রঙিন_দূত – ৩৫,৩৬

0
323

#রঙিন_দূত – ৩৫,৩৬
লাবিবা ওয়াহিদ
৩৫
—————————
সুমিষ্ট প্রভাত। প্রভাতের নরম আলো নতুন একটি দিনের সূচনা জানান দিচ্ছে। পাখিরা গাছে গাছে উড়ে বেড়িয়ে নিজস্ব কন্ঠে গান করছে। কেউ কেউ নতুন দিনের সূচনা হতেই বেরিয়ে পরেছে কাজের সূত্রে। আবার কেউ কেউ তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। পাখিরা কিচিরমিচির করতে করতে কারো কারো বারান্দায় বসে মনের সুখে গান করতে থাকে। কী সুন্দর তার সুর। তবে পরমুহূর্তে কারেন্টের তারে বসা কাকের “কা” “কা” শব্দে তার গানটি ফিঁকে পরে যায়৷ নরম রোদ্দুর জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে। থাই গ্লাস বন্ধ, এসি চলছে। ফুলের ঘ্রাণে এখনো রুমটা মাতোয়ারা। দেনমোহরের কাগজটা ড্রেসিং টেবিলের উপর পরে আছে। চেয়ারটাও ঠিক নেই। কাকের বিরক্তিকর গানে হৃধির তন্দ্রা কেটে যায়। পিটপিট করে তাকাতেই প্রথমে উজ্জ্বল আলো তার চোখে পরলো। মুহূর্তে-ই হৃধি ভ্রু-জোড়া কুচকে পুণরায় চোখ বুজে ফেলে। গতকাল রাতে জানালায় পর্দা দেয়ার কথা একদমই মনে ছিলো না। হৃধি চোখ কচলে দেয়াল থেকে মাথা সরাতেই কোমড়ে এবং পা জোড়ায় চিনচিন ব্যথা অনুভূত হলো। হৃধি পিটপিট করে নিজের কোলে তাকালো। মাহিন ঘুমিয়ে আছে তার কোলে। সব কিছু বুঝতে তার ক্ষণিক সময় লাগলো। আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতেই তার সব মনে পরলো।
ঘুমন্ত মাহিনকে কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। হৃধি কয়েক মুহূর্ত ওভাবে তাকিয়ে রইলো। পুণরায় অনুভব পা, কোমড় এবং ঘাড়ের অসহনীয় ব্যথা। সে একদমই বেঠিক হয়ে ঘুমোতে পারে না। সেখানে সারারাত সে এভাবেই ছিলো। আজ মা কাছে থাকলে নিশ্চয়ই খুব বকতো। হৃধি তপ্তশ্বাস ফেলে মাহিনকে ডাকার প্রস্তুতি নিলো। গতকাল হৃধি মাহিনের সাথে কথা বলেনি বলে মাহিন তাকে এই পানিশমেন্ট দিয়েছে। মাহিনের ভাষ্যমতে আদুরে পানিশমেন্ট। তবে হৃধির জন্যে আসলেই পানিশমেন্ট ছিলো। তাই সে গাল ফুলিয়ে রাখলো। একমাত্র এই ছেলের পাগলামির জন্য-ই তার এই অসহনীয় ব্যথা সহ্য করতে হচ্ছে। হৃধি ঘুমন্ত মাহিনের উপর রাগ ঝাড়লো না। আস্তে করে মাহিনের মাথাটা বালিশে এলিয়ে দিলো। আরাম পেতেই মাহিন আরও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো।

