#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৩৩,৩৪,৩৫
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩৩
হঠাৎ-ই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করল। সবার মধ্যে নেমে এসেছে নিগুঢ় সন্ধ্যার মতো পিনপতন নীরবতা। দর্শন নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য নিজের উপরই রাগ হলো। মুখ ফস্কে এত বড় সত্যিটা কি করে বলে ফেলল। এতদিন তো নিজের মধ্যে চাপা রেখেছিল, এখন কেন পারল না? এখন ওরা নানার প্রশ্ন করবে কি উত্তর দিবে, শুধু শুধু অস্বস্তিতে পড়বে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল কেউ কোন প্রশ্ন করল না হয়তো ওকে বিব্রত করতে চায় না। দর্শন মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা আর পারল না।
রুশান ওর স্বস্তিতে পানি ফেলে বলল,
“অর্ষা? তুই অর্ষাকে……
রুশানের মুখে অর্ষার নাম শুনে দর্শনের বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে গেল। কত দিন, কত মাস, কত বছর পরে কারো মুখে ওর নাম শুনল। এতদিন কেউ ওর নাম নেয়নি। হয়তো ভেবেছে দর্শন ওকে ভুলে গেছে।
দর্শনের মনটা হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠল। স্পষ্ট উত্তর দিল,
” হ্যা, অর্ষা। আমি অর্ষাকে এখনো ভালোবাসি।”
রুশান কিছুটা ক্ষিপ্ত হলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“এতকিছুর পরেও? এতকিছুর পরেও ওকে ভালোবাসিস? লাইক সিরিয়াসলি?”
ওর প্রশ্নে দর্শন বিরক্ত হলো কি-না জানা নেই কিন্তু অর্পা বিরক্ত হলো। মুখে কিছু না বললেও চোখেমুখে বিরক্তি ভাব ফুটে উঠল। সেদিকে চোখ পড়তেই রুশান চুপসে গেল। ও আর বাড়তি প্রশ্ন করল না। দর্শন আরো গম্ভীর হয়ে গেল।
অর্পা সবার দিকে একবার চেয়ে বলল,
“কই আমাদের তো কখনো কিছু বলিস নি। আমরা ভেবেছি তুই সব ভুলে লাইফে মুভ অন করেছিস। ভালো আছিস।”
“কারণ আমি চাইনি আমার জন্য আমার বন্ধুরা আর সাফার করুক, ডিস্টার্ব হোক। তাই সবটা নিজের মধ্যে গোপন রেখেছি।”
“সাড়ে সাতটা বছর একাই সাফার করেছিস। অথচ আমরা ভেবেছি সব নরমাল হয়ে গেছে। তুই ভুলে গেছিস সব।”
দর্শন মৃদু হাসল। মৃদু হেসে বলল,
“প্রথম ভালোবাসা কি ভুলা যায় যদি তা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়? হয়তো কিছু ভুল ছিল তাই ওকে হারিয়ে ফেলেছি।”
“এত বছর ওর খোঁজ করিসনি কেন? ইনফ্যাক্ট এখনো?”
“যে নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে কি খোঁজা যায়?”
“তা অবশ্য ঠিক। কোথায় যে গেল আর কেন গেল?”
“আমি চাই ও ওর মতো ভালো থাকুক। ও যা করেছে তাতে ওকে না পাওয়ার আফসোস কখনো হবে না।”
“এভাবে আর কত?”
“জানি না। জানতে চাই না। আমি ভালোবাসি ব্যস।”
“শুধু ভালোবাসিস? নাকি ঘৃণাটুকুও করিস?”
“যাকে ভালোবাসি তাকেই তো ঘৃণা করা যায়। সেক্ষেত্রে হয়তো ঘৃণাও করি।”
সবাই চুপ। কেউ ওর এই কথার প্রেক্ষিতে আর কোন কথা বলল না। থমথমে পরিবেশ। দর্শন এত বছর পরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এসে পরিবেশটা গম্ভীর করে দিল। সব স্বাভাবিক করতে বলল,
“ভাবছি কাজে লেগে যাব। আর বেকার বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”
ওর কথায় সায় দিয়ে রাতুল বলল,
“ইউএস থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে নিজেকে যদি বেকার বলিস তাহলে আমরা কি বলব?”
“ডিগ্রি আছে কিন্তু জব নেই। তোরা জব করছিস। সেক্ষেত্রে আমার দিক থেকে এগিয়ে আছিস।”
তামিম বলল,
“তাহলে তুই ও এগিয়ে যা।”
“হ্যা, লাইফে আগাতে চাই। ভালো কিছু অর্জন করতে চাই। জীবনে অনেক কিছু করার আছে। কয়েকটা হসপিটাল থেকে অফার পেয়েছি বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোকে করে দেখি কোথায় ভালো হবে দেন জয়েন করে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শন করব।”
“অবশ্যই। বসে থেকে কাজ নেই। এখন শুধু অর্জন করতে হবে। তাহলেই মেয়েদের লাইন পড়ে যাবে পেছনে।”
অর্পা ধমক দিয়ে বলল,
“মেয়েদের লাইন ছাড়া জীবনে কিছু নেই?”
তামিম জিভে কামড় দিয়ে বলল,”সরি সরি।”
অর্পা সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার আড্ডা এখানেই শেষ। এখন তোরা মনের খুশিতে মেয়ে মেয়ে করে গদগদ কর। এতদিনেও মানুষ হলি না।”
অর্পা দুম করে উঠে চলে গেল। সবাই রুশানের দিকে চেয়ে বলল,
“তোকে বলল না তো?”
