রঙিন_দূত – ৩৮,৩৯

0
297

#রঙিন_দূত – ৩৮,৩৯
লাবিবা ওয়াহিদ

————————-
–“এই হৃধি, শুনতে পাচ্ছেন? হৃধি?”
–“হুম..!”

হৃধি ঘুমের ঘোরে নড়াচড়া করে পুণরায় ঘুমে ডুবে যাচ্ছে। মাহিন হৃধিকে একটানে শোয়া থেকে বসালো। হৃধি ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বলে,
–“ঘুমোতে দিন মাহিন। টানছেন কেন?”
–“ছাদে যাবো!”

হৃধি চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,
–“কেন?”
–“আজ পূর্ণিমা হৃধি। আপনার সাথে জ্যোৎস্না বিলাস করতে চাই!”

হৃধির ঘুম উড়ে গেলো। পিটপিট করে তাকালো মাহিনের পানে। হৃধি চাইলো না করে দিবে। কিন্তু মাহিন সে সুযোগ দিলে তো! হৃধির মাথায় ঘোমটা দিয়ে মাহিন সটান হয়ে দাঁড়ায়। হৃধিও ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নামলো। মাহিন ততক্ষণে ফোন বের করে সিফাতকে কল দিয়ে বললো,
–“পুরো সিঁড়ি, ছাদ খালি তো?”
–“হ মাম্মা! কোনো মানুষের ছায়াও নাই। নিশ্চিন্তে যা!”

মাহিন কল কেটে দিলো। হৃধি হ্যাবলার মতো মাহিনের দিকে তাকিয়ে রয়। কী করতে চাচ্ছে মাহিন? মাহিন নিজের বলিষ্ঠ হাত দ্বারা হৃধির হাত ধরে বেরিয়ে গেলো। নিঃশব্দে সদর দরজা খুলে দু’জন বেরিয়ে গেলো। হৃধি চারপাশে নজর বুলিয়ে কারো অস্তিত্ব খুঁজে পেলো না। আচ্ছা, এখন কয়টা বাজে? সময় সম্পর্কে হৃধির ধারণা নেই। দু’জনে একসাথেই সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। তবে হৃধি ছয় তলা অবধি গিয়েই হাঁপিয়ে উঠেছে। শাড়ি পরে এত উপরে উঠা তার জন্যে একটু অস্বস্তিকর। রেগুলার শাড়ি পরে হাঁটা-চলার অভ্যাস নেই তো।
–“কী হলো হৃধি? থেমে গেলেন যে?”

হৃধি কয়েকবার ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে স্মিত স্বরে বলে,
–“এমনি। এইতো উঠছি‌!”

বলেই সিঁড়িতে এক পা ফেলতেই মাহিন ফট করে হৃধিকে কোলে তুলে নিলো। হৃধি আতংকে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। মাহিনের শার্টের কাঁধের অংশ খামচে ধরলো শক্তভাবে। যেন ছাড়লেই সে পরে যাবে। হৃধি গোল গোল চোখে মাহিনের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“করছেন কী?”
–“বউকে কোলে নিয়েছি। এছাড়া আপনি এত হালকা কেন? আমি তো ভেবেছিলাম কিছুটা ভারী হবেন!”

হৃধি হ্যাবলার ন্যায় মাহিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাহিন হেসে চোখ টিপ মেরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে যায়। ছাদে আসতেই হৃধি ছটফট করে নামার জন্যে।
–“ছাদে উঠিয়ে এনে অনেক হিরোগিরি করেছেন, এখন নামান আমায়। অতিরিক্ত হিরোগিরি করা ভালো না!”
–“তাহলে তাঁরাকে ডেকে আনি। আপনার জায়গায় ওকে কোলে নিবো!”

হৃধি চোখ গরম করে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিন হৃধির গরম রূপ দেখে হাসতে হাসতে ছাদের এক কোণায় নিয়ে যায়। সেখানে একটা দোলনা মজুদ আছে। দোলনাটা তিস্তার। মাহিন হৃধিকে আনবে বলে সিফাতকে দায়িত্ব দিয়েছে দোলনাটি এনে দেয়ার স্বার্থে। সিফাতও তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এই মাঝরাতে দোলনা ছাদে উঠিয়েছে। মাহিন হৃধিকে দোলনায় বসিয়ে দিলো। অতঃপর মাহিন দোলনার পিছে গিয়ে মৃদ্যু দোলাতে লাগলো দোলনাকে। দোলার সময় মাহিন হৃধির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–“আমি মজা করেছিলাম হৃধি। তাঁরাকে আমি কোলে নিবো না মোটেও। ও ডুবে ম’রু’ক বা ছাদ থেকে লাফ দিক, আমার কিচ্ছুটি হবে না। আমি তো আপনাকে দেখে যাবো অবিশ্রান্ত, পলকহীন!”