হৃধি পা দুটো টানটান করে মেলে দিলো। হাড্ডি-গুড্ডি যেন শক্ত হয়ে একে অপরের সাথে লেগে আছে। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে পাশ ফিরে নামতে যেতেই হাতে নুপুর জোড়ার স্পর্শ লাগলো। হৃধি সেগুলো হাতে নেয়। এটা মাহিন তাকে উপহার দিয়েছে। এই নুপুর জোড়াই সেদিন পছন্দ করেছিলো সে। কিন্তু মাহিনের জ্বালাতনে কিনতে পারেনি সে। একসময় নুপুরগুলোর জন্যে আফসোস থাকলেও এখন নুপুর তার হাতে। মাহিন তাকে পায়ে পরিয়ে দিয়েছিলো। মুহূর্তটুকু ভাবতেই হৃধি অধরে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। মাহিন কোলে শোয়ার আগেই হৃধি নুপুরজোড়া কৌশলে খুলে রেখেছিলো। নয়তো আরও ব্যথা উঠতো সাথে নুপুরের লালচে দাগও পরতে সময় নিতো না। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে খুলে রেখেছিলো। এখন হৃধি পুণরায় নুপুর জোড়া পরে নিলো। কিছুক্ষণ হাঁটা-চলা করে লাগেজ থেকে শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

মাহিন ঘুমের মাঝে শুনতে পাচ্ছে ঝুনঝুনির শব্দ। মৃদু ভ্রু কুচকে উঠলো তার। ঘুমঘুম চোখ পিটপিট করে তাকাতেই দেখলো কোনো এক রমনী তার পুরো ঘরে বিচরণ করছে। কখনো এদিক হাঁটা-চলা করে চুল ঝাড়ছে আবার বেলকনিতে চলে যাচ্ছে। সবকিছু বুঝে উঠতে মাহিনের মিনিটখানেক সময় লাগলো। পরমুহূর্তে আবারও সেই ঝুনঝুনির শব্দ। মাহিন তার আবছা খোলা চোখ জোড়া এবার পুরোপুরি খুলে ফেললো। হৃধি বর্তমানে লাগেজ থেকে জামা-কাপড় বের করতে ব্যস্ত। কাবার্ড খুলতে নিলে দেখে কাবার্ড লক। হৃধির ভ্রু কুচকে এলো। মাহিন এক হাতে মাথা ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইলো। হৃধিকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে আওড়ায়,
–“চাবিটা ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে আছে। আমি এতদিন ছিলাম না দেখে মা কাবার্ড লক করে রেখেছিলো!”

হৃধি চমকে পিছে ফিরে তাকালো। হৃধি তাকাতেই মাহিন চমৎকার হাসলো। অতঃপর হাসতে হাসতে মিষ্টি স্বরে বললো,
–“গুড মর্নিং বউরাণী! শ্বশুরবাড়িতে প্রথমদিন হিসেবে বেস্ট অফ লাক। আর বরাবরই আপনাকে আমার বউ বউ লাগছে!”

বলেই মাহিন উবুত হয়ে শুয়ে পরলো। মাহিনের এরূপ কান্ডে হৃধি বিষ্ময়ে হতভম্ব। ছেলেটার মাথা খারাপ নাকি? আজব আজব কথা বলে আবার ঘুমিয়ে পরলো? হৃধি ঘড়ির দিকে তাকালো। সকাল আটটা বেজে ঊনিশ মিনিট! হৃধি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ড্রয়ার থেকে চাবিটা নিয়ে কাবার্ড খুলে নিলো। সব অগোছালো। হৃধির মাহিনের প্রতি রাগ লাগলে মিনমিন করে মাহিনকে বকতে লাগলো,
–“এত বড় ছেলের কান্ড-জ্ঞান দেখো! দশ বছরের বাচ্চার মতো সব এলোমেলো করে রেখেছে। কথার বেলায় একশো তে একশো আর গোছানোর বেলায় শূণ্য!”