রুশান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
~~~
রাত বারোটা বেয়াল্লিশ মিনিট। অর্ষা হাই তুলছে। ডান হাতে চোখ ডলে বড় দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল। চুলগুলো এলোমেলো করে উঠে গেল। অনেক ক্লান্ত লাগছে। শরীর মেজমেজ করছে। ফ্রেশ হয়ে চুলগুলো বেঁধে লাইট অফ করে বিছানায় গা এলালো। অনেক ধকল গেছে আজ। আগামীকাল অফিসে একটা মিটিং আছে। তারই প্রেজেন্টেশন তৈরি করল রাত জেগে। চোখ বন্ধ করতেই চকিত হয়ে সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলল। মনটা অশান্ত লাগছে। হঠাৎ করে ভালো লাগছে না। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে লগইন করল। সার্চ লিষ্ট থেকে দর্শনের নাম বের করল। অনেক দিন ধরে ওর আইডিতে টু মারা হয় না। ওর আইডিতে গিয়ে অর্ষা হতাশ হলো। আপডেট কিছু নেই। শেষ এক মাস আগে একটা পিক পোস্ট করেছে। দর্শন তেমন এক্টিভ থাকে না। কখনো দু-চার লাইন পোস্ট করেনি। মাঝেমধ্যে নিজের পিক আপলোড করে। তাই দর্শনের সম্পর্কে কোন ইনফরমেশন পায়না। ও কি করে, কেমন আছে কিছুই বুঝা যায় না। অর্ষার ধারণা ওর অন্য আইডি আছে। নয়তো একটা মানুষ এত নির্লিপ্ত কি করে থাকতে পারে। অর্ষা দর্শনের পিকটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর ওর আইডি থেকে বের হয়ে হাবিজাবি কতগুলো নাম সার্চ করে সার্চ লিষ্ট থেকে দর্শনের নাম সরিয়ে দিল। যদি কেউ দেখে ফেলে!
অর্ষা মোবাইল কেউ ধরবে না তবুও মনের তৃপ্তির জন্য একাজ করে। অর্ষা মোবাইল রেখে চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দেওয়া জরুরি। অতীত ওকে ভালো থাকতে দেয় না। যতই কাজে ব্যস্ত থাকুক, নিজেকে ব্যস্ত রাখুক, সফলতার দাঁড় প্রান্তে পৌঁছে যাক না কেন অতীতের স্মৃতিগুলো কিছুতেই মন থেকে মুছা সম্ভব না। প্রফেশনাল পর্যায়ে যতই সাকসেস হোক না কেন ব্যক্তিগত জীবনে যে পিছিয়ে আছে। ব্যক্তিগত জীবনের হারকে প্রফেশনাল লাইফের সাকসেস দিয়ে ঢাকা যায় না। অর্ষা পারছে না। তাই ফলাফলস্বরুপ চোখের পানি পড়ছে।
প্রিয়া অর্পাকে মেসেঞ্জারে কল দিল। গতকাল রাতেই ফেসবুকে অর্পার একটা পিক দেখেছে। পিকটা ঢাকার স্বনামধন্য একটা রেস্টুরেন্টের প্রবেশ দাঁড়। অর্পা নিশ্চয়ই দেশে ফিরেছে। রাতেই কল দিতে চেয়েছিল কিন্তু এত রাতে কাউকে কল দেওয়া অনুচিত ভেবে আর দেয়নি। আজকে অফিসে এসে কাজের ফাঁকে অর্পাকে কল দিল প্রিয়া। অর্পা শুয়ে ছিল। প্রিয়ার কল দেখে উৎসুক হয়ে উঠে বসে। কল রিসিভ করে উৎফুল্ল মনে।
“হেই, প্রিয়া কেমন আছো?”
“আমি ভালো আছি। তুমি ঢাকায়?” প্রিয়ার কৌতূহলী প্রশ্ন।
“হ্যা, দশ-বারোদিন ধরে এসেছি আবার চলে যাব।”
“চলে যাবে? মানে?”
“আমি ওদেশেই স্যাটেল হব। কিছুদিনের জন্য এসেছি।”
প্রিয়া মন খারাপ করে বলল,
“এতদিন ধরে এসেছো অথচ আমাকে একবার বলোনি।”
অর্পা ভেবে দেখল ঠিকই তো। মেয়েটা প্রায়ই ওকে কল করে, মেসেজ দিয়ে খোঁজ খবর নিত। ওকে জানানো উচিত ছিল।
“সরি ইয়ার, আসলে হঠাৎ করে চলে এসেছি তেমন প্ল্যান ছিল না। আসো একদিন মিট করি।”
“অবশ্যই। কবে সময় হবে জানিও।”
“আচ্ছা জানাব। তা কেমন চলছে দিনকাল?”
“চলছে, চাকরি জীবন খারাপ না। বাসা থেকে বিয়ে দিতে চায় এটাই খারাপ খবর।”
“বিয়ের বয়স তো হয়েছে, বিয়ে করে নেও।”
“আমার বান্ধবীরা কেউ বিয়ে করেনি। তুমি তো এখনো বিয়ে করোনি। বড় বোনকে আগে বিয়ে করতে হয়।”
“ভালো ছেলে পেলে করব আমার সমস্যা নাই।”
প্রিয়া কিছুক্ষণ কাচুমাচু করল। তারপর বলল,
“একটা চমকে যাওয়ার মতো খবর শুনবে?”
“কী”
“অর্ষা…..”
“অর্ষা! অর্ষা কী?”
বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল।
“অর্ষা ছ’মাস হবে ঢাকায় আছে।”
“অর্ষা ঢাকায়? এতদিন কই ছিল?”
