কাননবালা,১৩,১৪

0
364

#কাননবালা,১৩,১৪
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৩

অনিক দুই হাতে মাথা চেপে বসে আছে।নাক মুখ রাগে লাল হয়ে আছে!রোজ রোজ অফিস থেকে ফিরে বউ আর মায়ের রাগান্বিত মুখ দেখতে আর ভালো লাগে না।পুরুষ মানুষ কোন দিকে যাবে?মায়ের রাগ ভাঙালে বউ আরো রাগ করে আর বউয়ের রাগ আগে ভাঙালে মা কষ্ট পায়!
অনিক নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা করে মাকে বললো,”মা চলো খাবে।সারাদিন কিছু খাওনি।”
রুশিয়া বেগম জ্বলন্ত আগুনের মত তেতে উঠেন। সারাদিন তিনি কোমড়ের ব্যথায় বিছানা থেকে উঠতে পারেন নি।বড় ছেলের বাসায় তিনি যতদিন থাকেন ততদিন নিজেই রান্না করেন।ছেলের বউয়ের আশায় ফেলে রাখেন না।তাছাড়া ছেলেটাও মায়ের রান্না পছন্দ করে।বয়স হয়েছে মাঝে মাঝে শরীর সায় দেয় না।তার শরীর খারাপ তবুও ছেলের বউ সকালে বের হয়েছে আর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছে।
বউয়ের রাগ ছেলের উপর ঢেলে বলেন,”তুই খা। সঙ্গে তোর বউরে খাওয়া। তুই চোখের সামনে থেকে দূর হ!”

অনিক ব্যর্থ পায়ে উঠে রুমিকে গিয়ে বলে,”মা তোমাকে বলেনি তার শরীর খারাপ?আজ কি রান্নাটা তুমি করতে পারতে না?তোমার কাছে আমি বা আমার মার থেকে তোমার বন্ধু আর কাজিন মহল বেশি ইম্পর্টেন্ট?কি হত আজ তাদের সাথে আউটিংয়ে না গেলে?সারাদিন বুড়ো মানুষটা না খেয়ে আছে।এতটা দায়িত্বহীনতা কেন রুমি?”

রুমি বাইরে থেকে ফিরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেকাপ তুলছিল। অনিকের করা প্রশ্নে খুবই দায়সারা ভাবে বলে,”ফিরতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওরা আসতে দিল না।”
অনিক চিল্লিয়ে ওঠে, “তুমি কি চাও রুমি?আমার মা এখানে না থাকুক?সে অসুস্থ, পুত্রবধূ হিসেবে তোমার উচিত ছিল না তার পাশে থাকা?”
রুমি বিরক্তি স্বরে বলে,”ওহ অনিক!আমাকে শাবানা টাইপ বউ ভেবো না।আমি কারো ইচ্ছায় চলি না এটা তুমি ভালো মতনই জানো।সো এসব ফালতু কথা বন্ধ করো।”

“আমার মা অসুস্থ! এটা ফালতু কথা?”

“অফকোর্স। হাট্টা খাট্টা একটা মানুষ হুট করে এভাবে অসুস্থ কি করে হয়?যত্তসব ড্রামা!”…… বিরক্তি কন্ঠে বলে রুমি।
অনিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।তার আসলে কি বলা উচিত ভেবে পায় না!নিজেকে বড় অকর্মাণ্য মনে হয়।
অনিক ফের নিজের রাগ চেপে রুমির কাছে গিয়ে শান্ত স্বরে বলে,” রুমি আমার সাথে চলো।মাকে খেতে বলবে।আমি খাবার নিয়ে এসেছি বাহির থেকে।সে বৃদ্ধ মানুষ রুমি! তাছাড়া অভীক আর সাতদিন পরই ফিরবে তখন তো মা চলেই যাবে!এ কয়টা দিন আর ঝামেলা বাড়িয়েও না!”

