প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৩৬,৩৭,৩৮

0
310

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৩৬,৩৭,৩৮
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩৬

যত্নে রাখা পুরনো ডায়েরিটা অর্ষা খুলে বসল। সাড়ে সাত বছর ধরে কলমের একটা দাগও পড়েনি। ওদের বাড়ি পরিস্কার করার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিল কিন্তু খুলে দেখেনি। অর্ষা বারান্দায় বসে আছে। আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারকা রাশি। হিরহির করে বাতাস বইছে। আশেপাশের সব বিল্ডিংয়ের লাইট অফ। দূরে শুধু একটা বিল্ডিংয়ে আলো জ্বলছে। কেউ হয়তো রাত জেগে কিছু ভাবনা কিংবা কাজে ব্যস্ত। অর্ষা বারান্দার মৃদু আলোয় ডায়েরি খুলল। প্রতি পাতায় কত কথা লেখা। সে-সব পড়ে অর্ষার মুখে কখনো মলিনতা আবার কখনো হাসি ফুটে উঠছে। ভাবছে কত ভালোবাসা ছিল, কত সুন্দর ছিল সে দিনগুলো। নিজের পাগলামি দেখে মাঝেমধ্যে হেসে উঠছে।

ডায়েরির এক পাতায় ঘটঘট করে লিখল “সাড়ে সাত বছর পরে আবারও রি-ওপেন করলাম।”
তারপর নিচে তারিখ লিখল।
কিছুক্ষণ ডায়েরিতে লেখালেখি করল। চেয়ারে হেলান দিয়ে ডায়েরিটা কোলে রেখে চোখ বন্ধ করল।

****

দর্শন অর্পার রুমে বসে আছে। মনের কথাগুলো কাউকে বলা প্রয়োজন। রুশানকে বললে রেগে যাবে। বলবে বাদ দে, ওকে নিয়ে কেন পড়ে আছিস? বিরক্তি প্রকাশ করবে। না শুনবে ওর অনুভূতিগুলো আর না এ নিয়ে ভালো মন্দ দুটো কথা বলবে। তাই অর্পাকে বলার সিদ্ধান্ত নিল যেহেতু অর্পার বাড়িতেই ঘটনার শুরু।
“আমি সুসাইড এটেম করেছিলাম তাই আমি কাপুরুষ?”
অর্পার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
অর্পা চুপ। ওর কাছে এর কোন জবাব নেই।

দর্শন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বলল,
“প্রতিটা মানুষ বাঁচতে চায়, আর সুন্দর ভাবে বাঁচতে চায়। আমি শখ করে মরতে যাইনি। কেউ শখের বশে মরে না। যে সুসাইড করে সে কাপুরুষ আর যারা বাধ্য করে, ঠেলে দেয় এই পথে তারা কী? তারা নিতান্তই সাহসী, বাস্তববাদী ভদ্রলোক? একটা মানুষ কখন মরতে চায়? যখন সে হতাশায় ডুবে যায়, উঠার চেষ্টা করেও পারে না, কারো সাহায্য পায় না, তখন সে মুক্তির পথ হিসেবে মৃত্যুকে বেছে নেয়৷ আমার কাছের মানুষগুলো আমাকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছে, আমাকে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমার মনোবল ভেঙে আমাকে দূর্বল করে দিয়েছে। তাদের কী উচিত ছিল না আমার মনোবল শক্ত করতে আমাকে সাহায্য করার? তা করেনি। আমার মনোবল ভেঙে আমাকে কাপুরুষ বানিয়েছে। আর এখন চিৎকার করে বলছে আমি কাপুরুষ তাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এটাই না-কি আমার দোষ ছিল। এই দোষে আমি এত বছর শাস্তি পেয়েছি।”

অর্পাও কিছু বুঝতে পারছে না। ছেড়ে যাওয়ার জন্য এটা কোন লজিক হলো?
“ও তোকে এই লজিক দেখিয়েছে? ও যে তোকে দেখতে যায়নি একবারের জন্য সেটা কী? ওর মধ্যে তো মানবতা বলেও কিছু ছিল না। ওর এই কাজকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবে?”

দর্শন চুপ করে আছে। অর্পা ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
“চুপ করে আছিস কেন? চুপ করে থাকলে হবে না। প্রশ্ন করতে হবে। ভালোবাসার মানুষকে মৃত্যুর পথে ফেলে চলে যাওয়াকে কাপুরুষতা বলে না?”

দর্শন স্থির হলো। তারপর চোখেমুখে কাঠিন্য এনে বলল,
“হ্যা, জবাব তো ওকে দিতেই হবে।”

পরের দিন~
দর্শন, অর্ষার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষার আসার খবর নেই। অবশ্য দর্শন সময়ের আগেই এসে পড়েছে। অবশেষে অর্ষা এল৷ ফর্মাল লুকে অর্ষাকে অন্য রকম লাগছে। একেক দিন একেক অর্ষাকে দেখে। অর্ষা গাড়ি থেকে নেমে কয়েক কদম হাঁটার পরেই দর্শনকে দেখল। ওকে এড়িয়ে যেতে চাইলে দর্শন ওর পথ আগলে দাঁড়াল।
অর্ষা বিরক্ত নিয়ে বলল,
“কী চাই তোমার?”

