হৈমন্তীকা,পর্ব:৩৬,৩৭,৩৮

0
265

হৈমন্তীকা,পর্ব:৩৬,৩৭,৩৮
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
৩৬.
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। অস্বাভাবিক শান্ত বাতাসে শরীর শিরশির করে উঠছে। রেলিং গলিয়ে একবার নিচে উঁকি দিলো হৈমন্তী। চোখ থমকে গেল সেখানেই। কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আছে তার প্রাক্তন বারান্দাটা। ধূলোয় স্তুপ হওয়া জায়গা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ বৃষ্টির পানিতে। মনে মনে বৃষ্টিকে কৃতজ্ঞ জানালো হৈমন্তী। ইচ্ছে হলো, ছুটে গিয়ে প্রাণপ্রিয় বারান্দা একটুখানি ছুঁয়ে দিতে। হৈমন্তী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দৃষ্টি সরিয়ে গহীন কালো আঁধারে স্থির করতেই কোমরে পুরুষালী স্পর্শ পেল সে। যা তার কোমড় ছুঁয়ে দু’হাতের দু’পাশে এসে স্থান পেল। পিঠ ঠেকে গেল প্রশস্ত বুকে। হৈমন্তী ভড়কালো। চমকে উঠলো ভীষণ। ধাতস্ত হতেই বললো,
—“কি করছেন তুষার?”

তুষার উত্তর দেয় না। উলটো গমগমে স্বরে বলে,
—“বৃষ্টি হচ্ছে না? দাঁড়িয়ে আছেন কেন? জ্বর বাঁধানোর ইচ্ছে হয়েছে?”
হৈমন্তীর মিনমিনিয়ে উত্তর,
—“রুমে ভালো লাগছে না।”

পরপরই আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিচের বারান্দাটির দিকে তাকালো সে। জিজ্ঞেস করলো,
—“আমাদের ফ্ল্যাটে কি কেউ থাকে না? কেমন বদ্ধ বদ্ধ যে?”
—“থাকে। শুধু আপনার বারান্দা আর রুমে থাকার অনুমতি নেই।”

হৈমন্তী যেন ভীষণ অবাক হলো। বললো,
—“কেন?”
—“কারণ আমি চাই না ওখানে কেউ থাকুক। ওই বারান্দাটা আমার হৃদয়খননের একমাত্র স্বাক্ষী, সূচনা আর ভালোবাসা।”

তুষার ক্ষীণ গভীর হলো। গলায় মুখ এগিয়ে স্পর্শের প্রগাঢ়তা বাড়ালো। নাকে ঠেকলো শ্যাম্পুর মিষ্টি ঘ্রাণ। শুধু কি শ্যাম্পুর ঘ্রাণ? হৈমন্তীর নিজস্বতাও মিশে আছে এতে। হৈমন্তী থেমে থেমে কেঁপে উঠলো। আড়চোখে তাকালো তুষারের মুখপানে। কম্পয়মান গলায় বলতে চাইলো,
—“আমার ঠান্ডা লাগছে তুষার। রুমে চলুন।”
তুষার শুনলো না। আরও কিছু সময় নীরবে, নিভৃতে কাটিয়ে দিলো তারা। হৈমন্তীও দিরুক্তি করতে পারেনি। তার কি সাধ্য আছে মানা করবার?

সরব খট খট শব্দে কে যেন কারাঘাত করলো দরজার পিঠে। হৈমন্তী ছিটকে সরে গেল প্রায়। তুষারের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, সে ভ্রু কুঁচকে দৃঢ় চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। হৈমন্তী আবার নতজানু হলো। মৃদু স্বরে তাগাদা দিলো,
—“দরজায় কেউ আছে। খুলুন, যান।”

তুষার শুনলো। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললো,
—“শাড়ি ভিঁজে গেছে। চেঞ্জ করে নিন। ঠান্ডা লাগবে।”
পেছন থেকে হৈমন্তী উঁচু গলায় বললো,
—“আমার কাছে আর শাড়ি নেই তো। সবগুলো ধুঁয়ে দিয়েছিলাম। শুকোয় নি এখনো।”

সেকথার আর উত্তর পাওয়া গেল না। ধীর স্থির হয়ে দরজার কাছে গিয়ে নব ঘোরালো তুষার। হেনাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুঁচকানো ভ্রু স্বাভাবিক করলো। হেনা খুবই শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
—“ভাত খাবি না? নিচে আয়। ভাত বাড়ছি।”
তুষার মায়ের মতো করেই বললো,
—“নিচে খাবো না। রহিমা আন্টিকে বলো রুমে খাবার আনতে।”
হেনা জোড় করলেন,
—“রাগ মনে পুষে রাখিস না বাপ। হৈমন্তীকে নিয়ে নিচে আয়।”
—“আমরা এখানেই খাবো মা।”

হেনা হতাশায় ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছোট্ট করে “আচ্ছা।” বলে চলে যেতে নিলেই পিছু ডাকলো তুষার। হেনা পেছনে ফিরে তাকালেন। তুষার নরম গলায় প্রশ্ন করলো,
—“তুমি ভাত খেয়েছ মা?”

