গল্পঃ রংবদল
পর্বঃ ০৬ (শেষ পর্ব)
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)
নিহালের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার পরেই ঊর্মিলা নিজের বাড়িতে চলে এসেছে। ওকে দেখে ওর বাবা-মায়ের সে কি কান্না! ঊর্মিলার বাড়িতে এসে শর্মিলার কথা অনেক বেশি মনে পড়ছে। নিজের রুমে ঊর্মিলাও অনেকক্ষণ কাঁদলো। দুইবোনের যেমন ঝগড়া হতো ঠিক তেমনি অনেক মিল ছিল। কেউ কারো সাথে কথা না বলে থাকতো পারত না।
প্রায় চারমাস হতে চলেছে শর্মিলা নেই। ঊর্মিলা ওদের ফ্যামিলি এলবাম বের করে আগের ছবিগুলো দেখতে লাগলো। শর্মিলার সাথে কাটানো কত রঙিন স্মৃতিতে ভরা এলবামটা! সবই আছে শুধু শর্মিলাই নেই। কে জানতো ছয় বছর আগে বিদেশে যাওয়ার আগে দেখাটাই লাস্ট দেখা হবে! ছয় বছর পরে দেশে ফিরে যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।
.
আবীর ঊর্মিলাকে অনেকভাবেই রাজি করানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ঊর্মিলার একটাই কথা আরাফকে ও কিছুতেই ঠকাতে পারবে না। জীবনসঙ্গী হিসেবে যদি কাউকে বেছে নিতে হয় তাহলে ও আরাফকেই বেছে নিবে।
এদিকে আবীর শর্মিলার পরে একমাত্র ঊর্মিলাকেই ভালোবেসেছে। এখন ঊর্মিলাকেই আবীরের চাই।
আবীর সিদ্ধান্ত নেয় যে, একমাত্র আরাফই পারবে।
যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও ঊর্মিলাকে নিজের করবে।
আবীর বেশি কিছু চিন্তা না করে পরদিনই আরাফের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
আরাফ ওর গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে এবার আরাফের মা আরাফকে জোর করছে বিয়ে করতে; আরাফ ওর মাকে কথা দিয়েছে,খুব শীঘ্রই বিয়ে করবে।
ঊর্মিলা না হয় এতদিন শর্মিলার প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলে ওকে ঘুরিয়েছে, এবার তো আর কোনো কারন দেখিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবে না। হরিণীকে তো এবার বাঘের খাঁচায় আটকা পড়তেই হবে,আর পালানোর সুযোগ দিব না।ঊর্মিলার কথা ভেবে ভেবেই আরাফের ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা দেখা গেল। ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠল। এই সময়ে কে আসতে পারে? কথাটা ভেবে আরাফ দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলে আবীরকে দেখে কিছুটা অবাক হলো আরাফ।
–কেমন আছেন আরাফ ভাই?
–জ্বি, ভালো। আপনি হঠাৎ এই সময়ে কোনো বিশেষ দরকার নাকি? আসুন ভিতরে আসুন।
–হ্যাঁ, বিশেষ দরকারেই এসেছি। কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না।
–আর বলে ফেলুন? এত চিন্তা কি?
–আসলে আমি ঊর্মিলাকে ভালোবাসি। ওকেই আমার চাই। ওকে দেখলে আমার অশান্ত মন শান্ত হয়ে যায়, ওর উপস্থিতিতে আমার খারাপ মুডও ভালো হয়ে যায়। (একদমে কথাগুলো বলল আবীর)
আবীরের মুখে এইকথা শুনে আরাফ থম মেরে কিছুক্ষন বসে রইল। মাথা যেন কাজ করছে না। তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো,
–ঊর্মিলা জানে? (আরাফ)
–হ্যাঁ, বলেছি। (আবীর)
–আপনার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ঊর্মিলা? মনের ভিতর ঊর্মিলাকে হারানোর একরাশ ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো আরাফ।
–না, ও রাজি হয় নি। ঊর্মিলা বলেছে, আপনাকে ও পছন্দ করে। কিন্তু আমি জানি একথাটা সত্যি নয়। আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলেছে। ও আপনাকে শুধু ওর বন্ধু ভাবে।
আবীরের কথা শুনে আরাফের মনে স্বস্তি ফিরে এলো। মনে মনে ভাবছে, ঊর্মিলা কি সত্যিই আবীরের কাছে বলেছে ও আমাকে পছন্দ করে?
কিন্তু আবীরের শেষের কথা শুনে ওর গাঁ জ্বলে উঠল।
— আপনাকে এড়িয়ে যাওয়ার কিছু নেই। মানুষের জীবনে বন্ধুত্ব থেকেই প্রেম হয়। আপনার কথা শুনতে আমি আর আগ্রহবোধ করছি না। আমার অনেক কাজ আছে।
–প্লিজ আরাফ ভাইয়া, আপনি বোঝার একটু চেষ্টা করেন। ওকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব।ওর মাঝেই আমি আমার শর্মিলাকে পাই।
— কিন্তু ওতো আর শর্মিলা না, ও হচ্ছে ঊর্মিলা।একথাটা কেনো ভুলে যাচ্ছেন?