“ওই যে জবাব।”

“সে তো আমি দিয়ে দিয়েছি।”

“সেটা তো একটা প্রশ্নের। আরো প্রশ্ন যে বাকি আছে।”

অর্ষা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আমি তোমার কোন প্রশ্নের জবাব দেব না। আর কেউ আমাকে বাধ্য করতে পারবে না।”

“তুমি বাধ্য। তুমি যখন অন্য একটা মানুষকে নিজের মতো বিচার করতে পেরেছো তখন প্রশ্ন তো উঠবেই।”

অর্ষা গম্ভীরমুখে বলল,
“আমি তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই। এটা আমার অফিস এখানে আমি কোন সিন ক্রিয়েট চাই না।”

“আর কত এড়িয়ে যাবে?”

“দেখো, আমি তোমার সাথে এ নিয়ে কথা বলতে চাই না, যদি চাইতাম তবে এতগুলো বছর তোমাকে এড়িয়ে চলতাম না। তাই এতগুলো বছর পরে জবাব পাওয়ার আশা করাটা বোকামি। ইউ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি সবকিছু সাড়ে সাত বছর আগেই মাটি চাপা দিয়ে ফেলেছি৷ এতগুলো বছরে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাই খুড়ে লাভ হবে না। ফ্রিতে একটা এডভাইস দেই সব কিছু ভুলে যাও এটাই তোমার জন্য বেস্ট হবে।”

“এত সহজ? তুমি আমার সাথে যা করেছো তা এত সহজে কী করে ভুলব? তুমি পারতে?”

“তো এখন কী করতে চাও? মামলা করবে? জজের কাছে আমার মৃত্যুদণ্ডের ফরিয়াদ করবে? তাহলে তাই করো সব অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলব তবুও প্লিজ রোজ রোজ একই প্রশ্ন করো না। ভালো লাগে না। বিরক্ত হচ্ছি।”

দর্শন ওকে দেখে অবাক হচ্ছে। একটা মানুষ এতটা বদলে যায় কী করে? কী করে মুখের উপর এভাবে কথা বলতে পারে? এই অর্ষাকে চেনেই না। দর্শনের মুখের এক্সপ্রেশন বদলে যায়। চোয়াল শক্ত করে বলল,
“আই হেইট ইউ। আর কখনো তোমার কাছে প্রশ্ন নিয়ে আসব না। এই প্রশ্নগুলো আজীবন প্রশ্ন হয়েই থাক৷ তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না।”

দর্শন চলে যেতেই অর্ষা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিরবির করে বলল,
“আমি তোমার সাথে যা করেছি তা নাকি ভুলতে পারবে না। আর তোমার জন্য আমার সাথে যা হয়েছে তা আমি ভুলব কী করে?”

অফিস শেষে অশান্ত মন নিয়ে অর্ষা প্রিয়ার বাসায় গেল। প্রিয়াও অফিস থেকে ফিরে সবেমাত্র ফ্রেশ হয়েছে। অর্ষাকে দেখে চমকে গেল। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে নয়তো এভাবে আসত না।

প্রিয়া ওকে নিয়ে নিজের ঘরে গেল। ফ্রিজ থেকে জুশ এনে অর্ষাকে দিল। অর্ষা এক ঢোক পান করে বলল,
“ও রোজ রোজ আমার সামনে আসছে। আমি কেন ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, কেন ওর সাথে এমন করলাম ব্লা ব্লা। এই একই প্রশ্ন শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। আজ বলল আমি যা করেছি তার জন্য না-কি আমাকে ক্ষমা করবে না। আর ওর জন্য আমার লাইফে যে ক্ষতি হয়েছে তার বেলায়? ওর জন্য আমি এতিম হয়ে গেছি। ওর জন্য আমার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে তার জন্য কী কখনো ওর কাছে কৈফিয়ত নিতে গিয়েছি? যাইনি তো। আমি শুধু ওর থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি। সব ভুলতে চেয়েছি। কিন্তু ও দিচ্ছে না। আমি এখানে ফিরে এসেছি শুধুমাত্র বাবা-মায়ের শেষ চিহ্নের জন্য। নয়তো কখনো ফিরতাম না। আর না কখনো ওর মুখোমুখি হতে হত। আমি কী করব প্রিয়া? এভাবে আমি বাঁচতে পারব না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।”
অর্ষা মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠছে। প্রিয়া ওকে জড়িয়ে ধরল। এর সমাধান প্রয়োজন। অর্ষা মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ছে। ভেঙে যাচ্ছে। এভাবে চললে ওর বড় কোন সমস্যা হয়ে যাবে। ওর মাইন্ড ফ্রেশ থাকা জরুরি। কিন্তু এর সমাধান কী? দর্শনের সত্যিটা জানা? প্রিয়া শীঘ্রই এর সমাধান বের করবে। অর্ষাকে আর কষ্ট পেতে দিবে না।

চলবে…..

