হৈমন্তীকা,পর্ব-১৩,১৪

0
358

হৈমন্তীকা,পর্ব-১৩,১৪
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

১৩.
বাইকের গতি বাড়ছে। শনশন আওয়াজে বাতাসের তীব্র ঝাপটা লাগছে কানে। ঠিক ভাবে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না হৈমন্তী। বাইকের পেছনের দিকটা আরও শক্ত করে খামচে ধরে সে চেঁচিয়ে বললো,
— “স্প্রিড কমান তুষার!”
— “ভয় পাচ্ছেন হৈমন্তীকা?”
প্রতিউত্তরে আলতো হেসে জিজ্ঞেস করলো তুষার। হৈমন্তী এবার ধমক দিয়ে উঠল,
— “স্প্রিড কমাতে বলেছি, তুষার! কথা শুনছেন না কেন?”

তুষার বাইকের স্প্রিড কমালো না। বরং আরও বাড়িয়ে দিলো। এতে যেন ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেল হৈমন্তীর। চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করার সময়টুকুও পেল না। কোনোমতে তুষারের কোমড়ের অংশের শার্ট শক্ত করে ধরে, চোখ-মুখ খিঁচে মূর্তির ন্যায় বসে রইলো সে। মনে মনে আল্লাকে ডাকতে লাগল। এখন বাইক থেকে পরলে নিশ্চিত হাত-পা ভেঙ্গে হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করতে হবে তার।
সরব, বাতাসের শব্দ কমে গেল। গায়ে তেমন বাতাস লাগছে না এখন। আশপাশটা কেমন নিরব, শান্ত! পিটপিট করে চোখ মেলল হৈমন্তী। রাস্তার পাশে বাইক দাঁড় করানো। মাথা থেকে হেলমেট খুলছে তুষার। হৈমন্তী চোখ মেলতেই সে বললো, “নামুন, হৈমন্তীকা।”

বাধ্য মেয়ের মতো বাইক থেকে নেমে পরলো হৈমন্তী। পরক্ষণেই কিছুক্ষণ আগের ঘটনো মনে পরতেই ক্ষীপ্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “আপনাকে তখন স্প্রিড কমাতে বলেছিলাম আমি। না কমিয়ে উলটো আরও বারিয়ে দিয়েছিলেন কেন?”
— “আপনাকে একটু জ্বালাচ্ছিলাম হৈমন্তীকা। রাগ করবেন না।”

তুষারের কথাটা ঠিক রাখতে পারলো না হৈমন্তী। রেগে গেল। ক্ষীপ্ত চোখ জোড়ার অগ্নিকুণ্ডের ন্যায় তেজ দিয়ে ভস্ম করে দিতে চাইলো তুষারকে। তুষার সেই ভয়ংকর নেত্রে চেয়ে আরও একবার আহত হলো যেন। দৃষ্টি গভীর হলো তার। বক্ষস্থলে সৃষ্টি হলো এক কঠিন ব্যাথা। সেই ব্যাথার রেশ ধরেই হেসে ফেলল সে। এগিয়ে গিয়ে হৈমন্তীর হাতের ভাঁজে হাত রাখলো। লহু স্বরে বললো,
— “চলুন, হৈমন্তীকা।”

রেস্টুরেন্টটির নাম নীড়পাতা (ছদ্মনাম)। এই অদ্ভুদ নামের রেস্টুরেন্টটির সব কিছুই কেমন অদ্ভুদ লাগছে হৈমন্তীর। চেয়ার, টেবিল থেকে শুরু করে ওয়েটারদের পোশাক-আশাকও ভীষণ রকমের অদ্ভুদ! সবাই পাঞ্চাবী পড়ে আছে। মাটির পাত্রে সার্ফ করা হচ্ছে খাবার। একপাশের দেওয়াল জুড়ে সোনালী অক্ষরে খুব সুন্দর করে লেখা, ‘মাছে ভাতে বাঙালি।’

