রঙিন_দূত – ১২,১৩,১৪

0
437

#রঙিন_দূত – ১২,১৩,১৪
লাবিবা ওয়াহিদ
১২
————————
মাগরিবের আযান দিচ্ছে। ওভার শেষ। এবার ব্যাটিং এ নামবে মাহিনের বিপক্ষ দল। আপাতত ব্রেক চলছে। হৃধি তার বাবার দেয়া কাপে চায়ের চুমুক বসাচ্ছে। এক ঘন্টা পূর্বে কফি খেয়ে এখন এবার চা নিচ্ছে, বিষয়টা অদ্ভুত লাগলেও বাবার জন্যে সবটা হজম করে নিচ্ছে হৃধি। করিম উল্লাহ কোনো টঙ থেকে চা না নিয়ে ডিরেক্ট বাসায় গেছিলো চা নিতে। যাওয়ার পথেই স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে বলেছিলো যেন চা বানিয়ে চায়ের ফ্লাক্সে ভরে রাখে। তাইতো বাসায় পৌঁছে খুব একটা সময় লাগায়নি করিম উল্লাহ। হাতে ফ্লাক্সটা নিয়ে সোফায় বসে হাঁপানি দূর করে। অতঃপর পুণরায় চলে যায়। মেয়েকে একা ফেলে এসেছেন, কম চিন্তা হচ্ছে না তার।
চা খাওয়ার সময়ই তাঁরা আপুকে দেখতে পায় হৃধি। তাঁরা তো হৃধিকে দেখে চমৎকার হাসি দেয়।
–“আরে হৃধি যে!”
–“হ্যাঁ, বাবার সাথে আসলাম!”
–“বেশ করেছো। আমার তো বেশ মন খারাপ হচ্ছিলো তোমার জন্যে।”

হৃধি তার পাশের সিটে বসা মেয়েটিকে অনুরোধ করলো উঠে যেতে। যেহেতু করিম উল্লাহ তাকে বসিয়েছে তাও ক্ষণিকের জন্যে তাই মেয়েটা উঠে যায়। তাঁরা আপুও সেখানে গিয়ে বসে। তাদের গল্প করার মাঝে হৃধির কফি খাওয়াও শেষ হয়ে যায় এবং ওয়ানটাইমটা ফেলে দেয়। ঠিক তখনই করিম উল্লাহ ভীড় ঠেলে হাজির হয়। হৃধি তো তৎক্ষনাৎ আল্লাহ’র দরবারে শুকুরিয়া আদায় করলো। যদি করিম উল্লাহ কিছুটা চলে আসতেন, তখন হৃধির হাতের কাপটা নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতেন? তখন? একটুর জন্যে ধরা খায়নি ভেবেই হাফ ছাড়লো। করিম উল্লাহ মেয়ের পাশে তাঁরাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক, মেয়েটা একা ছিলো না। তাঁরা হাসিখুশি ভাবেই কুশল বিনিময় করলো করিম উল্লাহ’র সঙ্গে।
কিছু মিনিটের ব্যবধানে হৃধির পাশের চেয়ারটা থেকে একজন উঠে যায়। করিম উল্লাহ সেখানেই বসে পরে।

হৃধি বেশ খেয়াল করছে তার থেকে দূরত্বে থাকা মাহিনকে। মাহিন ঠান্ডা পানির বোতলে চুমুক দিচ্ছে আর শাফীনের থেকে টান মেরে তোয়ালটা নিয়ে নিজের ঘর্মাক্ত কপাল মুছতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখে হৃধি আপনমনেই হেসে দিলো। শাফীন কী যেন বলছে মাহিনকে, মাহিন কোনো জবাবই দেয়নি। ফিল্ডিং এ সময় মাহিন পুরোটা সময় হৃধিদের আশেপাশেই দাঁড়িয়েছে। দৌড়াতে গিয়ে অবশ্য সকলের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে চোখ টিপও মেরেছে। হৃধিও যেন চোখ রাঙাতে ভুলেনি। কী অসভ্য এই ছেলে, এতো মানুষের ভীড়েও এর অসভ্যতামি কমে না!
খেলা শেষ হয় এশারের পরপর। মাহিনের টিম জিতে যায়। তারা প্রত্যেকেই নগদ বিশ হাজার টাকা পুরস্কার হিসেবে পায়। তাঁরা খুশিতে হৃধির এক হাত চেপে উঠে দাঁড়ায়। হৃধিও সমান তালে খুশি। কেন খুশি হচ্ছে জানে না। তবে খেলা দেখার মুহূর্তে সে মাহিনদেরই অভ্যন্তরে সাপোর্ট করেছে। মাহিন জিতে শাফীনের কাধে হাত দিয়ে একপাশে চলে গেলো এবং এক মধ্যবয়সী লোককে জড়িয়ে ধরে। তাকে দেখেই হৃধির আনন্দ নিমিষেই হারিয়ে যায়। উনি নিশ্চয়ই মাহিনের বাবা। তার চাল-চলন এবং পোশাকে বেশ বড়লোকী ভাব আছে। দেখে যে কেউ বুঝে যাবে তিনি আভিজাত্যপূর্ণ! হৃধি নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়। এর মাঝেই তাঁরা মাহিনের বাবার দিকে ইশারা করে বলে,
–“ওটা শাফীনের বাবা, মাহমুদ আঙ্কেল!”
—–
কিছুক্ষণ বাদেই করিম উল্লাহ মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। সাথে অবশ্য তাঁরাও এসেছে। করিম উল্লাহ ওদের বাড়ির গেট পর্যন্ত দিয়ে নিজে মসজিদে চলে গেলেন। হৃধি হাতে ফ্ল্যাক্স নিয়ে তাঁরার সাথে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। তাঁরার মুখ যেন থামার নয়, সে নানান কথা বলেই চলেছে। এদিকে হৃধি আনমনা, তাঁরার কোনো কথা তার কান অবধি পৌঁছেছে কিনা, তাঁরার জানা নেই। দো’তলায় হৃধির ফ্ল্যাট হওয়ায় তাঁরা তাকে বিদায় জানিয়ে উপরে চলে গেলো।

