প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৩৯,৪০

0
397

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৩৯,৪০
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩৯

নিস্তব্ধ একটা রাত। ঘুম নেই অর্ষা, অর্পা, দর্শন কিংবা রুশানের চোখে। অর্ষার ক্লান্ত চোখগুলো চেয়ে আছে আকাশ পানে। বাড়িতে ফেরার পর থেকে কেঁদেই চলেছে। কান্নাই যেন জীবনের সঙ্গী। কত চেষ্টা, কত পরিশ্রম বিভীষিকাময় অতীতকে মুছে ফেলার কিন্তু পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে কেন ফিরে এল দেশে! বিদেশেই তো ভালো ছিল। মাঝেমধ্যে মনে পড়ত কিন্তু চোখের সামনে তো ছিল না দর্শন। অপরদিকে দর্শন অনুশোচনায় মরে যাচ্ছে৷ অর্ষা, যার পুরো পৃথিবী ছিল বাবা, মা নেই বলে কত কষ্ট চেপে রেখেছিল বুকে সে সাড়ে সাত বছর আগে বাবাকে হারিয়েছে। বাবা-মা ছাড়া প্রতিটি সন্তানের জন্য দুনিয়া কত কঠিন যদি হয় সে মেয়ে তবে তো কথাই নেই। অর্ষাকে কত প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। কষ্টগুলো শেয়ার করার মতো কেউ ছিল না। কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে, গুমরে কেঁদে উঠেছে। তখন মাথায় হাত বুলানোর মতো কেউ ছিল না। জীবনে এতবড় ধাক্কা খেয়েছে বলেই বদলে গেছে। এসব ভাবতেই দর্শনের বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

অর্পা রুশানের গিফট বক্সটা হাতে নিয়ে বসে আছে। খুলবে কি-না ভাবছে। চকচকে র‍্যাপিং বক্সটা নেড়েচেড়ে দেখছে। কেমন ঝনঝন করছে। বক্সটা বড় হলেও বেশি ওজন নয়। কৌতূহল নিয়ে বক্সটা খুলল অর্পা। বক্সের ভেতর দেখে চমকে উঠে। রিলেশন চলাকালীন সময়ে যা যা গিফট করেছিল সেগুলো সব ফেরত পাঠিয়েছে। সাথে একটা চিরকুট। অর্পা দ্রুত চিরকুট হাতে নিল। হাঁটতে হাঁটতে জানালার কাছে গিয়ে চিরকুটটা খুলল। গোটাগোটা হাতে লিখা,
“জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিও। আগামী দিনগুলো সুন্দর ও ভালোবাসাময় হোক। তোমাকে কি দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল যাই দেই এত দামী দামী উপহারসামগ্রীর মধ্যে বিলিন হয়ে যাবে। তোমার মনে পড়বেই না। তাই ইউনিক কিছু দেওয়ার চেষ্টা। তোমার দেওয়া উপহারগুলো ফেরত পাঠালাম। হয়তো সবটা পারিনি তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা অনেক আগেই ফেরত দিয়েছি। কী বলো তো? তোমার মন। যেটা অনেক বছর আগে ফেরত নিয়ে গেছো। যাইহোক প্রবাস জীবন সুন্দর হোক। চমৎকার একজন জীবন সঙ্গী পাও এই প্রার্থনাই করি। ভালো থেকো।”
অর্পা রাগে গজগজ করছে। রুশান ওকে ডিরেক্টলি খোঁচা মারছে। কত বড় সাহস! আর মন ফেরত নিয়েছে মানে কী? ও ফেরত দেয়নি? ও কি ইচ্ছে করে ব্রেক আপ করেছে? ও যদি উল্টো পালটা কাজ না করত তাহলে কি ব্রেক আপ হত?
চোখে পানি এসে পড়ছে অর্পার।
রাগে, ক্ষোভে রুশানের নাম্বারে ডায়েল করল। রুশান নিজেও জেগে ছিল। ঘুম আসছিল না ওর। অর্পার ফোন দেখে মৃদু হেসে বিরবির করে বলল,
“এত তাড়াতাড়ি রিয়েকশন আশা করিনি।”

কল রিসিভ করেই রসিকতা করে বলল,
“বাহ! এত রাতে আমাকে মনে পড়ল?”

