গল্পঃ রংবদল
পর্বঃ ০৩
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)
ভার্সিটির গার্ডেন এরিয়াতে শর্মিলাকে প্রপোজ করি।
প্রপোজ করার পরে শর্মিলার কথা শুনে আমি পুরোই বোকা হয়ে যাই।
–আপনাকে না আমারও খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে, আপনি যখন হাসেন। আপনি নিজে আমাকে প্রপোজ করেছেন আমি ভাবতেই পারছি না। আমাকে নাকি এতদিন ফলো করে আজ প্রপোজ করলেন। (শর্মিলা)
আমি শর্মিলার কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।। ও এতকিছু জানে কীভাবে? তামিমের দিকে তাকাতেই তামিম বলল,
–রাফি ওকে আজকে সব বলেছে তোর পাগলামির কথা। শর্মিলা যাতে প্রপোজ একসেপ্ট করে।
ওর কথা শুনে মনে মনে অনেক লজ্জা পাচ্ছিলাম।এর মাঝেই তামিম কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
–দোস্ত, তোর রাস্তা তো ক্লিয়ার এবার আমারটা করে দে..
এরপর সেখানেই তামিম-রিনির প্রেম নিবেদন হয়।
দুজন হয়ে যাই ভায়রা ভাই।
এরপরের দিনগুলো ছিল ভীষণ রঙিন। প্রতিদিন বাইকে করে শর্মিলাকে নিয়ে ভার্সিটিতে আসতাম।মোটামুটি পুরো ভার্সিটিতে আমাদের দুই বন্ধুর প্রেম কাহিনি ছড়িয়ে পরলো।
.
.
মায়ের ডাকে অতীত থেকে বের হলাম।রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে একটা ঘুম দিলাম।
.
সকাল হতে না হতেই ঊর্মিলাকে দেখার জন্য মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠলো।যেমনটা লাগতো আমার শর্মিলার জন্য।ঊর্মিলার মাঝেই আমি আমার শর্মিলাকে দেখতে পাই। ঊর্মিলার দেওয়া এড্রেসে রওনা দিলাম। ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে দুইবার কলিং বেল চাপতেই একটা মেয়ে এসে দরজা খুলল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
–ঊর্মিলা বাসায় আছে? আমি ওনার কাছে এসেছি।
আমার কথা শুনে মেয়েটি ভ্রু কুচঁকে তাকালো।আমাকে দরজায় বাইরে রেখেই ঊর্মিলাকে ডাক দিল। ও হয়ত ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র,চোখ-মুখ ফোলা।দরজায় আমাকে দেখে অনেক অবাক হয়ে গেলো। আমাকে ভিতরে আসতে বলে দেয়ালে থাকা ঘড়ির তাকালো। আমিও ওর দেখাদেখি ঘড়ির দিকে তাকালাম। দেখলাম ঘড়িতে আটটা বেজে বিশ মিনিট।এতো সকালে আসায় নিশ্চয়ই ঊর্মিলা মনে মনে বিরক্ত হয়েছে। বিরক্ত হলে হোক,ওকে দেখলে যে আমার মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি কাজ করে।
.
ঊর্মিলা ওর বাসায় থাকা মেয়েটাকে বলল,
–যা তো মিলি, আরাফকে ডেকে নিয়ে আয়। গিয়ে বলবি আজকে একসাথে নাস্তা করব।।
ঊর্মিলার কথা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
–আরাফ ভাই কি আপনার সাথেই থাকে?
–আজব! আমার সাথে থাকবে কেনো? ও পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। যেহেতু আমি পরিচয় গোপন করে থাকি তার ওপর আবার শর্মিলার মত চেহারা তাই একা থাকাটা রিস্ক মনে করি। আমি আর মিলি একসাথে থাকি ও অন্য ফ্ল্যাটে থাকে।
–ওহহ,,আচ্ছা।
আমাকে বসিয়ে রেখে ঊর্মিলা ফ্রেশ হয়ে এসে সকালের নাস্তা রেডি করছে।আমি শুধু চেয়ে চেয়ে ওকে দেখছি।
.