রুমি আবার ত্যাড়া ভাবে বলে,”তো সে চলে যাবে দেখে তার পা ধরবো আমি।আমি রুমি কখনো কারো কাছে ছোট হইনা।তার ইচ্ছা হলে খাবে নতুবা খাবে না।”

“তুমি যাবে না?”

“না না! “….. রুমি ঘাড় বাকিয়ে বলে।

অনিকের মন চাচ্ছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে রুমিকে কিন্তু বউয়ের গায়ে হাত তোলা অনিক পছন্দ করে না। নিজের রুম থেকে বেড়িয়েই দেখে অনিক মা ব্যাগ হাতে ড্রয়িং রুমে বসে আছে।অনিককে দেখে তিনি ফ্যাকাশে হেসে বলেন,” বড়ো আমার পাশে এস বস।”
অনিক মায়ের কোল ঘেসে বসে।রুশিয়া বেগম অনিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”ভালো থাকিস বাবা।তোর ফুপুকে আসতে বলেছিলাম। সে নিচে অপেক্ষা করছে।আমি তার কাছে চলে যাচ্ছি।তাকে নিয়ে পরশু ঢাকা ফিরবো।নিজের খেয়াল রাখিস।”
অনিকের চোখে জল এসে যায়।মাকে এখন কোন ভাবেই এখানে রাখা যাবে না তা অনিক বুঝে গেছে।খাবারের প্যাকেট সেভাবেই অবহেলায় পড়ে থাকে টেবিলে, রুশিয়া বেগম না খেয়েই ছেলের বাসা থেকে চলে যান।অনিক মাকে এগিয়ে দিয়ে আর বাসায় ফিরলো না।গোটা রাতটাই রাস্তায় কাটিয়ে দিলো।আর রুমি সে দিব্যি খেয়ে দেয়ে ঘুম দিলো।স্বামী শাশুড়ীর রাগ অভিমান কোন কিছুই তাকে ছুঁতে পারলো না!

********
সেতু মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত! কোন কিছুই তার ভালো লাগে না।সারাটাদিন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে।চোখে মুখে বিষন্নতার ছোঁয়া। পরিবারের ছোট হওয়ায় সবসময়ে আদরের ভাগ তার জন্য বরাদ্দ ছিল।কোন কিছু পাওয়ার হলে জেদ করে হলেও আদায় করতো।কিন্তু আজ সেতু ব্যর্থ।জেদ করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়?যায় না তো।সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।তাজকে ভালোবেসে ফেলেছে সেতু।বড় অন্যায় করে ফেলেছে।যে মানুষটা সকাল সন্ধ্যা ওকে অবহেলা করে কি করে তাকে ভালোবাসতে পারে সেতু?ভেবে পায় না কিছুতেই! কারো অবহেলা যে এতটা কষ্টদায়ক তা সেতু জানতো না।হুট করেই নীতুর কথা মনে হয় সেতুর।আপা চিরকাল অবহেলা পেয়ে এসেছে।তারও তো ভীষণ কষ্ট হত? নীতুর কথা মনে হতেই বিছানার উপর পড়ে থাকা ফোনটা ছোঁ মেরে তুলেই কল করে বসে।

নীতুর ওয়ার্কিং আওয়ার চলছে।ভীষণ ব্যস্ত! খটখট করে কম্পিউটার কি বোর্ডে হাত চালাচ্ছে। সাদা আর গোলাপি মিশ্রণের একটা কুর্তি কৃষ্ণবর্ণ শরীরে অন্যরকম আভা ছড়াচ্ছে।গলায় দু প্যাচে স্কার্ফ জড়ানো, লম্বা চুলে বেণী আর চোখের কোণে ছড়ানো কাজলে নীতুকে আরো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। পলাশ নীতুর দিকেই তাকিয়ে ছিল।মেয়েটা দিনকে দিন তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাকে মুগ্ধ করছে।হুট করেই নীতুর ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন কলের শব্দে পলাশ দ্রুত দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।নীতু পলাশকে স্কিউজ মি বলে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে ফোন হাতে।স্ক্রীণে সেতু নামটা দেখে নীতুর কপালে ভাজ পড়ে। হ্যালো বলে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আপি বলে। নীতুর বুকের ভিতর ধ্বক করে ওঠে বোনের কান্নামিশ্রিত কন্ঠ শুনে। সেতু অনবরত কেঁদে যাচ্ছে।নীতু সময় দেয় সেতুকে কান্না থামার জন্য। পরে আদুরে স্বরে বলে ওঠে, “আমার সেতু বাবু কাঁদছে কেন?শাশুড়ী বকেছে বুঝি?”