প্রশ্নটায় কি যেন ছিল। মন ভরে উঠলো উনার। ঠোঁটে অল্প হাসি ফুটিয়ে তিনি জবাব দিলেন,
—“খাবো। একটু পর।”
—“তোমার কয়েকটা শাড়ি পাঠিয়ে দিও মা। হৈমন্তীকার পরার কাপড় আনা হয় নি।”

ওমনি হেনা যেন ব্যস্ত হয়ে পরলেন। তুষারকে ক্ষীণ ধমক দিয়ে বললেন,
—“একি! আগে বলবি না? আমি আনছি। দ্বারা।”

হেনা যেতেই দরজা লাগিয়ে দিলো তুষার। হৈমন্তীকে আগের মতোই ভেঁজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
—“ঠান্ডা লাগছে হৈমন্তীকা? আপাতত আমার একটা টি-শার্ট পরে নিন। আমি এসি বন্ধ করে দিচ্ছি।”

_____

দুপুর গড়াতেই রুমে বসে থাকতে আর ভালো লাগলো না হৈমন্তীর। কতক্ষণ আর শুয়ে, বসে কাটানো যায়? তুষার মানা করা সত্ত্বেও তা অবজ্ঞা করে নিচে নেমে এলো সে। রান্নাঘরে তাকে দেখে অনেকটা অবাকই হলেন হেনা। বিস্মিত স্বরে বললেন,
—“হৈমন্তী, তুমি এখানে যে? কিছু দরকার ছিল?”

হৈমন্তী নিচু গলায় বললো,
—“এমনি। আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে হলো। কি বানাচ্ছেন আন্টি?”

হেনা হাসলেন। চুলার মাছগুলো উল্টিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—“বোকা মেয়ে। আন্টি বলছো কাকে? মা ডাকবে।”
কথার পিঠে হৈমন্তীও হাসলো। কিছু বলার আগেই আফতাব সাহেবের হাঁক শোনা গেল হঠাৎ। হেনা দ্রুত হাত চালিয়ে অন্য চুলা থেকে চায়ের কেতলি নামালেন। এক চামচ চিনি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা চা ঢাললেন কাপে। তারপর হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে অনুরোধের সুরে বললেন,
—“উনাকে একটু চা-টা দিয়ে আসতে পারবে হৈমন্তী? আমার হাতে কাজ তো! নয়তো আমিই যেতাম।”

হৈমন্তী করুণ চোখে তাকালো। তাকে যেতে হবে চা দিতে? হেনা তার সংশয় দেখে একটু হাসলেন। আবারও বললেন,
—“ভয় নেই। বকবে না। আমি কাল রাতে বুঝিয়েছি উনাকে।”

হৈমন্তী যেন একটু সাহস পেল। চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল ড্রইংরুমে। আফতাব সাহেব টিভি দেখছিলেন। তখনো হৈমন্তীকে খেয়াল করেননি তিনি। হৈমন্তী আমতা আমতা স্বরে বললো,
—“আপনার চা আঙ্কেল।”

টিভি দেখার মাঝেই ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। পাশ ফিরে হৈমন্তীকে দেখে তা যেন আরও গাঢ় হলো। গাম্ভীর্যের গভীরতা বাড়লো সেই সঙ্গে। তবে অবাক বিষয়, সত্যিই তাকে কিছু বললেন না আফতাব সাহেব। গমগমে মুখশ্রী নিয়ে একবার তাকালেন মাত্র। পরপরই বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে গেলেন সেখান থেকে।

তুষারের দেখা মিললো এর কিছুক্ষণ পরই। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে উঁচু গলায় হৈমন্তীকে ডাকলো সে। রান্নাঘর থেকে গুটিগুটি পায়ে হৈমন্তী কাছাকাছি আসতেই বললো,
—“আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি হৈমন্তীকা। আপনি আর কতক্ষণ এখানে থাকবেন? মায়ের রান্না শেষ হয়েছে?”

হৈমন্তী মাথা দুলিয়ে বললো,
—“হ্যাঁ। কোথায় যাচ্ছেন?”
—“টিউশন আছে। আপনি রুমে চলে চান। আমি না আসা অব্দি বের হবেন না। ঠিকাছে?”