হৃধি নিজ হাতে সব গুছিয়ে মাহিনের জামা-কাপড় এক পাশে রাখলো। তারপর নিজের থ্রি-পিস আর শাড়িগুলো সুন্দর ভাবে সাজিয়ে নিলো। এসব করতে করতেই ন’টার বেশি বেজে গেলো। হৃধি কাবার্ড লাগিয়ে বিছানায় নজর দিলো। মাহিন এখনো ঘুম। ঘুম দেখে মনে হয় যেন সারা রাত হৃধিকে পাহারা দিছে। হৃধি মুখ বাঁকিয়ে সদ্য শুকিয়ে যাওয়া চুলগুলোকে খোপা করে মাথায় ঘোমটা তুললো। নুপুরগুলো পা থেকে খুলে ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে স্ব-যত্নে তুলে রাখে। অতঃপর দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেলো। রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে। হৃধি সেদিকে এগোতেই দেখলো ফাতিমা বেগম অর্থাৎ তার শ্বাশুড়ি মা কাজ করছে। ফাতিমা বেগমকে হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে কাজের মেয়েটি। ফাতিমা বেগম চুলোর আঁচ ককিয়ে পিছে ফিরতেই হৃধিকে নজরে এলো। হৃধি নাজুক হেসে সালাম দিলো। ফাতিমা বেগম হেসে সালামের উত্তর নিলো।
–“কী ব্যাপার? নতুন বউ কিচেনে কেন?”
–“বেশি কিছু না আন্টি, রুমে ভালো লাগছিলো না তাই চলে আসলাম!”
–“আন্টি কিসের?”

হৃধি জিহবায় কামড় দিলো। ফাতিমা বেগমকে পর্যবেক্ষণ করতেই দেখলো তিনি কড়া চোখে তাকিয়ে। হৃধি হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“সরি, আম্মু। ওই অভ্যাস থাকায় মুখ ফসকে বলে ফেলেছি!”
–“আচ্ছা, বুঝেছি। তা আমার ছেলে কই? ঘুমাচ্ছে?”

হৃধির কেমন লজ্জাবোধ হলো। দৃ্ষ্টি নত করে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,
–“জ্বী আম্মু!”

ফাতিমা বেগম ফিক করে হেসে উঠলেন। হৃধির নিকট এগিয়ে গেলো সে। থুঁতনি ধরে মাথা উঁচু করে বলে,
–“এত লজ্জা পেতে হবে না। একি, তোমার নাক খালি কেন? নথ পরো না?”
–“জ্বী না আম্মু!”

ফাতিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর হৃধিকে লিভিংরুমে বসতে বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। হৃধিও নির্বিঘ্নে বসে রইলো। চারপাশে নিজের নজর বুলিয়ে নিলো। কী অদ্ভুত! এখন থেকে সে এই বাড়ির বড়ো বউ, এটা তার সংসার। করিম উল্লাহ’র সেই ছোট্ট রাজকন্যার এখন সংসার হয়েছে। বাবার কথা মনে পরতেই হৃধির মনটা ছোট হয়ে গেলো। তার মন খারাপের সময়টা ছিলো ক্ষণস্থায়ী! ফাতিমা বেগম হাতে একটি প্যাকেট নিয়ে এলেন। প্যাকেটের সাইজ খুব ছোট। ফাতিমা বেগম হৃধির পাশে বসে প্যাকেটটি খুলে ছোট ফুলের নথটি বের করলো। হৃধি বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে রয় নথটার দিকে। ছোট নিঁখুত ফুলটা কী সুন্দর চিকচিক করছে৷ ফাতিমা বেগম হৃধির খালি নাকে সেটি পরিয়ে দেয়। অতঃপর হৃধির কপালে চুম্বন করে বললো,
–“আমি নাস্তা রেডি করছি, তুমি গিয়ে মাহিনকে ডেকে দাও। ছেলেটার দেরী করে ওঠার অভ্যাসটা এখনো গেলো না!”

——————–
–“মাহিন, উঠুন বলছি। নয়তো আমি সত্যি জগভর্তি পানি এনে আপনার মাথায় ঢালবো!”

মাহিন চট করে উঠে বসলো। এলোমেলো চুল এবং বিরক্তিভাব মুখশ্রী দেখে হৃধির খুব হাসি পেলো। কিন্তু হৃধি হাসি চেপে রাখলো। মাহিন বিরক্তির স্বরে বললো,
–“আহ, হৃধি। আপনি বিয়ের প্রথম সকালেই বোকারাণী থেকে রামচন্ডীতে রূপান্তর হলেন? এটা কী ঠিক হলো?”
–“বেশ করেছি রামচন্ডী হয়েছি! আপনিও আমায় কম জ্বালান না! দ্রুত উঠে পরুন, আর কফিটা শেষ করুন!”