রাতে হৃধি ফোন নিয়ে বসে। অদ্ভুত সব চিন্তা ভর করেছে তার মস্তিষ্কে। সম্পূর্ণ ভাবনা মাহিনকে কেন্দ্র করেই। তার মন ক্ষণিকের জন্যেও মাহিনকে চাইলে মস্তিষ্ক তাকে ভালোভাবে নাড়া দিয়ে দেয়। বারংবার তার মাথায় ঘুরপাক খায় আর বাবা এবং মাহিনের পরিবারের কথা। পরিবারের বড় ছেলে মাহিন, নিশ্চয়ই অনেক স্বপ্ন রয়েছে তার বাবা-মায়ের। সেখানে হৃধির মতো সাধারণ মেয়েকে তো কখনোই মেনে নিবে না। আর করিম উল্লাহ’র কথা তো বাদ না দিলেই নয়। মাহিনকে নিয়ে তার মন ভাবতে চাইলে বারংবার বাবা নামক মানুষটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যথেষ্ট ভরসা করেন করিম উল্লাহ হৃধিকে। হৃধি অবাধ্য হলে না জানি তার বাবার কী হাল হবে, কতোটা ভাঙ্গবে তার তিলতিল করে গড়ে তোলা বিশ্বাস!
এসব নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে একসময় হৃধির মাথা ধরে গেলো, প্রচুর যন্ত্রণা করছে এই মাথা। হৃধি আর ভাবতে পারছে না। কিন্তু দুই নৌকার মাঝে যেহেতু পা দিয়েই ফেলেছে তখন তাকে ভাবতে হবে, হবেই!
ফোনের টোন শ্রবণ হয় হৃধির। বদ্ধ আঁখিপল্লব মেলে তাকালো হৃধি। ফোন চেক করতেই বুঝলো মেসেজটি মাহিনের।
–“ঘুমিয়ে পরুন হৃধি! মাঠে খেলে আজ আমি ভিষণ ক্লান্ত। শুভ রাত্রি। আর হ্যাঁ, আগামীকাল ভার্সিটিতে আমায় পাবেন না!”

———————
–“মেয়েরা পুরুষের ব্যক্তিত্ব এবং তার কথা বলার সৌন্দর্যে প্রেমে পড়ে,” উক্তিটি মানেন তো হৃধি?”

অদ্ভুত নয়নে তাকিয়ে কথাটা বললো মাহিন। মাহিনের এই চাহনি বড্ড অস্বস্তিকর হৃধির নিকট। হৃধি কই ভেবেছিলো মাহিনকে আজ আর কোথাও দেখা যাবে না। গতকাল যা দৌড়ঝাপ করেছে, হয়তো বিছানাতেই পরে পরে ঘুমাচ্ছে। তাই হৃধি বেশ শান্তিতেই নিজেদের এলাকার গলিতে ঢুকেছে। কিছু দূর আসার পর হৃধির চিল করা নিমিষেই ফুঁস হয়ে গেলো। মাহিন, সাব্বির, রাফিদ এবং সিফাত দাঁড়িয়ে। মাহিনের কৃষ্ণকালো চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। চোখগুলোও কেমন লাল। ঘুম না হওয়ার কারণে হয়তো। কিন্তু সে এখানে দাঁড়িয়েছে কেন? হৃধি দ্রুত নিজের মুখ ঢাকলো। অতঃপর এদিক ওদিক তাকিয়ে খুব সাবধানতার সাথে মাহিনকে অতিক্রম করতে চাইলেই মাহিন ওরকম এক প্রশ্ন করে বসেছে। যার ফলে হৃধি না চাইতেও তার পা জোড়া থমকে যায়।

হৃধি এলোমেলো কেশে বারংবার ঘোমটা টানছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কোনো পরিচিত মুখ তাকে এই মাহিনের সাথে দেখে ফেললে সর্বনাশ! অ’ স’ ভ্য ছেলের কান্ড দেখো! পথ থেকে সরছেই না! হৃধি জড়তার সঙ্গে বললো,
–“পথ আটকে দাঁড়ানোটা কিন্তু অসভ্যতামি হয়ে যাচ্ছে মাহিন!”
–“আপনার জন্যে আমি সহস্রবার অসভ্য হতে রাজি। হবেন কী মিসেস অসভ্য?”