অর্পা আরো রেগে গেল।
“শাট আপ! এটা কেমন উপহার ছিল? আমার দেওয়া জিনিস আমাকেই উপহার দিচ্ছো? আর চিরকুট! তোমার মাথায় কি সমস্যা আছে?”

“সবার আগে আমার উপহার বক্স খুলেছো? ইন্টারেস্টিং!”

অর্পা ধরা পাওয়ার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“ব্রেক আপ-এর জন্য আমাকে দায়ী মনে করো? আমি দোষী ছিলাম? হাহ?”

“চিরকুটের কোথাও এমনটা লেখা ছিল বলে মনে পড়ছে না।”

“তুমি অনেক চালাক। ডাইরেক্টলি কিছু বলোনি কিন্তু খোঁচা ঠিকই মেরেছো।”

রুশান এতক্ষণে সিরিয়াস হলো। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“আমি কোথাও এটা বলিনি। কারণ আমি জানি আমারই দোষ ছিল। আমার চরিত্র খারাপ ছিল। আমি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করি, একাধিক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করি। মোটকথা আমি মেয়েবাজ ছেলে। চরিত্র খারাপ ছেলের সাথে কোন ভালো মেয়েই সম্পর্ক রাখবে না। খুব ভালো করেছো। তোমার সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী ছিল। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তোমার জীবনটা ছাড়খার হয়ে যেত।”

রুশান যে আবারও ওকে তাচ্ছিল্য করল। অর্পার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
“আমি কখনো বলেছি তুমি মেয়েবাজ? আমাকে অপবাদ কেন দিচ্ছো?”

“তোমাকে কই অপবাদ দিলাম? আমি তো শুধু নিজের সত্যিটা তুলে ধরলাম। আমি যা তাই বললাম।”

অর্পা ওর কথায় তীক্ত অভিমান, অভিযোগের সুর পাচ্ছে। নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে দিল। তবে বোঝাতে চাইল না রুশানকে। ওর ফুসফুস শব্দ শুনেই বুঝে গেল ও কাঁদছে। তাই কণ্ঠস্বর মোলায়েম করে জিজ্ঞেস করল,
“কাঁদছো কেন?”

অর্পা কান্না থামিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলল,
“কাঁদবো কেন? তুমি বহু বছর আগে আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করেছো। আমাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছো কাঁদিনি তো। আজ কেন তোমার তিক্ত কথায় কাঁদবো? তোমার তিক্ততায় যতই রক্তক্ষরণ হোক কাঁদবো কেন? কে তুমি?”

রুশান ভেতরে ভেতরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে বলল ঠিকই তো কে আমি? কেন প্রভাব পড়বে? তবে একদিন তো সব ছিলাম। প্রিয় বন্ধু, প্রিয়তম। আজ কেউ নই।
“বিদেশে যদি কখনো শাড়ি পরার সুযোগ হয় তবে শাড়িটা পরো। ভালো লাগবে আমার। যদিও আমার ভালো লাগায় তোমার কিছু যায় আসে না। যদি কখনো মনে হয়……
যাইহোক তোমার ঘুম নষ্ট করতে চাই না। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও। রাখছি।”

অর্পা উত্তর না পেয়ে ক্ষেপে গেল। ক্ষেপে গেলে রুশানকে যে গালিটা দিত আজ সেটা দিয়ে বসল।
“তুই ঘুমা কু’ত্তা’র বা’চ্চা। শান্তি করে ঘুমা।”

রুশান বুঝতে পারছে অর্পা ভীষণ রেগে গেছে তাই গালাগাল করছে।
“আমার তো ঘুমই নেই আর শান্তি!
আমি নিশাচর পাখি আকাশেতে উড়ি আর তারে খুঁজি। টাটা বাই।”
রুশান কল কেটে দিল। অর্পা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “ছন্দ মেলাচ্ছে! সব সময়ের মতো জঘন্য ছন্দ।”

…….