বলেই যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে মাহিন তাকে থামিয়ে দেয়।
–“কফিটা তুমি বানিয়েছো?”

আবার “তুমি!” হৃধি মিনমিন করে বললো,
–“আম্মু বানিয়েছে!”
–“তুমি কেন বানাওনি? তুমি না বানালে আমি খাবো না। এটা তুমি খেয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে এসো!”

হৃধি আড়চোখে মাহিনের দিকে তাকালো।
–“মা আমায় রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি, আমি কী করবো?”

মাহিনকে ভাবান্তর দেখা গেলো। এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে বলে,
–“হ্যাঁ তাইতো। তুমি তো নতুন বউ। রান্নাঘরে তোমার কী? আচ্ছা, আজকের মতো ম্যানেজ করে নিলাম। পরবর্তীতে তুমি বানিয়ে আনবে। ওকে?”

হৃধি ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে পরলো। মাহিন হাসলো। হেসে আপনমনে আওড়ায়,
–“লাজুকলতা আমার!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

#রঙিন_দূত – ৩৬
লাবিবা ওয়াহিদ

———————
মাহিন নাস্তা ছেড়ে হৃধির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। হৃধি কোণা চোখে মাহিনের এরূপ দৃষ্টি লক্ষ্য করলে বেশ অস্বস্তিতে পরে যায়। তবে হৃধি নিজেকে শক্ত করে নিরবে মাহিনকে এড়িয়ে যায়। মাহমুদ আলী, ফাতিমা বেগম, শাফীন সকলেই টেবিলে উপস্থিত। নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের সাথে এই প্রথম নাস্তা হৃধির। বেশ অস্বস্তি হলেও হৃধি চুপ করে রইলো। পরিবেশটা যেমন তার জন্যে নতুন তেমনই সে নিজেও নতুন বউ। এক ধাপ এগোলেও মনে হয়, সে কোনো ভুল করেছে বা করছে না তো? হাঁটতেও তার চরম অস্বস্তি। সে জায়গায় সকলে একসাথে বসে খাচ্ছে। খালা অর্থাৎ কাজের মহিলাটি সকলকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। এত এত অস্বস্তির মাঝে মাহিনকে দেখো, এই ছেলে যেন শান্তি নামক শব্দকে সবসময় ভাগিয়ে দেয়। দেখছে হৃধি অস্বস্তি, জড়তায় ভুগছে আর এই ছেলে তাকে বাহবা না দিয়ে উল্টো ড্যাবড্যাব করে দেখছে। কী এক বিধ্বস্ত পরিবেশ। বেচারী হৃধিও খেতে পারছে না। ফাতিমা বেগম খেতে খেতে বললেন,
–“কী হলো, খাচ্ছো না কেন?”

হৃধি চমকে ফাতিমা বেগমের দিকে তাকালো। হাসার চেষ্টা করে আধো কন্ঠে আওড়ালো,
–“খা..খাচ্ছি!”

মাহমুদ আলী এবার হৃধির দিকে তাকালেন। শাফীন খেতে খেতে দুই কপোত-কপোতীর দিকে লক্ষ্য করছে। দূর্ভাগ্যবশত বাবা সামনে থাকায় বেচারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। মাহমুদ কে তার চেহারার গাম্ভীর্য কিছুটা কমিয়ে নরম স্বরে বলে,
–“এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি খাবার ভালো হয়নি!”
–“তেমন কিছু নয় বাবা!”