“বাহিরে ওর চাচাদের কাছে। জানো ও অনেক বদলে গেছে। লাইফ নিয়ে যার বিন্দুমাত্র ভাবনা ছিল না সে এখন সব কিছুতেই সিরিয়াস। অনেক কঠিন হয়ে গেছে।”
অর্পা বিশ্বাস করতে পারছে না অর্ষার খবরটা। ও এতদিন পরে? আর এখন ঢাকায়? দর্শন জানেও না। অর্ষা কি একবারও দর্শনের খোঁজ করেনি? হয়তো করেনি। যদি করত তবে জানত! অর্পা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কী করে আজকাল?”
“ও আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। ভালো স্যালারিতে জব করছে। সব সময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।”
“ওর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। ওকে নিয়ে আসতে পারবে?”
“জানি না আসবে কি-না। তবে চেষ্টা করব।”
“চেষ্টা করো। আবার চলে যাব কবে আসব জানি না। ওকে বলো আমি ওকে দেখতে চাই।”
“আচ্ছা। বলব।”
অর্পার মনে একটা আশা যদি যাওয়ার আগে দর্শন আর অর্ষাকে মুখোমুখি করতে পারে। ওদের মুখোমুখি হওয়া জরুরি। অর্ষা রাজি হলে ওকে দর্শনের মুখোমুখি করবে। যত প্রশ্ন আছে সব ক্লিয়ার হবে। এখন ওর রাজি হওয়ার পালা।
…..
অর্ষা অফিস শেষে অফিসের পোশাকে খাবার অর্ডার করে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। অপেক্ষা করছে প্রিয়ার জন্য। প্রিয়া এলো আরো দশ মিনিট পর। ওর ঘর্মাক্ত মুখ দেখে কিছু বলল না। প্রিয়া চেয়ার টেনে বসে টিসু নিয়ে কপাল মুছল।
“সরি দোস্ত, দেরি হয়ে গেল। শোন তোকে একটা তাজা খবর দেই অর্পা আপু এসেছে। আবার নাকি চলে যাবেন।”
“কেন?”
“তার সেখানেই ভালো লেগেছে। আমি যাব মিট করতে। তুই যাবি?”
প্রিয়া প্রশ্নটা করে ঢোক গিলল। অর্ষা প্রসংগ এড়িয়ে গেল। অর্পার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সমস্যা এক জায়গায়।
চলবে…..
#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩৪
প্রিয়া ওকে রাজি করানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। অর্পা এত করে বলল। অর্ষা রাজি হলে দু’জন এক সাথে অর্পার সাথে দেখা করতে যেতে পারবে। এক সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে। একা একা যেতে ইচ্ছে করে না তাই ওকে রাজি করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
“অর্ষা, কী সমস্যা? সব কিছু বদলে গেছে। অর্পা আপু আবার চলে যাবে। তোকে একটু দেখতে চায়।”
“আমি বুঝতে পারছি কিন্তু কিভাবে যাব ওর সামনে? শেষ দেখা, শেষ কথা এমনকি শেষের ঘটনাগুলো কি ভুলতে পেরেছে? আমি তাদের কাছে সেখানেই আছি। আমার অস্বস্তি লাগবে। আমি পারব না সহজ হতে। কোন পক্ষই পারবে না সহজ হতে। তুই যা।”
প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরস্থির গলায় বলল,
“সত্যি কথা তো এটাই তুই এখনো সেখানে পড়ে আছিস। লাইফে মুভ অন করেছিস কিন্তু মানসিকভাবে সেইদিনগুলো আঁকড়ে বেঁচে আছিস।”
ওর কথা শুনে অর্ষা রেগে গেল। সত্যি সব সময় তেতো হয় অর্ষার কাছে তেতোই লাগছে।
“প্রিয়া, তুই বেশি কথা বলছিস। তোর কথা হয়ে গেলে আমি যাচ্ছি।”
“যা, এখন তো তোর আর কাউকে প্রয়োজন হয় না। নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট।”
অর্ষা দুম করে দাঁড়িয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। প্রিয়া ওর যাওয়া দেখে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে নিজের উপরই রাগ হলো।
“এটা আমি কী করলাম? জানি তো অর্ষার রাগ বেশি। অর্পা আপুর সাথে দেখা করা নিয়ে শুধু শুধু ঝামেলা করলাম। ওর ইচ্ছে না হলে যাবে না এটাই তো স্বাভাবিক।”
প্রিয়াও ওর পেছনে পেছনে দৌড়ে গেল। অর্ষা ততক্ষণে গাড়ির সামনে চলে গেছে। প্রিয়া ওকে পেছনে থেকে ডাকছে।
“অর্ষা, দাঁড়া।”
অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে ঘুরে ওর দিকে রাগি ফেস করে তাকাল।
“কী চাই তোর?”
“সরি সরি। আমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। ঠিক আছে দরকার নেই তোর যাওয়ার তবুও রাগ করিস না।”
অর্ষা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। প্রিয়া ওকে চুপ দেখে বলল,
“আমাকে লিফট দিবি?”
অর্ষা আশেপাশে চেয়ে বলল,
“তুই গাড়ি আনিস নি?”