আয়ান ড্রয়িংরুমের টিভিতে বসে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছে। বাংলাদেশ – শ্রীলঙ্কা ম্যাচ। ওর মধ্যে টানটান উত্তেজনা। বসা থেকে হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে। টিভির স্কিনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে ভেতরে ঢুকে যাবে। আবারও সোফায় এসে বসছে। ওর পাগলামি দেখে ওর মা ভীষণ বিরক্ত। তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে চায়। তাই রিমোট নিয়ে টিভি অফ করে দিল। আয়ান বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে মাকে বলল,
“টিভি অফ করলে কেন? এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ।”

“তোর সাথে আমার এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
মাকে বেশ সিরিয়াস লাগছে। মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বলতে এসেছেন। তাই আয়ান নিজেও সিরিয়াস হলো মায়ের কথা শোনার জন্য। সোজা হয়ে বসে বলল,
“মা,,কোন সমস্যা?”

মা কয়েকবার পলক ফেলে নড়ে-চড়ে বসে আয়ানের দিকে তাকাল। আয়ানের পূর্ণ মনোযোগ তার দিকে।
“আমি তোর বিয়ের কথা ভাবছি।”

আয়ান ছোটখাটো ধাক্কা খেল। এই তার মায়ের গুরুত্বপূর্ণ কথা? এখন তো আয়ানের হাসি পাচ্ছে। দম ফাটানো হাসি।
“এই তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা?”
আয়ান হাসতে লাগল। ওর মা ধমক দিয়ে বলল,
“বেয়াদবের মতো হাসবি না। আমি হাসি-ঠাট্টা করতে আসিনি। আমি তোর বিয়ে দিতে চাই। মেয়ে আমি পছন্দ করে ফেলেছি।”

মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছি কথাটা শুনে আয়ান ঝাটকা খেল।
“মানে? কাকে?”

“অর্ষাকে।”

আয়ান ওর নাম শুনে বিস্ময়ে কপাল কুঁচকে বলল,
“হোয়াট! মাথা ঠিক আছে তোমার? অর্ষা? তুমি আমার জন্য অর্ষাকে পছন্দ করেছো?”

“কেন অর্ষা কোন দিকে দিয়ে তোর চেয়ে কম?”

“ও আমার চেয়ে কম না বরং বেশি। দেখতে শুনতে ভালো। ও একজন আর্কিটেক্ট। পেশায় সফল। ওর চেয়ে আমি পিছিয়ে আছি। কিন্তু সেটা কথা না। কথা হচ্ছে ওকে আমি সব সময় বোনের নজরে দেখছি। বোনকে কোনদিন কোন ভাই বিয়ে করতে পারে না।”

“ও তোর খালাতো বোন। আর খালাতো বোনকে বিয়ে করা জায়েজ।”

আয়ান বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
“উফফ মা! জায়েজ নাজায়েজ আমি বুঝি না। আমি ওকে বিয়ে করতে পারব না।”

আয়ানের মা ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“কারণটা কী? ওর মধ্যে ঘাটতি আছে তাই? ওকে বিয়ে করলে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হবে তাই? দেখ আয়ান, সবকিছু আল্লাহর হাতে। তিনি চাইলে কোন মিরাকলও করতে পারেন।”

আয়ান বিস্ময় নিয়ে ওর মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
“মা, আমাকে তুমি এতটা নিচু মনের মনে করো? আমি এডুকেটেড একটা ছেলে। এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত। আমি এসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাই না। আর আমাকে বিয়ের কথা বলছো? অর্ষা? অর্ষা কখনো রাজি হবে? ও আমাকে কখনো সেই চোখে দেখে না।”

আয়ানের মা অনুনয়ের সুরে বলল,
“যদি রাজি হয়? রাজি হলে তুই বিয়েতে রাজি হবি? আয়ান আমি মা হয়ে অনুরোধ করছি। মেয়েটার কেউ নেই। ও খুব একা। মনের ভেতর ওর অনেক দুঃখ-কষ্ট চাপা আছে। ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে। এভাবে একটা মানুষ বাঁচতে পারে?”