হৃধি চরম লেভেলের বিষম খেলো। মাহিনের বন্ধুরা তখন হেসে কুটিকুটি। হৃধি গাল জোড়া লাল করে বলে,
–“লজ্জা-শরম নেই আপনার?”
–“আপনার থাকলেই চলবে, আমার এসবের প্রয়োজন নেই।”
–“আসলেই নির্লজ্জ আপনি!”
–“আপনার জন্যেই তো!”
–“ঘুম নেই?”
–“আপনাকে দেখার জন্যে হৃদয়টা ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আপনাকে দেখা শেষ, এখন বাসায় গিয়ে শান্তিতে ঘুমাবো!”

হৃধি মাহিনকে ক্রস করে যেতে চাইলেই মাহিন আবারও পথ আটকায়!
–“জরুরি কথা বলতে তো ভুলেই গেলাম!”
–“কী?”
–“আপনাদের পাশের ফ্ল্যাট নাকি খালি হয়েছে?”
–“তা জেনে আপনি কী করবেন?”
–“অনেক কিছু, সেটা বলবার সময় নেই! দেখানোর সময় আছে!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

#রঙিন_দূত – ১৩
লাবিবা ওয়াহিদ

———————————
অগ্রহায়ণের শেষ ভাগ। ইংরেজী ক্যালেন্ডারে ডিসেম্বরের ছয় তারিখ। শীত কিছুটা অনুভূত হয়। দু’দিন ধরে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। হিম বাতাসে নিমজ্জিত পরিবেশ। আজ বৃষ্টির দেখা না মিললেও মেঘে আবৃত সমস্ত আসমান। এই বাদলা দিনে সূর্যের দেখা পাওয়া মুশকিল। হৃধি গলিতে হেঁটে চলেছে সম্পূর্ণ আনমনা হয়ে। হাঁটতে হাঁটতে হৃধি মাহিনদের এপার্টমেন্টের সামনে আসলো। একপলক চোখ বুলিয়ে নেয় আপাদমস্তক এপার্টমেন্টে। বড় নেম প্লেটে বাড়ির হোল্ডিং নম্বর দেয়া। বাড়ির হোল্ডিং নম্বর “১৮”। হৃধিরা যে বাড়িতে থাকে সেটার হোল্ডিং নম্বর “২৬”। অর্থাৎ বেশি দূরে নয় হৃধিদের এপার্টমেন্ট। তাঁরা আপুক একদিন দেখিয়েছিলো এই বাড়িটা। তার আবার শাফীনকে নিয়ে বেশ গর্ব। বড় ঘরের ছেলেকে পড়িয়েছে, কম কথা নাকি? তাই বলা চলে একপ্রকার শো অফই করে। হৃধির দৃষ্টিতে লোক দেখানো লাগলেও তাঁরাকে সে বিষয়ে কখনোই বুঝতে দেয়নি। করুক না শো অফ, তাতে হৃধির কী?

সাত তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংটি। মাহিন’রা কতো তলায় থাকে সে বিষয়ে হৃধির ধারণা শূন্যের কোঠায়। এছাড়াও বাড়িটার নকশা, ডেকোরেশন কিছুটা হাই লেভেলের। দু কোণার দু’পাশে দু’টো সিসি ক্যামেরাও দৃশ্যমান। হৃধির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। হৃধি বাড়ির সামনে না দাঁড়িয়ে চলে গেলো নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। অপার্টমেন্টের সামনে আসতেই কিছুটা চমকে গেলো। গেটের সামনে মালপত্রের ট্রাক দেখা যাচ্ছে। কিছু লোক সেটা থেকে ফার্ণিচার বের করে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। হৃধি মনে মনে নিশ্চিত হলো, নতুন কোনো ভাড়াটিয়া নিশ্চয়ই এসেছে। হৃধি মাথার ঘোমটাটা টেনে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। দো’তলায় আসতেই সে আরও অবাক হলো। তাদের পাশের ফ্ল্যাটেই নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে। হৃধি কিছুটা অবাক হলেও পরমুহূর্তে পাত্তা দিলো না। দ্রুত নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল চেপে দিলো। হৃধির খেয়ালও নেই, মাহিন সেদিন তাকে কী জিজ্ঞেস করেছিলো। মোটকথা, মাহিনের বলা সেসব কথাগুলোর এক বিন্দুও সে বুঝতে পারেনি৷ তাই হৃধি সেদিন মাহিনকে না ঘেটে চলে এসেছিলো। এর মাঝে মাহিন চার দিন মিসিং ছিলো। না কোথাও দেখেছে আর না মাহিন তাকে মেসেজ করেছে। সে কী অবস্থা হৃধির। সে কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে যায় মাহিনের জন্যে। হঠাৎ করে কই উধাও হয়ে যায় ছেলেটা? অবশ্য আজও নিখোঁজ! কে জানে, কোথায় হারিয়ে গেলো!