— তবুও একি চেহারা,একি রকম আচরণ।মনে হয় ওই আমার শর্মিলা।
–ফালতু কথা শুনে আমি টাইম ওয়েস্ট করতে চাই না।
বলে আরাফ উঠতে নিলে আবীর হুট করে আরাফের পা- দুটো ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
–দেখুন আরাফ ভাইয়া, এমনটা করবেন না। আমার প্রতি নিষ্ঠুর হবেন না। ঊর্মিলাকে আমাকে ভিক্ষা দিন প্লিজ।
–আরে,আরে কি করছেন আবীর? আমার পা ছাড়ুন প্লিজ। ঊর্মিলা কোন পন্য-সামগ্রী না যে আপনাকে আমি ভিক্ষা দিতে পারব। আর ওর নিজের মতামতটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি যত যাই বলি কেনো?
বলে আবীরের কাছ থেকে নিজের পা দুটো ছাড়িয়ে নিল। আবীরের কান্না দেখে আরাফেরও ভীষণ খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর! দুজনই একজনকে চায়। আবীরকে বুকে জড়িয়ে নেয় আরাফ। তারপর বলে,
–আমি আপনার জন্য দেখি কি করতে পারি।আমাকে একটু সময় দিন।
.
.
আবীর যাওয়ার পরে আরাফ কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না! একদিকে ঊর্মিলার প্রতি নিজের ভালোবাসা আর অন্যদিকে ঊর্মিলার প্রতি আবীরের পাগলামি। সারাটা রাত দ্বিধাদ্বন্দে কাটিয়ে দিল।
পরদিন সকাল হতে না হতেই আরাফ উর্মিলাকে কল দিয়ে কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে,
–ঊর্মিলা আমার একটা প্রশ্নের একবারে সোজাসাপ্টা উত্তর দিবি।
–হ্যাঁ,বল।
–তুই কি আমাকে ভালোবাসিস? উত্তর হ্যাঁ বা না বলবি?
–তুই এতো সাত-সকালে এই জন্য কল দিয়েছিস।
আমি তো বলেছি এ ব্যাপারে পরে কথা বলব।
— পরে? আর কোন পরে? (রাগ দেখিয়ে)
তুই এখনি এই মুহূর্তে উত্তর দিবি? বল?
— মনে কর, আমার উত্তরটা হ্যাঁ।
— থ্যাংক্স আল্লাহ। (মনে মনে)
তোকে একটা কথা বলি, আবীর তোর জন্য আমার মাথা পাগল করে ফেলছে। গতকাল আমার বাড়ি এসে আমার হাতে-পায়ে পড়ছিল। কি একটা অবস্থা!
আচ্ছা বাদ সেসব কথা। রাখি এখন।
.
.
বিকেলে আবারো আবীর আরাফের বাড়িতে হাজির।
আরাফ পুরোই আবীরের ওপর বিরক্ত। আবীরের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ওকে বাড়ি থেকে বের দিল। আবীর চলে যাওয়ার পরে আরাফের মনের ভিতর অপরাধবোধ জেগে ওঠে। ভীষণ খারাপ লাগে আবীরের জন্য। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে শত অপমানের পরও প্রিয় মানুষটাকে কাছে চায়।
আবীর আর কিছু না ভেবে ওর মায়ের কাছে ফোন দেয়। একমাত্র মা-ই মতামতই ওর কাছে সঠিক মনে হয়। আরাফ ওকে মাকে ফোনে সবটা খুলে বলে।
আরাফের মা সবকথা যেই মতামত দেয়, সেটাই আরাফ মেনে নেয়। যদিও ওর ভীষণ কষ্ট হয় মায়ের সিদ্ধান্তটা মেনে নিতে। তবুও ওর কারণে যদি দুটো মানুষ সুখী হয় সেটা দেখাই বা কম সুখের নাকি!
.
আরাফের সিদ্ধান্তের কথা শুনে ঊর্মিলা হ্যাঁ- না কিছুই বলে নি। তবে বোঝা যাচ্ছে, আরাফের সিদ্ধান্তে ঊর্মিলা সন্তুষ্ট। কিন্তু আবীরের খুশি দেখে কে? আরাফের কথা শুনে ওকে কাঁধে নিয়ে অনেকক্ষণ নাচানাচি করে। আবীরের কাহিনি দেখে ঊর্মিলা হাসতে হাসতে শেষ।
.
.
দুইমাস পরে..
আবীর আর ঊর্মিলার বিয়ে হচ্ছে আজ। সেই বিয়েতে হিরো-হিরোইনদের মত সেজে এসেছে আরাফ আর ওর ওয়াইফ রিমি। বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছে দুজন। মায়ের কথা শুনেই
একমাস ধরে রিমিকে বিয়ে করেছে আরাফ। রিমিকে নিয়ে বেশ সুখে আছে আরাফ। প্রথম প্রথম ঊর্মিলার জন্য কিছুটা মন খারাপ হলেও রিমিও ঊর্মিলার মতো অনেক চঞ্চল। বলা যায় আরাফের জীবনে রিমির উপস্থিতিই ঊর্মিলাকে ভুলিয়ে রেখেছে। আজকে আবীর-ঊর্মিলাও খুশি, অন্যদিকে আরাফ-রিমিও খুশি। তবে আরাফ একটু বেশিই খুশি ওর কারণে একটা মানুষ প্রিয় মানুষকে সারাজীবনের জন্য পেতে যাচ্ছে।
.
ভালোবাসা অনেক সুন্দর। যদি তা সত্যিকার অর্থে বোঝা যায়।
(সমাপ্ত)