বলেই হৃধির গালে অধর ছুঁয়ে সরে এলো। হৃধি যেন সেখানেই শক্ত হয়ে গেলো। চোখ তার অসম্ভবরকম বড়ো। পরমুহূর্তে সম্বিৎ ফিরতেই আকাশের দিকে তাকালো। কী সুন্দর চাঁদ, আজ বুঝি পূর্ণিমা? কালো মেঘকুঞ্জরা চাঁদের আশেপাশে অবলীলায় ঘুরছে। কী অপরূপ এই দৃশ্য। মাহিন এবার হৃধির পাশে এসে বসলো। হৃধিকে সপ্তপর্ণ নিজের বক্ষে নিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। হৃধির আবেশে চোখ বুজে আসে। মাহিনকে এভাবে পাশে পেলে হৃধি যেন দুনিয়ার সমস্ত নিয়ম, সম্পর্ক, বিষয় ভুলে যায়। এই বৃহৎ পৃথিবীতে মাহিন ব্যতীত যেন কেউ নেই, শুধু তাকেই অনুভব করতে পারে! নিবিড়ভাবে। মাহিনের সাথে পাহাড়সম সুখ আছে। সেখান হতে এক মুঠো সুখ পাওয়ার তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে হৃধি অশান্ত, অবাধ্য মন। হৃধিকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো মাহিন। আপনমনেই দুটো লাইনে সুর তুললো,
–“পূর্ণিমাসন্ধ্যায়, তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়।

ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়,
করেছি যে দান!”

হৃধি নিশ্চুপ হয়ে শুনলো। ছেলেটার কন্ঠস্বর সত্যি প্রশংসনীয়।
–“হৃধি, এই পূর্ণিমার দিকে তাকান!”

হৃধি পিটপিট করে তাকালো। রাতের শীতল হাওয়া তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে বারংবার। শীতল হাওয়ার সঙ্গে যেন শীতল অনুভূতি বয়ে বেড়াচ্ছে। এই নিস্তব্ধ রজনীতে দু’জন একসাথে সময় কাটানো কতটা অপরূপ তা উপলব্ধি করতে পারছে হৃধি। এ যেন সুখের ভাণ্ডার!
–“এই পূর্ণিমার রাতে আমি আপনাকে দেখেছিলাম। ছাদে। বিষণ্ণ আমি আমার বিষণ্ণতা ভুলতে পূর্ণিমা সন্ধ্যাকে সঙ্গী বানিয়েছিলাম। সেদিন কারেন্ট ছিলো না, ছাদভর্তি মানুষের আনাগোনা ছিলো। আমি পাশের ছাদের ওই কোণার রেলিঙটায় বসেছিলাম, জানেন?”