ভার্সিটি থেকে ফিরেই হৃধি ঘুমের দেশে পারি দিলো। আজ যেহেতু কোচিং নেই সেহেতু সেই চিন্তা নেই। হৃধির ঘুম ভাঙ্গে বিকালে। পিটপিট করে চোখ মেলতেই দেখলো রিনা তার দিক্র ঝুঁকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। হৃধি অপ্রস্তুত হলো। বেসামাল ভঙ্গিতে হৃধি উঠে বসে। রিনা প্রতিবারের মতোই তার জাতীয় ভেঁটকি দিলো। হৃধি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–“পাগল হয়ে গেছো? এভাবে ঝুকেছিলে কেন?”
–“মাছি দৌড়াইতে আপা!”

বলেই হাতের ঝাড়ুটা ঘুরাতে ঘুরাতে ফ্যানের সুইচ বন্ধ করে দিলো রিনা। হৃধি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা ধরে। হৃধি ওয়াশরুমে ঢুকতেই রিনা খিলখিলিয়ে হেসে মিনমিন করে বলে,
–“আপনারে ভয় দেখানের লেইগা আপা! আপনে তো সবকিছুকে অল্পতেই ভয় পান আর লাফান! আপনের এই লাফাইন্না দেখতেই ভাল্লাগে!”

গায়ে ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে আসতেই নতুন মুখ আবিষ্কার করে হৃধি। রাবেয়া খাতুনের বিপরীতেই সেই নতুন মুখ। মধ্যবয়সী মহিলা। রূপ আছে মহিলার, মুখশ্রীতেও এক আলাদা মায়ায় আবৃত। মহিলার অধরে যেন হাসি লেগেই আছে। কথাও বেশ নম্র স্বরে বলছে। কথা বলতে বলতে মহিলার চোখ যায় হৃধির দিকে। হৃধি দ্রুত মাথায় ওড়না জড়িয়ে নিলো। এতে যেন মহিলা চমৎকার হাসি দেয়। হৃধির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“আপনার মেয়ে নাকি ভাবী?”

রাবেয়া খাতুন পিছে ফিরে। মেয়েকে কাছে আসতে ইশারা করে বলে,
–“হ্যাঁ, ভাবী।”

হৃধি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সালাম দেয়। মহিলাও বেশ বিনয়ী স্বরে সালামের উত্তর নিলো।
–“নাম কী তোমার মা?”
–“হৃধি, হৃধি ফারজিয়া!”
–“মাহশাল্লাহ। এসো, পাশে এসে বসো তো!”

হৃধি বিনয়ী হেসে মহিলার পাশে গিয়ে বসলো। মহিলা বেশ ধৈর্যের সাথে হৃধিকে তার পুরো পরিচয় দিলো। মহিলার নাম ফাতিমা বেগম। আজই তাদের পাশের ফ্ল্যাটে উঠেছেন। ফাতিমা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছে। হৃধি এটা শুনেই বুঝে যায় মহিলার ভদ্রতার আসল কারণ। হৃধির বেশ ভালোই লেগেছে ফাতিমা বেগমকে। বেশ প্রাণোচ্ছল মানুষটি। হৃধি ফাতিমার থেকে অনুমতি নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়! হৃধি চলে যেতেই রাবেয়া খাতুন বলে,
–“তা ভাবী, আপনাদের তো আরও ফ্ল্যাট ছিলো। তাহলে হঠাৎ ভাড়া বাড়িতে উঠলেন যে?”
–“আর বলবেন না ভাবী, বড় ছেলে সব খালি ফ্ল্যাটেই রঙ মিস্ত্রীদের লাগিয়েছে। প্রশ্ন করলে বলে নতুন পরিবেশের স্বাধ নেয়া ভালো। তাইতো বাধ্য হয়েই আসলাম। তবে এখানটাও খারাপ লাগেনি। আশা করছি কয়েকটা মাস ভালোভাবেই কাটিয়ে দিতে পারবো। তাহলে আজ উঠি? অনেক কাজ বাকি আছে!”
–“ঠিক আছে ভাবী। আবার আসবেন!”

বিনয়ী হেসে ফাতিমা বেগম চলে গেলেন নিজেদের বাসায়। হৃধি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মাহিনের কথাই ভাবছে। এপার্টমেন্টের অপরপাশে দেয়ালে আবৃত। দেয়ালের পাশে এক কারেন্টের খাম্বা। সেখানে দাঁড়িয়েই মাহিন তাকে দেখতো। ডানপাশে কয়েক হাত পরেই আরেকটা গলি বেরিয়েছে। সেখানে সকাল বা বিকালে একটা ভ্যান দাঁড় করানো থাকবেই। হঠাৎ রাবেয়া খাতুনের হাঁক শ্রবণ হলো। হৃধি হাতদুটো টানটান করে ভেতরে চলে গেলো। লাঞ্চ না করেই হৃধি ঘুমিয়ে গেছিলো। তাই মূলত খাবার খেতেই রাবেয়া খাতুন ডাকছেন।