আরাফ আবীরের পাশের সোফায় বসে আছে।ওর দৃষ্টি শুধু আবীরের ওপর। আরাফের ভীষণ রাগ হচ্ছে আবীরের ওপর। ওর প্রেমিকার দিকে কেমন বদনজরে তাকিয়ে আছে আবীর। যদিও একপাক্ষিক প্রেম,তবুও প্রেমিকা তো! মন চাচ্ছে চোখ দুটো উঠিয়ে ফেলি।
একসাথে নাস্তা শেষে আবীর মূল ঘটনা বলা শুরু করলো।
–“আমাদের ভার্সিটিতে আমাদের প্রেমের কাহিনি ফার্স্ট ইয়ার থেকে শুরু করে সবাই জানতো।
শর্মিলার সাথে আমার যখন প্রেম হয় তখন আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়তাম। এরপর যখন মাস্টার্সে উঠি তখন আমাদের ভার্সিটির ভিপি হওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়াই। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল রায়হান। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল কিন্তু ভোটের দিন রায়হান কারচুপির চেষ্টা করে। সেই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আমাদের দুজনের মারামারি হয়। ও আমাকে হুমকি দেয়,
আমাকে দেখে নিবে। ভোটে আমিই জয়ী হই। এটা দেখে আমার বিভিন্নভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোভাবেই তেমন ক্ষতি করতে পারেনা।আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের গ্যাংটা ছিল অনেক বড়,আর আমরা সবাই সকলের প্রতি বিশ্বাসী এবং আন্তরিক ছিলাম।
সকলে যেহেতু জানতো শর্মিলার সাথে আমার প্রেম চলছে তো রায়হানরা শর্মিলাকে টার্গেট করে আমার ওপরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। সাথে আবার আমার অতীতের এক শত্রু নিহালের সাথে হাত মিলায়। নিহাল হচ্ছে অনেক বড়লোক বাবার বখাটে, মাদকাসক্ত ছেলে। রায়হান আর নিহাল প্ল্যান করে শর্মিলাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে, কিন্তু ওর দলের লোকেরা ভুল করে শর্মিলাকে না নিয়ে ওর বান্ধবী রিনিকে তুলে নিয়ে যায়। রিনিকে তুলে নিয়ে নিহাল আর রায়হান ধর্ষণ করে।সেইটার ভিডিও আবার আমার ফোনে পাঠায়। তারপর আমাকে ফোন দিয়ে আরও নানারকম হুমকি দেয়। আমি বুঝতেও পারি নি রায়হানের সাথে মারামারি হওয়ার কারনকে ইস্যু করে ওরা এমন একটা জঘন্য কাজ করবে।আগে জানলে কখনোই আমি রায়হানের সাথে মারামারি করতাম না। ছোটবেলা থেকেই আমি অনেকটা চাপা স্বভাবের। সহজে রাগ করি না । সবসময় নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু রিনির সাথে ঘটা কাহিনিতে আমি আর নিজের রাগ কমাতে পারি নি। রাগের বর্শবর্তী হয়ে কোন কিছু না ভেবেই বন্ধুদের সাথে নিয়ে নিহালকে না পেয়ে ওর ছোটভাই পিয়াসকে ইচ্ছেমত মেরে আধমরা করে আসি। এটা ছিল আমার আরো বড় একটা ভুল।