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩৭

নীরবতায় কাটছে দিন। পাতা ঝড়া শীতের আগমন ঘটেছে। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সকালে অর্ষার ঘুম থেকে উঠতেই ইচ্ছে করে না। শরীর ও মন আরেকটু উষ্ণতা চায়। কম্বল জড়িয়ে আদূরে ঘুম দিতে চায় কিন্তু অফিসের জন্য তা আর হয়ে উঠে না। অতি পছন্দের ঋতুটা হঠাৎ-ই অপছন্দের হয়ে উঠেছে। নয়টায় অফিস। যেতে অন্তত আধঘন্টা সময় লাগে। ফ্রেশ হওয়া, অফিসের জন্য তৈরি হওয়া, নাস্তা করা সব মিলিয়ে চল্লিশ -পয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। অর্ষা অগত্যা বিছানা ছাড়ল। আড়মোড়া দিতে দিতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পর্দা সরিয়ে সকালটা উপভোগ করতে উদ্বত হলো তখনই সার্ভেন্ট ঘরে কফি দিয়ে গেল। অর্ষা ধোঁয়া উঠা কফির মগ হাতে নিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়াল। পুরো শহর কুয়াশায় ঢাকা। তবুও জীবন জীবিকার জন্য কতজন ছুটে চলেছে, স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীরা শীতের পোশাক পরে ঠান্ডায় গুজো হয়ে হাঁটছে। অর্ষা কফিটা শেষ করে ফ্রেশ হয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিল।

ডাইনিং-এ যেতে যেতে খালা-খালুর কথোপকথন শুনল। তারা ওর বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। ওকে দেখে চুপ করে গেল। অর্ষাও পাত্তা দিল না। না শোনার ভান করে নাস্তা করতে বসল। টেবিলে আয়ানকে দেখতে না পেয়ে বলল,
“আয়ান ভাই অফিসে চলে গেছে?”

অর্ষার খালা বলল,
“হ্যা, ওর কি একটা কাজ আছে তাই আগে আগে চলে গেছে।”

অর্ষা আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিল। ফ্রুটস জুশের গ্লাসে চুমুক দিতেই খালু আমতা আমতা করে বলল,
“অর্ষা, এতদিন তুমি তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত ছিলে। ভালো ক্যারিয়ার গড়তে উদ্যমী হয়েছিলে। এখন তো তোমার চাকরি ভালো চলছে। সবকিছু আছে তোমার কাছে। এবার তো বিয়েটা করা যায়। তোমার খালা মনির শরীর কেমন থাকে জানোই তো। তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করে। বারবার বলে মরার আগে ওর বিয়েটা দিতে পারলে, ওকে সংসারী দেখে যেতে পারলে মনটা শান্তি পেত।”

অর্ষা পুরো ফ্রুটস জুশ শেষ করে খালার দিকে একবার তাকাল। তারপর খালুর দিকে চেয়ে বলল,
“আমি জানি আপনারা আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। আপনারা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি জানি কেন এত চিন্তা করেন। তবে একটা প্রশ্ন করি, সত্যিই কী আমার সব আছে? বিয়ে করে সংসার করার মতো সব এবিলিটি আমার আছে? আমি কী পারব অন্য একটা পরিবারে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে? তাদের সব দিক দিয়ে সুখী করতে? আমি এতিম, বাবা-মা নেই। এছাড়া আরও জটিলতা আছে। এমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে এটা ভেবেই খালা দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। খালা কেন এত চিন্তা করো? আমি চাকরি করি। টাকাপয়সা সব আছে আমার। আল্লাহর রহমতে আমাকে না খেয়ে মরতে হবে না। আজীবন নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারব। আ’ম হ্যাপি উইথ দিস। বিয়ে, একটা পরিবার এসব আমার প্রয়োজন নেই।”

“তবুও মা, ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য শুধু টাকাপয়সা নয়, একটা পরিবারও প্রয়োজন।”

“খালা মনি তুমি সব জেনেও…..

” আমরা এমন ছেলের সাথেই তোর বিয়ে দেব যে কি-না তোকে সুখে রাখবে। তোর জীবনের জটিলতা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। তুই শুধু একবার হ্যা বল।”

অর্ষা মাথা নিচু করে আছে। চোখে পানি জমেছে। কেউ যদি দেখে ফেলে তাই মাথা তুলছে না। দ্রুত বেরিয়ে গেল অফিসের জন্য।
ও যেতেই খালা মনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“কথা কিছুতেই আগানো যাচ্ছে না। ও ওর অতীতের মধ্যে এতটা ডুবে আছে যে বের হতে পারছে না। এখনো আতংকে থাকে। ভয় পায় কথা বলতে।”

“আয়ানের সাথে ওর বিয়েটা দেব কিভাবে? আমাদের আয়ানের সাথে কথা বলা উচিত। আয়ান যদি পারে….”