সেতু কাঁদো স্বরে বলে,”আপি আমাকে নিয়ে যাও।আমার দমবন্ধ লাগে এই বাসায়! আমি মরে যাবো এখানে থাকলে।”
নীতু আৎকে উঠে বলে,”কিসব বলছিস?কান্না থামিয়ে বল কি হয়েছে?”

“আপি এত অবহেলা আমি নিতে পারছি না।আপি,উনি আমাকে একটুও ভালোবাসে না।একটুও না!আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।উনি অন্য কাউকে ভালোবাসে আপি!”

নীতুর মনে হচ্ছে, নীতুর বুকে পাথর চাপা পড়েছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাজ কি তবে তাকে ভুলতে পারে নি?তবে কি তাজ তাকে সত্যিই ভালোবেসেছে?এসব প্রশ্ন মাথায় আসতেই নীতু নিজেকে ধিক্কার দেয়।তাজ এখন তার জন্য বোনের হাসবেন্ড ছাড়া আর কিছু নয়।হ্যা সে নিজেও তাজকে ভুলতে পারেনি। তাই বলে কি স্বাভাবিক ভাবে লাইফ লিড করছে না।তাজের উপর মুহুর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।প্রথমে তাকে এখন আবার সেতুকে কষ্ট দিচ্ছে। কি চায় মানুষটা?
নিজেকে সামলে নীতু পাল্টা প্রশ্ন করে,”ভালোবাসিস? ”

সেতুর ফোনের ওপাশে মাথা দুলিয়ে হ্যা বলে। নীতু হেসে ফেলে।অথচ নীতুর চোখের কোণে জল!
পরক্ষণেই সেতুকে বলে,” সেতু, তাজবীদ একজন ভিন্ন মানুষ আর তুইও।দুটো ভিন্ন স্বত্তা বিয়ের মাধ্যমে এক হয়েছিস।তার মানে এই নয় যে তুই তাজবীদকে জয় করেছিস বা সে তোকে।সময় দে সেতু।যেকোন সম্পর্ক সুন্দর করতে সময় দিতে হয়!যেহুতো তাজবীদ কনফেস করেছে সে কাউকে ভালোবাসতো।তবে তাকে ফিরে আসতে সময় দে।আর তোকে বুঝতে, জানতেও তো সময় প্রয়োজন।তাইনা?ভেঙে পড়িস না।তাজবীদ তোকে আজ ভালোবাসে না কিন্তু ঠিক একসময় বাসবে।””মানুষ অতীত আঁকড়ে ধরে বাঁচে না।মানুষ বসবাস করে বর্তমানে! “”পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে কোন লাভ নেই বরং ফেস কর।আর সারাক্ষণ বিয়ে, ভালোবাসা এসব নিয়ে না ভেবে নিজের জন্য ভাব।তাতে তুইও ঠিক থাকবি আর তাজবীদও নিজেকে সামলে উঠবে পুরানো আঘাত থেকে।পড়াশুনাটা শুরু কর।ঢাকায় ভর্তি হ।তারা যদি বাধা দেয় আমিই পড়ার টাকা দিবো চিন্তা করিস না।মনে রাখবি, কখনো নিজের সাথে কম্প্রোমাইজ করবি না!”……….নীতু একবারো মুখে তাজ নামটি উচ্চারণ করলো না।