রিনিকে ওরা ধর্ষনের পর ছেড়ে দেয় নি। পিয়াসকে পেটানোর পর আরো ক্ষুদ্ধ হয়ে রিনির ওপর আরো পাশবিক নির্যাতন করে। ওদের কাছ থেকে রিনি কোন একভাবে পালিয়ে আসে। তারপর শর্মিলাকে ফোনে সব জানায়। শর্মিলা আমার ওপর ভীষণ রেগে যায় রিনির সাথে ঘটা এতবড় কাহিনি ওর থেকে গোপন করেছি। শর্মিলা রিনিকে নিয়ে থানায় মামলা করতে যেতে চায়।আমি ওকে যেতে নিষেধ করি।ওকে বুঝাই যে রায়হানের কোন ক্ষমতা না থাকলেও নিহালের ক্ষমতা+টাকার জোরে ওদের কিছু হবে না। উল্টো তোমরা হেনস্তা হবা। আর তোমাদের দুজনের অনেক রিস্ক কারন ওরা এখন রিনিকে খুঁজছে।
রিনির পরিবারও রিনিকে মেনে নিতে পারছিল না।সমাজের লোকজন রিনির সম্পর্কে যা ইচ্ছে তাই বলা শুরু করে। আমরা দুজন রিনির বাড়িতে যাওয়ার পর দেখি রিনি একটা অন্ধকার একটা রুমে শুয়ে আছে। আমাদের দেখে একটু বালিশে হেলান দিয়ে বসার চেষ্টা করে। দুইদিনে ওর চেহারা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে,চুলগুলো এলোমেলো। চঞ্চল হাসিখুশি রিনির এমন অবস্থা দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগলো। আমার কারনেই ওর আজ এই অবস্থা। শর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! রিনি কোন কথা বলতে পারছে না, কান্না করতে করতে কন্ঠস্বর ভেঙে গেছে। আমাদের দুজনের উদ্দেশ্য একটা মোবাইল দিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
— এটা নিহাল নরপিশাচের ফোন।আমি চুরি করে এনেছি। এটা মধ্যে ও ভিডিও করে রেখেছে। তোমরা ভিডিওগুলো ডিলেট করে দিও। না হয় ও আমাকে হুমকি দিয়েছে এই ভিডিওগুলা ও ভাইরাল করে দিবে।
শর্মিলা ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,
–লক করা তো ফোনটা।
রিনি কন্ঠ শোনা যায় না তবুও অনেক কষ্টে বলে,
— লকটা আমি জানি।আমার টেবিলে একটা কাগজে লিখা আছে। ওই নরপিশাচটা আমার সামনেই ফোনে লক খুলছিল। তখন দেখে লিখে রেখেছি।
এরপর আবার শ্বাস নিয়ে শর্মিলার হাত দুটো ধরে বলে,
–আমাকে শর্মিলা মাফ করে দিস। তোর সাথে কত ফাজলামি করেছি, মনে কখনো কষ্ট পেয়ে থাকলে মাফ দিস।
–আরে তুই এভাবে বলছিস কেনো? যেনো এটাই আমাদের শেষ দেখা। চিন্তা করিস না আবার সব ঠিক হয়ে যাবে রিনি। (শর্মিলা)
–না রে,কিচ্ছু ঠিক হবে না। হতে পারে এটাই আমাদের শেষ দেখা।নিহালের মোবাইল চুরি করেছি এবার ও আমাকে পেলে মেরেই ফেলবে। শুনেছি এটাতে নাকি ওর অনেক গোপন তথ্য আছে।
আর আমি লুকিয়ে লুকিয়ে এটাও শুনেছি যে আবীর ভাইকে কঠিন শাস্তি দিবে ওর ভাই পিয়াসকে মেরেছে তাই। ওরা ভেবেছে আমিই আবীর ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড তাই আমার জীবনটা নষ্ট করে দিছে।তুই সাবধানে থাকিস শর্মি। ওরা জানতে পারলে তোর কথা জানতে পারলে তোরও ক্ষতি করে দিবে।।তোরা এখনই বাড়ি চলে যা সন্ধ্যা হয়ে যাবে, বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হলে তোর আবার যেতে অসুবিধা হবে।
আবীর ভাইয়া ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।
.