“না।”
“আচ্ছা আয়।”
প্রিয়া আর অর্ষা দু’জনই গাড়িতে উঠে বসে। অর্ষা ড্রাইভ করছে চুপচাপ। প্রিয়াও কোন কথা বলেনি। কি বলবে আবার রেগে যাবে তাই চুপ করেই আছে।
অর্ষাই নীরবতা ভেঙে বলল,
“অতীতটাকে আমি বড্ড ভয় পাই। সে অতীতের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার নেই। তাই অতীতকে এড়িয়ে চলি। সেই মানুষগুলো কিংবা ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। হয়তো পারব না।”
প্রিয়া ওর দিকে তাকাল। চোখগুলো ছলছল করছে। মুখটাও বিষন্ন। ওর অবস্থা বুঝে বলল,
“ঠিক আছে আমি আর কখনও বলব না। যা তোকে কষ্ট দেয় আমি কখনো তার সম্মুখীন হতে বলব না। অর্পা আপু অনেক করে রিকুয়েষ্ট করেছিল তাই তোকে জোর করছিলাম। এখন আমি বুঝতে পারছি।”
“আমার ইচ্ছে করে অর্পা আপুর সাথে দেখা করতে। উনি নিজ থেকে আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন। আবার বললি চলে যাবে কিন্তু ওই যে আমি এক জায়গায় বাঁধা পড়ে আছি। তাই…..
” আরে বাদ দে…. অর্পা আপুর সাথে দেখা করা জরুরী নয়।”
“হুম। জীবনের সবচেয়ে জরুরী মানুষটাই হারিয়ে গেছে।”
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। প্রিয়া নীরব। মনে মনে ভাবছে যদি সেই মানুষটাকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হত। এটা ভেবে প্রিয়াও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
……
প্রিয়া রাতের বেলায় বিছানায় বসে বসে টিভি দেখছে আর চিপ্স খাচ্ছে। এমন সময় মোবাইল বেজে ওঠে। মোবাইলের স্কিনে অর্ষার নাম। প্রিয়া কল রিসিভ করল। কল রিসিভ করতেই অর্ষা বলল,
“কী করিস?”
“টিভি দেখি।”
অর্ষা চুপ। আর কিছু বলছে না। ওকে চুপ দেখে প্রিয়া নড়ে-চড়ে বসে ওর দিকে মনোযোগ দিল।
অর্ষা তখনও চুপ। প্রিয়া কান পাতল ভালো করে। অর্ষার নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। প্রিয়া তবুও প্রশ্ন করছে না। অপেক্ষা করছে অর্ষার কথা শোনার জন্য।
“প্রিয়ু তুই কবে যাবি?”
প্রিয়া না বুঝতে পেরে প্রশ্ন করল,
“কোথায়?”
অর্ষা আবারও চুপ। দীর্ঘ করে নিশ্বাস নিল।
“অর্পা আপুর সাথে দেখা করতে?”
প্রিয়া ওর কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো। এইজন্য অর্ষা এত সময় নিচ্ছিলো। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছে?
“যাব এক সময়। কিন্তু কেন?”
“না মানে আমিও যেতাম।”
প্রিয়া আরেক দফা বিস্মিত হলো। চোখেমুখে দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
“তুই যাবি?”
“হ্যা।”
প্রিয়া স্বাভাবিক হলো। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“অর্ষা, মনের বিরুদ্ধে কিছু করিস না। এমন কিছু করিস না যা তোকে কষ্ট দিবে। মনের মধ্যে অশান্তি বাড়বে।”
“প্রিয়ু আমি সবকিছু থেকে বের হতে চাই। অর্পা আপুর সাথে দেখা করব। উনি যদি কোন প্রশ্ন করে নিজের মতো উত্তর দেব। ব্যস।”
“ভেবেচিন্তে বলছিস?”
“হ্যা, অনেক ভেবেছি। পুরো দিন ভেবেছি। আমি পারব।”
“আচ্ছা, আমরা পরশু শুক্রবার আপুর বাসায় যাব। তোর আমার অফিস ছুটি আছে। ওইদিন আপু আমাকে তার বাসার এড্রেস দিয়েছিল।”
“আচ্ছা।”
শুক্রবার!
অর্ষা মেরুন রঙের জর্জেটের ফোর পিচ পরে তৈরি হয়ে নিল। ম্যাচিং করে কানে দুল আর গলায় প্লাটিনামের চেইন পরল। চুলগুলো সাদা পাথরের ছোট হেয়ার ব্যান দিয়ে আংশিক আঁটকে বাকিটা ছেড়ে দিল। মুখে হালকা মেক আপ করে নিল। হাতে ঘড়ি। প্রথমে প্রিয়ার বাসায় গেল তারপর সেখান থেকে এক সাথে অর্পার বাসায়। অর্পার বাসার সামনে গিয়ে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে অর্ষা। কতদিন পর! প্রিয়া কলিং বেল বাজাল। তারপর দু’জন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। একজন মহিলা দরজা খুলে দিল। ওরা ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল। ভেতরের রুম থেকে অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রিয়া মহিলার দিকে চেয়ে বলল,
“আমরা অর্পা আপুর সাথে দেখা করতে এসেছি। আপু কই?”
মহিলা মার্জিত ভাষায় বলল,
“ওই তো ওর রুম। যাও তোমরা।”
অর্ষা উনাকে প্রশ্ন করল,
“আপনি আপুর কে হোন?”
“আমি ওর মা।”
প্রিয়া আর অর্ষা দুজনেই উনাকে সালাম দিয়ে ভেতরে গেল। প্রিয়া আগে ঢুকল। অর্পার বেডরুমটা অনেক বড়। হল রুমের মতো। প্রিয়া ভেতরে গিয়ে আহাম্মক হয়ে গেল। বড় সোফার মধ্যে দু-তিন জন ছেলে আর ওর সাথে ওর বিছানায় একটা মেয়ে বসে আছে। ওরা নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা করছে। প্রিয়া বুঝতে পারছে না ভেতরে ঢুকে ঠিক করেছে কি-না। দরজা পুরো হাট করে খোলা ছিল তাই আর নক করেনি। নক করা কি উচিত ছিল? হঠাৎ প্রিয়ার চোখ আঁটকে গেল বড় সোফায় বসে থাকা তিনটা ছেলের মধ্যে একজনের দিকে। ওর বুক ধুক করে উঠল। প্রিয়া দ্রুত দরজার দিকে তাকাল। অর্ষা ইতস্তত মুখে ভেতরে ঢুকছে। ততক্ষনে অর্পা বিছানা থেকে নেমে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরেছে। প্রিয়া আতংকিত চোখেমুখে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষা লাজুক হাসল। কিন্তু প্রিয়ার শুকনো আর থমথমে মুখের দিকে চেয়ে অর্ষার চোখেমুখে প্রশ্ন ফুটে উঠল। তাই চোখের ইশারায় প্রশ্ন করল কী হয়েছে। প্রিয়া উত্তর দিতে পারছে না। ঢোক গিলে পেছনে ইশারা করে মৃদুস্বরে বলল,
“দর্শন ভাইয়া!”