হৃধির কন্ঠে “বাবা” ডাক শুনে মাহমুদ আলীর গাম্ভীর্য কোথায় যেন ছুটে পালালো। ভেতরটা যেন হালকা হয়ে প্রশান্তির ঢেউ খেলছে। কী অদ্ভুত মায়া এই একটি শব্দে। মেয়ের সখ কোন বাবার হয় না? কিছু কিছু বাবাদেরও তো মন চায়, তাদের এক রাজকন্যা হবে, তাকে আগলে রাখবে, যত্ন করবে কিন্তু তার এই সখ যে পূরণ হলো না। সৃষ্টিকর্তা তাকে দুটো ছেলেই দিয়েছে। তবে হৃধির মুখে বাবা ডাক শুনে তার মেয়ের শূণ্য স্থানটি হঠাৎ-ই পূর্ণ হতে শুরু করেছে। মাহমুদ আলী হাসলেন, স্মিত। খাবার খেয়ে হৃধির পাশে গিয়ে তার মাথায় বিলি কেটে দিলেন। অতঃপর আদুরে গলায় আওড়ায়,
–“আল্লাহ তায়া’লা তোমায় সবসময় সুস্থ এবং ভালো রাখুক, মা!”

বলেই তিনি নিজ ঘরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন। মাহিন চমকালেও পরমুহূর্তে হাসলো। তার বাবার পরিবর্তনে মাহিন ভিষণ খুশি। হৃধিকে নিয়ে আজ যেন তার সুখী পরিবার।

–“খেতেও আজকাল মেয়ে মানুষের লজ্জা করে বুঝি?”

হৃধি চমকে পিছে ফিরে তাকালো। মাহিন পকেটে দু’হাত গুজে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। হৃধি বর্তমানে মাহিনের সবুজ বেলকনিতে অবস্থান করছে। হৃধি আমতা আমতা করে আওড়ায়,
–“মা..মানে?”
–“না খেয়ে উঠে এলেন যে?”

এবার হৃধি কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মাহিনের দিকে। তার ভাব এমন যেন তিনি ধোঁয়া তুলসি পাতা। অথচ খাবার টেবিলে সে-ই যে চাহনি দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো, পায়ে সুঁড়সুঁড়ি দিচ্ছিলো তার বেলায়?
–“দোষ করে আবার এসেছেন গীত গাইতে?”

মাহিন হেসে চট করে হৃধিকে পেছন থেকে শক্ত আলিঙ্গলে নিবদ্ধ করলো। হৃধির যেন দম আটকে যাবার জোগান। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে মাহিনের বাঁধন থেকে মুক্ত হবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে সে। এতে মাহিন তার আলিঙ্গন শক্ত এবং ঘনিষ্ঠ করলো। হৃধির যেন সর্বাঙ্গে বিজলি চমকালো। হৃধি কম্পিত স্বরে কিছু বলার জন্যে প্রস্তুতি নিতেই মাহিন বেশ নেশালো স্বরে বলে,
–“আরেকবার নড়লে কোলে নিয়ে নিবো আপনাকে। জিম করে কিন্তু ফিট হয়েছি বেশ!”

হৃধি যেন চুপসে গেলো নিমিষে। নড়াচড়াও বন্ধ। একদম বিড়ালের মতো মাহিনের বক্ষে মাথাটা এলিয়ে রেখেছে। কান দিয়ে যেন ভোঁ ভোঁ শব্দে ধোঁয়া বের হচ্ছে তার। গলায় নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে হৃধি যেন নিঃশ্বাস নেয়াও পাপ।
–“জানেন, আপনার নথটা আমায় পাগল করে দিচ্ছে, মানসিক যন্ত্রণা নাকি আনন্দ দিচ্ছে বুঝতে পারছি না। তবে এই নথের মাধ্যমে আপনি আমার বড্ড আপন খেতাবে নাম লিখালেন হৃধি। আমার কাছে এখনো সব কল্পনা মনে হয়। আমি যেন সুখের রাজা। এখানে সুখের অন্ত নেই। ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার মতো সুখ কী পৃথিবীতে দুটো আছে হৃধি?”