হৈমন্তী এবারও মাথা দুলালো। বিস্তর হাসলো তুষার। হৈমন্তীকে কাছে টেনে কপালে অধর ছোঁয়ালো। কোমল স্বরে বললো,
—“নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো।”

বলে সে আর দাঁড়ালো না। ব্যস্ত পায়ে বেড়িয়ে গেল ড্রইংরুম হতে।

_____

কোলাহলে পূর্ণ এলাকা বৃষ্টির কারণে বড্ড নিস্তব্ধ। দৌঁড়ে যে যার গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ছাতা হাতে ধীর পায়ে হাঁটছে রাস্তায়। উপভোগ করছে বৃষ্টিমূখর পরিবেশ। বারান্দার দরজা আটকে দিয়েছে হৈমন্তী। পানির ছিঁটায় ফ্লোর ভিঁজে যাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে আছে আধখোলা জানালার একপাশে। পরনে হলুদ রঙের জামদানি শাড়ি। শাড়িটা হেনা দিয়েছেন। ভীষণ সুন্দর দেখতে।
চিন্তায় মগ্ন হৈমন্তী তুষারের আগমন টের পেল না। তুষার নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো। মৃদু স্বরে ডাকলো,
—“হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী ক্ষীণ চমকে পেছনে তাকালো। কাকভেঁজা তুষারকে দেখতেই আঁতকে উঠে বললো,
—“আল্লাহ! পুরো ভিঁজে গেলেন তো। ছাতা নিয়ে যান নি সাথে?”
তুষার হাতের ব্যাগগুলো ফ্লোরে রেখে বললো,
—“না। ভুলে গিয়েছিলাম।”

বলে হাতের ঘড়িটা খুলে রাখলো ড্রেসিংটেবিলে। শার্টের বোতাম খুলতে নিলেই ধমক দিয়ে উঠলো হৈমন্তী,
—“এখানে খুলছেন কোন আক্কেলে? ওয়াশরুমে যান।”

তুষার হাসলো। এক কদম হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে প্রথম তিনটে বোতাম খুলতেই উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠলো হৈমন্তী। তুষারের হাসির শব্দ বাড়লো। হাসির দমকে নেত্র কোণে গুটিকয়েক ভাঁজ পরলো, নাক লাল হলো ভীষণ। হৈমন্তী মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর স্বরে আবার বললো,
—“ফাজলামি না করে ওয়াশরুমে যান।”

তুষার পাত্তা দিলো না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো,
—“আপনাকে রাগলে মারাত্বক লাগে হৈমন্তীকা। আসুন, কাছে আসুন। একটু ছুঁয়ে দেই।”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল হৈমন্তী। ক্ষীণ লজ্জায় মিইয়ে গেল। উঁচু গলায় বললো,
—“আপনি যাবেন?”

হাসতে হাসতে তুষারের জবাব,
—“যাচ্ছি। ব্যাগে আপনার জন্য শাড়ি এনেছিলাম। ভিঁজে গেছে সম্ভবত। একটু দেখুন তো।”

_________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

হৈমন্তীকা

৩৭.
সবুজ রঙের শাড়িটির অনেকাংশ ভিঁজে গেছে। কাগজের প্যাকেটটা আধছেঁড়া হয়ে পরে আছে ফ্লোরে। চেয়ার টেনে সেখানে শাড়িটি মেলে দিলো হৈমন্তী। অগোছালো বিছানা টান টান করে বিছালো। তুষার ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো তখন। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
—“শাড়ি ভিঁজে গেছে?”

হৈমন্তী একবার তুষারের মুখপানে তাকালো। জবাব দিলো,
—“হু। একটু।”

পরপরই আলমারির দিকে এগোলো সে। দু’পাশের লম্বাটে দরজা টান দিয়ে খুললো। হাত এগিয়ে রঙ-বেরঙের শাড়িগুলো কয়েক সেকেন্ড ছুঁয়ে দেখল খুব যতনে। এরপর আনমনেই বললো,
—“এ দু’একদিনে কতগুলো শাড়ি হয়েছে আমার! আপনি দিয়েছিলেন ছয়টা। মা দিয়েছেন তিনটা। এখন আবার একটা আনলেন। মোট দশটা শাড়ির মালিক আমি।”

হৈমন্তীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ঠোঁটে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি। টের পেল, তুষার কাছাকাছি চলে এসেছে তার। ঘাড়ে উষ্ণ নিশ্বাসের অস্তিত্ব পাচ্ছে সে। হঠাৎ কোমড় আঁকড়ে কাঁধে থুতনি ঠেকালো তুষার। শাড়ির ভাঁজ গলিয়ে খুব গভীরে যেতেই বরাবরের ন্যায় কেঁপে কেঁপে উঠলো হৈমন্তী। তুষার চমৎকার হাসলো। প্রশ্ন করলো,
—“শাড়িগুলো না ধুঁয়ে দিয়েছিলেন? শুকিয়ে গেছে?”

হৈমন্তী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারলো না। আড়ষ্টতায় ক্ষীণ মিইয়ে গেল। মৃদু আওয়াজে বললো,
—“সকালের কড়া রোদেই শুকিয়ে গিয়েছিল। এবার সরুন।”

তুষার নাকচ করে বললো,
—“ভালো লাগছে আমার। সরতে পারব না।”
বলে একটু থামলো সে। তারপর আবার প্রশ্ন করলো,
—“আমি তো এখন আপনার আপনজন হৈমন্তীকা। ভীষণ আপন মানুষ। তবুও আপনি আমাকে আপনি বলে ডাকেন কেন?”

