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে।
অর্পা একটু বেশিই অস্বস্তি ফিল করছে। রুশান সব বুঝতে পেরে বলল,
“গাইস! টেক ইট ইজি। প্লিজ আমাদের আনইজি ফিল করিও না। ওই আর গুড ফ্রেন্ড। প্রথম দিকে তো তাই ছিলাম। মাঝে একটা সম্পর্ক হয়েছিল সেটা ভেঙেও গেছে কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বটা রয়েই গেছে। অল্প বয়সের আবেগের একটা সম্পর্কের মূল্য কি বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি? ”
রুশান যুক্তিতর্ক দাঁড় করালেও অর্পার কাছে ওর কথাগুলো অপমানজনক মনে হলো। রুশান কত সহজে বলে দিল সব। অর্পা তবুও মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। সবাই রুশানের কথা শুনে স্বাভাবিক হলো।
খাওয়াদাওয়া আড্ডার ফাঁকে সবাই সবার খোঁজ খবর নিল। কে কবে বিয়ে করছে, কার বফ, গফ কি করে নানান প্রশ্ন। অর্পাকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিল,
“আগে তো ওদেশে ফিরি। সেখানে আগে ভালো করে স্যাটেল হই। ডাক্তারি পাশ করেছি মাত্র। কোথাও জয়েন করিনি। জয়েন করে সবকিছু গুছিয়ে তারপর ওখানের কাউকে বিয়ে করে নেব। ওখানে বলতে অবশ্যই বাঙালি মুসলিম হতে হবে।”
ওর কথা শুনে সবাই চমকে উঠে। তামিম বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
“তুই ওখানে স্যাটেল হবি?”
“হ্যা, আমি আসলে একেবারে আসিনি। ফ্রি আছি তাই জাস্ট সবার সাথে দেখা করতে এসেছি। জবে জয়েন করলে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তখন হয়তো আসা হত না। তাই জবে জয়েন করার আগেই এলাম।”
“কি বলছিস? আমরা এটা ভাবতে পারছি না। তুই আবার চলে যাবি? শুধুমাত্র দেখা সাক্ষাতের জন্য এসেছিস?”
অর্পা সবার মলিন মুখ দেখে উসখুস করতে করতে বলল,
“আসলে ওখানে অনেক দিন থেকেছি তাই অভস্ত্য হয়ে পড়েছি। চেনাজানাও হয়েছে খুব। ওখানে আমি একটা ব্যাটার লাইফ পাব। তাছাড়া এখানে আমার বাবা-মা ছাড়া তো আর কেউ নেই। ওখানে গিয়ে নিজে ভালোভাবে স্যাটেল হই তারপর তাদের নিয়ে যাব।”
ওর কথা শুনে সবাই ব্যথিত হলো। কিন্তু যেহেতু ওর লাইফ তাই কারো কিছু বলার অধিকার নেই। ও সেখানে কম্ফোর্ট ফিল করবে সেখানেই থাকবে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রাতুল রুশানকে প্রশ্ন করল,
“তুই কবে বিয়ে করছিস?”
রুশান মাথা চুলকে আঙুলের কড় গণনা করে বলল,
“মাত্র ২৬ বছর বয়স আমার। বিয়ের বয়স কি হয়েছে?”
“তা না হোক প্ল্যানিং….
” আমি কোনো কিছু প্ল্যানিং করে করি না। যখন যেটা হওয়ার হবে। প্ল্যান করে মাথা কেন খাব?”
রুশান খাওয়াতে মনোযোগ দিল। রাতুল পালটা প্রশ্ন করল,
“গার্লফ্রেন্ড? বিয়ের বয়স হয়নি বেশ কিন্তু প্রেম তো করছিস।”
রুশানের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিষম খেয়ে বলল,
“প্রেম ভালোবাসা ছাড়া থাকা যায়? এখন জিজ্ঞেস করবি গার্লফ্রেন্ড কি করে, কই থাকে? আমার গার্লফ্রেন্ড মঙ্গল গ্রহে থাকে, সেখানে গবেষণায় ব্যস্ত।”
তামিম ওর কথা শুনে গালি দিয়ে বলল,
“শা’লা!”
রুশান মৃদু হাসল। তারপর বলল,
“প্রাইভেসি রাখছি।”
অর্পা ওর কথায় কান দিল না। ও আগের মতোই পাগল আছে। দর্শনের দিকে তাকাল। ও গম্ভীর মুখে বসে আছে। অর্পা ওর দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ে বলল,”দর্শন তো দার্শনিক টাইপ কিছু হয়ে যাচ্ছিস। ঘটনা কি? রিলেশন টিলেশন কিছু চলে? আই মিন গার্লফ্রেন্ড আছে?”
দর্শন মুখে গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখেই বলল,
“আমি এখনো একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসি।”
সবাই ওর কথা শুনে চমকে গেল। কারো বুঝতে বাকি নেই কার কথা বলছে। কিন্তু তার নাম উচ্চারণ করল না। অর্পা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুশানের দিকে তাকাল। রুশান কত সহজে সব ভুলে গেছে অথচ দর্শন আজো তার পুরনো প্রেমিকাকে অসম্ভব ভালোবাসে। প্রকৃত ভালোবাসা কত সুন্দর!
চলবে……