অর্ষার বুক ছ্যাৎ করে উঠল দর্শনের নাম শুনে। অর্পা সরে দাঁড়াতেই দর্শনের দিকে ওর চোখ পড়ল। ওর সারা শরীর কাঁপছে। বুকে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। দর্শনসহ ওর দুই বন্ধু রাতুল আর তামিম বিস্মিত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শনের চোখ অর্ষাতে নিবদ্ধ। ও কিছু বলতে পারছে না। ওর বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। চাপা কষ্টগুলো নোনাজল হয়ে বের হতে চাইছে। ঝাপসা চোখে চেয়ে আছে অর্ষার দিকে। কত দিন, কত মাস, কত বছর পরে দেখছে! কত প্রশ্ন ছিল করার। এতগুলো বছর ধরে ভেবে এসেছে যদি দেখা হয় তবে জিজ্ঞেস করবে কেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলে? অপরাধ কী এতটাই বড় ছিল? এত ভালোবাসা হঠাৎ তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল কেন?
কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে যাচ্ছে তাই স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। অর্ষার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কখনো ভাবতে পারেনি এমন করে দুজনের দেখা হয়ে যাবে। ওর শরীর খারাপ লাগছে।
কোন রকমে বলল,
“আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমাকে এখুনি বাসায় যেতে হবে।”
অর্ষা আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। অর্ষার পেছনে পেছনে প্রিয়াও চলে গেল। উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে দর্শনের দিকে চেয়ে আছে। দর্শন দাঁড়ানো থেকে ধপ করে আবারও বসে পড়ল। অর্পা ওর দিকে একবার চেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। প্রিয়া আর অর্ষার সাথে কথা বলতে চায় তাই ওদের পেছনে গেল। কিন্তু ওরা ততক্ষণে লিফটে ঢুকে গেছে। অর্পা ফিরে এল দর্শনের কাছে। ওর সামনে এক গ্লাস পানি ধরে বলল,
“তুই ঠিক আছিস?”
দর্শন গ্লাসটা নিয়ে এক নিশ্বাসে পুরোটা শেষ করে বড় করে শ্বাস নিল। তারপর অর্পার দিকে তাকাল। সে দৃষ্টিতে অর্পা নিদারুণ যন্ত্রণা দেখতে পেল।
“তোর সাথে ওর যোগাযোগ ছিল?”
অর্পা ওর প্রশ্নে থমকে গেল। দর্শন কী ভাবছে এসব?
“না, ওর সাথে আমার যোগাযোগ থাকলে তোকে জানাতাম না? আমরা সবাই ওকে নিজেদের মতো করে খুঁজেছি। আমার শুধু প্রিয়ার সাথে যোগাযোগ ছিল। ও আমার দেশে আসার খবর শুনে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল আমি আমার বাসার এড্রেস দিয়েছিলাম। ওকে দেখে তুই যেমন সারপ্রাইজ হয়েছিস আমিও হয়েছি।”
অর্পা প্রিয়ার কাছ থেকে জানা অর্ষার ফেরার কথাটা এড়িয়ে গেল। দর্শন যদি ওকে ভুল বুঝে? তবে যাইহোক ভালোই হয়েছে। দু’জনেই জানে ওরা এক শহরে বসবাস করে।
“আমি সারপ্রাইজ নই, শকড হয়েছি। এতটা শকড হয়েছি যে মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারিনি। ওকে কত প্রশ্ন করার ছিল, কিন্তু আজ আমি নির্বিকার ছিলাম। কেন? কেন আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের কৈফিয়ত চাইনি? কেন আবারও পালাতে দিলাম? হোয়াই?”
দর্শন চিৎকার করল।
দর্শন হাতের মুঠোয় রাখা গ্লাসটা আরো জোরে চেপে ধরল। মুহুর্তেই গ্লাসটা ভেঙে চুরমার হয়ে কাচের টুকরোগুলো নিচে পড়ল। কাচের টুকরোর উপরে গাঢ় লাল রক্তের ফোঁটা পড়ছে। কিন্তু সেদিকে দর্শন বেখেয়ালি।
চলবে…..