“অর্ষা যদি না রাজি হয় তাই ওকে বলিনি। আয়ানের সাথে বিয়ে দিলে ওর জীবনে আর কোন জটিলতা থাকবে না। কার সাথে বিয়ে দেব, কোন পরিবারে দেব তারপর যদি বাবা-মাহীন ভেবে সুযোগ নেয়, যদি অবহেলা করে। বোনকে অকালে হারিয়েছে। ওকে সুখী দেখতে চাই।”

“এইজন্যই তো ছেলের বউ করতে চাইছি। যাতে ওর ফিউচার সিকিউর থাকে।”

“কিন্তু কিছুই আগাতে পারছি না। ঘুরে-ফিরে এক জায়গায় গিয়ে থেমে যায়।”

পুরোটা দিন গাঢ় বিষন্নতায় কেটেছে অর্ষার। ভার মুখেই অফিস থেকে বের হয়েছে। কিছুই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে জীবন থেকে সব রঙ হারিয়ে গেছে। বেসুরে, বেরঙ জীবন। ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিল। জানালার কাচ খুলে বাইরে তাকাল। এই ঠান্ডার মধ্যেও কেমন যেন দম বন্ধ লাগছে। জানালা খুলতেই ফুরফুরে বাতাস ভেতরে এল। অর্ষাকে ছুয়ে দিল গভীর ভাবে। শরীরে হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে উঠল। ফুটপাতে একটা মেয়ে একটা বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে একজন ভদ্রলোক এল। মেয়েটির কোল থেকে বাচ্চাটি নিয়ে আদর করতে লাগল। দুজনে মিলেই আদর করতে করতে কীসব বলছে আর হাসছে। কি সুন্দর দৃশ্য!
একটা বাচ্চার কাছে তার নিরাপদ আশ্রয়স্থল তার বাবা-মা। বাবা-মা থাকলে আর কিছু লাগে না। কারো কাছে আকুলতা নিয়ে পড়ে থাকতে হয় না। আর বাবা-মায়ের কাছে সন্তানই সব। একটা সন্তান তাদের জীবনে রঙ এনে দেয়। খুশিতে ভরিয়ে দেয়। সন্তানহীন জীবন প্রত্যেক দম্পত্তির রঙিন জীবন বিবর্ণ করে দেয়।
অর্ষা চোখ ফিরিয়ে নিল। কান্না পাচ্ছে খুব। নিজেকে অসহায় লাগছে। বুকটা হু হু করছে।চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ভেতরের চাপা কান্নাটা চিৎকার করে বলে উঠছে,
“হে সৃষ্টিকর্তা কেন আমাকে অপূর্ণ করে দিলে? আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমি পূর্ণ নই কেন?”
চোখ মুছে অর্ষা বাইরে বের হলো। সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ চোখ গেল এটিএম বুথের দিকে। দর্শন বুথ থেকে টাকা তুলছে। অর্ষা ওকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। দর্শন টাকা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে অর্ষাকে দেখেও না দেখার ভান করে গাড়ির কাছে গেল। গাড়ির সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শনকে দেখে হাসি মুখে কি যেন বলল। দর্শন নিজেও আলতো হাসল। তারপর দরজা খুলে দিল মেয়েটার জন্য। মেয়েটা ভেতরে বসতেই দর্শন অপর পাশের দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। মুহুর্তেই গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল। অর্ষা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখল।

_______

অর্পার জন্মদিনের দাওয়াত করার জন্য কল করেছে প্রিয়াকে। প্রিয়া দাওয়াত কবুল করে ইতস্তত করে বলল,
“আপু অর্ষাকে বলেছো?”

প্রিয়ার প্রশ্নে অর্পা বিব্রত হলো। এতকিছুর পরে অর্ষাকে বলতে চায় না। চায়না ও আর দর্শন আর মুখোমুখি হোক। দর্শন আবারও কষ্ট পাক। এই কথাটা প্রিয়াকে বলা জরুরি। তাই স্পষ্ট উত্তর দিল,
“না, আমি চাই না দর্শন ওর জন্য আর কষ্ট পাক।”

প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কষ্ট তো অর্ষা কোন অংশে কম পাচ্ছে না।
“কিছু মনে করো না। আসলে আমি চাইছি ওদের আবারও মুখোমুখি করতে। এদিকে অর্ষা কষ্ট পায়, কাঁদে সব কিছু বন্ধু হিসেবে আমাকে দেখতে হচ্ছে। আর অপর প্রান্ত দর্শন ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে তারজন্য বন্ধু হিসেবে তোমাদের দেখতে হচ্ছে। আপসেট হতে হচ্ছে। অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে কিন্তু এভাবে কতদিন? যতক্ষণ পর্যন্ত একে অপরের সাথে খোলাখুলি কথা না বলছে, যতদিন পর্যন্ত সবকিছু ক্লিয়ার না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এভাবেই চলবে। কেউ সত্যির মুখোমুখি হবে না।”

“কোন সত্যি?”

“যা শুনলে হয়তো তুমি শিউরে উঠবে। তোমার আমার দেখার মধ্যেও হয়তো অনেক ফাঁক রয়ে গেছে। অনেক কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না সেজন্য জানা জরুরী, বলা জরুরী। আর তাই চাচ্ছি দুজন বারবার মুখোমুখি হোক যতদিন পর্যন্ত সব ধোয়াশা না কাটে।”

“যদি হিতে বিপরীত হয়?”

