ভূতূড়ে_জমি #_২য়_পর্ব

0
199

ভূতূড়ে_জমি
#_২য়_পর্ব
লেখক_Misk_Al_Maruf
.
সকালে বাড়িতে হট্টগোল শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। অনেকটা ঘুমন্ত চোখে উঠোনে আসতেই সবুজ দৌড়ে এসে আমাকে বললো,
“ভাই শুনছেন! কামরুল চাচারেও কালকে রাতে ভূতেরা ঐ একই জায়গাতে মাটির মধ্যে গাইড়া রাখছিল। তার অবস্থা নাকি আরো মারাত্মক।”
সবুজের কথা শুনে মুহূর্তেই আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
যেই সৎ চাচাদের আমি কালকে থেকে সন্দেহ করে আসছি আজ তারাই কিনা একই ফাঁদে আটকে গেলো? এ কিভাবে সম্ভব? এটা কি আসলেই কোনো জ্বীনের কাজ নাকি মানুষের কাজ?
এসব ভাবনার মাঝে সবুজ পুনরায় বললো,
“ভাই আমি চাচারে দেখতে যাই! কালু কবিরাজরে নাকি খবর দিছে জ্বীন ছাড়ানোর জন্য।”
সবুজের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ আমি বাস্তবে ফিরে বললাম,
“আচ্ছা তুই একটু দাঁড়া! আমি হাতমুখ ধুয়ে আসতেছি, আমিও যাবো।”
আমার কথা শুনে সবুজ সম্মতি দিতেই কোনোরকম হাতমুখ ধুয়ে আমার সৎ চাচার বাড়িতে রওনা দেই।

পাকিস্তান আমলে আমার দাদা ছিলেন গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। যেহেতু সেই আমলে একজন পুরুষের দুই তিনটি বিয়ে করা ছিল বেশ স্বাভাবিক ব্যপার তাই আমার দাদাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমার বাবা এবং আপন ছোট চাচা হলেন দাদার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান অপরদিকে কামরুল চাচা এবং তার ছোট ভাই সবরুল চাচা ছিলেন দাদার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। দূর্ভাগ্যবশত আমার দুই দাদীই দাদার মৃত্যুর আগেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দাদার মৃত্যুর আগে তিনি সকল ছেলেদের জায়গা জমি সুষমভাবে ভাগ করে দিলেও শিয়ালপাড়ার ঐ ভূতূড়ে জমি নিয়ে আমার সৎ চাচাদের আলাদা একটা লোভ ছিল। কেননা জমিটি এতোটাই উর্বর ছিল যে যেকোনো ফসল অতি কম খরচেই ভালো ফলন দিতো। দাদার মৃত্যুর আগে আমার বাবাকে তিনি ঐ জমিটুকু লিখে দিলেও আমার সৎ চাচারা দাদার মৃত্যুর পরই বিভিন্ন ভাবে বেঁকে বসেন। এই জমি নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক মামলা এবং শালিসি হলেও ঝামেলা এখনো পর্যন্ত চলছেই।

কামরুল চাচার বাড়িতে আসতেই বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীর ভীড় দেখে আমি অবাক হলাম না। ভীড় ঠেলে সামনে এগোতেই দেখি একজন জটাধারী লোক মূর্ছা যাওয়া কামরুল চাচাকে তার সামনে শুইয়ে কি যেন মন্ত্রতন্ত্র পড়ছে। লোকটিকে দেখে মুহূর্তেই আমার মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ আমি সকলের সামনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে সোজা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে ঢুকে দেখি আমার চাচী একজন মহিলার কোলে মাথা দিয়ে অঝোর ধারায় কান্না করছেন। পাশেই আমার একমাত্র চাচাতো বোন চোখমুখ লাল করে বসে আছে। তিথি অর্থাৎ আমার চাচাতো বোন ছোটবেলা থেকেই আমাকে পছন্দ করে কিন্তু ওর বাবার সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব থাকায় সচরাচর তেমন আমার কাছাকাছি আসেনি।
নীরবতা ঠেলে আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“কি ব্যপার তিথি? চাচাকে হাসপাতালে না নিয়ে এই ভুয়া কবিরাজকে ডাকতে গেলি কেন? তোদের কি মনে নেই গতবছর সেই ভুয়া কবিরাজকে হাতেনাতে প্রমাণসহ ধরে গণধোলাই দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছিলাম? আবারো ঘুরেফিরে তোরা একই বোকামি করছিস?”
আমার কথা শুনে তিথি ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো,
“আমি কি জানি? সবরুল চাচাই তো ওনাকে ডেকে নিয়ে আসলো! ওনারা বলছে বাবাকে নাকি সত্যিই জ্বীনে আঁচড় করেছে। তুমি একটু ওনাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে বলো না বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে। আমার এসব আর একদমই ভালো লাগছে না। বাবার কখন যে কি হয়ে যায় আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা।”
এই বলেই তিথি ওর চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। তিথির কথায় চাচীর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তখনি আমি ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে আসলাম।
সকলের উদ্দেশ্যে কর্কশ কন্ঠে বললাম,
“এখানে আর এসব চলবে না। চাচাকে আমি এখনি হসপিটালে নিয়ে যাবো। এসব দুই নাম্বারি করে আমি চাচাকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে পারবো না। এইসব দুই নাম্বারি বন্ধ করেন।”
আমার কথা শুনে যেন সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তখনি সবরুল চাচা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“বড় ভাইরে জ্বীনে ধরছে আর ওনার চিকিৎসা এই কবিরাজই করাইবো। নিজের বাড়ি গিয়া নিজের চড়কায় তেল দে। এইখানে আইসা তোরে কেউ মাতব্বরি করতে বলে নায়।”
ওনার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সামান্য জায়গা জমির কারণে উনি যে নিজের ভাতিজাকে এতোটা ঘৃণা করতে পারেন তা যেন আমার ভাবনাতেই ছিল না। তবুও নিজেকে যথেষ্ট সংযত করে বললাম,
“শুনেন, আমার আব্বা আপনার সৎ ভাই বলে আমার প্রতি আপনার অনেক রাগ থাকতে পারে কিন্তু আমি কখনোই চাইবো না চাচার এই বিপদে আপনারা ভুল পথে পাড়ি জমান। আর গতবছরের এই কবিরাজদের ভন্ডামি সম্পর্কে আপনি নিশ্চই অবগত আছেন।”
আমার কথা শুনে তিনি সীমিত সময়ের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