হৈমন্তী তখন উলটো প্রশ্ন করে,
—“আপনি কেন আমাকে আপনি বলে ডাকেন?”
তুষার সময় না নিয়ে উত্তর দেয়,
—“কারণ আপনাকে আপনি বলে ডাকতে আমার ভালো লাগে। আপনি ডাকটায় আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই হৈমন্তীকা। আপনাকে নিজের মাঝে ভীষণ ভাবে অনুভব করতে পারি।”
—“আমিও এজন্যই আপনাকে আপনি বলে ডাকি। ডাকটা আমারও ভীষণ প্রিয়। এবার সরুন। নয়তো আমি কিন্তু এখন সত্যি সত্যি বকব।”

তুষার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। হাতের বাঁধন শক্ত করে বললো,
—“বকুন। আমি ছাড়ছি না আপনাকে।”
—“আমি কিন্তু দরজা লাগাই নি।”
—“সমস্যা নেই।”
—“সরুন, তুষার।”

তুষার শুনলো না। হঠাৎ-ই কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। নিষ্পলক কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কাঁধে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
—“দিন দিন এত সুন্দর হচ্ছেন কিভাবে হৈমন্তীকা? আপনার রুপে আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে।”

হৈমন্তীর নিশ্বাস থেমে গেল যেন। শরীর অবশ হয়ে এলো। তুষার আবারও বললো,
—“ভালোবাসি আপনাকে হৈমন্তীকা।”

____

বিকালের প্রথম ভাগ মাত্র। রান্নাঘরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে হৈমন্তী। তাওয়ার আধকাঁচা ঝাল পিঠাগুলো উল্টে দিয়ে হেনা বললেন,
—“গরমের মধ্যে শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন হৈমন্তী? গরম লাগছে না? ফ্যানের নিচে গিয়ে কিছুক্ষণ বসো আসো। যাও!”

হৈমন্তী নিচু গলায় বললো,
—“অভ্যেস আছে মা। তাছাড়া এখন তো বর্ষাকাল। ভালোই লাগছে এখানে।”
হেনা হাসলেন। দুধ উতরানো কেতলিতে তিন চামচ চা-পাতা দিয়ে বললেন,
—“জানো, আমার তুষারটাও না তোমার মতো। ছোট বেলায় আমি রান্না করলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। এখন তো ওর বাবার জন্য আমার ওপর চাপা অভিমান করে আছে। তবে ঠিকই মায়ের খবরাখবর নিতে চলে আসে। কখনো ভুলে না। আমার হাতের চা ছাড়া ওর চলেই না। দেখবে, একটু পর চায়ের জন্য চেঁচামেঁচি শুরু করে দেবে।”

বলে আবারও মুখ ভরে হাসলেন হেনা। কি মায়াময় সেই হাসি! কি স্নিগ্ধ! হৈমন্তীর মন হঠাৎ-ই খারাপ হয়ে গেল। রাবেয়া যখন রান্না করতেন, হৈমন্তীও তো তখন এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতো। সে নিজে রান্না করলে তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে উপদেশ দিতে দিতে কাহিল বানিয়ে দিতেন রাবেয়া। উনারও তো হয়তো হৈমন্তীর কথা মনে পড়ে। তখন কি তার মা তার জন্য কাঁদে? হেমন্তর কি আপুর জন্য মন খারাপ হয় না? বাবার কি মেয়ের কথা ভেবে অভিমান ভুলতে ইচ্ছে করে না? ওরা কেউ কি মনে করে তার কথা? হৈমন্তীর তো করে। এই যে, এখন করছে। বিষাদে বুক ভারি হচ্ছে। যন্ত্রণা সইতে না পেরে বেরিয়ে আসছে একেকটা দীর্ঘশ্বাস।

সরব হেনার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো তার। তিনি কাপে চা ঢালতে ঢালতে ভীষণ গর্বের সঙ্গে বললেন,
—“দেখেছ? ডাক শুরু হয়ে গেছে ওর।”

হৈমন্তীর কান সজাগ হলো এবার। ড্রইংরুম থেকে তুষারের হাঁক শুনতে পাচ্ছে সে। চায়ের জন্য রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠছে তুষার। হেনা চায়ের কাপটা হৈমন্তীকে দিয়ে বললেন,
—“চা টা একটু দিয়ে আসো তো মা।”

হৈমন্তী মাথা দুলালো। ধীর পায়ে ড্রইংরুমে এগোতেই দেখল, সোফায় আরাম করে বসে বিরক্ত ভঙ্গিতে টিভির চ্যালেন পাল্টাচ্ছে তুষার। হৈমন্তী আরোও দু’কদম এগিয়ে তুষারের কাছাকাছি দাঁড়ালো। টেবিলে চায়ের কাপ রেখে ঢিমে যাওয়া গলায় বললো,
—“আপনার চা।”

তুষার চায়ের কাপ নিলো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনার কি মন খারাপ হৈমন্তীকা? কেউ কিছু বলেছে?”