“বিপরীত হতে হতে একদিন বাস্তব সত্যতা সামনে আসবে।”

“আমার ভয় করছে দর্শন কী রিয়েক্ট করবে আর তাছাড়া অর্ষা আসার জন্য রাজি হবে বলে মনে হচ্ছে না।”

“অর্ষার সাথে ইমোশনাললি কথা বলবে রাজি হবে। আর দর্শনের ব্যাপারটা তুমি বুঝে নিও।”

“কিন্তু কিছু কি মিরাকল হওয়ার সম্ভাবনা আছে? আমিও অপেক্ষা করছি আড়ালে কি আছে দেখার জন্য।”

“ইনশাআল্লাহ। আশা করা যায়। আর আমি তো আছি। ওদের মুখোমুখি করব। শুধু দোয়া করো ওরা যেন খোলাখুলি কথা বলে। ওদের মনের ভেতর অনেক কথা জমা হয়ে আছে কিন্তু বলে না। কোন কারণে বলার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে। ”

অর্পা কল কেটে বড় করে শ্বাস নিল। প্রিয়া ম্যাসেজ করে অর্ষার নাম্বার দিয়েছে। অর্পা ওর নাম্বার বের করল। বের করে কল দিল।

চলবে…..

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩৮

অর্ষা ল্যাপটপে মুভি দেখছিল। পাশে রাখা মোবাইলটা কেঁপে উঠায় সেদিকে চোখ গেল। অর্পা কল করেছে। ওর কপালে ভাজ পড়েছে। অর্পা ওকে কল করেছে কিন্তু কেন? অনেক আগেই প্রিয়ার কাছ থেকে অর্পার নাম্বার নিয়েছিল। নাম্বারও সেভ করে রেখেছিল। কিন্তু কখনো কল দেওয়া হয়নি। এতকিছুর পরে নিশ্চয়ই খোশগল্প করতে কল দেয়নি। হয়তো সিরিয়াস কিছু নিয়েই কথা বলবে। অর্ষা ভেবে পাচ্ছে না কি বিষয়ে কথা বলতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেল।
“এই যাহ! কলই কেটে গেল। যাক ভালো হয়েছে।”
অর্ষা আবারও মুভি দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেল। পরক্ষণেই আবার কল আসল মোবাইলে। অর্ষা অনেকটা বাধ্য হয়ে দুরুদুরু বুকে কল রিসিভ করল।
কল রিসিভ করে চুপ করে রইল। অপর পাশ হতে অর্পা বলল,
“অর্ষা!”

“হ্যা, অর্ষা বলছি।”

“আমি অর্পা।”

“হ্যা আপু বলো।”

“কেমন আছো?”

“এইতো ভালো। তুমি কেমন আছো?”

“ভালো। সামনের সপ্তাহে চলে যাচ্ছি।”

এই মুহুর্তে কি বলা উচিত অর্ষা জানে না তাই চুপ করে থাকাকে শ্রেয় মনে করল।
“আগামীকাল আমার জন্মদিন। ক্লাবে একটা পার্টি রেখেছি৷ আসলে পার্টি বললে ভুল হবে। জন্মদিন ইস্যু হলেও পার্টি মূলত শেষ মিলনায়তন। আবার কবে আসি ঠিক নেই। হয়তো আসবও না। আসলেও হয়তো কারো সাথে আর দেখা হবে না। কারণ সময় পরিস্থিতি সব সময় এক রকম থাকে না। সবকিছু, সবাই বদলে যেতে পারে। এখন তো বদলে যাওয়াই মানুষের ধর্ম। তাই চাইছিলাম শেষ বারের মতো প্রিয়দের সাথে একটু সময় কাটাতে। তুমি তো কখনো আমার অপ্রিয় ছিলে না। আশা করি আসবে। ব্যক্তিগত দ্বিধা দ্বন্দ্ব সব সময় সাথে নিয়ে ঘুরতে হয় না। সব অস্বস্তি কাটিয়ে মাঝেমধ্যে খোলামেলা বাঁচতে হয়। প্রাণ খুলে কথা বলতে হয়, হাসতে হয়। আই হোপ তুমি বুঝতে পেরেছো। যথেষ্ট বুদ্ধিমান তুমি।”

অর্ষা নিচু স্বরে বলল,
“হ্যা, বুঝতে পেরেছি।”

“তাহলে আসছো? লাস্ট টাইম। আর হয়তো কখনো বলব না। এড্রেস…….। সন্ধ্যে বেলায় চলে এসো।”

অর্ষা জানে না যাবে কি-না তবে এই মুহুর্তে মুখের উপর না করতে পারছে না।
“আচ্ছা। ভালো থেকো। অগ্রিম জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।”

“ধন্যবাদ। তুমিও ভালো থেকো। রাখছি।”
অর্ষা বিদায় দেওয়ার আগেই অর্পা কল কেটে দিল। অনেকটা ব্যস্ততা দেখাল। অর্ষা মোবাইল হাতে নিয়ে ভাবছে ব্যস্ত না ইগ্নোর করল। ইগ্নোর করলে কী কল করত? জন্মদিনের ইনভাইটেশন দিত?
অর্পা কল কেটে কাউচের উপর বসল। ইচ্ছে করছিল অর্ষাকে অনেকগুলো কথা বলতে। অনেক প্রশ্ন করতে কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রেখে স্বাভাবিক কথাবার্তাই বলেছে।
অর্ষা ভাবতে ভাবতে প্রিয়াকে কল দিল। প্রিয়াকে কল দিতেই সাথে সাথে রিসিভ করল যেন ওর কলেরই অপেক্ষায় ছিল। কল রিসিভ করে সাথে সাথে বলল,
“হ্যা, বল কী খবর?”