বলেই হাত দিয়ে জায়গাটি দেখিয়ে দেয়। কৌতুহলী হৃধিও সেদিকে তাকায়। মাহিন পুণরায় বলতে শুরু করে,
–“আমার এই প্যাসন বাবার পূর্ব থেকেই পছন্দ ছিলো না। এ নিয়ে আমার মনটাও বেশ খারাপ থাকতো। সেদিনও তার ব্যতিক্রম নয়। এই বিল্ডিং এ রাফিদ থাকতো আর মোস্ট ইম্পর্টেন্ট কেন যেন এই ছাদটাই আমার ভালো লাগতো। জানেন সেদিন আমি প্রথমবারের সিগারেট স্পর্শ করেছিলাম। আমি অসৎ পথে হাঁটতে চাইছিলাম। যেই সেটাকে অধরে ডুবাবো তখনই আপনাকে দেখতে পাই উজ্জ্বল চাঁদের আলোয়। স্নিগ্ধ আপনিকে দেখে আমি মিনিটখানেকের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। আপনাকে দেখে আমার ভেতরটায় কীরকম ঝড় উঠেছিলো আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। সেই একটা রাত এ আপনার দর্শনে আমি নিজের কালো সাদা জীবনটাকে রঙিন দেখতে শুরু করেছিলাম। অদ্ভুত কারণে আপনাকে দেখতে পেয়ে আমার ইচ্ছা পূরণের স্বপ্ন আরও নিবিড় হয়। আমি সেদিন পাত্তা দেইনি বিষয়টি। তবে এই পাত্তা না দেয়ার ফল আমি তিন মাস ভুগেছি। আপনার সাথে আমার দ্বিতীয়বারের মতো দেখা হয় ওড়নার ঘটনার দিন। সেদিনই আমি উপলব্ধি করি, এই @রঙিন দুতকে আমার প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন। তাইতো হার না মেনে আপনাকে জয় করতে মাঠে নামলাম, আল্লাহ-ও আমায় বিজয়ী করলো, আপনাকে আমার বিজয়ের উপহার দিলো।”

হৃধি নির্বোধ পাখির ন্যায় সবটা শুনে গেলো। তার চোখে-মুখে বিষ্ময়ের ঝিলিক। ছেলেটা সত্যি-ই এতটা মূল্যবান মনে করে হৃধিকে? এতটা ভালোবাসে কেন সে? হৃধি কী আদৌ এই আকাশসম ভালোবাসার যোগ্য? দুই কপোত-কপোতী ওভাবেই পূর্ণিমা বিলাস করলো দীর্ঘক্ষণ। একসময় হৃধি বলে ওঠে,
–“আপনি না নিয়্যত করেছিলেন, আমাকে আপনার ঘরে উঠালে “তুমি” সম্বোধন করবেন। তাহলে?”
–“আগে নিয়্যত করলেও আমি কেন যেন পারি না। বলা বাহুল্য, আপনার বিষয়ে “তুমি” টা আসে না। দেখলেন না প্রথম দু’দিন তুমি আপনিতে গুলিয়ে ফেলছিলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনি-ই সম্বোধন করবো। কারণ “আপনি” ডাকটা সুন্দর, মধুর। ক’জন স্বামী পারে তার স্ত্রীকে একঢাল অনুভূতির সঙ্গে আপনি ডাকতে?”

পুণরায় হৃধি মুগ্ধ, স্তব্ধ। হৃধি আপনমনে বলে ওঠে,
–“আপনি সুন্দর নাকি আপনার ভাবনা?”
–“আপনার হৃদয় যা বলে।”
–“আপনি আপাদমস্তক সুন্দর, মাহিন!” পুণরায় অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠলো হৃধি।

————————–
আজ সকাল সকাল ত্বোহা হৃধিদের বাসায় এসে হাজির হয়। ত্বোহাকে দেখে হৃধির হৃদয় নেচে উঠলো। প্রাণপ্রিয় বান্ধুবীকে জড়িয়ে ধরলো নির্বিঘ্নে!
–“কেমন আছিস?”
–“রাখো তোমার খবর নেয়া! এতদিন মরেছি নাকি বেঁচে আছি জিজ্ঞেস করলি না এখন আসছে খবর নিতে। বিয়ে করেছিস জানালে কী তোর জামাইকে খেয়ে ফেলতাম নাকি তোর বিয়েতে রোস্টের পিস কমে যেতো? খেতাম তো ওই এক পিস রোস্ট-ই!”
–“আহ! রেগে যাচ্ছিস কেন? বিয়েটা ছিলো একদম আনএক্সেপ্টেড। আমি কী জানতাম নাকি যে আমার বিয়ে?”
–“ঘটনা কী?” ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো ত্বোহা।

হৃধি চাইলো না দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সব বলতে। তাই হৃধি ত্বোহাকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। মাহিন বাসায় নেই। সাব্বিরের সাথে দেখা করতে গেছে। হৃধি রুমে এসে ধীরে ধীরে ত্বোহাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। ত্বোহা সব শুনে অবাকের চরম পর্যায়ে। একসময় ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“ভার্সিটির মেয়েগুলা যদি জানে তুই মাহিন ভাইয়ের বউ, তাহলে দেখিস! ফুলতে ফুলতে এরা বেলুন হয়ে যাবে!”