কবিরাজকে বিদায় দিয়ে যখনই তার সামনে থেকে কামরুল চাচাকে উঠিয়ে নিয়ে আসতে যাবো তখনই কালু কবিরাজ বেশ রাগান্বিত স্বরে সবরুল চাচার উদ্দেশ্যে বললেন,
“এই ছোকড়ার কথায় আজ আমাকে বিশ্বাস করলি না উল্টা অপমান কইরা চইলা যাইতে বললি। এইখানেই শেষ না, দেখবি এক এক করে তোগো বংশের সবগুলারে জ্বীনে ধ্বংস করবো। আমারে করা অপমান এর ঘানি তোগো বইয়া বেড়াইতে হইবো। পরে আমারে ডাইকাও খুঁইজা পাবি না।”
কালু কবিরাজের কথা শুনে সবরুল চাচা যে বেশ ভয় পেয়েছেন সেটা তার মুখো দর্শন করেই বুঝতে পারলাম। আমি এসবে আর তেমন কান ভারী না করে তখনই চাচাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

তিথি আমার পাশে বসে আছে শরবতের গ্লাস নিয়ে। কতবছর পর ওদের বাসায় যে পা দিয়েছি তা ঠিক মনে নেই। ভাই ভাইয়ের কোন্দল আমার বাপ চাচাদের ভিতরে যে কতটা প্রখর ছিল সেটা এমুহূর্তে বেশ ভালো ভাবেই অনুধাবন করতে পারছি। আমিও বা কিভাবে পারলাম বাপ চাচাদের এই বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে? আমারতো অন্ততঃ উচিত ছিল যতযাই হোক চাচাদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখা।
আমার ভাবনার মাঝে হঠাৎই তিথি আমার দিকে শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“শরবতটা খেয়ে নেও মারুফ ভাই।”
আমি আর ইতস্তত না করে শরবতের গ্লাসটি হাতে নিয়ে ঢকঢক করে শরবত টুকু খেয়ে নিলাম।
খাওয়া শেষ হতেই তিথি চিন্তিত মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা তোমার কি মনে হয়? এটা কি আসলেই কোনো জ্বীনের কাজ নাকি অন্য কিছু?”
আমি কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললাম,
“সত্যি বলতে পড়শু দিন আব্বাকে যখন শিয়াল পাড়ার ঐ ক্ষেতের পাশেই তোর আব্বার মতো অবস্থায় পেয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল তোর আব্বা আর সবরুল চাচা মিলেই হয়তো শত্রুতার বশে আব্বার সাথে এরকম করেছিল। কিন্তু ঘটনাতো এখন পুরোপুরি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। তুইতো জানিসই এসব ভূতপ্রেতে আমার বিশ্বাস কম তাছাড়া গতকাল বিকালে আব্বাকে যেখান পাওয়া গিয়েছিল সেখানে সদ্য খাওয়া কিছু সিগারেটের শলাকা দেখেছিলাম। জ্বীন ভূতেরতো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে ওরা সিগারেট খাবে।”
তিথি আমার কথা শুনে কৌতূহল দৃষ্টিতে বললো,
“কিন্তু এমনওতো হতে পারে যে কালকে দিনের বেলাতেই কেউ সিগারেটগুলো খেয়ে ওখান দিয়ে যাওয়ার পথে ফেলে রেখেছে। আমারতো মনে হয় এটা আসলেই জ্বীনদের কাজ।”
“সিগারেটের বিষয়টা হয়তো তোর কথা কিছুটা সত্য তবে এটা যে জ্বীন ভূতের কাজ সেটা মানতে আমি এখনই নারাজ। তবুও বাড়িতে যেহেতু কিছুদিন আছি দেখি রহস্য উদঘাটন করতে পারি কিনা।”