হৈমন্তী প্রথমে ভেবেছিল, এটা শুধুই বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্ট। এজন্যই হয়তো এখানে বাঙালি সংস্কৃতি স্বতস্ফুর্ত ভাবে বিরাজমান। অথচ না। তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মেনুকার্ডে আরও বিভিন্ন দেশের খাবারের নাম উল্লেখ করা আছে। হৈমন্তী আরও একবার রেস্টুরেন্টটি ভালোভাবে দেখে নিলো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
— “আমাকে এখানে কেন এনেছেন তুষার?”
— “আমি সকাল থেকে কিছুই খাই নি হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী খানিক নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— “কেন খান নি?”
— “আপনার সঙ্গে খাবো বলে। আপনি আমাকে খাইয়ে দেবেন।”

নিঃসংকোচ আবদার। হৈমন্তী বিমূঢ় হয়ে বার কয়েক বার পলক ফেলল। তুষার তখনো মেনুকার্ড দেখতে ব্যস্ত। তার অভিব্যক্তি ভীষণ শান্ত, স্বাভাবিক। উঁচু গলায় হাঁক ছেড়ে ওয়েটারকে ডাকলো সে। মেনুকার্ড থেকে কিছু খাবার ওর্ডার করে হৈমন্তীকে বললো,
— “আমার কাছে এসে বসুন হৈমন্তীকা। ওখান থেকে আপনার অসুবিধে হবে।”
হৈমন্তী উদাস নয়নে তাকালো। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— “আপনি এবার বেশি বেশি করছেন না তুষার?”
— “একদমই না।”

হৈমন্তীর চোখে চোখ রেখে খুব গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো সে। হৈমন্তীর উদাসীনতা বাড়লো। বিরক্তি ছেয়ে গেল সর্বাঙ্গে। আরও একবার তুষারকে বোঝানোর চেষ্টা করলো সে,
— “দেখুন তুষার, আপনি যদি এই আবদারটা আমাকে একজন ছোট ভাই হিসেবে করতেন, বিশ্বাস করুন, আমি সেটা পূরণ করতাম। কিন্তু আপনি তা করছেন না। আমি আপনার বয়সে তিন বছরের বড় তুষার। আমাদের এভাবে একসাথে ঘোরার মানে নেই। আপনাকে খাইয়ে দেওয়ার মানে নেই। আপনি যা চাইছেন তা কখনো সম্ভব নয়। আমাদের সমাজ, পরিবার এটা কখনোই মানবে না। মূল কথা, আমিও আপনাকে চাইছি না। তবে কেন আমার পেছনে ঘুরে নিজের সময় নষ্ট করছেন আপনি? কেন বুঝতে পারছেন না, এটা অসম্ভব!”

কথাগুলো বলে শুকনো ঢোক গিললো হৈমন্তী। জবাবের অপেক্ষা করতে লাগল। তুষার কিছুক্ষণ চুপচাপ, নির্নিমেষ চেয়ে রইলো তার মুখপানে। পরক্ষণেই ঠোঁটে বিস্তর হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। কাতর চোখ খানায় একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে নিষ্পাপ স্বরে আওড়ালো,
— “কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি হৈমন্তীকা। আপনি কেন সেটা বুঝতে পারছেন না?”

হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল হৈমন্তীর। ছেলেটা এমন অবুঝের মতো করছে কেন? এটা বিদেশ না! বাংলাদেশ! যেখানে নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে ভালোবাসা মানে, মেয়েটা ছেলেটাকে ফাঁসিয়েছে। নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে বিয়ে করা মানে, ছেলেটার কপাল খারাপ!