খাওয়ার সময় রিনা তাকে অসম্ভব আশ্চর্য এক খবর শোনালো। তাদের পাশের ফ্ল্যাটেই নাকি আলী কমপ্লেক্স মার্কেটের মালিক এবং তার স্ব-পরিবার উঠেছে। হৃধি যেন আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে। আলী কমপ্লেক্স হাউজের মালিক মানে তো মাহিনের বাবা। এর মানে কী মাহিনরা..???? খাবার আর হৃধির গলা দিয়ে নামলো না। যা শক খেয়েছে তাতে ভালোই পেট ভরেছে। রিনা আরও বলে ওঠে,
–“আপা গো, মালিকের পোলা দু’খান পুরাই সিনেমার নায়ক! বিশেষ কইরা বড়োটায়। হায় আল্লাহ! বাস্তবেও এমন নায়ক দেখুম স্বপ্নেও ভাবি নাই! আপনার মতোন বড়োলোক ঘরের মাইয়া হইলে ইটিসপিটিস শুরু কইরা দিতাম গো আপা!”

কথাগুলো শুধু হৃধির কান পর্যন্ত-ই গেলো। মুখে যেন কুলূপ এঁটেছে সে। বিষ্ময় এখনো কাটেনি। মাহিনের কথাগুলোর মানে তাহলে এই ছিলো? এসবের জন্যেই মাহিন এতদিন নিখোঁজ ছিলো? কোনো রকমে খাবার গিলে উঠে যায় হৃধি। রাবেয়া খাতুন আসতেই রিনা তার বুলি থামিয়ে ফেলে।

রাতে হৃধির ডাক পরলো। রিনা বেরিয়েছে সাতটা নাগাদ। হৃধি রাবেয়া খাতুনের সামনে এসে অলস ভঙ্গিতে বললো,
–“বলো আম্মু!”

তৎক্ষনাৎ হৃধির হাতে এক বড় ঢাকনাসহ কাচের বোল ধরিয়ে দেয় রাবেয়া খাতুন। খুশিমনেই আওড়ালো,
–“যা এগুলো ফাতিমা ভাবীর বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আয়। তারা আজকেই মাত্র শিফট হলো, ভালোমন্দ রান্নার সময় কই? যা, এগুলো দিয়ে আয়।”
–“আমি কেন আম্মু? আ..”
–“আবার বেশি বকছিস? বললাম না যেতে? আমার কতো কাজ পরে আছে, নাহলে তো আমি-ই যেতাম!”

হৃধি মুখ বাঁকালো। কাজ বলতে তো এখন সিরিয়াল নিয়ে বসবে রাবেয়া খাতুন, তা বুঝি হৃধি জানে না? সাড়ে আটটা থেকে শুরু হবে, দশটায় গিয়ে উঠবে। এই দেড় ঘন্টা যেন রাবেয়া খাতুনের জন্যে ফিক্সড। হৃধি পাশে বাটিটা রেখে মাথায় ভালো ভাবে ঘোমটা দিয়ে নিলো। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে হৃধির। কই বিকালেও তো ফাতিমা বেগমের সামনে এতোটা অস্বস্তি হয়নি। এখন কেন এই অস্বস্তিরা ঘিরে ধরেছে? মাহিনের মা বলে? হৃধি এক শুকনো ঢোক গিলে বাটিটা নিয়ে সদর দরজার দিকে চলে গেলো। হৃদপিন্ডটা ক্রমাগত ঢিপঢিপ শব্দ করেই চলেছে। বের হতেই অদ্ভুত শিহরণে নাড়িয়ে দিলো হৃধিকে। আজিব! এই ভয়ংকর মুহূর্তে এতো ঠান্ডা বাতাস আসছে কোথা থেকে? হৃধি অন্তরে কয়েকবার আল্লাহ’কে স্মরণ করলো। অতঃপর মাহিনদের দরজার সামনে এসে আস্তে করে বেল বাজালো। বেল বাজাতে গিয়ে খেয়াল হলো, হাতটাও অসম্ভব রকম কাঁপছে। আধা মিনিটের মাঝেই দরজা তার নিজ শব্দের সাথে খুলে গেলো। হৃধি দৃষ্টি উঁচু করে তাকালো। নেভি ব্লুটিশার্ট এবং কালো টাউজারে আবৃত মাহিন দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই ঘর গোছাতে ব্যস্ত। মুখে ক্লান্তির ভাব দেখা গেলেও হৃধিকে দেখে তার অধরে দেখা মিললো এক চমৎকার হাসির। হৃধির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“তাহলে জেনেই গেছেন আমি আপনার অতি নিকটে? জানেন, এই প্রথম সারপ্রাইজ ভেস্তে যাওয়ার তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। আমি চেয়েছিলাম নিজ উদ্যোগে আপনায় জানাবো। বাদ দিন, ভেতরে আসুন!”
–“প্রয়োজন নেই। আম্মু পাঠিয়েছে!”