হৃধি উত্তরে লাজুক হাসলো। মাহিনের গানিগুলো ইয়ং জেনারেশনে হিট বললেই চলে। তাছাড়াও মাহিন এই ভার্সিটি থেকেই পড়াশোনা শেষ করেছে, এজন্য মাহিনের নাম একটু বেশি-ই সবার কাছে। মেয়েগুলোর তো কোনো কথাই নেই।

বিকালের দিকে ত্বোহা চলে গেলো। হৃধির খুদা পেয়েছে কিন্তু মাহিন এখনো আসছে না। হৃধির এতে বেশ মন খারাপ। ভেবেছিলো লাঞ্চ মাহিনের সাথেই করবে, কিন্তু তারই তো খবর নেই। দেরী করবে একবার ফোন করে বলে দিতেই পারতো। তা না করে তিনি বন্ধুমহলে ব্যস্ত। হৃধির অভিমান হলো, চাপা অভিমান। রাবেয়া খাতুন বেশ জোর করে মেয়েকে খাওয়ানোর জন্যে। লাঞ্চে ত্বোহার সাথে বসলেও সে খাবার নেয়নি। ওই মাঝেমধ্যে ত্বোহা জোর করে তার মুখে ভাত পুরে দিয়েছিলো। এই আর কী। তবে ওতটুকুতে কী খুদা নিবারণ সম্ভব? হৃধি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেলো। বিছানায় শুয়ে একমনে ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়। মাহিনের একটি কলের আশায়। মাহিনকে ভাবতে ভাবতে মাহিনের কল এলো। হৃধি দ্রুত উঠে বসলো। কপালের ঘাম মুছে কল রিসিভ করে ফোন কানে লাগায়।
–“হৃধি, আমি এখন একটা শো এর উদ্দেশ্যে রওনা হবো। আসতে কত রাত হয় আমি সঠিক বলতে পারছি না। আপনি সাবধানে থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ!”

মাহিন কল কাটার পূর্বেই হৃধি তড়িৎ প্রশ্ন করে বসলো,
–“কিসের শো?”
–“ভালোবাসি, প্রোগ্রামে আজ আমার ইনভেটিশন এসেছে। আমি মল থেকে পাঞ্জাবি কিনে পরে নিবো। রাখছি, কেমন?”
হৃধি আস্তে করে “হুম” বললো। মাহিন কল কাটতেই হৃধি রাবেয়া খাতুনের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লো।
–“মা, খুদা পেয়েছে। খাবার দাও!”

————————–
–“আপনার জন্যে মোস্ট রিকুয়েষ্টেড একটি প্রশ্ন এসেছে। প্রশ্নটি হচ্ছে আপনি সিঙ্গেল নাকি মিঙ্গেল?”

মেয়ে হোস্টারের কথায় মাহিন স্মিত হাসলো। বেশ নরম স্বরে বললো,
–“জ্বী না, আমি বিবাহিত!”

মাহিনের বলা শেষ শব্দটি হৃধির বুকে তীরের মতোন বিঁধলো। সে কল্পনা করেনি মাহিন তার বিয়ের কথা প্রকাশ করে দিবে। মেয়েটা চোখে মুখে একরাশ বিষ্ময় নিয়ে বেশ অবাকের সাথে বললো,
–“ও মাই গড! এ আমি কী শুনছি। দ্য কিলার বয় কি না ম্যারিড? আমি শিওর, আপনার এই কথা শুনে মেয়েরা স্ট্রোক করবে!”

হোস্টারের উত্তরে মাহিন হেসে দিলো। এর উত্তর তার কাছে নেই।
–“তা বলুন, কতদিনের পরিচয়। লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ?”
–“অবশ্যই লাভ ম্যারেজ। আমার প্রথম অনুভূতি সে!”
–“সবাই বলে প্রেম আর আপনি বলছেন অনুভূতি?”
–“প্রেম শব্দটি ক্ষণিকের জন্যে জীবনে আসে যেটার সঠিক ভিত্তি নেই। আর এই অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসার। ভালোবাসার পরিমাণ, সুদীর্ঘ হয়। তাইতো ইতিহাসে কত ভালোবাসার গল্প আছে, যা মানুষ হাজার বছর ধরে লালন করছে।”
–“ইতিহাস গড়ার ইচ্ছে নাকি?”