অর্ষা ওর প্রশ্ন শুনে ভরকে গেল। তারপর কন্ঠ গম্ভীর করে বলল,
“কী খবর মানে কী? তোকে কী কোন খবর দেওয়ার কথা ছিল?”

প্রিয়া থতমত খেয়ে বলল,
“না মানে কিছু বলার জন্যই তো কল করেছিস।”

“হ্যা বলার জন্যই। শোন, আগামীকাল না-কি অর্পা আপুর জন্মদিন। তোকে ইনভাইট করেছে?”

“হ্যা, করেছে তো। কেন?”

“আমাকেও করেছে।”

“ওহ আচ্ছা।”

“সামনের সপ্তাহে তো চলে যাচ্ছে। অনেক করে বলল কিন্তু আমি কী করে যাব? ওখানে দর্শন থাকবে। দুজনেই অস্বস্তিতে পড়ব।”

“সে তোর ইচ্ছে। আমি কি বলব? তবে কি জানিস একটা কথা বলি। কিছু মনে করিস না। তোর কথা শুনলে মনে হয় তুই অনেক বড় ক্রাইম করে ফেলেছিস। তাই নিজেকে গর্তে লুকিয়ে রাখতে চাস। এই ব্যাপারগুলো আমার জাস্ট অসহ্য লাগে। আরে ভাই, বাঁচার হক তোরও আছে। তাই নিজের মতো বাঁচার চেষ্টা কর। কে কি বলবে ডোন্ট কেয়ার। কেয়ার করতে গেলেই তোকে সংকুচিত হয়ে পড়তে হবে। এমন ভাবে চলবি যেন তোর কোন কিছুই ফারাক পড়ছে না। কাকে কী বলছি,, যাকগে বল কি বলতে চাস।”

“কিছু না কল রাখছি।”
অর্ষা কল কেটে দিল।

_________________

রুশান ভাবছে প্রাক্তনকে কি উপহার দেওয়া যায়। প্রাক্তনের জন্মদিনের দাওয়াত পেয়েছে দুদিন পর হয়তো বিয়েরও দাওয়াত পাবে। কি নির্মম! কিভাবে সব বদলে যায়! কি করে মানুষও বদলে যায়! কি করে নিজেও বদলে গেল! জন্মদিনে যাবে কিন্তু ওকে কি উপহার দিবে? রুশান ওকে দেওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। মার্কেটে গেলে অনেক দামী দামী উপহারসামগ্রী চোখে পড়লেও সেগুলোতে সন্তুষ্ট নয় রুশান। ও অর্পাকে আনকমন কিছু দিতে চায়। যা অর্পার মন ছুয়ে যাবে অথবা মনে দাগ কেটে যাবে। রুশান কিছুক্ষণ ভেবে বসা থেকে উঠে গেল। টেবিলে গিয়ে বসে টেবিলল্যাম্প অন করে রঙিন কাগজে গটগট করে কয়েক লাইন লিখল। তারপর লেখাটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। পারফেক্ট! হাতের লেখাও আগের চেয়ে যথেষ্ট সুন্দর হয়েছে। মনে রাখার মতো একটা চিরকুট লিখেছে। র‍্যাপিং পেপারে মাঝারি সাইজের একটা বক্স প্যাক করল। ব্যস। এই-বার সন্তুষ্ট রুশান। নাহ! আরো কিছু দেওয়া উচিত। অফিস থেকে ফেরার পথে ওর জন্য একটা শাড়ি কিনবে। সব গুছিয়ে রাতে পার্টি এঞ্জয় করতে চলে যাবে।
রুশান দুটো গিফট বক্স নিয়ে অর্পার পার্টিতে গেল। ওর গায়ে এস কালার স্যুট। অনেকটা ফ্রেশ লাগছে। একটা টেবিলের উপরে অনেকগুলো বক্স রাখা। রুশান চুপচাপ সেখানে বক্স দুটো রেখে দিল। চারদিকে হরেক রকমের লাইটিং। স্লো মিউজিক চলছে। তবে লোকজন কম। সব মিলিয়ে বিশ কি পঁচিশ জন হবে। হয়তো আরো মানুষ পরে আসবে। রুশান ওয়েটারের কাছ থেকে একটা ড্রিংক নিল। এক স্থানে দাঁড়িয়ে অর্পাকে খুঁজছে। আজকে অর্পার জন্মদিন। ওকেই তো খুঁজবে। অর্পাকে খুঁজে পেল। অর্পা কালো খয়েরী রঙের একটা গাউন পরেছে। মাথায় একটা ক্রাউন। চুলগুলো খোলা। চোখে টানা টানা কাজল, ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী লিপস্টিক। কানে স্টোনের দুল আর গলায় জ্বলজ্বল করছে একটা লকেট। একদম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল অর্পাকে। মনে হচ্ছে কোনো রাজ্যের রাজকন্যা এসে দাঁড়িয়েছে। রুশান অপলক চেয়ে আছে। তখনই হঠাৎ ঘাড়ে কারো হাত পড়ল। রুশান চমকে পেছনে তাকাল। দর্শন ওর কাঁধে হাত রেখেছে। দর্শনের সাথে হাতে হাত মেলালো রুশান।
“হেই, কী খবর দোস্ত?”