সেতু বিড়বিড় করে বলে,”আই লাভ ইউ আপি।তুমি এত ভালো কেন?আমি তোমার কথা মেনে চলবো।দেখি কি হয়।”

“গুড গার্ল।…..বলে নীতু কল কেঁটে দেয়।নীতু ফোন রেখে চোখের কোণে জমা জলটুকু আঙুল দিয়ে মুছে নেয়। ঠোঁট প্রসারিত করে হাসির রেখা টানে।বড় করে শ্বাস ছেড়ে নিজের নির্ধারিত আসনে বসে।পলাশ নীতুর দিকে তাকিয় বলে,” এনিথিং রং মিস নীতু? ”

” নাথিং।”….নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলে নীতু।

*************
তাজ অফিস থেকে ফিরে দেখে সেতু ফ্রেশ মুডে মোবাইলে গেমস খেলছে।তাজ খানিকটা অবাক হয়।এতদিন বাসায় ফিরে সেতুকে সবসময় গম্ভীর মুখেই দেখেছে।তাজের অবাক লাগলেও প্রশ্ন করে কৌতুহল মিটালো না।তাজ ফ্রেশ হয়ে আসতেই সেতু বলে ওঠে, “আমি পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করতে চাইছে।আপনার আপত্তি আছে? ”

তাজ কপাল কুঁচকে বলে, “আমার আপত্তি থাকবে কেন?”

“পরিক্ষাটা কম্পিলিট করতে খুলনায় যাবো পরিক্ষার সময়।তারপর এখানে ভর্তি হব।আসার সময় তো বই নিয়ে আসে নি।আমার কিছু বই কেনা লাগবে।আমি টাকা দিলে আপনি কি আমাকে বই কিনে দিতে পারবেন?”

তাজ সেতুর কথায় বিস্মিত হলো।তাজের অবাক চাহনি দেখে সেতু বলে,”যেহুতো আমাকে আপনি বউ বলে স্বীকারই করছেন না তাই আপনার খরচ দিতে হবে না।”

তাজ ব্যঙ্গ করে বলে,”তো কে দিবে?”

“নীতু আপি দিবে।সে আমাকে বলেছে আমার পড়াশোনার খরচ তার।”

নীতুর নামটা শুনতেই তাজের চোখে কাঁপন দেখা দেয়।বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়।বিস্মিত কন্ঠে বলে,”নীতু?”

“হ্যা আপি তো ঢাকায় থাকে।এখানে জব করে না।তাই কোন সমস্যা হবে না।”

“কোথায় থাকে তোমার বোন?”……. সাবধানী স্বরে বলে তাজ।তাজের ভয় হচ্ছে বুকের ভিতরে উথাল ঝড়ের ধ্বনি সেতু টের না পেয়ে যায়।

” মিরপুরে।”…..মোবাইলে গেমস খেলতে খেলতে বলে সেতু।
তাজ চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলে।নীতুকে একপলক দেখার আশায় শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উত্তেজনা দেখা দেয়!

***************
দিন কয়েকপর,
অভীক মাত্রই জার্মান থেকে ফিরেছে।এতবড় জার্নিতে ক্লান্ত শরীর। বাসায় ফিরেই ফুপিকে কাঁদতে দেখে কলিজা ধ্বক করে ওঠে। ফুপু সহসা কাঁদেন না।তিনি নিঃসন্তান মানুষ।স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ দিয়ে সারাদিন তালিম দাওয়াত করে বেড়ান।খুলনার তিনতলা বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে তার চলে যায়।শত বিপদেও অভীক ফুপিকে শান্ত থাকতে দেখেছে।সেই মানুষটা আজ কাঁদছে।অভীককে দেখেই ফুপি বলে ওঠেন,”অভীক তোর মা বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে।কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে।তাকে নিয়ে পাশের ফ্লাটের মেয়ে দুটো হসপিটালে গেছে বাবা।”