জবাবে মাথা দুলিয়ে না জানালো সে। তুষার আরও কিছু বলবে, তার পূর্বেই কলিংবেল বেজে উঠলো। বিরতিহীন, লাগাতার ভাবে। রহিমা খালা সদর দরজা খুলতেই ফুঁসফুঁস শব্দে ভেতরে প্রবেশ করলেন আফতাব সাহেব। ড্রইংরুমে হৈমন্তীকে দেখে মাথার রাগগুলো যেন দপ করে জ্বলে উঠলো। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে একবার হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে হেনাকে ডাকলেন তিনি। হেনা দৌঁড়ে এলেন সেকেন্ড পেরোতে না পেরোতেই। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তেঁতে উঠলেন আসরাফ সাহেব,
—“কার জন্য তুমি রাতে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিলে হেনা? এই মেয়েটার জন্য? এই মেয়ের কারণে আমি এখন বাহিরেও বেরুতে পারছি না। পাড়াপ্রতিবেশি তো ছাড়ো! বিল্ডিংয়ের দারোয়ান পর্যন্ত আমাকে জিজ্ঞেস করছিল ছেলের বউয়ের কথা। আমি কেন ছেলেকে বয়সে বড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি? লোকে ছিঃ বলছে হেনা। ভাবতে পারো ব্যাপারটা আমার জন্য কতটা অপমানজনক?”

কথাগুলো বলে হাপাতে লাগলেন তিনি। বার্ধক্যের দরুণ জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলেন। বাবার অভিযোগ তুষার চুপচাপ শুনলো। প্রতিবারের মতো শান্ত কণ্ঠে ভয়ংকর একখানা কথা বলতে নিলেই কাঁধের শার্ট খামচে ধরে মানা করলো হৈমন্তী। মুখ নুইয়ে খুব ধীর গলায় উচ্চারণ করলো,
—“বাবা।”

আফতাব সাহেব থমকালেন। নিমিষেই শান্ত হয়ে চমকে যাওয়া নজরে তাকালেন। হৈমন্তী নম্র গলায় আবার বলতে লাগলো,
—“আপনাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি বাবা। আমি চাই আপনি আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসুন। কিন্তু আমি….”

আরও কিছু বলার পূর্বেই তিনি গটগট পায়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে গমগমে গলায় বললেন,
—“বেশি বাড়াবাড়ি পছন্দ নয় আমার। নিজের সীমার মধ্যে থাকো।”

হৈমন্তী বিহ্বল চোখে উনার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। তুষারের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেও কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে। আচ্ছা, জেদি বাপ-ছেলে কি এমনই হয়?

_____

কাল রাতের মতো আজকেও বর্ষণের দেখা মিললো পৃথিবীতে। তুষারও টিউশন থেকে ভিঁজে ভিঁজে এলো রাত ৮টার সময়। এসেই একপলক হৈমন্তীর দিকে তাকালো সে। তবে মুখে কিছু বললো। গটগট পায়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।
আগের দিনের তুলনায় আজ ঝড়ের তান্ডব বেশি। যার দরুণ লোডশেডিং হচ্ছে। একবার দু’বার লাইট অন অফ হতে হতে একসময় একদমই বন্ধ হয়ে গেল রুমের সাদা ঝকঝকে বাতি। হৈমন্তী আঁতকে উঠলো। অন্ধকারে চোখে কিছুই ধরা দিচ্ছে না।
ওয়াশরুম থেকে তুষারের গলা শোনা গেল,
—“হৈমন্তীকা?”

প্রায় তৎক্ষণাৎ সে জড়োসড়ো গলায় জবাব দিলো,
—“আমি কিছু দেখতে পারছি না তুষার।”
—“ফোনের লাইট জালান হৈমন্তীকা। সাথে আছে ফোন?”

হৈমন্তী কোনোমতে “হুম।” বলে আন্দাজে বিছানা হাতড়ালো। একটু ডানে হাত নিতেই পেয়ে গেল ফোন। প্রাণে প্রাণ এলো যেন। তুষার আবার বললো,
—“বেডসাইড টেবিলের প্রথম ড্রয়ারে দেখুন মোমবাতি আর লাইটার আছে।… পেয়েছেন?”

কথা মতে ঠিক তা-ই করলো হৈমন্তী। পেয়ে যেতেই প্রফুল্ল কণ্ঠে বললো,
—“পেয়ে গেছি।”

এরপর আর তুষারের গলা শোনা গেল না। একটু পর সে নিজেই বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম হতে। এক হাতে ভেঁজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে হৈমন্তীর কাছে আসলো। প্রশ্ন করলো,
—“ভয় পেয়েছিলেন?”