“মা, প্রথমত ও রাজি হবে না আর দ্বিতীয়ত আমি একজনকে ভালোবাসি।”

ওর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে ওর মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ভেবেছিল আয়ানকে বুঝিয়ে রাজি করতে পারলেই অর্ষাকে রাজি করিয়ে ফেলবে। কিন্তু এখন তো অসম্ভব।কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলল,
“আয়ান, তুই কাকে ভালোবাসিস? অর্ষার সাথে তোর বিয়ে এটা আমার অনেক বছরের স্বপ্ন। এইজন্য তোকে বড় করেছি? এই শিখেছিস পড়াশোনা করে? তুই আজ আমাকে অনেক ছোট করলি। আমি অন্য কোন মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে একদম মেনে নেব না।”
শেষের কথাগুলো কঠোরতা নিয়ে বলল।

আয়ান মাকে বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,
“মা, বোঝার চেষ্টা করো। এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এটা তোমার স্বপ্ন হলেও আমার স্বপ্ন নয়।”

অর্ষা পেছনে থেকে বলল,
“এটা আমার স্বপ্নও নয়।”

অর্ষার কন্ঠস্বর শুনে দু’জনেই চমকে উঠে পেছনে তাকাল। অর্ষা অশ্রুসিক্ত লাল চোখ নিয়ে চেয়ে আছে। টুপ করে এক ফোঁটা উষ্ণ পানি গাল বেয়ে পড়ল। আয়ান মুখ ঘুরিয়ে মনে মনে বলল,”ওহ শিট! এটা কি হলো।”

অর্ষা ওদের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর খালাতো উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি আমার বিয়ের জন্য এতটা অস্থির হয়ে পড়েছো যে ভালোমন্দ, আমাদের ফিলিং যাচাই-বাছাই না করেই ছেলের সাথে বিয়ের কথা ভেবে ফেলেছো? এখন আয়ান ভাইয়াকে ফোর্স করছো? আয়ান ভাইয়াকে না-হয় ফোর্স করছো। তোমার ছেলে, তুমি হয়তো তাকে রাজি করিয়ে ফেলতেও পারতে কিন্তু আমি? আমাকেও ফোর্স করতে? খালা মনি আয়ান ভাইয়া সব সময় আমার জন্য ভাই ছিল অন্য কিছু কখনো ছিল না আর হবেও না।”

“অর্ষা, আমাকে মাফ করে দিস। আমি তো তোকে নিজের কাছে রাখার জন্য….

অর্ষা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” জানি তো দয়া করছিলে। তুমি জানো না আমি মা হতে পারব না? সম্ভাবনা খুবই কম? তবুও কেন মা হয়ে ছেলের জীবন নষ্ট করতে চাইছো?”

“সন্তান দেওয়ার মালিক আল্লাহ। এতে তোর কোন হাত নেই৷ আর আয়ান এতটা ছোট মনের নয়। এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত। আল্লাহ চাইলেই তুই মা হতে পারবি। তাছাড়া এডপ্ট করার….