মেয়েটির সাথে তাদের মাঝে হাসির রোল পরলো। মাহিন একসময় হাসি থামিয়ে বলে,
–“কে জানে, কখন কার ইতিহাস গড়ে যায়। এর তো সঠিক গ্যারান্টি নেই!”
–“কীভাবে দেখা? প্রথম উপলব্ধি করলেন কীভাবে সেই ভাগ্যবতী আপুকে?”
–“সেটা বলবো নাহয় কোনো এক সময়। তবে আমার সফলতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আমার বউ৷ সে পাশে না থাকলে আমি মাহিন কখনোই এখানে বসতে পারতাম না!”

হৃধির চোখের কোণ ভিঁজে যায়। রিমোটটাকে শক্ত করে চেপে ধরে সে। তারই চোখের সামনে টিভির পর্দায় মাহিন তারই প্রসংশা করছে? এরকম নানান কথাবার্তা চললো। সবশেষে মেয়েটি বললো,
–“একদিন তাহলে দেখা হবে আপনার ওয়াইফের সঙ্গে। দেখা না করেও উপায় নেই, যে প্রসংশা করলেন আপনি। শুভ কামনা আপনাদের দাম্পত্য জীবনের জন্যে। এছাড়া আপনার ভয়েসে অরিজিনাল গান কবে শুনবো? অনেক তো শুনলাম কভার, এবার নাহয় নতুন কিছু শুনি। আপনার ভক্তরা যে আর মানতে চাইছে না!”
–“ইনশাল্লাহ শীঘ্রই অরিজিনাল গান করবো। সেই অপেক্ষাতে যেমন আমার ভক্তরা আছে তেমন আমি নিজেও। আশা রাখছি ভালো কিছুই উপহার দিতে সক্ষম হবো।”

প্রোগ্রাম শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। হৃধি তখনো থম মেরে বসে আছে, একই ভঙ্গিতে। রাবেয়া খাতুন কিচেন থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। হৃধির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
–“কী, মাহিন বাবাকে দেখা হলো? এখন রিমোট দে, আমার সিরিয়াল আছে!”

হৃধি বিনা-বাক্যে রিমোটটা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। বিছানায় বসতেই ফোনের ভাইব্রেশন উপলব্ধি করলো। হৃধি বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিতেই দেখলো মাহিনের কল। হৃধি বিনা-বাক্যে কল রিসিভ করে সালাম জানালো। মাহিন সালামের উত্তর নিয়ে বললো,
–“হৃধি, আমার ফিরতে অনেক লেট হবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ আর ও বাড়িতে ফিরবো না। এমনিতেই নতুন জামাই আমি। এমতাবস্থায় রাত করে বাড়ি ফেরাটা খুব একটা ভালো দেখায় না। তাই আমি বাড়িতে চলে যাবো। আবার আগামীকাল সকালে এসে আপনাকে নিয়ে যাবো!”
–“কালকেই চলে যাবো?” মন খারাপ করে আওড়ায় হৃধি।
–“হ্যাঁ! এছাড়া আর উপায় নেই তো। আপনি ব্যতীত এক রাত কাটাচ্ছি এটাই আমার জন্যে যন্ত্রণার, আজ নাহয় আপনার মা-বাবার সাথে সময় কাটান। এনাফ টাইম আছে আপনার হাতে। এখন রাখি, গাড়ির কাছে এসে গেছি!”
–“সাবধানে ফিরবেন।”

আগামীকাল চলে যাবে বিধায় মাঝরাত পর্যন্ত হৃধি তার বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটালো, এত এত গল্প করলো। তার জন্যে যেন বেস্ট দিন ছিলো আজ। আজ তার গম্ভীর বাবাটাকে খুব প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছিলো। করিম উল্লাহ আজ খুব খুনশুটি করেছেন রাবেয়া খাতুনের সাথে। হৃধি মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখেছে আর হেসেছে।