_____

অনবরত কলিংবেলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। থামছেই না। রাবেয়া বেশ বিরক্তি সহিত রান্নাঘর থেকে বেরলেন। দরজার কাছে যেতে যেতে রোষপূর্ণ গলায় হাঁক ছাড়লেন, “কে?”
অতঃপর দরজা খুলতেই বিরক্তি যেন উবে গেল উনার। দরজার সামনে থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আফতাব সাহেব। রাবেয়াকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন,
— “আসরাফ সাহেব বাসায় আছেন? উনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

রাবেয়া থেমে থেমে বললেন,
— “আ-আছে। ভেতরে আ-সুন।”
— “ভেতরে ঢুকবো না। উনাকে এখানে ডাকুন।”
— “জি।”

এরপর ভেতরে ঢুকে আসরাফ সাহেবকে ডেকে আনলেন রাবেয়া। নিজে চলে গেলেন রান্নাঘরে। ইলিশ মাছ বোধহয় এতক্ষণে পুড়েই গেল! এ নিয়ে রাবেয়ার চিন্তার শেষ নেই।
আসরাফ সাহেব আফতাব সাহেবকে দেখে খানিক হাসলেন। বিনয়ের সঙ্গে বললেন,
— “কোনো সমস্যা ভাই? এ সময়ে আসলেন!”
আফতাব সাহেব কোনো ভণিতা ছাড়াই গম্ভীর স্বরে বললেন,
— “যতদ্রুত সম্ভব অন্য বাসা দেখুন। আগামী মাসে বাসা ছেড়ে দিতে হবে আপনাদের।”
আসরাফ সাহেবের কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো। বিস্ময় নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন,
— “মানে? কেন? আমাদের দ্বারা কি কোনো ভুল হয়েছে ভাই?”
— “সেটা আপনার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করুন। আপনার মেয়ে কোথায়? নিশ্চয়ই বাইরে?”
— “হ্যাঁ। কিন্তু আমার মেয়ে কি করেছে?”

আফতাব সাহেব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলেন এবার,
— “আপনার মেয়ে আমার ছেলেকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। যেই দেখেছে আমার ছেলের অনেক টাকা, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল! সেই আমার ছেলের গলায় ঝুলতে চলে এসেছে। আমার ছেলের মাথা খেয়ে ফেলেছে আপনার মেয়ে। ওকে ছাড়া আমার ছেলে যেন কিছু বুঝেই না। অথচ, আপনার মেয়ের কি নাকট! নিজেই আমার ছেলের মাথা নষ্ট করে, নিজেই কমপ্লেইন করছে আমার ছেলে কি-না আপনার মেয়েকে বিরক্ত করে। আরে, আপনার মেয়েই একটা থার্ড ক্লাস! নিজের চেয়ে ছোট ছেলেকে নিজের প্রেমের জালে ফাঁসাচ্ছে…”

বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় মুহুর্তেই রেগে গেলেন আসরাফ সাহেব। আফতাব সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “ভদ্র ভাবে কথা বলুন! আমার মেয়ে কেমন তা আপনার থেকে জানতে হবে না আমার। নিজের ছেলের দোষ আমার মেয়ের ঘাড়ে চাপাবেন না। খবরদার!”
আফতাব সাহেব আরও দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “আপনাদের থেকে ভদ্রতা শিখতে হবে না আমার। নিজেরা আগে শিখে আসুন গিয়ে। আগামী মাসের প্রথম তারিখেই যেন এ ফ্ল্যাটে আপনাদের কাউকে না দেখতে পাই আমি। নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব আপনাদের। কি ভেবেছেন আপনারা? আমার ছেলেকে নিজের বশে আনতে চাইবেন, আর আমি আনতে দিবো? কক্ষনো না!”

আসরাফ সাহেব প্রতিবাদ করতে গিয়েও করলেন না। আফতাব সাহেবের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলেন। আসরাফ সাহেবের মতে নিরবতাই সবচেয়ে বড় অপমান। তাছাড়া, কুকুর ঘেউঘেউ করলে কি আমাদেরও ঘেউঘেউ করতে হবে? নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু কোনো ভাবেই পারছেন না। শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওদিকে আফতাব সাহেব চেঁচামেচি করেই যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে উপর,নিচ তলার ফ্ল্যাট থেকে মানুষ চলে এসেছে দেখতে। চেঁচামেচি শুনে রাবেয়া রান্নাঘর থেকে ছুটে আসলেন। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি হয়েছে হৈমন্তীর আব্বু? আফতাব ভাই এত চেঁচাচ্ছেন কেন?”