অভীকের মনে হলো একমুহূর্তের জন্য তার নিঃশ্বাস আটকে গেছে।মাকে ভীষণ ভালোবাসে অভীক।অভীক হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
এতবড় জার্নির ক্লান্তি মুছে গিয়ে সেখানে মায়ের জন্য একরাশ উৎকন্ঠা দেখা দেয় অভীকের মনে।অভীক চলে যেতেই ফুপি অযু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন প্রিয় ভাবির মঙ্গল কামনায়।

***——
মেডিনোভা হসপিটালের করিডোরে অভীক বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কাঁচের অপর পাশের দৃশ্যের দিকে।অভীক যেন চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে।যেই মেয়েটা মায়ের বেডের পাশে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে সেই মেয়েটা অভীকের চেনা।এই পরিচিত মুখটা দেখে অভীক যেন এক মুহুর্তের জন্য শ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে।
অভীকের মন মস্তিষ্ক উভয়ই মুহূর্তের জন্য চলে যায় তিন বছর পূর্বের ফ্লাশব্যাকে।একটা ছোট খাটো রুম….বিদ্যুৎ ছিল না সেদিন।চার্জারের মৃদু আলো ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে।চারপাশে ভ্যাপসা গরম…সেই তপ্ত সন্ধ্যায় মৃদু আলোতে অভীকে দেখলো জরিটরি মিশ্রিত রঙ বেরঙের একটা শাড়ি পড়া মেয়ে জড়োসড়ো হয় বসে আছে।যার চোখের দৃষ্টি নিমজ্জিত! ঠোঁটের কোণে একরাশ লজ্জা!

সেদিনের সেই এক পলকের একমুহূর্তের দেখা মুখটি কি করে এখনো মনে গেথেঁ আছে অভীক ভেবে পেলো না!

সেদিনের সেই জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা মেয়েটির সাথে আজকের দেখা মেয়েটির মধ্যে অনেক তফাৎ থাকলেও অভীক ঠিকই চিনে ফেললো।কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটিকে দেখে মুহূর্তেই অভীক ভুলে গেলো এখানে কেন সে এসেছে? কোথা থেকে একরাশ সংকোচ, লজ্জা, দ্বিধাবোধ এসে অভীককে আঁকড়ে ধরলো।ঠিক সেদিনের সেই জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা রমণীটির মত!