আমরা চলে আসার সময় রিনি একটা খাম শর্মিলার হাতে দিয়ে বলে এটার মধ্যে একটা কাগজ আছে সেটাতে পাসওয়ার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাগজ আছে। তুই বাড়িতে গিয়ে খুলবি তার আগে নয়,এটা তোর কাছে আমার অনুরোধ। শেষবারের মত শর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে তারপর আমাদের বিদায় জানায়।
রাস্তায় বেরুনোর পর শর্মিলা আমার সাথে একটা কথাও বলে নি। আমিও ভীষণ চিন্তায় ছিলাম শর্মিলার বাবা-মা দুজনেই বিদেশে গেছে, ওর বাবার হার্টের চিকিৎসা করাতে।এই মুহূর্তে শর্মিলার একা বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না। ওরা যদি জেনে যায় রিনি নয় শর্মিলা আমার প্রেমিকা তাহলে রিনির মত শর্মিলার বিপদ হতে পারে। আমার বাড়িতেও রাখা সম্ভব না কারণ বিয়ের আগে একটা মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে রাখলে সমাজের লোকেদের খারাপ কথা ছড়াতে দু’মিনিটও লাগবে না। আমার বন্ধুদের ফোন দেওয়ার পর ওরা সবাই আমাদের কাছে চলে এলো।
ওরা আমাকে বুদ্ধি দিল,শর্মিলাকে আজকে এই মুহূর্তে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে যেতে, না হলে যেকোনো সময় নিহাল শর্মিলার ক্ষতি করে ফেলতে পারে।তার কারণ শর্মিলার কাছে নিহালের ফোন। বন্ধুদের কথা শুনে প্রথমে নিহালের ফোনটা বন্ধ করে দিলাম যাতে লোকেশন ট্র্যাক করতে না পারে।
.
সেখানেই শর্মিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। শর্মিলা তো আমার কথা শুনে রেগে আগুন। আমার কলারে ধরে বলে,
–আজকে তোমার জন্য রিনির এই করুন দশা,আর এই পরিস্থিতিতে আমি তোমাকে বিয়ে করব? ফাজলামি করো।(রাগী সুরে)
আমি ওকে বোঝানোর ট্রাই করলাম যে ওর এখন পদে পদে কত বিপদ। কিন্তু ও না বুঝেই আমার মুখে তর্ক করতে থাকে। তারপর আর কি করার! ওকে জোর করে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করলাম।
বিয়ে করে গাড়ী করে ফিরছি পথিমধ্যে রাফি ফোন দিল। ওর কাছে শুনি রিনি সুইসাইড করেছে। কথাটা শুনে হঠাৎ করে আমার
শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। যেই মানুষটার সাথে কিছুক্ষন আগেও কথা বলে আসলাম সেই মানুষটা এখন দুনিয়ায় নেই। ভাবতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। আমি শর্মিলার দিকে আড়চোখে তাকালাম।
তাকিয়ে দেখি ও এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
রিনির মৃত্যুর খবর শুনে ওর মনের অবস্থা কেমন হবে সেটাই ভাবছি। প্রথমত, আজকেই রিনির সাথে হওয়া ভয়ংকর খবরটা শুনলো, হঠাৎ করে ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে হলো, আবার এখন ওর মৃত্যুর খবর শুনে ও কীভাবে মেনে নিবে? সবগুলো ঘটনার সাথে আমিই কোন না কোনভাবে জড়িত।
আমি ওর হাতটা ধরতেই ও আমাকে একটা ঝাড়া দিয়ে বলে,
–খবরদার আমাকে ধরবে না। তুমি আজকে যা করলে তার জন্য কোনোদিন ক্ষমা করব না। আমি বাবা-মাকে কি করে মুখ দেখাব? তুমি একটা খারাপ মানুষ।আজকে রিনির সাথে এই ঘটনা হওয়ার জন্য একমাত্র তুমি দায়ী।তোমাকে আমি ছাড়ব না।
.
আমি বুঝতে পারলাম এখন রিনির মৃত্যুর খবর শর্মিলাকে বললে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হবে।
আমি শর্মিলাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। আমার বিয়ের কথা শুনে মা ভীষণ রেগে গেল। মাকে অনেকক্ষন ধরে অনেক কিছু বলে মানিয়ে নিলাম। রাতে বাবা আসলে যে বাড়িতে আরো ঝামেলা হবে,সেটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখলাম।
তারা তো আর জানে না তাদের ছেলেটা কত ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছে! শর্মিলাকে বাড়ি রেখে আমি রিনির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আসার আগে শর্মিলাকে বলে আসলাম একা একা যাতে কোথাও না যায়।
ওদিকে শর্মিলাও জানতে পারে রিনির মৃত্যুর খবর। খবর শুনে আমাকে কিছু না জানিয়ে একা একাই শর্মিলা রওনা দেয়..
#চলবে