আসরাফ সাহেব উত্তর দিলেন না। শক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মেঝেতে।

_____

হৈমন্তী তখনই বেরিয়ে গেছে রেস্টুরেন্ট থেকে। তুষার শত ডাকলেও থামে নি। রিকশা পাওয়া মাত্রই উঠে বসে তাতে।
নিজের ফ্ল্যাটে আসতেই খানিকটা অবাক হয় সে। প্রতিদিনের তুলনায় একটু বেশিই শান্ত আজকের পরিবেশ। আসরাফ সাহেব সোফায় চুপচাপ বসে ছিলেন। সেদিকে একবার তাকিয়ে হৈমন্তী যেতে নিলেই, পেছন থেকে উনার গম্ভীর ডাক, “এদিকে আয় হৈমন্তী।”

__________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

হৈমন্তীকা

১৪.
বাবার ডাকে থমকে দাঁড়ালো হৈমন্তী। জবাব নিলো,
— “জি, বাবা।”
আসরাফ সাহেবের মুখ মলিন, গাম্ভীর্যপূর্ণ। হৈমন্তীর দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না তিনি। বরং ওভাবেই বললেন,
— “নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রাখ। নতুন বাসা পেলেই এ ফ্ল্যাট ছেড়ে দেব আমরা।”
— “হঠাৎ… কেন বাবা?”

হৈমন্তীর কপালে ভাঁজ পরলো। বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করলো সে। অথচ আসরাফ সাহেব কোনোরূপ উত্তর দিলেন না। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। হৈমন্তীও আর পালটা প্রশ্ন করলো না। নিরবে প্রস্থান করতে নিলেই আসরাফ সাহেব সরব জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
— “তোর কি তুষারের সঙ্গে সম্পর্ক আছে হৈমন্তী?”

হৈমন্তী ভড়কে গেল। ভীতু নয়নে তাকালো আসরাফ সাহেবের দিকে। বুঝতে পারছে না, হুট করে তিনি এহেন প্রশ্ন করছেন কেন তাকে? তুষার কি উনাকে কিছু বলে দিয়েছে? কিন্তু তা কিভাবে হয়? তুষার তো এতক্ষণ তার সঙ্গেই ছিল।
সামান্য তোতলিয়ে হৈমন্তী বললো,
— “ন-না বাবা। হঠাৎ এমন অদ্ভুদ প্রশ্ন করছো কেন?”
তিনি একপলক হৈমন্তীর দিকে তাকালেন। নিজের রুমে যেতে যেতে কথাটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বললেন,
— “না, কিছু না।”

হৈমন্তী হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। আসরাফ সাহেবকে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে কখনো দেখেনি সে। এতটা চিন্তিত হতেও কখনো দেখেনি। সকালেও তো ঠিক ছিলেন তিনি। এখন আবার কি হলো? বিষয়টা ঘাটাতে গিয়েও কি ভেবে আর ঘাটালো না হৈমন্তী। সেও আজ বড্ড ক্লান্ত। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে গিয়েই প্রথমে ফুল স্প্রিডে বৈদ্যুতিক পাখা চালিয়ে দিলো সে। আরাম করে বিছানায় বসলো। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই কোত্থেকে হেমন্ত হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো তার কাছে। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। অতঃপর উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “আপু, আব্বু কিছু বলেছে তোমাকে? বকেছে?”
হৈমন্তী ভ্রু কুঁচকালো,
— “বকবে কেন?”
— “মা তোমাকে কিছু বলে নি?”
— “না।”