বলেই মাহিনের দিকে বড় ঢেকে রাখা বাটিটা এগিয়ে দিলো। হৃধির দৃষ্টি নত। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। মাহিন বিস্তৃত হেসে হৃধির হাত থেকে বাটিটা নিয়ে নেয়। হাতে নেয়ার পূর্বে ইচ্ছাকৃতভাবে হৃধির হাতে নিজ হাত স্পর্শ করায়। এতে হৃধির অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়। অপ্রস্তুত দৃষ্টি মাহিনের পানে নিক্ষেপ করতেই মাহিন চোখ টিপ দেয় এবং বলে,
–“যাক, আমার শ্বাশুড়ি তাহলে বেশ বুদ্ধিমতি!”

হৃধি কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝলো না। হঠাৎ-ই মাহিনের পিছে এসে কেউ দাঁড়ালো এবং মাহিনকে প্রশ্ন করে ওঠলো,
–“কে এসেছে আব্বু?”
–“পাশের ফ্ল্যাটের হৃধি, আন্টি খাবার পাঠিয়েছে।”

মুহূর্তেই ফাতিমা বেগম মাহিনের পাশে এসে দাঁড়ালেন। হৃধিকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,
–“আরে ভেতরে এসো। বাসা কিছুটা অগোছালো, মনে কিছু নিও না। আর এসবের কী দরকার ছিলো?”
–“না, না আন্টি। আজ নয়, অন্য একদিন আসবো। আর প্লিজ এসব বলবেন না, আপনাদের নিশ্চয়ই সমস্যা হচ্ছে।”

বলতেই হৃধি কোণা চোখে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের সেই অভদ্র দৃষ্টি। হৃধি কোনোরকমে কথা কাটিয়ে চলে আসলো। এই ছেলের সামনে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়!

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

#রঙিন_দূত – ১৪
লাবিবা ওয়াহিদ

———————————————-
সুমিষ্ট মিষ্টি সকাল। জেনারেটরের তীক্ষ্ণ শব্দ শ্রবণ হচ্ছে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। সুনশান এলাকায় যান্ত্রিক শব্দটা মেনে নেয়ার মতো না। কিন্তু কোথা থেকে যে শব্দটা আসছে, হৃধি ঠাওর করতে পারলো না। চুপ করে পরোটায় কামড় বসাচ্ছে সে। বারংবার মাহিন-ই তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। রাবেয়া খাতুন কাজ করছে। পানি কখন চলে যাবে ঠিক-ঠিকানা নেই। তাই যতো দ্রুত কাজ শেষ হবে ততো-ই ভালো। একটু পরপরই রাবেয়া খাতুন হাঁক ছেড়ে হৃধিকে জিজ্ঞেস করছে, “খাওয়া শেষ হয়েছে তোর? দ্রুত প্লেটটা দিয়ে যা, ধুঁয়ে নিবো!”

হৃধির মুখশ্রীর বিরক্তি ফুটে ওঠলো। ভ্রু-যুগলের মাঝে ভাঁজ ফেলে দ্রুত খাওয়া শেষ করলো। অতঃপর প্লেটটা নিয়ে রান্নাঘরে গেলো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, রাবেয়া খাতুন নেই! হৃধি বেসিনের কাছে প্লেটটা রাখতে নিলেই রাবেয়া হাতে কাপড়ের বালতি নিয়ে হৃধির উদ্দেশ্যে বললো,
–“প্লেটটা ধুঁয়ে তারপর ভার্সিটি যা, আমি ছাদে কাপড় শুকাতে গেলাম!”

বলেই হৃধিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাবেয়া খাতুন চলে গেলেন। হৃধি কিছুক্ষণ ওভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। সম্বিৎ ফিরতেই দ্রুত প্লেটটা ধুঁয়ে নিলো। চা খেতে ভিষণ ইচ্ছে করছে কিন্তু সেই সৎ-সুযোগ হৃধির হাতে নেই। রিকশা পেতে সে আবার দেরী করে ফেলতে পারে। ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে নিজের রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিলো ভার্সিটির জন্যে। রাবেয়া খাতুন এখনো ফিরেনি। তার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নামতেই লাগে সাত থেকে আট মিনিট। কোনো ফ্ল্যাটের মহিলার সাথে দেখা হলে তো কথাই নেই, কোনো খবরই থাকবে না তার। হৃধি তপ্তশ্বাস ফেলে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। দরজা খুলে বের হতেই মাহিনের মুখোমুখি হলো হৃধি। মাহিন তার ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছে। পরণে ভার্সিটির কোড ড্রেস। হৃধিকে দেখতেই ফিচেল হাসি দেয়। অতঃপ্প্র নির্নিমেষ তাকিয়ে বলে,
–“দিনটা তাহলে শুভ-ই যাবে!”

হৃধি তাজ্জব বনে গেলো। “শুভ সকাল” উইশ না করে বলছে দিন শুভ যাবে? আজব ছেলে তো! হৃধি পুণরায় মাহিনের দিকে তাকাতেই মাহিন চোখ টিপ মেরে চোখে সানগ্লাস লাগায়। অতঃপর এটিটিউডের সাথে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। হৃধি তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। মাহিনের হুটহাট কাজ হৃধির মাথার উপর দিয়ে যায়। সম্বিৎ ফিরলো রাবেয়া খাতুনের ডাকে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নামছে।
–“কিরে হৃধি? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? লেট হচ্ছে তো!”
–“তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, যাই হ্যাঁ?”