#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩৫
প্রিয়া ড্রাইভ করছে অর্ষা ওর পাশে। অর্ষাকে ড্রাইভ করতে দেয়নি। অর্ষা কাচ খুলে জানালার বাইরে চেয়ে আছে। ওর দৃষ্টি স্থির। মনের ভেতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে কোন সমস্যা হচ্ছে না প্রিয়ার। ও ড্রাইভ করতে করতে অর্ষার দিকে তাকাচ্ছে।
প্রিয়া নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামালো। গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষায় অর্ষা হকচকিয়ে গেল। প্রিয়া গাড়ি থেকে নেমে দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনে আনে। অর্ষার হাতে দিয়ে বলল,
“গলা ভিজিয়ে নে।”
অর্ষা এক ঢোক পানি খেতেই প্রিয়া অনুতাপের সুরে বলল,
“আ’ম সো সরি। আমি জানতাম দর্শন ভাইয়া ইউএসএ। কবে এল কিছুই জানি না। আমি যদি জানতাম ওখানে দর্শন ভাইয়া আছে তাহলে তোকে কখনোই নিতাম না। আ’ম রিয়েলি সরি।”
অর্ষা নিশ্চুপ। ওকে নিশ্চুপ দেখে প্রিয়া আরো বিপত্তিতে পড়ল।
“অর্ষা, কিছু বল। দূর, না জানিয়ে এভাবে দুম করে চলে যাওয়া ঠিক হয়নি। ওরাও হয়তো এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। সবাই কেমন থমথমে ছিল।”
অর্ষা মুখ খুলল দীর্ঘ সময় পর।
“প্রিয়া, গাড়ি স্টার্ট দে। ভালো লাগছে না।”
প্রিয়া ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“টেক ইট ইজি। এসব ভেবে কষ্ট পাস না। একদিন না একদিন তো দেখা হওয়ারই ছিল। হয়ে গেছে। এটাই ভেবে নে।”
অর্ষা নিরস কন্ঠে বলল,
“তাই বলে এভাবে? এভাবে দেখা হওয়ার ছিল? আমি কতটা অস্বস্তিতে পড়েছি। আমার ভেতরটা কেমন লাগছিল। এখনো কেমন অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে মরে যাব।”
অর্ষা অস্থির অস্থির করতে লাগল।
“অর্পা আপু কখনো বলেনি দর্শন ভাইয়ার কথা। যদি জানতাম তাহলে তোকে এসবে জড়াতাম না। আমি একাই যেতাম। প্লিজ কষ্ট পাস না। আমাকে মাফ করে দে।”
“এখানে তোর দোষ কোথায়? আমি তো নিজে থেকেই গেলাম। ভাগ্য আমাকে টেনে নিয়ে গেছে। নয়তো হঠাৎ করে যাওয়ার জন্য উতলা কেন হব?”
“আমি তো ভেতরে ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে গেছি। আমার এতটা অস্থির লেগেছে তোর তো লাগবেই।”
অর্ষা আবারও নীরব। মনে পড়তে সেই দৃশ্য। প্রিয়ার ইশারায় পেছনের দিকে তাকাতেই দর্শনকে দেখে প্রাণপাখিটা বের হয়ে যাচ্ছিল। দর্শনের বিস্মিত চোখ-মুখ। হঠাৎ ওকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া। মনে হচ্ছিল দর্শন এই বুঝি ওকে চেপে ধরবে। তারচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল এত বছর পরে ওকে দেখে। সেই বাচ্চা বাচ্চা মুখটা আর নেই৷ গম্ভীর ম্যাচুউর একটা মানুষ। আগের মতোই গোছানো, পরিপাটি। এইটুকুর বেশি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এক পলক চেয়েই চোখ সরিয়ে ফেলেছিল। নয়তো দুই চোখ যে ঝলসে যেত!
দর্শন ঘর জুড়ে পাইচারি করছে। মাঝেমধ্যে বিছানায় বসছে। আবারও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরছে আবারও পাইচারি করছে। ভেতরে থেকে দরজা বন্ধ তাই বাইরের কেউ ওর অবস্থা বুঝতে পারছে না। দদর্শনের প্রচণ্ড অস্থির লাগছে। মাথার ভেতরে একটাই শব্দ ঘুরছে। অর্ষা! অর্ষা! অর্ষা!
এতবছর পর! সাড়ে সাত বছর! অনেকটা অপেক্ষা করেছিল তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল আর কখনো দেখা হবে না। এক সময় এটাও ভেবেছিল আর না হোক দেখা। কেটে যাক জীবন এভাবেই। কিন্তু দেখা হয়ে গেল। আজ এত কাছে চলে এসেছিল। তবুও ধরতে পারেনি, বলতে পারেনি একটা শব্দ। কী অদ্ভুত! আজ অর্ষা আর ও কয়েক হাত দূরত্বে ছিল। তবে সাড়ে সাত বছর কোথায় ছিল? ওর ধরাছোঁয়ার ভেতরে? ওর আশেপাশে? দর্শন আর কিছুই ভাবতে পারছে না। হাতের ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখল। হাতে ব্যান্ডেজ করা। দর্শন হাতের দিকে তাকাল। মনে পড়ল অন্য এক অর্ষাকে। কত বদলে গেছে। ওকে দেখে স্থির হয়ে ছিল তারপর চলে গেল। আবারও চলে গেল। সেই লম্বা, পাতলা মেয়েটা হঠাৎ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। ওর চোখে মুখে লাজুক একটা আভা ছিল। মুহুর্তেই ওর দিকে চোখজোড়া নিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই অর্ষা শুধু ড্রেস আপ, মেক আপ অন্য রকম ছিল।
চুলগুলো আগের চেয়ে বড় হয়েছে। নিজেকে পরিপাটি রাখতে শিখে গেছে। দর্শন নতুন করে মুগ্ধ হচ্ছিল। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিল ওর দিকে। মনে হচ্ছিল স্বপ্ন কিংবা ওর কল্পনা। তারপর ভাবল স্বপ্ন কিংবা কল্পনা এত সুন্দর হতে পারে? ভুল ভাঙল যখন অর্পা ওকে জড়িয়ে ধরল। অর্ষা ওর চোখে চোখ রাখল। সেই চোখ! দর্শনের বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।
চোখে ভাসছে সেই সোনালী রোদ্দুরের দিনগুলো যখন অর্ষা ওকে ভালোবেসে কত পাগলামি করত।
__________
কয়েক দিন পর। এক বিকেলে দর্শন মন খারাপ করে বাগানে বসে আছে। চুপচাপ ছেলেটা ইদানীং আরো বেশি চুপচাপ থাকে। পরিবারের সবাই লক্ষ্য করেছে বিষয়টা। কিন্তু দর্শনের কাছ থেকে যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ পায়নি। দর্শন এমনিতেও কথা বলে কম। মন খুলে কথা বললে না-হয় সমস্যা, ভালো-মন্দ বোঝা যায়। কিন্তু ও তো কিছুই বলে না। ওর ফুপাতো বোন রাইসা এসে বলল,
“এভাবে বাড়িতে বসে বোরিং সময় না কাটিয়ে রেডি হয়ে নে, আমাদের অফিসে পার্টি আছে।”
“তো আমি কী করব?”