হেমন্ত এবার মাথা দুলাতে দুলাতে বললো,
— “আমি পুরোটা জানি না। ওই সময় বাসায় ছিলাম না। তবে আমাদের বিল্ডিংয়ের কার্তিক থেকে জেনেছি, দুপুরে নাকি তুষার ভাইয়ার আব্বু এসেছিল বাসায়। তোমার নামে আব্বুকে আজেবাজে কথা বলে গেছে। সম্ভবত তোমার আর তুষার ভাইয়াকে নিয়ে। ঝগড়াও লেগেছিল বললো। বিল্ডিংয়ের মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিল আমাদের বাসার সামনে। তখন থেকেই আব্বু এমন রেগে আছে। আমি তো ভেবেছিলাম আব্বু তোমাকে বকবে। একটু আগে আমাকেও বকেছিল।”

শেষের বাক্যটি মন খারাপ করে বললো হেমন্ত। পরক্ষণেই বোনের দিকে তাকালো, সে কিছু বলবে সেই আশায়। অথচ হৈমন্তী কিছুই বলছে না। চুপচাপ, অনুভূতি শূণ্য হয়ে বসে আছে বিছানায়। দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ। বাহ্যিকভাবে শান্ত দেখালেও হৈমন্তীর ভেতরটা কেমন তীব্র বিষাদে বিষিয়ে যাচ্ছে। সে আন্দাজও করতে পারেনি এমন কিছু ঘটবে। তার জন্য আসরাফ সাহেবকে অপমানের সম্মুখীন হতে হবে!

বুক চিঁড়ে এক বেদনাদায়ক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
— “পানি দেয়, হেমন্ত।”
হেমন্ত এক মুহুর্ত দেড়ি করলো না। বিছানার পাশের ছোট্ট টি-টেবিলের জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো হৈমন্তীর দিকে। ধীর স্থির ভাবে গ্লাসের অর্ধেক পানি পান করলো হৈমন্তী। বিষাদে পানিও গলা দিয়ে নামছে না যেন। চোখের সামনে শুধু বাবার চিন্তিত, শুকনো মুখশ্রী ঝাপসা ভাবে ভেসে উঠছে বারংবার। একদিন আসরাফ সাহেব উৎফুল্ল মনে বলেছিলেন, এমন এক মুহুর্ত আসবে, যখন তিনি হৈমন্তীকে নিয়ে গর্ব করবেন। তার মেয়েই তার মুখ উজ্জ্বলের কারণ হবে।
কিন্তু কোথায়? সেই মুহুর্তটা তো আসলো না। বরং নিজের এই মেয়ের জন্যই অন্যের কাছে অপদস্ত হতে হয়েছে উনাকে। ভাবতেই নেত্রকোণে বিন্দু, বিন্দু জল এসে জমা হলো তার। টলমলে হয়ে উঠলো আঁখিজোড়া। বোনের কষ্ট দেখে অদ্ভুদ ভাবে হেমন্তরও কষ্ট হতে লাগলো খুব। পানির গ্লাস নিয়ে সে কাঁদো গলায় আওড়ালো,
— “প্লিজ, কান্না করো না আপু। আমি তুষার ভাইয়ার সাথে আর মেলামেশা করবো না। তুমি শুধু কান্না থামাও।”

_____

নভস্থলের মন আজ বেজায় খারাপ। সেই সকাল থেকেই কেঁদে চলেছে সে। মাঝে মাঝে তার এই বিরতিহীন কান্নায় অসহ্য হয়ে ধমক দিয়ে চমকে উঠছে বিদ্যুৎ। হৈমন্তী উদাস মনে আকাশ পানে চেয়ে রইলো। দু’দিন ধরে ভার্সিটি যাওয়া হয় না তার। সে ইচ্ছে করেই যায় না। ছাদ, বারান্দা সব জায়গা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। বাহিরে গেলেই তো তুষারের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। যা সে চায় না। একদম চায় না।
হঠাৎ রান্নাঘর থেকে মায়ের হাঁক শুনতে পেল হৈমন্তী। রাবেয়া জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে বলছেন,
— “ছাদ থেকে ডানদিকের গাঁধা গাছটা নিয়ে আয় হৈমন্তী। গাছটা এমনিতেই নষ্ট হওয়ার পথে। পানিতে হয়তো মরেই যাবে।”
হৈমন্তী দিরুক্তি করল না। হেমন্ত বাসায় নেই। শত মানা করার পরও শেষে দেখা যাবে তাকেই যেতে হয়েছে ছাদে। সে ছোট্ট করে জবাব দিলো, “আনছি।”