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ ১৪

অভীকের ওষ্ঠদ্বয় অতি আশ্চর্যে এখনো আলাদা হয়ে আছে।না চাইতেও অভীক নিজের বিস্ময় লুকাতে পারছে না।
অনেকক্ষণ পর অভীক নিজেকে সামলে কেবিনে প্রবেশ করে।নিজের ভিতরের অস্থিরতা কিছুতেই অভীক লুকাতে পারছে না।সবসময় স্ট্রেইট কথা বলা অভীক আজ বড় নার্ভাসনেসে ভুগছে।ঘামে ভিজে গেছে শার্ট! অভীককে দেখে সাথি এগিয়ে এসে বলতে শুরু করে কি করে রুশিয়া বেগমকে হসপিটালে নিয়ে আসলো।অভীক যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না।ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি আর অপরাধ বোধে ভুগছিল! নীতু খুবই স্বাভাবিক ভাবে অভীকের দিকে ফিরে তাকালো।কৃষ্ণবর্ণ মুখটিতে মৃদু হাসির রেখা টেনে বললো,”মি.অভীক আন্টি এখন ঠিক আছে। ডক্টর দেখে গেছে।মাথায় দুটো স্টিচ আর কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে।কিছুদিন রেষ্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ”
অভীক চোখের পলক ফেলে মাথা নাড়লো।মায়ের সুস্থতায় আলহামদুলিল্লাহ বললো মনে মনে। সাথি ফের বলে উঠলো,”ভাইয়া আজ যে ভয় পেয়েছিলাম।আন্টির মাথায় রক্ত দেখে তো আমিই বেহুশ হতে গিয়েও হয়নি।নীতু আপু ছিল বলে রক্ষে।সে দারোয়ানকে ডেকে গাড়ি ঠিক করেছে।তারপর দুজনে মিলে আন্টিকে চারতলা থেকে নামিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। হসপিটালিটির যেখানে যা সবকিছু আপুই করেছে। আমি কেবল বোকা বোকা চোখে সবকিছু দেখে গেছি।এতটা নার্ভাস হয়ে পরেছিলাম!”
অভীক কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে নীতুর দিকে তাকালো।নীতু কিছুই বললো না।রুশিয়া বেগমের পাশে ঠায় বসে রইলো।অভীক কেবিন থেকে বেড়িয়ে আবার ডাক্তারের সাথে কথা বললো। পুরো দু’ঘন্টা নীতু বসে রইলো, রুশিয়া বেগমের জ্ঞান ফিরার অপেক্ষায়।
অভীক পুরোটা সময়ই ভীষণ আরষ্ট হয়ে রইলো।নিজেকে কেমন খুনী দাগি আসামী মনে হতে লাগলো। রুশিয়া বেগম জ্ঞান ফিরে নীতুকে দেখে হু হু করে কেঁদে দিলো।নীতু নিজ হাতে চোখ মুছে দিল তার।অভীক এসে মায়ের পাশে বসলে তিনি ছেলেকে জরিয়ে ধরে কেঁদে দিলেন ফের।অভীক মাকে তার বুকের সাথে জরিয়ে রাখলো।সাথি খাবার কিনে আনলে নিজ হাতে নীতু খাবার খায়িয়ে ঔষধ খাওয়ালো।অভীক সবটা চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখলো।নীতুকে এত স্বাভাবিক ভাবে সবটা করতে দেখে অভীক গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।অভীক আবারো বিশ্বাস করলো, আল্লাহর সৃষ্টির সেরা রহস্যময় সৃষ্টি হলো নারী!

*********
মহিমা বেগমের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে।বুকের উপর চাপ অনুভব করছেন।বুকের কাছে আঁচল সরিয়ে অনবরত সরিষার তৈল মেজে যাচ্ছেন। একটু পর শ্বাস কষ্ট কমলেও চোখে জল এসে গেল।নীতু… আমার নীতু বলে কেঁদে উঠলেন।নীতু কখনোই মহিমা বেগমকে বেশি কাজ করতে দিত না।সব কাপড় চোপড়, থালা বাসন নিজে ধুয়ে দিতো।পাছে মায়ের ঠান্ডা না লাগে।বাসার সব কাজ ধরতে গেলে এখন মহিমা বেগমই করেন।সুরভি আগের মতই ছাড়া হাত পা নিয়ে কাজ করে। নিখিল অফিস থেকে ফিরেই দেখে মা বিছানায় বসে কাঁদছে। নিখিলকে দেখে মহিমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।এই সেই ছেলে যার জন্য নিজে কত কষ্টই না করেছেন।ছেলেটা হওয়ার সময় কিছুই খেতে পারতেন না তিনি।খুবই রুগ্ন ছিলেন।এরপর তো একটু বড় হওয়ার পর সেরা জামাটা ছেলেকে পড়িয়েছেন।ভালো স্কুল, কলেজ ছেলের জন্য। মেয়েদের ভাগের আদরটুকুও ছেলের জন্য বরাদ্দ ছিল।নীতু কোলের মাছ পছন্দ করতো আর নিখিলও।তিনি নিখিলকেই সবসময় বেশিই দিতেন।মেয়েরা অভিযোগ করলে মহিমা বেগম বুক ফুলিয়ে বলতেন,”শেষ বয়সে দেখলে আমার ছেলেই দেখবো তোরা তো সব পরের ঘর করবি।আমার আব্বার সাথে তোদের তুলনা করিস না!”
আজ মনে হলো তিনি ভুল ছিলেন।মেয়েরা তার যতটা খোঁজ নেন ছেলে তার এক আনাও নেন না।
নিখিল মাকে শান্ত কন্ঠে বলে,”মা ঔষধটা তো নিয়মিত খেতে পারো।তাহলে আর শরীর খারাপ হয় না।কতগুলো টাকার ঔষধ অথচ তুমি নষ্ট করো।!”
ছেলের চোখে বিরক্তি দেখে মহিমা বেগমের বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে। অনেক সময়ই মনে থাকে না ঔষধ খাওয়ার কথা।অসুস্থ স্বামী আর সংসার সামলে নিজের কথা ভুলে যান তিনি। পাশে বসে কেউ মনে করিয়ে দেয় না। নীতু থাকলে ঠিকই হাতে ধরিয়ে দিত। নিখিল কথা বলে চলে গেলো।মহিমা বেগম ফের কাঁদতে শুরু করলেন।ছেলেকে কি করে বুঝাবেন?বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার ঔষধের থেকেও সন্তানের সঙ্গের বেশি প্রয়োজন হয়!