হৃধির কাঁপুনি যেন বাড়লো। মাহিনের কন্ঠস্বর যেন মাদক দ্বারা স্নান করানো হয়েছে। এভাবে বলছে কেন ছেলেটা? তাকে মারবে নাকি? এতো সুন্দর কথাবার্তা তাকে কে শিখিয়েছে? শ্বাশুড়ি মা যেন মাহিনেএ জম্মের পর মধু ঢেলে ঢেলে খাইয়েছে। উফ, কতটা অনুভূতিপূর্ণ কথাগুলো।

তাদের এই একাকীত্ব বহুল সময়ের হলো না। এর মাঝেই দরজার নক শোনা যায়। মাহিনের বিরক্তির নিঃশ্বাস শ্রবণ হয়। কিছুক্ষণ আনাড়ি করলেও হৃধিকে ছাড়তে বাধ্য হয়। হৃধি লজ্জায় লাল হয়ে শক্ত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়। মাহিন বিরক্তির স্বরে চেঁচায়,
–“আসছি! থাম, শাফীন!”

—————————
বিয়ের পর হৃধি এই প্রথমবার তার বাড়িতে এসেছে। রাবেয়া খাতুন তো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। মেয়েকে ছাড়া একা কীভাবে কাটাচ্ছে সেটা একমাত্র উনি-ই জানেন। মাকে পেয়ে হৃধির চোখও ঝাপসা হয়েছে অবিরত। কাঁদার ফলে এখন চোখ-মুখ মাত্রতিরিক্ত লাল। মেয়ে আসবেন বলে করিম উল্লাহ আজ অফিস যাননি। সকাল সকাল বাজারে ছুটেছিলেন মেয়ে এবং মেয়ে জামাইয়ের জন্যে ভালো-মন্দ আনতে। এখন মেয়েকে চোখের সামনে দেখে, মাহিনের সাথে বন্ডিং থেকে ভেতরটা শীতল হাওয়ায় ছেঁয়ে যায়। অজানা প্রশান্তি কাজ করছে মনগহবরে। এই ভেবে শান্তি পাচ্ছে মেয়েটা তার সুখে আছে। নয়তো কত ভয় এবং দুশ্চিন্তায়-ই না ছিলেন তিনি।

দুপুরের খাবারে একসাথে সকলে বসলো। খাওয়ার সময় রিনা মাহিনকে পাতে আস্ত এক মাছের মাথা তুলে দিলো। অতঃপর দাঁত কেলিয়ে বললো,
–“আরে নায়ক দুলাভাই, খান খান। না খাইলে গান গাইবেন কেমতে? আপনার মেলা গান হুনি আমি।”

মাহিন হাসলো। চাপা হাসি। পেটে তার এক বিন্দুও জায়গা নেই। এজন্যই তার মামা বলতো
–“শ্বশুরবাড়িতে নতুন হলে সাবধান। নতুন জামাই হলে এত এত খাওয়াবে যে কূল কিনারা খুঁজে পাবি না।”

একসময় মাহিন তার সিনিয়র কাজিনদের এমন গাদাগাদি করে খাওয়া দেখলে বেশ হাসতো। আজ যেন সে-সব হাসি-তামাশার চরম শাস্তি পাচ্ছে। মাহিন হৃধির দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। হৃধির কিছুটা সময় লাগলো মাহিনের ইঙ্গিত বুঝতে। সে বিষয়টা উপলব্ধি করতেই রাবেয়া খাতুনকে নিচু স্বরে বললো,
–“আম্মু, মাহিন মেবি খেতে পারছে না। এভাবে জোর করে না খাওয়াই ভালো। তুমি একটা ব্যবস্থা করো তো!”

রাবেয়া খাতুন প্রথমে মেয়ের কথা শুনতে না চাইলেও পরবর্তীতে লক্ষ্য করলেন মাহিন খাবার নাড়ছে, এক লোকমাও মুখে পুরছে না। রাবেয়া খাতুন মুহূর্তে-ই দমে গেলেন। রিনার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“রিনা! ছেলেটাকে বিরক্ত করিস না। অনেক জামাই আদর করেছিস, এখন নিজেও গিয়ে খেতে বস। জামাইয়ের জন্যে আমি তো আছি!”