অদ্ভুদ হলেও সত্য, ওইদিনের ঘটনা নিয়ে রাবেয়া এখনো একটা প্রশ্নও করেন নি তাকে। তার আচরণ একদম স্বাভাবিক। তবে আসরাফ সাহেব আগের চেয়ে কথা কমিয়ে দিয়েছেন। কথায় কথায় ‘মা’ ডাকটা বড্ড মনে পরেছে এই দুইদিনে হৈমন্তীর।

হৈমন্তী খুব সাবধানে ছাদে পা ফেলল। পানিতে পিচ্ছিল হয়ে গেছে মেঝে। গুটিগুটি পায়ে ছাদের ডানদিকে গিয়ে গাঁধা গাছের টবটা একহাতে নিলো। অন্যহাতে ছাতার হ্যান্ডেলটা ধরে পেছনে ফিরতেই ভীষণ ভাবে চমকে গেল সে। ছাদের সদর দরজায় অস্পষ্ট ভাবে তুষারকে দেখা যাচ্ছে। তার স্থির দৃষ্টি হৈমন্তীর মুখপানে। চেহারায় একরাশ গাম্ভীর্যের ভীড়। হৈমন্তী দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। মস্তিষ্কে কোনোরূপ উদ্ভট ভাবনা আসতে না দিয়ে শক্ত মনে পা ফেলতে লাগলো সামনের দিকে। উদ্দেশ্য, তুষারকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তার এই কঠোর ভাবটা বেশিক্ষণ টিকলো না। হঠাৎ-ই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ছাতার ভেতর ঢুকে পরল তুষার। স্তব্ধ হৈমন্তী তৎক্ষণাৎ থমকে দাঁড়ালো। বড় বড় চোখে তাকালো তুষারের দিকে। তুষার ভ্রুক্ষেপহীন। আলতো হাতে হৈমন্তীর গালে হাত রাখলো সে। লহু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— “কেঁদেছেন কেন হৈমন্তীকা?”

তুষার অনেকটা ঝুঁকে আছে হৈমন্তীর দিকে। তার অস্বস্থি হচ্ছে। তুষারকে হালকা ধাক্কা দিলো সে। কাঠকাঠ গলায় বললো,
— “সরে দাঁড়ান তুষার!”

তুষার কথা শুনলো না। অবাধ্যের ন্যায় ওভাবেই রইলো। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,
— “আপনারা বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন, হৈমন্তীকা? কেন? কেন এত জ্বালাচ্ছেন আমাকে?”
— “আমি আপনাকে জ্বালাচ্ছি না তুষার। বরং আপনি জ্বালাচ্ছেন আমাকে। আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন তুষার। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। তবুও কেন পিছু ছাড়ছেন না আমার? কেন নিজের সময় নষ্ট করছেন?”

তুষারের চাহনি গভীর হলো। আরও ঝুঁকে এলো সে। সযত্নে হৈমন্তীর কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো। ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
— “আপনি আমাকে ভালোবাসবেন হৈমন্তীকা। একদিন ঠিক ভালোবাসবেন।”
হৈমন্তী আশ্চর্য চোখে তাকালো। কণ্ঠে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
— “এতকিছুর পর আপনি কিভাবে ভাবছেন আমি আপনাকে ভালোবাসব? অন্তত আপনার বাবার ওরকম ব্যবহারের পর তো কক্ষনো না।”

তুষারের কপালে ভাঁজ পরলো। বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “মানে?”
হৈমন্তী হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি।
— “জানেন না, তাই তো? আপনার বাবাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। আর হ্যাঁ, একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?”
তুষার জবাব দিলো না। শুধু ভ্রু কুঞ্চিত করে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। হৈমন্তী নিজ থেকেই আবার বললো,
— “দয়া করে আমার পিছু ছেড়ে দিন।”

____________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here