আমতা আমতা করে আওড়ায় হৃধি! অতঃপর হৃধি ছুটে নেমে যায়। নিচে নামতেই দেখলো গেটের বাইরে মাহিন ফোন দেখছে। সাদা শার্ট, কালো পেন্ট এবং গলায় আইডি কার্ড ঝুলানো। পকেটে অবশ্য আইডি কার্ড ঢুকিয়ে রেখেছে। চোখে কালো সানগ্লাস, হালকা বাতাসে কয়েক গাছা চুল অবাধ্যভাবে উড়ছে। কী মারাত্মকটাই না লাগছে মাহিনকে। হৃধি কোণা চোখে একবার তাকালেও বারংবার তার দিকেই চোখটা যাচ্ছে। মাহিন ফোনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে ওঠে,
–“রিকশায় উঠে পরুন হৃধি, দেরী হয়ে যাচ্ছে!”

হৃধি সামনে দৃষ্টি দিলো। তার থেকে কয়েক হাত দূরেই একটা রিকশা দাঁড়িয়ে। ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ কুচকে গেলো হৃধির। মাহিনের দিকে তাকাতেই দেখলো মাহিন হৃধির দিকে তাকিয়ে।
–“কী হলো হৃধি? আমায় ছাড়া যেতে ইচ্ছে করছে না বুঝি?”

চোখ রাঙায় হৃধি। মাহিন বুকের বা পাশে হাত রেখে হাসলো। হৃধির আশেপাশে নজর যেতেই দেখলো দু’জন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে মাহিনকে দেখতে দেখতেই হাঁটছে। মাথাটা জ্বলে উঠে হৃধির। মাহিনের ঠিক করে দেয়া রিকশাতে তো আরও যাবে না। হৃধি রিকশার পিছে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলো। সবকিছুই হৃধির বিরক্ত লাগছে।
–“হৃধি, রিকশায় উঠতে বলেছি আপনাকে!”

কে শুনে কার কথা। হৃধি মাহিনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলো। মুহূর্তে-ই মাহিনের কন্ঠস্বর পাল্টে গম্ভীরতায় রূপ নিলো!
–“হৃধি, কথা শুনুন। রিকশায় উঠতে বলেছি আপনাকে। কথা না শুনল অন্য প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে বাধ্য হবো!”
–“কী করবেন আপনি? দেখুন মাহিন, আমি যা ইচ্ছা তাই করবো! আপনি আমার বিষয়ে নাক গলানোর কে? স্টে এওয়ে ফ্রম মি!”
–“আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি হৃধি। আমার রাগ এবং আপনার জেদ, কোনোটাই কল্যাণকর নয়!”
–“আপনার চেয়ে আমার নিকট আমার জেদটাই প্রিয়।”

মাহিন আশেপাশে দৃষ্টি বুলালো। গেটের ভেতরেও। নাহ কেউ আসছে না। মাহিন তড়িৎ হৃধির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হৃধি কিছুটা অপ্রস্তুত হয় যার ফলে দু’কদম পিছিয়ে যায়। হৃধি ভীতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মাহিন বলে ওঠে,
–“আপনার জেদের তারিফ করতে হয়, আমার সাথে ত্যাড়ামি করছেন? এই ত্যাড়ামির ওষুধ কিন্তু আমার আছে হৃধি!”

শুকনো ঢোঁক গিলে হৃধি। আমতা আমতা করে আওড়ায়,
–“দূ..দূরে থাকুন!”
–“রিকশায় উঠুন!”
–“কেন শুনবো আপনার কথা?”
–“আপনারই ফায়দা। না উঠলে আমি কোলে করে উঠাবো এবং আপনার পাশের শূন্য স্থানে আমি নিজেকে সোপে দিবো। তখন ভালো লাগবে?”

হৃধি চোখ বড় বড় করে তাকালো মাহিনের দিকে। মাহিনের এমন উক্তির মানে ধরতে হৃধির সময় লাগেনি। পুরোই অসভ্য এই ছেলে। আর ত্যাড়ামিতে তো শীর্ষে অবস্থান করছে। হৃধি হেরে গিয়ে রিকশায় উঠে বসলো। রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে নিতেই হৃধি তাকে থামিয়ে দেয় এবং হুডির এক পাশ ধরে পিছে ফিরে নাক টেনে বললো,
–“রিকশা ঠিক করেছেন ভালো কথা, ভাড়া দেয়ার কথা কল্পনাও করবেন না!”

হৃধির পানে অপলক চেয়ে মাহিন হাসলো। অতঃপর হৃধির সম্পূর্ণ কথাকে অগ্রাহ্য করে বললো,
–“আপনাকে ভিষণ আদুরে লাগছে হৃধি!”

——————————–
–“তুমি কী মাহিনের দূরসম্পর্কের কাজিন হও?”