শুনে বোকা হাসলো হৈমন্তী। জবাব দিলো না। মোমবাতির হলুদ, কমলা মিশেল আলো সরাসরি পরছে তার স্নিগ্ধ, অবুঝ মুখখানায়। তুষারের চোখ আটকে গেল। প্রবল আকাঙ্ক্ষায় তীর্থ হলো মন, মস্তিষ্ক। নিষিদ্ধ ইচ্ছে জেগে উঠলো খুব গোপনে। শুকনো ঢোক গিললো সে। নেত্রজোড়া সরাতে নিয়েও পারলো না। হঠাৎ কি যেন হলো! হৈমন্তীকে হুট করে কোলে তুলে নিলো সে। বিছানায় শুইয়ে কাছে আসতে নিলেই বুকে আলতো ধাক্কা দিলো হৈমন্তী। ভীতু গলায় বললো,
—“কি করছেন?”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
—“কিচ্ছু না।”

পরপরই নিজের অধরে অধৈর্য অধরের স্পর্শ পেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল সে।

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

হৈমন্তীকা

৩৮.
ঝড়ের তান্ডবের তীব্রতা বেড়ে গেছে। কারেন্টের খবরাখবর পাওয়া যায় নি এখনো। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে তুষারের সান্নিধ্য পেয়ে কেমন নেতিয়ে গেল হৈমন্তী। অধর থেকে অধরের স্পর্শ আলাদা হতেই তুষারের বুকে মাথা গুঁজলো সে। ঘন ঘন শ্বাস নিলো দু’জনেই। ভারি হলো বক্ষস্থলের ওঠা-নামা। শরীর কেঁপে উঠলো শিরশির করে। নেত্র কোণে জল এসে জমলো হৈমন্তীর। কান্না এলো খুব। হঠাৎ তুষারকে দু’হাত মেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। বুকের সঙ্গে যথাসম্ভব মিশিয়ে নিলো নিজেকে। কান্নার দমক তুলে ফুঁপিয়ে উঠল সশব্দে। তুষার ব্যস্ত হয়ে উঠল। আগলে নিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
—“কি হয়েছে হৈমন্তীকা? কাঁদছেন কেন? আমি ছুঁয়েছি বলে? আর ছঁবো না। কান্না থামান। কান্না থামাচ্ছেন না কেন?”

হৈমন্তী বুকে লেপ্টে থাকা অবস্থায় এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, সে কান্না থামাবে না। তুষার আবার বললো,
—“বলেছি তো, আমি আপনাকে আর ছুঁবো না। তবুও কাঁদছেন কেন?”

হৈমন্তী আবারও মাথা নাড়ায়। জবাব দেয় না। তুষার একটু ঝুঁকে হৈমন্তীর মুখশ্রী দেখবার চেষ্টা করে। মুখের ডান পাশটা অল্প দেখা যাচ্ছে। চোখ, মুখ, নাক, কান লাল হয়ে কি একটা অবস্থা! আগলে রাখার ধরণ আরেকটু দৃঢ় করে তুষার বললো,
—“পরিবারের কথা মনে পরছে হৈমন্তীকা?”

তুষারের পিঠের টি-শার্ট খামচে ধরল হৈমন্তী। সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে ভীষণ ক্ষীণ স্বরে বললো,
—“আমার খুব মনে পরছে বাবার কথা, মায়ের কথা, ভাইটার কথা। আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চলুন তুষার। প্লিজ নিয়ে চলুন।”

বলতে বলতে আবারও ফুঁফিয়ে উঠলো সে। তুষার নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ। কপাল থেকে ছোট্ট চুলগুলো কানে গুঁজে, স্বযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মোলায়েম স্বরে শুধালো,
—“খুব শীগ্রই আপনাকে নিয়ে যাবো হৈমন্তীকা। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করুন। সকালে ফোন দিয়ে মায়ের সঙ্গে একবার কথা বলে নিবেন। ঠিকাছে?”
হৈমন্তী নাক টেনে উত্তর দিলো,
—“আচ্ছা।”

বেশ সময় নিয়ে হৈমন্তীর ফুঁপানোর শব্দ থামলো। ক্ষীণ শান্ত হলো সে। অশ্রুর স্বচ্ছ জলে তুষারের বুকের বা’পাশটা ভিঁজে একাকার। তুষার ঠোঁট এগিয়ে হৈমন্তীর কপালে ঠেকালো। হঠাৎ দরজায় কারাঘাত করে উঠল কেউ। রহিমা খালা এসেছেন। দরজার ওপাশ থেকে তার উঁচু কণ্ঠ ভেসে আসছে,
—“ভাইজান, ম্যাডামে খাইতে ডাকছে। আইবেন না?”