“তুমি ভাবছিলে মা-বাবা নেই এতিম একটা মেয়ে, তার উপর সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার তাই আয়ান ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলে। খালা মনি আমি এতটা অসহায় নই। যখন ডাক্তার বলেছিল আমার মা হওয়ার সম্ভাবনা ৫% সেদিন এত কষ্ট পাইনি। বাবা হারানোর শোকের চেয়ে আমার জন্য কিছুই বড় ছিল না। বয়সটা তখন তেমনই ছিল। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে বড় হই তখন বুঝতে পারি বাবার সাথে সাথে আমি কি হারিয়েছি৷ তখন চিৎকার করে কেঁদেছি। আজ তুমি আমাকে আবারও মনে করিয়ে দিলে আমার মধ্যে কতটা কমতি আছে। আমি এটা তোমার কাছে আশা করিনি।”
অর্ষা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। হেঁচকি উঠে যাচ্ছে ওর।
একটা মেয়ের জীবনের স্বার্থকতা যখন সে বাবা-মার চোখে শ্রেষ্ঠ সন্তান হতে পারে, যখন সে স্বামীর চোখে শ্রেষ্ঠ স্ত্রী হতে পারে, যখন সে সুসন্তান জন্ম দিতে পারে। অর্ষার জীবনে তো কোন স্বার্থকতাই নেই।

অর্ষা উঠে দাঁড়াল। চোখের পানি মুছে বলল,
“আমি আর এখানে থাকব না। আজই চলে যাব।”
অর্ষা নিজের রুমে চলে গেল। আয়ান আর ওর মা পেছনে পেছনে ওর ঘরে গেল। ওকে আটকানোর চেষ্টা করছে। অর্ষাকে কেঁদেকেটে অনুনয় করছে ওর খালা মনি। অর্ষা শুনতে নারাজ। নিজের লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আয়ান মাকে রুম থেকে বের করে অর্ষার মুখোমুখি হলো। অর্ষাকে ভাইয়ের দাবিতে অনুরোধ করল, মায়ের হয়ে মাফ চাইল।

অর্ষা লাগেজ রেখে বিছানায় বসে পড়ল। কিছুক্ষণ স্থির থেকে বলল,
“আমি থাকব এক শর্তে।”

“কী শর্ত?”

“তুমি তোমার প্রেমিকাকে বিয়ে করে ফেলো। নয়তো খালা মনি এমন করতেই থাকবে। আর আমিও অস্বস্তির মধ্যে থাকব। ফ্রিলি থাকতে পারব না এখানে।”

“আচ্ছা, আমি দিশার সাথে কথা বলব।”

“তোমার প্রেমিকার নাম দিশা?”

“হ্যা, শানাইয়া খান দিশা। ও এখনো পড়াশোনা করছে। বাবা-মা, ভাই সবাই ডাক্তার।”

অর্ষার ভ্রু কুঁচকে এল। কিছু একটা ভাবছে।

চলবে……

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪০

আয়ানের কথা শুনে দিশার একদম দিশাহারা অবস্থা। এই মুহুর্তে বিয়ে অসম্ভব। অসম্ভব মানে অসম্ভব। ফ্যামিলির কেউ বিয়ের জন্য রাজি হবে না। ওর বিয়ের কথা এখন কেউ ভাবছে না। কেন ভাববে? ও তো গ্রাজুয়েশনই শেষ করেনি। পড়াশোনা শেষ করে কিছু করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর না বিয়ে। কিন্তু আয়ান বাড়ির যে পরিস্থিতি বলছে তাতে বিয়ের কথা না আগালে অনিশ্চয়তায় ভুগবে। যদি ওর মা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে দিয়ে দেয়? তাহলে ওর কী হবে? ও আয়ানকে অনেক ভালোবাসে। ওকে ছাড়া একদম বাঁচতে পারবে না। কিন্তু এখন কি করে বাবা-মাকে গিয়ে বলবে আয়ানের কথা, আয়ানের ফ্যামিলি কন্ডিশন। এত সাহস ওর নেই। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিশার। ঘরজুড়ে পাইচারি করছে ও। চুলগুলো এলোমেলো। একটু পর পর রাগে চুল টানছে। কোন উপায় বের করতে না পেরে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। তারপর মোবাইল হাতে নিল আয়ানকে কল করার জন্য। কল করতে গিয়েও থেমে গেল। কিন্তু একটা মনে করে মোবাইল ঘরে রেখে বের হয়ে গেল।