দর্শনের সোজাসাপ্টা উত্তর।
“তো যাবি আমার সাথে।”
“তোদের অফিসের পার্টিতে আমার কী কাজ? তাছাড়া ওসব পার্টি-সার্টি আমার পছন্দ না।”
“অফিসের পার্টি সেখানে ফ্যামিলি এলাও আছে। সো আমার সাথে গেলে তোকে কেউ কিছু বলবে না। আর পার্টিতে কেন যাবি? মুড অন করতে। সারাদিন বাসায় থাকলে তো মুড অফ থাকবেই। যা রেডি হয়ে নে।”
“দেখ রাইসা, অযথা বিরক্ত করিস না ভালো লাগছে না।”
সেন্টি খেয়ে বলল,
“আমি বিরক্ত করলাম? ভালো ভেবেই তো বলেছি তবুও…. ওকে ফাইন।”
রাইসা গাল ফুলিয়ে বসে রইল।
দর্শনের মনে হলো একটু বেশিই বলে ফেলেছে।
“যা আর ড্রামা করিস না ড্রামা কুইন। আমি যাব তোর সাথে।”
রাইসা খুশি হয়ে গেল ওর কথা শুনে।
অর্ষা অফিসের পার্টিতে একাই গিয়েছে। পুরো অফিসে আকর্ষণীয় লাইটিং করা হয়েছে। চারদিকে জাঁকজমক পরিবেশ বিরাজ করছে। অর্ষা পরেছে কালো রঙের গাউনের সাথে রাতের উপযোগী হালকা মেক আপ। ম্যাচিং স্টোনের এয়ারিং ও গলায় নেকলেস। হাতে সাদা পাথরের ব্রেসলেট, হাই হিল। অর্ষা সবার সাথে টুকটাক কথা বলার পাশাপাশি আশেপাশের সবকিছু তদারকি করছে। অর্ষা চায়না কোন কারণে, কোন ভাবে অফিসের নাম ক্ষুন্ন হয়, অন্য কোম্পানির কাছে ভাবমূর্তি নষ্ট হোক। তাই আশেপাশে নজর রাখছে। অর্ষার গলা খুসখুস করছে। তাই ড্রিংক আনতে গেল। পার্টি এখনো শুরু হয়নি। অফিসের কলিগরা একে অপরের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছে। রাইসা দর্শনকে নিয়ে অফিসের মেইন হলে প্রবেশ করেছে। দর্শন একটু ইতস্তত বোধ করছে। যখন রাইসা ওর কলিগের সাথে আসা ফ্যামিলি, ফ্রেন্ড অথবা নিজেদের প্রেমিক -প্রেমিকাদের সাথে পরিচয় করায় তখন থেকে একটু ইজি ফিল করছে।
দর্শন আর রাইসা এক সাথে বসল। গ্রোগাম শুরু হয়ে গেছে। দর্শনের সবকিছু বোরিং লাগছে। আশেপাশে কাপল ড্যান্স, হাসি-কৌতুকের মধ্যে নিজেকে বেমানান লাগছে। তাই মোবাইল বের করে ফেসবুকে লগইন করল। ফেসবুকে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল।
তখনই কানে ফেঁসে এল,
“হেই অর্ষা!”
অর্ষা নামটা শুনে চমকে উঠে দর্শন। একই নামের অনেক মানুষ থাকে এটা জানা সত্ত্বেও দর্শন ঘাড় ঘুরালো।
“ইউ আর লুকিং সো বিউটিফুল।” অর্ষার এক কলিগ অর্ষাকে বলল। অর্ষা প্রতিউত্তরে মুচকি হাসল।
দর্শন দ্বিতীয় বারের মতো ধাক্কা খেল। অর্ষা! আবারও অর্ষা! দর্শন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে অর্ষাকে দেখছে৷ এ কোন অর্ষা! আকাশ থেকে নেমে আসা কোন অপ্সরী। দর্শন অপলক চেয়ে আছে। অর্ষাকে এখানে দেখবে সেটা কল্পনাতীত। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর অর্ষার চোখে পড়ল দর্শন। অর্ষাও বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। বুকের ধুকধুকানি বেড়ে চলেছে। আবারও অনাকাঙ্ক্ষিত দেখা! মনে প্রশ্ন জাগছে দর্শন এখানে কী করছে?