তুষার প্রথমেই উত্তর দিলো না। হৈমন্তীর গালে হাত রেখে বললো,
—“উঠুন হৈমন্তীকা। খাবেন না? উঠুন।”
হৈমন্তী আরও জেঁকে শুলো যেন,
—“খাবো না। ঘুমাবো।”
—“শরীর খারাপ করবে তো। আসুন, একটু করে খাবেন।”
হৈমন্তী চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
—“না।”

তুষার তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। রহিমা খালা আবারও ডাকতেই জবাব দিলো,
—“খাবো না আজকে রহিমা খালা। মা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, ঘুমিয়ে পরেছি।”

রহিমা খালা “আইচ্ছা” বলে চলে গেলেন গটগট পায়ে।

_____

চুলায় পানি ওতরাচ্ছে। হৈমন্তী আনমনা হয়ে চপারবোর্ডে সবজি কাটছিল। মনটা বড্ড বিষাদে জড়োসড়ো হয়ে আছে। সকালে রাবেয়ার সঙ্গে কথা বলেছিল সে। মায়ের কান্নায় জর্জরিত গলার আকুলতা শুনে কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার। হেমন্তর সঙ্গে কথা বলতে পারে নি হৈমন্তী। ও স্কুলে চলে গেছে ততক্ষণে। বোনের জন্য নাকি প্রতিদিন মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাবাও নাকি মাঝরাতে আড়ালে আবডালে কাঁদেন। শুনে হৈমন্তীর ভেতরটা হুহু করে উঠে। রাবেয়া যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন,
—“কেমন আছিস হৈমন্তী? সুখে আছিস তো মা?”

হৈমন্তী কান্না দমিয়ে রাখতে পারেনি কোনো ভাবেই। সশব্দে কেঁদে দিয়েছিল তুষারের শার্ট মুঠো করে ধরে। সরব হেনার ডাকে চমকে তাকালো হৈমন্তী। অসাবধানতায় ধারালো ছুঁড়িটা গভীর ভাবে গেঁথে গেল বৃদ্ধা আঙুলের ঠিক নিচটায়। ব্যথায় মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো সে। হেনা ভড়কে গেলেন। এগিয়ে এসে কলের নিচে চেপে ধরলেন হাত। ধমকের সুরে বললেন,
—“আমি মানা করেছিলাম না? আমার মানাটা একটু শুনলে কি হতো মেয়ে? একদম ভালো হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি।”

পরমুহূর্তেই উঁচু গলায় রহিমা খালাকে ডাকলেন তিনি,
—“রহিমা, প্রাথমিক চিকিৎকার বক্সটা নিয়ে আয়। সাথে তুষারকেও ডাকিস। আজকে ওর বউয়ের একটা বিচার করেই ছাড়ব। মেয়েটা একদম আমার কথা শুনে না।”

হৈমন্তীর ব্যথা পাওয়ার কথা শুনে হন্তদন্ত পায়ে রান্নাঘরে উপস্থিত হলো তুষার। চুল বেয়ে তখনো পানি ঝড়ছে। সম্ভবত মাত্রই শাওয়ার নিয়ে এসেছে। হেনাকে বললো,
—” তুমি সরো মা। আমি দেখছি।”

হাত জ্বলছে খুব। টনটন করছে কেমন। হৈমন্তী চোখ খিঁচে আছে। তুষার আলতো করে হাতটা ধরতেই টলমলে নয়নে চাইলো। তুষারের চোয়াল শক্ত। ভ্রু, কপাল কুঁচকে রাখা। সাবধানে হাতটা পরখ করছে সে। হৈমন্তী ফাঁকা গলায় ঢোক গিললো। ধরা গলায় বললো,
—“সরি।”

তুষার জবাবহীন। চেহারায় দারুণ গাম্ভীর্য এঁটে রেখেছে। চুপচাপ ব্যান্ডেজ করে মারাত্বক শান্ত গলায় সে বললো,
—“মা মানা করেছিল না আপনাকে? মাকে সাহায্য করবেন ঠিকাছে। কিন্তু তা যেন রান্নাঘর অব্দি না গড়ায়। নয়তো আমি খুব কঠোর হতে বাধ্য হবো হৈমন্তীকা।”

তুষারের এহেন কথায় প্রচন্ড অবাক হলো হৈমন্তী। কিছু বলবে, তার সুযোগ না দিয়ে অপর হাত শক্ত করে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল তুষার।

আসতাব সাহেব ড্রইংরুমের সোফায় বসে ফোনে কথা বলছিলেন। কিছুক্ষণ পর পর ধমকে উঠছিলেন। আইপিএস-এ কি যেন ঝামেলা হয়েছে। কাল সন্ধ্যে বেলা ঠিক করার কথা বলেছিলেন তিনি। দুপুর হয়ে গেল, অথচ এখনো কাজে হাতই দেয় নি তারা। এ নিয়েই আফতাব সাহেব প্রচন্ড বেজার।

তুষার বাবার দিকে একবার তাকালো। সিঁড়ির একধাপ উপরে উঠতেই ডেকে উঠলেন আফতাব সাহেব। জিজ্ঞেস করলেন,
—“এই মেয়ের কি হয়েছে? রান্নাঘরে এত চেঁচামেচি হচ্ছিল কেন?”
তুষার সহজ ভাবে উত্তর দিলো,
—“হাত কেটে গেছে।”
—“খুব বেশি কেটেছে? ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন এখনো?”