দর্শনের রুমের কাছে গিয়ে দেখল দরজা খোলা। দিশা দরজায় নক করল। ভেতরে থেকে দর্শন যেতে বলল। দিশা উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকাল। ওর ভাই বসে বসে গিটার পরিষ্কার করছে। দর্শন গিটার বাজায় না কিন্তু গিটারটা পরিষ্কার করে রাখে। কিন্তু কেন এসব করে কে জানে। হয়তো বেকার বোর লাগে তাই। সময় কাটাতেই এসব করে।
দিশা ভেতরে যাওয়ার পরেও ওর ভাইয়ের নজর ওর দিকে আসেনি।
“ভাইয়া, তুমি তো গিটার বাজানো ছেড়ে দিয়েছো তবে এসব কী?”

“কোন সব?”

“এই যে কয়েকদিন পর পর গিটার পরিষ্কার করছো। গিটার যখন বাজাও না….

” গিটার বাজানো ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু গিটার তো ছাড়িনি। যতদিন সাথে আছে যত্ন করে যাব।”

“আচ্ছা, গিটার বাজাও না কেন?”

দর্শন প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই জিজ্ঞেস করল,
“তুই কী বলতে এসেছিস?”

দিশা এতক্ষন ভাইয়ের দিকে চেয়ে থাকলেও এখন দৃষ্টি নামিয়ে নিল। বুক ধুকপুক করছে। কিভাবে বলবে ভাইকে বুঝতে পারছে না। ওকে নিশ্চুপ দেখে দর্শন মাথা তুলে ওর দিকে তাকাল। ও মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। আঙুলে আঙুল ঘষছে। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু ইতস্তত বোধ করছে। বিষয়টি অবশ্যই সিরিয়াস আর স্পর্শকাতর নয়তো চট করে বলে চলে যেত। দর্শন গিটার রেখে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকাল।
“দিশা, নির্ভয়ে বলতে পারিস। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোর সমস্যার সমাধান দেওয়ার।”

দিশা সাহস পেয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। সাহস সঞ্চার করে বলল,
“ভাইয়া, আমি অনেক বড় সমস্যায় আছি। বাবা কিংবা মা কারো সাথে শেয়ার করতে পারছি না। বলতে ভয় করছে। তাই তোমার কাছে এলাম। প্লিজ ভাইয়া হেল্প মি।”

“হ্যাঁ, বল। শুনছি।”

“আমি আসলে…..
দিশা ঢোক গিলল। হাত-পা কাঁপছে কেন? কাঁদোকাঁদো হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। দর্শন ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে।
” তুই কী?”

দিশা আবারও ঢোক গিলল। চোখ বন্ধ করে গরগর করে বলল,
“আমি একজনকে ভালোবাসি।”

দর্শনের কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক লাগল। বর্তমান যুগের মেয়ে প্রেম করতেই পারে। কাউকে ভালোবাসতেই পারে।
“তো?”

দিশা চোখ খুলল। তারপর কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
“ওর বাবা-মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। ওকে বিয়ে করাতে চাইছে। আসলে ওর বাবা অনেক অসুস্থ। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক বছর আগে। এখন একমাত্র ছেলের সংসার দেখতে চায়। আর এইজন্য ওর মা ওকে ফোর্স করছে প্লাস ইমোশনাললি ব্ল্যাকমেইল করছে।”

“এখন?”

দিশা আবারও চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“বাবা-মা এই মুহুর্তে কিছুতেই বিয়ের জন্য রাজি হবে না। বলবে আগে পড়াশোনা করো, ক্যারিয়ার গড়ো তারপর বিয়ে।”

“তুই এখন বিয়ে করতে চাইছিস? লাইক সিরিয়াসলি? আর বাবা-মা তো ঠিকই বলবে। আগে পড়াশোনা শেষ কর। ভালো একটা জব কর তারপর বিয়ে নিয়ে ভাবিস। বিয়ে করে লাইফ হেল করার বুদ্ধি তোকে কে দিল?”