“আমার খবর তো ভালো। তোর খবর বল।”

“চলছে, ভালোই।”

দর্শন একবার অর্পার দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“তুই ভালো আছিস?”

রুশান প্রথমে ভরকে গেল। অতঃপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“অবশ্যই।”

“তাহলে ওইদিকে এভাবে চেয়ে আছিস কেন? অর্পাকে ভুলতে পেরেছিস?”

রুশান তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“বলদ! ওর বার্থডেতে এসেছি। ও আজকের বড় চমক। অবশ্যই আজ সবাই ওকে দেখবে। ওর দিকেই সবার এটেনশন থাকবে। তাই আমিও দেখছি।”

‘আর ইউ শিওর?”

“হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”
দর্শন আর কথা বাড়ালো না। অর্পাকে শুভেচ্ছা জানাতে চলে গেল। অর্পার সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। বারবার মনে হলো অর্পা কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলছে না।
দর্শন ড্রিংক নেওয়ার জন্য অন্যদিকে গেল। ড্রিংক নিতে গিয়ে প্রিয়াকে দেখল। প্রিয়া নিজের মোবাইলে সেল্ফি তোলায় ব্যস্ত। দর্শন ওকে দেখে ওর আশেপাশে তাকাল। অর্ষা আনেনি তো? ওকে না দেখে নিশ্চিন্ত হলো। দর্শন ড্রিংক নিয়ে ক্লাবের বাইরের দিকে গেল। ক্লাবটি তিনতলায়। দর্শন বারান্দার রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে অস্বস্তি লাগছে। এত মানুষের মধ্যে সচারাচর যায় না ও। হঠাৎ অপর পাশে একটা মেয়েকে দেখে থমকে গেল। অর্ষা এসেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে না পার্টিতে এসেছে। ওর চেহারা কিংবা সাজে তার আমেজ নেই। ও কালো রঙের একটা লং ড্রেস পরেছে, কানে স্টোনের ছোট টপ, আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, লম্বা সিল্কি চুলগুলো খোলা। হাতের হ্যান্ড ব্যাগটা ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করা। ও আশেপাশে না চেয়ে নিজের মতো করে ভেতরে ঢুকে গেল। দর্শন অর্পার উপর ভীষণ বিরক্ত হলো। সব জেনেও অর্ষার প্রতি এত ভালোবাসা কই থেকে আসে? একবারও কি দর্শনের কথা ভাবেনি? ওর সাথে কী করেছে ভুলে গেল? ওকে ইনভাইট করা কি খুব জরুরী ছিল? দর্শনের ইচ্ছে করছে চলে যেতে কিন্তু পারছে না। আজ অর্পার জীবনের এত বড় একটা দিন। বিরক্ত মুখেই ভেতরে গেল।
অর্ষা অস্বস্তি নিয়ে অর্পার কাছে গিয়ে শুভেচ্ছা জানাল৷ সবাই চলে আসার পর অর্পা কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন করল। রুশান দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখল। কাছে যায়নি। আজ ইচ্ছে করছে না কাছে যেতে। কেমন একটা ব্যথা অনুভব করছে। মনে হচ্ছে কাছে গেলে অঘটন ঘটে যাবে।

কেক কাটা শেষে অর্ষা, অর্পার দেখে বিদায় নিতে যাচ্ছিল। তার আগেই দর্শন অর্পার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণ ও দর্শনকে দেখেনি।
দর্শন অর্পার কাছে গিয়ে একটু গম্ভীর ও অসন্তুষ্ট মুখে বলল,
“অর্পা আমি যাই, আজ আমার একটু কাজ আছে।”

অর্পা রহস্য নিয়ে বলল,
“আজ একটা সারপ্রাইজ আছে। তাই কারো যাওয়া হবে না। প্লিজ আরেকটু অপেক্ষা কর।”

অর্ষা পেছনে থেকে ফিসফিস করে বলল,
“আপু আমার তো এখানে কোন কাজ নেই। অনেক রাত হয়ে গেছে। আজ আমি আসি।”

অর্পা, অর্ষার হাত চেপে ধরে বলল,
“এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা তোমারই।”
অর্পা ওর হাত চেপে ধরে এক পাশে নিয়ে যাচ্ছে। অর্ষা ওর আচরণে ভরকে গেল। বুঝতে পারছে না কি করতে যাচ্ছে তবে ভীষণ ভয় হচ্ছে।

ক্লাবের সাথে ঝুলন্ত বড় একটা বারান্দা। সেখানে প্রিয়া, অর্ষা, অর্পা, দর্শন, রুশান, তামিম আর রাতুল বসে আছে। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। অর্ষা বারবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে আর অর্পা বারবার থামিয়ে দিচ্ছে।
“অর্ষা, তুমি না কত সুন্দর গান করতে? আমার জন্মদিন উপলক্ষে একটা গান গাইবে?”