তিথির সাথে টুকটাক আরো কিছু কথা বলে বাড়িতে চলে আসলাম।
বাড়িতে আসতেই শুনি বাবার শরীরে নাকি প্রচন্ড জ্বর ঝেঁকে বসেছে। বাবার রুমে নিজ হাতে ঔষধ আর পানি নিয়ে প্রবেশ করলাম। আমাকে দেখে তিনি উঠে বসার চেষ্টা করতেই আমি তাকে আরো কিছুটা সাহায্য করলাম বসার জন্য। তখনি শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করি,
“আচ্ছা আব্বা সেইদিন রাতে তোমার সাথে কি হয়েছিল খুলে বলোতো।”
তিনি দুর্বল স্বরে বললেন,
“বিশ্বাস কর জীবনের এই এতোগুলা বছরে কোনোদিন কোন জ্বীন-ভূতের অস্তিত্বও পাই নাই। অনেক লোকই কইতো শিয়ালপাড়ার ঐ বাঁশঝাড়ের থেকে নাকি সাদা কাপড় পরা এক মহিলারে বাইর হইয়া আসতে দেখছে অথচ আমি আজ পর্যন্ত কিছুই দেখি নাই। উল্টা সেদিন টর্চ লাইট নিয়া গেছিলাম ক্ষেতের অবস্থা দেখতে। যহনি দেখা শেষে ক্ষেতের আইল দিয়া হাঁটা ধরি তখন হঠাৎ কইরাই পেছন থেকে কেউ আমার মুখ চাইপা ধরলো। এরপর আর কিছু মনে নাই। পরে নাকি তোর মায় আর ঐ বাড়ির সবুজ সাদেক আমারে ক্ষেতের পাশেই কুয়ার মধ্যে অর্ধেক গাড়াইননা অবস্থায় পায়।”
“তোমার কি এইটা জ্বীন ভূতের কাজ মনে হয়?”
“জানিনারে বাজান! তোর চাচাগো বাদে আমার সাথেতো আর কারো শত্রুতা নাই। এখন দেখি তোর চাচারও নাকি একই অবস্থা।”

বাবার সাথে আরো টুকটাক কথা বলে তার রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।

রাত ২টা…
হঠাৎই অচেনা নাম্বার থেকে কারো ফোন পেয়ে বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। কোনো রকম ফোনটি রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে ভয়ার্ত স্বরে তিথি বলে উঠলো,
“মারুফ ভাই! সবরুল চাচা সেই এশার নামাজের পর থেকে বাড়ি ফিরে নাই। তার নাম্বারে কল দিয়াও চাচি বন্ধ পাইতেছে। তুমি একটু দেখবা কিছু করা যায় কিনা? আব্বাও তো অসুস্থ নাহলে তিনিই যাইতো তার খোঁজ করতে। আমি অনেক কষ্টে তোমার নাম্বারটা জোগাড় কইরা তোমারে কল দিছি।”
তিথির কথায় সাথে সাথে আমার ঘুম উবে গেলো। আমি উৎকন্ঠা নিয়ে বললাম,
“আচ্ছা দাঁড়া আমি এখনি দেখতেছি।”

অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই গভীর রাতে চাচাকে কোনো জায়গাতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীর অনেকেই সন্দেহের বশে সেই শিয়ালপাড়ার জমিতেও খোঁজ লাগিয়েছে কিন্তু অবাক করা বিষয় সেখানেও তার কোনো খোঁজ নেই।
ভোরের সূর্য যখন পূর্বাকাশে কিছুটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ঠিক তখনি সাদেক আমাকে ফোন দিয়ে বলে,
“মারুফ ভাই! চাচারেতো পশ্চিম পাড়ার খালে কাঁদার মধ্যে গাড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসেন।”
সাদেকের কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই ঠিক তখনি আমার গতকালকের সেই কালু কবিরাজের কথা মনে পরে যায়। সে বলেছিল আমাদের বংশের সকলকে নাকি জ্বীন ধ্বংস করবে। তাহলে কি এটা সেই অভিশপ্ত জমির দোষ নাকি আমাদের বংশের মধ্যেই জ্বীনের কোনো কুনজর পরেছে?…

[To be continued]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here