কথাটা যেন এক অস্বাভাবিক বাক্য। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না তুষার। ভ্রু উঁচু করে তীক্ষ্ণ নয়নে তাকালো। ছেলের এমন দৃষ্টিতে হকচকালেন তিনি। কোনোমতে কানে ফোন রেখে অন্যদিকে চলে গেলেন।

_____

আজ আকাশে বৃষ্টি নেই। চাঁদের আলোয় মুখরিত সব। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে সুদূর হতে। হৈমন্তী রেলিংয়ে থাকা হাতটায় একবার তাকালো। সাদা ব্যান্ডেজ করা। ক্ষত স্থানটা জ্বলছে একটু। হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকায়। তুষারকে দেখে ম্লান হাসে। জিজ্ঞেস করে,
—“আপনি কি এখনো রেগে আছেন তুষার?”

সে এগিয়ে আসতে আসতে উত্তর দেয়,
—“আপনার সঙ্গে রাগ করতে আমার ভালো লাগে না। তাই রেগেও থাকি না।”

বলে হৈমন্তীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সে। মাথায় থুতনি ঠেকালো। প্রশ্ন করলো,
—“আমি আপনাকে কখন ভালোবেসেছিলাম, তা কি জানেন হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী মাথা নাড়ালো,
—“না।”
তুষার হাসলো। সেই দূর্বোধ্য, বিস্তর হাসি।
—“আমার একটা প্রেমিকা ছিল ক্লাস ফাইবে। ওর নাম রুবিনা ছিল। আমি সারাদিন রুবিনা, রুবিনা বলে ডাকতাম ওকে। বাবার পছন্দ ছিল না সেটা। মিডেলক্লাস ছিল যে। আমার খাবার থেকে শুরু করে কাপড়, গেমস্, টিভি চ্যালেন সব বাবার কথা মতো করতে হতো। এমনকি নিজের বন্ধু নির্বাচন করার অধিকারও আমার ছিল না। এক রওনক ছাড়া। ও বড়লোক দেখে বাবা কিছু বলতো না। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কারো সাথে মেশা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল প্রায়। বাবার মতে ওদের আচার-আচরণ ভালো না, ব্যবহার ভালো না, ওরা লোভী হয়। আমি যদি ওমন হয়ে যাই? ওই মেয়েটাও মিডেলক্লাস ছিল বিধায় বাবা ওকে কড়া ভাবে বলে দেন আমার সঙ্গে না মিশতে। রুবিনাও মেশা বন্ধ করে দেয়। ঠিক তখন থেকেই বাবার প্রতি দূরত্বটা তৈরি হয়ে ছিল আমার। নিজের জীবনের প্রতি নিজেই উদাসীন ছিলাম। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকতাম। রওনকের সাথে মেলামেশা হতো না অত।

তারপর একদিন হুট করেই আপনি চলে এলেন। আমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন। আমি অভ্যস্ত ছিলাম না এতে। তাই চুপ হয়ে আপনার কথা শুনতাম। আপনাকে হৈমন্তী বলে কেন ডাকতাম না, সেটার কারণ সত্যি বলতে আমি জানি না। তবে প্রথম থেকেই আপনার প্রতি মুগ্ধ ছিলাম আমি। হয়তো সে জন্যেই নিজস্ব একটা ডাক দিয়েছিলাম আপনাকে। আমার ব্যক্তিগত ডাক।

আমি আপনাকে হুট করেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম হৈমন্তী। অজান্তেই।”

থেমে গেল সে। হৈমন্তী অপেক্ষা করতে লাগলো তুষারের পরের কথা শোনার জন্য। কিন্তু আশানুরূপ তুষার কিছুই বললো না আর। কোমড় স্পর্শ করে গলায় মুখ গুঁজে দিলো হঠাৎ। অধর ছোঁয়ালো। নিশ্বাসের গতি বাড়ালো। অত:পর মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
—“হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী কিছু বলে না। একটু থেমে তুষার আবার ডাকে,
—“হৈমন্তীকা? আমি– আমি আপনাকে একটু গভীর ভাবে ছুঁই?”

ব্যাকুল আবেদনে সিক্ত হয়ে উঠলো হৈমন্তী। কণ্ঠস্বর কাঁপছে খুব। উত্তর কিভাবে দেবে?
উত্তর না পেয়ে তুষার তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। সরে যেতে নিলেই তাকে বাঁধা দিলো হৈমন্তী। হাত আঁকড়ে ধরল নখের ধারালো আঘাতে। তুষারের মুখে হাসি ফুটলো। হুট করে হৈমন্তীকে কোলে তুলে নিলো সে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে রুমে এগোলো।

অপেক্ষার অবসান বুঝি শেষ হলো? পূর্ণতার আবেশে আকাশ, বাতাস, বিশ্ব মুখরিত হলো স্নিগ্ধতায়।

_________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here