**********–
ইতুর সকাল থেকেই মেজাজ গরম।আজো তার শাশুড়ী উল্টা পাল্টা কথা বলেছে তার নামে পাশের ফ্লাটের আন্টির সাথে। ইতু মাথা গরম নিয়েই সন্ধ্যার পর থেকে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটা কাজ করছে শব্দ করে।মিলন চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ইতু যতই বদমেজাজী হোক কখনো মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনা এটা মিলনের ভালো লাগে।অবশ্য তার ঝাল ঠিকই মিলন ভোগ করে।মিলন তাতে অসন্তোষ হয় না।ইতু কাপড় ভাজ করছিল।মিলন পাশে বসে নিজেও কাপড় ভাজ করতে শুরু করে।ইতু বিরক্ত চোখে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তুতুন মেঝেতে বসে খেলছে আর বারবার মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকাচ্ছে।তুতুনও মায়ের মেজাজের আঁচ বুঝে গেছে। মিলন ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে,”ইতু এরকম আচরণ কেন করছো?তুতুন ভয় পাচ্ছে তো।”
ইতু চোখ রাঙিয়ে মিলনের দিকে তাকায়। মিলন চুপিসারে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
তুতুনকে ঘুম পাড়িয়ে ইতু ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে দেখে বিছানার এক কোণে একটা প্যাকেট রাখা।সাথে ছোট্ট চিরকুট। “আমি তোমাকে ভালোবাসি ইতু।কে কি বললো তাতে কিছু যায় আসে না আমার।আমার বদমেজাজী ইতুকেই আমি প্রচন্ড ভালোবাসি!ম্যাডামের রাগ কমানোর ঘুষ হিসেবে এই অধম চটপটি নিয়ে এসেছে।রাগ কমিয়ে এবার আমায় উদ্ধার করুন।”

ইতুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।চটপটি দুটো বাটিতে ঢেলে বারান্দায় বসা মিলনের কাছে নিয়ে যায়।মিলন ইতুকে দেখে একগাল হেসে দেয়। ইতু কপট রাগ নিয়ে বলে,”আমি বদমেজাজী? ”
মিলন একচামচ চটপটি মুখে পুরেই বলে,”একটু! ”