অর্ষার চোখেমুখে ভয়, অস্বস্তি, আতংক।
“আপু আমি এখন আগের মতো গাইতে পারি না। এখন আর গান গাওয়া হয় না।”

অর্পা কিছু বলল না শুধু মৃদু হাসল।
“দর্শন, তুই গিটার বাজিয়ে শোনা।”

দর্শন সরাসরি বলল,
“আবল তাবল বকিস না।”

অর্পা ওকেও কিছু বলল না।
“অর্ষা, সেদিন তুমি কেন আসোনি? দর্শনকে পাগলের মতো ভালোবাসতে ওর সুইসাইড করার নিউজ শুনে তো সেদিন পাগলের মতো ছুটে আসার কথা ছিল। কিন্তু আসোনি। ও কাপুরুষের মতো কাজ করেছে এই যুক্তিতে আড়ালে ছিলে, তারপর একদম আড়াল হয়েই রইল। কেন? তুমি সত্যি ওকে ভালোবাসতে তো?”

দর্শন ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,” অর্পা, এই টপিক কেন? অতীত নিয়ে আর কোন কথা না হোক। এসব নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করিস না, ভালো লাগে না। বাদ দে এই টপিক।”

“আমি জানতে ইচ্ছুক দর্শন। কোন অপরাধে তুই, আমরা এতবড় শাস্তি পেলাম। তুই ভুল কাজ করেছিলি এটা জানার পরেও আমরা সবাই ছুটে গিয়েছি, তোর পাশে থেকেছি। তোকে সব সময় সাপোর্ট করেছি। আসলে কি জানিস বন্ধুরা এমনই হয়৷ প্রেম ভালোবাসার চেয়ে বন্ধুত্ব অনেক বড়। বন্ধুরা কখনো বন্ধুকে বিপদে ফেলে পালায় না।”

অর্ষার বদলে প্রিয়া বলল,
“বন্ধুরা বন্ধুর অপমানও সহ্য করে না। বন্ধুকে কারো সামনে ছোট হতে দেয় না। অর্ষা সেদিন গিয়েছিল। ছুটেছিল পাগলের মতো। আর সেই ছোটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। পিচঢালা রাস্তায় রক্তের বন্যা বয়ে যায়। আই সিওতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। ডাক্তার যখন ভরসা দিতে পারছিল না তখন একমাত্র মেয়েকে হারানোর আতংকে স্ট্রোক করে বসে ওর বাবা। অর্ষা তো রেসপন্স করে কিন্তু ওর বাবা না ফেরার দেশে চলে যায়। অর্ষার জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারে ওর বাবা নেই। ওর ভেতর তখন কি চলছিল কেউ আন্দাজ করতে পারছো? ভাঙা পা, সারা শরীর ভর্তি ক্ষত নিয়ে চলেছে দুইটা মাস। ওর শরীরে এখনো অনেক ক্ষতের চিহ্ন আছে। দর্শনের আর কি ক্ষতি হয়েছে? কিছুদিন পরে ঠিকই সেই দর্শন হয়ে গেছে। কিন্তু ও এতিম হয়ে গেছে সেদিন। পরবর্তীতে ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারে…..

” স্টপ প্রিয়া!”
অর্ষার চিৎকারে সবার মনোযোগ নষ্ট হয়। এতক্ষণ ধরে সবাই গভীর ভাবে তলিয়ে গিয়েছিল একটা দুঃখজনক অতীতে। অর্ষা চোখ বন্ধ করে কান চেপে ধরে চিৎকার করছে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল অর্ষা। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। শরীর থরথর করে কাঁপছে ওর।
অর্ষা আর এক মুহুর্ত দেরি করল না। বেরিয়ে গেল। কিন্তু প্রিয়া গেল না।
“ওর হাসিখুশি জীবনটা তছনছ হয়ে গেছিল সেদিন। সব হারিয়ে মেয়েটা যখন নিঃস্ব তখন দর্শন ইউএসএ বসে বসে পিক পোস্ট করে। অর্ষা যখন নতুন করে বাঁচার জন্য, খুশী থাকার জন্য ঢাকা ব্যাক করে তখন প্রতিনিয়ত তোমাদের প্রশ্ন আর খোঁচায় দুর্বিষহ হয়ে পড়ে ওর জীবন। তোমরা সবাই মিলে ওর বেঁচে থাকা হারাম করে দিচ্ছো। কি চাও ও মরে যাক? মরে তো গেছেই। বেঁচে আছে শুধু খেয়ে-পরে, মনটা মরে গেছে। দুপক্ষের দেখার পরেও আরো কিছু থাকে যার সাক্ষী তৃতীয় কোন ব্যক্তি।”
প্রিয়া কাঁদতে লাগল। তারপর অর্ষার পেছনে ছুটতে লাগল।

সবাই ওর কথা শুনে বাকরুদ্ধ। বিশেষ করে দর্শন। ও হাঁটু গেরে বসে পড়ল। পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here