হৃধি ভ্রু কুচকে তাকালো তার বিপরীতে বসা মেয়েটির দিকে। গোল গাল চেহারা, দেখতে খারাপ না। তবে মেয়েটা হৃধির অপরিচিত। হৃধির পাশেই ত্বোহা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। তাই মেয়েটির কথা তার শ্রবণ হয়নি। হৃধি কলমের শেষভাগ অধরের পাশে লাগিয়ে বলে,
–“হঠাৎ এই প্রশ্ন? আর আপনি কে?”
–“আমি মালিশা। মাহিনকে আমার পছন্দ!” শেষোক্ত বাক্যটি বেশ লাজুক স্বরে বললো। হৃধি চমকে তাকালো মেয়েটির দিকে।
–“তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?”
–“সাব্বির ভাইয়া আছে না? মাহিনের ফ্রেন্ড? উনি বললো তুমি নাকি মাহিনের সাথে লাইন করিয়ে দিতে পারবে! প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!”

হৃধিকে বেশ অপ্রস্তুত দেখালো। হৃধি আশেপাশে তাকাতেই দেখলো সাব্বির অদূরে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি তার ওদের দিকেই সীমাবদ্ধ। হৃধি সাব্বিরকে দেখতেই সাব্বির নানা ইঙ্গিতে বুঝালো,
–“এই মেয়েকে প্লিজ বুঝাও, এর জ্বালায় আর থাকতে পারছি না!”

হৃধি গলা খাকারি দিলো। অতঃপর মিনমিন করে বলে,
–“যদি পছন্দ করেই থাকেন তাহলে মাহিনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করুন। পছন্দের মানুষ তো উনি-ই তাই না?”
–“আমার ভিষণ নার্ভাস লাগছে। তাই তো তোমায় বললাম!”

হৃধি কিছু বললো না। তার এসব ড্রামা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। ভাগ্যিস হৃধি কাউকে হার্ট করে কথা বলতে পারে না। নয়তো এই মেয়েকে দু’কথা শুনিয়ে দিতে পিছপা হতো না। মালিশা পুণরায় বলে ওঠে,
–“তুমি আমার সাথে যাবে? তুমি থাকলে আমার নার্ভাসনেস কাজ করবে না। প্লিজ! আমার রিকুয়েষ্টটা রাখো!”

হৃধি কী বলবে শব্দভান্ডারে খুঁজে পেলো। পরিশেষে তপ্তশ্বাস ফেলে বলে,
–“ঠিক আছে, চলুন!”

হৃধির সম্মতিতে মেয়েটাকে বেশ খুশি দেখালো। এদিকে হৃধির হৃদয় কতোটা পুড়ছে সেটা সে নিজেই উপলব্ধি করছে। কিন্তু সে মানতে নারাজ যে মাহিনের প্রতি তার বিন্দুমাত্র ফিলিংস আছে। হৃধিকে ত্বোহাকে বাসায় যেতে বলে মালিশাকে নিয়ে চলে গেলো মাস্টার্স ভবনের দিকে। ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হৃধির। তাও মুখশ্রীতে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। মালিশার তো পারে না নেচে বেড়াতে। টুকটাক কথা বলতে বলতে ভার্সিটির পেছনেই হৃধি আসলো। কেন জানি না হৃধির মন বললো মাহিন এখানেই আছে। আসলেই ছিলো। রাফিদ এবং অন্যান্য বন্ধুদের সাথে। মাহিনকে দেখে মালিশা শক্ত করে হৃধির হাত ধরলো। হৃধি একবার মাহিনের দিকে তো আরেকবার মালিশার দিকে। ইচ্ছে তো করছে দু’টোকে একসাথেই মাটিতে পুঁতে রাখতে। কিন্তু সে সফল হয়নি। রাফিদের দৃষ্টি হৃধির দিকে পরতেই রাফিদ মাহিনকে ইশারা করলো। মাহিন তড়িৎ হৃধির দিকে তাকালো। মাহিনের দৃষ্টিতে হৃধির যেন আত্মা কেঁপে উঠলো। কী ভয়ানক সেই চাহনি। হৃধিকে দেখে মাহিনের খুশি লাগলেও তার পাশে অবস্থিত মেয়েটিকে দেখে ভ্রু কুচকালো। অচেনা লাগছে মেয়েটিকে।

মালিশা হৃধির হাত টেনে মাহিনের সামনে আসে এবং লাজুক স্বরে বলে,
–“আপনাকে কিছু বলার ছিলো!”

মাহিন হৃধির দিকে দৃষ্টি দেয়। হৃধি জড়তায় বারমগবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মাহিন হৃধির দিকেই দৃষ্টি দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
–“বলো!”

মালিশা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে চোখ-মুখ খিচে বললো,
–“আই লাভ ইউ মাহিন!”

মাহিনের প্রতিটি বন্ধুই অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মালিশার দিকে। কিন্তু মাহিবের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মাহিন তো শুধু হৃধির অভিব্যক্তি দেখতে ব্যস্ত। হৃধি ভাব-ভঙ্গিতে বোঝাই যাচ্ছে সে বিরক্ত এসবে! মাহিন বাঁকা হেসে হৃধির দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,
–“সরি, আই হ্যাভ এ গার্লফ্রেন্ড! তোমার সাথের মেয়েটি-ই আমার পূর্ণাঙ্গ ভালোবাসা!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here