দিশা মৃদু হাসল। তারপর বলল,
“হয়তো একদিন খুব ভালো ক্যারিয়ার হবে কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাই যদি না থাকে ক্যারিয়ার দিয়ে কী হবে? এই মানুষটার জায়গা অন্য কেউ পূর্ণ করতে পারবে? সারাজীবন অপূর্ণতায় ভুগবো না?”

দিশার কথা শুনে দর্শন থমকে গেল। এ কি বলল ওর বোন? ও তো রুশান আর অর্ষার সুরে কথা বলছে। একদিন রুশান বলেছিল ভালো ক্যারিয়ার পাবি কিন্তু ভালোবাসার মানুষ পাবি? অর্ষাও শেষ বেলায় বলে গিয়েছিল জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারলেও ওর মতো ভালোবাসার একটা মানুষ পাবে না। তাই তো হয়েছে। এই যে আজ এত বড় ডিগ্রি তবুও শূন্যতায় ভুগছে। ভালোবাসাহীন এতগুলো বছর কাটিয়েছে। এখনো কাটাচ্ছে। দিশা ভাইয়ের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে আছে। ও কি ভুল কিছু বলে ফেলল? ভাইয়া কি ওর কথায় কষ্ট পেল?
দর্শন নিজেকে সামলে বলল,
“নাম কী ছেলেটার? কী করে?”

“ওর নাম আয়ান। ও একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে জব করে।”

“আচ্ছা আমি বাবার সাথে কথা বলব। চেষ্টা করব রাজি করানোর।”

দিশার মুখে হাসি ফুটল। উচ্ছাসিত মুখে বলল,
“ধন্যবাদ ভাইয়া। এখন আমিও বিয়ের কথা ভাবছি না। কিন্তু চাইছি ওর সাথে আমার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যাক। দুই ফ্যামিলি একসাথে বসুক। তাহলে আমি একটু চিন্তামুক্ত হতে পারব। তুমি প্লিজ চেষ্টা করো। আই হোপ তুমি আমার সিচুয়েশন বুঝতে পারছো।”

দর্শন মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। আর ইংগিত দিল ভরসার।

_________

দর্শন অনেক চেষ্টার পর অর্ষার নাম্বার জোগাড় করেছে। মনে মনে অনেক কথা গুছিয়ে কল দিল ওর নাম্বারে। কল রিসিভ করে অর্ষা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে বলছেন?

উত্তরে দর্শন বলল,
“জানো, রাতে ঘুম হচ্ছে না আমার। কোন কাজ করতে পারছি না। একটু দেখা করতে পারবে?”

অর্ষার আর উত্তরের প্রয়োজন হলো না। ও যে দর্শন সেটা বুঝতে একটুও সমস্যা হলো না। হবে কেন? এ যে সেই মানুষটা যার কন্ঠস্বর ছাড়া একটা দিন কাটেনি।
“জি না। সময় হবে না।”

“এত ব্যস্ত?”

“হ্যা, খুব ব্যস্ত। নিজেকে নিয়ে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে।”

দর্শন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল,
“এই ক্যারিয়ারের জন্য একদিন কেউ তোমায় অবহেলা করত যদিও এটা তোমার ভাষ্যমতে। তাই ক্যারিয়ারের আমসত্ত্ব করতে চাইছো? ব্যস্ততা দেখাচ্ছো? এই যে আমি ডাক্তারি পাশ করে ঘরে বসে আছি। কোথাও মন বসাতে পারছি না এইজন্য একটু করুনা তো করো।”

“আমি এতটা মহৎ নই যে করুনা করব। আমাকে আর কল করবে না। অনুরোধ করছি, একটু শান্তিতে বাঁচতে দেও।”
অর্ষা খট করে কল কেটে দিল। দর্শনের বেশ রাগ হলো। মোবাইলের দিকে চেয়ে রাগে গজগজ করছে। চোখ লাল করে হাত শক্ত করে মুঠো করল। রগগুলো দৃশ্যমান। কোমল দর্শন দিন দিন হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। এই অবহেলা মেনে নিতে পারছে না। আদোও কি এই অবহেলার যোগ্য?