*************–
রুশিয়া বেগমকে একদিন হসপিটালে রাখার নির্দেশ দিয়েছে ডাক্তার। সাথির খারাপ লাগছিল বলে নীতু তাকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে।রাত বাজে নটা।সারাদিন হসপিটালে থাকার কারণে নীতুর চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।চোখের কাজল লেপ্টে রয়েছে।আজ সকালে নীতু মায়ের দেয়া একটা সুতি শাড়ি পড়েছিল।এত দৌড় ঝাপের কারণে পরনের পোশাক কুঁচকে এলোমেলো হয়ে আছে।চুলের খোপাটাও এলিয়ে পড়েছে!তারপরও নীতুর মধ্যে কোন আরষ্টতা দেখা গেলো না। সবটাই অভীক পর্যবেক্ষণ করে! নীতুর এরকম ব্যক্তিত্বে অভীক অনেকটাই অবাক হয়েছে। রুশিয়া বেগম ঘুমিয়ে পরতেই নীতু অভীককে বললো,”মি.অভীক আমি এখন আসি।”
অভীক খেয়াল করলো এই সামন্য বাক্যটা বলার সময়ও নীতুর ঠোঁটে মৃদু হাসি ছিল। অভীক ঠিক সেই সময় আরো একটি বিষয় অনুধাবন করলো। প্রথম থেকেই নীতু তাকে নাম ধরে ডাকছে।তারমানে নীতুর মনে আছে ওই বিদঘুটে সময়টা। অভীকের আবার হাসফাস লাগে! অভীক কখনোই কারো সামনে এতটা উইক ফিল করে নি।তবে আজ কেন?
অভীক নীতুকে এগিয়ে দিতে কেবিন থেকে বের হয় একসাথেই। করিডোর প্যাসেজে দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে।পকেটে হাত ঢুকিয়ে অভীক হাঁটছে।চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ পাশে হাঁটতে থাকা কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির দিকে।কৃষ্ণবর্ণ মুখটিতে ফুটে উঠেছে অন্যরকম এক আত্মবিশ্বাস! নিরবতা ভেঙে অভীক বললো,”মিস নাকি মিসেস বলবো?”
নীতু কপালে ছড়িয়ে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে বলে,”মিস..!”
অভীক এবার দাঁড়িয়ে পড়ে নীতুর দিকে ফিরে।নীতুও থেমে যায় মুখোমুখি হয়ে।অভীক পুরুষালী গমগম স্বরে বলে,”মিস নীতু আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আজ যদি আপনি সময়মত মাকে নিয়ে হসপিটালে না আসতেন তবে সত্যিই অনেকবড় ক্ষতি হয়ে যেতো আমার।”

নীতু সরাসরি অভীকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,” মি.অভীক, কারো জন্যই কোন কিছু আটকে বা থমকে থাকে না।।সৃষ্টিকর্তা কারো না কারোর মাধ্যমে শূন্যস্থান পূরণ করে দেন। তাই এসব ফর্মালিটির কোনই প্রয়োজন আমি দেখছি না।
অভীক নীতুর বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হলো।চোখে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বললো,”ধন্যবাদ না নিলেও সরি টুকু গ্রহণ করলে আমি কৃতজ্ঞ হবো।”

নীতু বুঝতে পারলো কেন অভীক তাকে সরি বলতে চাইছে।কেননা অভীকের চোখে মুখে অনুতপ্ততার রেশ!তাই চোখে মুখে ধারালো অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বললো,”মি.অভীক আমরা বড় স্বার্থপর গোছের মানুষ। আমরা যতটা সহজে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি ততটা সহজে অনুতপ্ত হই না।অনুতপ্ত আমরা তখনই হই যখন কৃতজ্ঞতার ভার অধিক হয়ে যায়! আসি ভালো থাকবেন।”

নীতু ব্যস্ত পায়ে হাঁটা শুরু করলো।অভীক ব্যথিত, বিহ্বল ও নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো নীতুর চলে যাওয়ার দিকে।কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির চলার মাঝেও কেমন রুক্ষতা! অভীক আবার অপরাধবোধে বিদ্ধ হলো।হ্যা আজকে নীতুকে দেখার পর থেকে অভীক নিজ কাজে অনুতপ্ত। আজকের আগ পর্যন্ত না নীতুকে মনে ছিল তার, না ছিল কোন অনুতপ্ততা!কৃতজ্ঞতাই যেন অভীককে অনুতপ্ত হতে বাধ্য করলো!অভীকের মনে হলো নীতুর সাথে তার দেখা না হওয়াই ভালো ছিল।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here