এখন রাত বাজে প্রায় একটা। হৃধির ঘুম আসছে না। অদ্ভুত কারণে। হয়তো আগামীকাল থেকে তার প্রিয় রুমটায় আর থাকবে না। বারবার এপাশ ওপাশ শুচ্ছে সে। একসময় রিংটোনের তীব্র ধ্বনি শ্রবণ হলো। হৃধি চমকে বালিশের পাশে হাতড়ে ফোন হাতে নিলো। মাহিনের কল? ফিরেছে নাকি? হৃধি চটজলদি কল রিসিভ করে চোখ বুজলো।
–“ঘুমিয়ে গেছেন হৃধি?”
–“আপনি ফিরেছেন?”
–“হ্যাঁ। ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে-দেয়ে সবে শুলাম। আপনি ঘুমাননি যে?”
–“এমনি, ঘুম আসছিলো না!”
–“বুঝেছি। আমাকে মিস করছিলেন তাই না? দাঁড়ান আগামীকাল থেকে আপনাকে ঝাপটে ধরে ঘুমাবো। আর সাথে…”
–“লাগামহীন কথাবার্তা ছাড়ুন, আমার ঘুম পাচ্ছে রাখছি!”

বলেই মাহিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে কল কেটে দিলো। এই ছেলে যেমন সভ্য দেখায় তেমনই অ’সভ্য তার কথাবার্তা। হৃধি লজ্জায় রাঙা হয়ে মিনমিন করে বলে,
–“ঠোঁটকাটা একটা!”

—————————
ফাতিমা বেগম হৃধিকে দেখতেই তাকে জড়িয়ে ধরলো।
–“অবশেষে মনে পরলো এই মায়ের কথা?”

হৃধি স্মিত হাসলো।
–“কেমন আছো আম্মু?”
–“মায়ায় জড়িয়ে দিয়ে তো চলে গেলি, ভালো থাকি কী করে? আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই কেমন আছিস?”
–“ভালো!”
–“ভেতরে আয়। আজ আমি স্কুল যাইনি তুই আসবি দেখে। সকাল থেকে তোর পছন্দের ডিশ বানিয়েছি। আয় খেয়ে বলবি কেমন লেগেছে!”

হৃধি হাসলো। মাহিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ফাতিমা বেগম হৃধিকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। সেখান থেকে দু লোকমা খাইয়ে তবেই হৃধিকে ছাড়ে। হৃধি চিবুতে চিবুতে রুমে চলে আসে। খাবার গিলে রুমে ঢুকে প্রথমে হাতের হ্যান্ডব্যাগটা যথাস্থানে রেখে মাথার হিজাব খুলতে লাগে। মাহিন রুমে নেই, ওয়াশরুম হতে পানির শব্দ আসছে। হৃধি সবে হিজাব খুলে ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়েছে। ঠিক তখনই মাহিন কোমড়ে তোয়াল জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। উম্মুক্ত মাহিনকে দেখে হৃধির চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। সদ্য গোসল সেরেছে মাহিন। মাহিন হৃধিকে দেখে এক চোখ টিপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হৃধির হেঁচকি উঠলো। মাহিন বোকা বনে গেলো। হৃধির অনবরত হেঁচকি উঠছে। হৃধি চোখ সরিয়ে দ্রুত পালাতে নিলে মাহিন তাকে ধরে হেঁচকা টান দিলো। হাতে টান খেয়ে হৃধি নিজেকে সামলাতে না পেরে ধপ করে মাহিনের বক্ষে গিয়ে পরলো। এতে যেন হৃধির হৃদপিন্ডের ধড়ফড়ানি আরও অধিক বেড়ে যায়। নিঃশ্বাস যেন গলাতেই আটকে যায়। হৃধি শক্ত করে চোখ বুজে রয়। একদম শক্ত হয়ে আছে সে। ভিষণ লজ্জা এবং জড়তা ঘিরেছে তাকে। থরথর করে কাঁপছে একপ্রকার। মাহিনও টিপ্পনী কেটে বলে,
–“হেঁচকি উঠছে কেন?”
–“পা..পা..পানি খাবো!”

বলেই হৃধি সরে আসতে নিলে মাহিন পুণরায় ঝাপটে ধরে, পেছন থেকে। এবার যেন হৃধির জান যায় যায় অবস্থা। মাহিনের উম্মুক্ত বুকের সাথে হৃধির পিঠ লেপ্টে আছে, বিষয়টা ভিষণ লজ্জাজনক। কঠিন রকম লজ্জা।
–“আরে, আরে। এত তাড়া কিসের? আমার কাছে থাকুন। পানি তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here