অর্পা রুশানের সাথে দেখা করতে ওর অফিসে এসেছে। প্রথমে বাসায় যেতে চেয়েছিল কিন্তু সে স্পর্ধা হয়নি। ওদের রিলেশনের ব্যাপারটা রুশানের পরিবার জানত। তাই সেখানে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ার মানেই হয় না। অর্পা রুশানের ডেস্কে গেল। রুশান ডেস্কে নেই। অর্পা ওকে খুঁজতে খুঁজতে দোতলার ক্যান্টিনে চলে গেল। ক্যান্টিনের কফিশপে গিয়ে বসল। এক কাপ কফি অর্ডার করে একটা টেবিলে গিয়ে বসল। রুশান কাজ রেখে কোথায় গেল বুঝতে পারছে না। এখন না ব্রেক আর না লাঞ্চ টাইম। তাহলে গেল কোথায়। অর্পা ওকে কল করার কথা ভাবল। ভাবতে ভাবতে কফি চলে এল। কফিতে ধোঁয়া উড়ছে। মোবাইল ব্যাগের পাশে রেখে ধোঁয়া উড়া কফির মগ হাতে নিল। মগে মৃদু ফু দিয়ে এক চুমুক কফি ইঞ্জয় করতে করতে রুশানকে কল দিল। রিং হচ্ছে। শুধু রিং-ই না ওর ফোনের রিংটোন বাজছে আশেপাশে কোথায়। অর্পা ওর মোবাইলের রিংটোনটা জানে। শুনেছে অনেকবার। আশেপাশে ওকে পাবার আশায় ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল। ওই তো রুশান। পকেট থেকে মোবাইল বের করেছে। মোবাইলের স্কিনে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কল কেটে দিল। অর্পা ওর কাজে অবাক হলো। ও কল কেটে দিতে পারে এমনটা ভাবতেই পারেনি। অর্পার রুশানের অবস্থান খেয়াল হলো। ও একটা টেবিলে কফি নিয়ে বসে আছে। একা নয় ওর সাথে একটা মেয়েও আছে। ওরা কি বিষয়ে কথা বলছে। এতটা গুরুত্বপূর্ণ! অর্পার ভীষণ রাগ হলো। রুশান বদলায়নি। নয়তো কাজ রেখে একটা মেয়ের সাথে বসে বসে গল্প করত?
মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটা বেশ সুন্দরী, গোছানো ধরনের। ওরা হেসে হেসে কথা বলছে। অর্পা রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে ওদের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রুশানের কলার টেনে ধরে বলল,
“একটুও বদলাওনি। অফিসের কাজ রেখে এখানে বসে মধুর আলাপ করা হচ্ছে? এই মেয়েটা কে? ওর সাথে কী চলছে?”

রুশান কিছু বলার আগেই মেয়েটা ভয় ভয় মুখ করে বলল,
“মেম মেম, আপনি ভুল বুঝছেন। আমি উনার কলিগ মাত্র। বস আমাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছে। আমরা কাজেই এসেছি। কাজের কথাই বলছি। বিশ্বাস করুন।”

অর্পা রুশানের কলার ছেড়ে দিল। বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বলল,
“আ’ম এক্সট্রিমলি সরি। আমি বুঝতে পারিনি।”

রুশান শুকনো হাসল। ওর এই হাসিতে কত ব্যথা, কত অভিমান, কত অভিযোগ!
“বুঝতে তো সেদিনও পারোনি। যদি বুঝতে……

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here