হঠাৎই দর্শনের কাঁধে কারো হাতের ছোয়া পড়ল।
“এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
দর্শন ঘুরে রাইসাকে দেখল। অর্ষার দিকে আরো একবার তাকাল। অর্ষা ওর দিকেই চেয়ে আছে।
“এমনি।”
দর্শন দাঁড়ানো থেকে বসে পড়ল। রাইসা ওর মতো কথা বলে যাচ্ছে আর দর্শনের চোখ অর্ষাতে বিভোর। অর্ষার হাঁটাচলা, কথা বলা সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে। ওর স্টাইল বদলেছে ক্ষানিকটা। পরক্ষণেই মনে হলো ক্ষানিকটা নয় অনেকটা। হয়তো এখন মানসিকভাবেও বদলেছে। আগের মতো রাগের বশে বোকামি করে না, কোন কিছু নিয়ে পাগলামি করে না। সবকিছুতেই সিরিয়াস।
অর্ষা ম্যানেজারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলছে। অর্ষাকে দেখে মনে হচ্ছে ও এখানে জব করে। নয়তো এত মানুষের সাথে কীসের কথা। রাইসাকে জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিল।
রাইসা জিজ্ঞেস করছে,
“খাবি কিছু?”
আর দর্শন অর্ষাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ওই মেয়েটাকে চিনিস?”
রাইসা ওর প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলো। তারপর অর্ষার দিকে তাকাল। এতক্ষণ ধরে কত কথা বলছে অথচ দর্শনের খেয়াল নেই। দর্শন তাহলে ওকে দেখছিল।
“হ্যা, চিনি তো। ওর নাম অন্বেষা হাসান।”
“এখানে জব করে?”
“হ্যা, ছ’মাস হলো জয়েন করেছে। তোর মতো বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে, আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার।”
দর্শনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বিস্ময় নিয়ে অর্ষার দিকে তাকাল। যে মেয়ে পড়াশোনাকে এড়িয়ে চলত, মোটে পড়তেই চাইতো না, দর্শনের কথাও শুনত না, পরীক্ষায় পাশ মার্ক তুলে যেত, সে আজ ইঞ্জিনিয়ার। আসলেই মেয়েটা বদলে গেছে।
অর্ষা কাজের ফাঁকে দর্শনের দিকে তাকাল। দর্শন তখন রাইসার সাথে কথায় ব্যস্ত।
রাইসা মুচকি হেসে বলল,
“মনে লেগেছে? তোর সাথে মানাবে ভালো কথা বলে দেখব?”
রাইসা মিটমিট করে হাসছে। দর্শনের গা জ্বলে যাচ্ছে।
“শাট আপ! পরিচিত লাগছিল তাই জিজ্ঞেস করলাম। আজেবাজে কথা শুরু করে দিয়েছিস আজিব।”
“বারে,, তুমি যেভাবে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছো।”
“পরিচিত লাগছিল তাই চেয়ে ছিলাম। আর একটা কথা বললে তোর খবর আছে।”
দর্শন আবারও অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা দর্শনের দিকে চেয়ে ছিল তাই চোখে চোখ পড়ে গেল। দুজনেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল। প্রোগ্রাম দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
অর্ষার পার্টি আর ভালো লাগছে না। টায়ার্ড লাগছে। ম্যানেজারকে বলে পার্টি শেষ হওয়ার আগেই চলে যাচ্ছে। অফিসের বাইরে বের হতেই গা ছমছম করে উঠল। সারি সারি গাড়ি রাখা অথচ একটা মানুষ নেই। চারদিকে আলো জ্বললেও গভীর রাত তাই কিছুটা ভয় লাগছে।
অর্ষা সাহস রেখে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ওর গাড়ি পার্কিং লটেই আছে। এক পা আগাতেই কেউ ওর হাত চেপে ধরল। অর্ষার শরীর, মন দুই-ই কেঁপে উঠল অজানা আতংকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার সাহস হচ্ছে না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে নিজেই ওর হাত ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফেলল। সামনের মানুষটাকে দেখে অর্ষা বাকরুদ্ধ। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হঠাৎ ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে দাঁত খিচিয়ে বলল,
“এত সহজে চলে যাবে? সেদিন যেতে দিয়েছি বলে আজও দেব?”
অর্ষা নিজেকে দর্শনের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে দর্শন ওকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে।
“ছাড়ো আমাকে?”
“এত বছর ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলে তাই দূরত্ব সহ্য করেছি, এখন এত কাছে থেকে দূরত্ব কেন সহ্য করব?”
“একদম ফালতু কথা বলবে না। আমাকে যেতে দেও। নয়তো চিৎকার করব।”
“করো, আমি তোমাকে চিৎকার করতে নিষেধ করেছি? যত শক্তি আছে খাঁটাও। আজ তোমাকে ছাড়ছি না।”
অর্ষা শান্ত হলো। চিৎকার চেঁচামেচি করে লাভ হবে না। তাই শান্তভাবে প্রশ্ন করল,
“কী চাও তুমি?”
“জবাব চাই। আমার জবাব চাই।”
“আমি কাউকে জবাব দিতে বাধ্য নই।”
দর্শন চিৎকার করে বলল,
“অবশ্যই বাধ্য তুমি। একটা মানুষের জীবনের সাথে এভাবে খেলবে আর জবাব দিবে না? আমার সাথে কেন এমন করলে? কেন ছেড়ে গেলে? কী অপরাধ ছিল আমার? সাড়ে সাত বছর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি কিন্তু পাইনি।”
অর্ষা ক্ষোভ নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“কারণ তুমি কাপুরুষ। কাপুরুষ তুমি।”
দর্শন ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। ওকে ছেড়ে দিল। ছিটকে সরে গেল ওর কাছ থেকে। অর্ষা বলছে ও কাপুরুষ। অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা কাঁপছে। ওর কাঁপুনিতে রয়েছে রাগ, ক্ষোভ আর ঘৃণা।
দর্শন আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। চলে গেল ওকে রেখে। দর্শন যেতেই অর্ষা বসে পড়ল দেয়াল ঘেঁষে। দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ডুকরে কেঁদে উঠল।
চলবে…….