রিনা হাতে থাকা তরকারির বাটিটা ডাইনিং টেবিলে রেখে মাহিনের উদ্দেশ্যে পুণরায় বললো,
–“দুলাভাই, কিছু লাগলে অবশ্যই কইবেন। আমি এক ছুটে চলে আসমু!”

বলেই রিনা চলে গেলো। মাহিন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। খাবার পর্ব সেরে করিম উল্লাহ’র সাথে কথা বলে মাহিন হৃধির রুমে আসলো। অতঃপর বিনা-বাক্যে হৃধির বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরলো। বিছানায় নাক লাগতেই হৃধির নিজস্ব সুঘ্রাণ অনুভব করলো সে। আবেশে মাহিন চোখ বুজে ফেললো। এর মাঝে হৃধি এলো। মাহিনের সামনে সুপারি ধরে মিনিমিন স্বরে আওড়ায়,
–“এটা খেয়ে নিন। বমির ভাব লাগবে না!”

মাহিন চোখ মেলে মাথা উঁচু করে তাকালো। চট করে উঠে বসে হৃধির হাত থেকে সুপারিটা মুখে পুরে নিলো। অতঃপর হৃধির উদ্দেশ্যে বললো,
–“দরজাটা লাগিয়ে দিন!”

হৃধি ভ্রু কুচকে তাকাতেই মাহিন হেসে বলে,
–“উল্টো কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই। আমি ঘুমাবো, দরজা খুলে অন্তত শ্বশুরবাড়িতে ঘুমাতে পারবো না!”

মাহিন আরও কিছু বলতে চাইলেও হৃধির জন্যে বাধ্য হয়ে দমে যায়। এমনিতেই খাবার-দাবার বেশি হয়েছে। যাকে বলে খেতে খেতে পেট ফুলে গেছে। এমতাবস্থায় কিছুতেই হৃধিকে হাতের মুঠোয় আনতে দৌড়-ঝাপ করতে পারবে না। তাইতো এই ফন্দি এঁটেছে। হৃধিও বোকার মতো দরজা লাগিয়ে দিলো। হৃধি কয়েক কদম এগিয়ে বিছানায় বসতেই মাহিন চট করে পরিহিত টি-শার্ট খুলে ফেলে। হৃধি এক চিৎকার দেয়।মাহিন তড়িঘড়ি করে হৃধির মুখ চেপে ধরে।
–“আরে আস্তে হৃধি! জাস্ট টি-শার্ট খুলেছি, এতো চিৎকার দেয়ার কী আছে? এমনিতেই শ্বশুরবাড়িতে আনইজি ফিল করছি, তার উপর আপনি চিৎকার করলে ওরা বলবে আপনাকে রোজ দিনে রাতে টর্চার করি!”

হৃধি চোখ বড়ো বড়ো করে মাহিনের পানে তাকিয়ে আছে। মাহিনকে সে পুরোপুরি খালি গায়ে না দেখলেও সেন্ডো গেঞ্জি বা টি-শার্টে দেখেছে। এছাড়া হৃধি তো এই দু’দিনে মাহিন থেকে দূরত্ব বজায় রাখতো। এই মাহিন যা চিজ, হৃধির মাহিনের কাছে একা যেতেই ভয় লাগতো।
হৃধি জোর করে নিজের মুখ থেকে মাহিনের হাত সরিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলো। কম্পিত গলায় বললো,
–“প্লিজ টি-শার্ট পরে নিন!”

হৃধির এরূপ বচনে মাহিন ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো,
–“মানে সিরিয়াসলি হৃধি? আমি এখনো আপনার লজ্জা ভাঙতে পারিনি? এখন তো মনে হচ্ছে গত দু’দিন দিন-রাত খালি গায়ে আপনার সামনে ঘুরাঘুরি করা উচিত ছিলো!”
–“লজ্জা-শরম নেই আপনার?”
–“নাহ! আমার লজ্জা তো আমার লজ্জাবতী কেড়ে নিয়েছে। সে কী করে আমার কাছে থাকে বলুনতো?”

বলেই হৃধিকে টেনে শুইয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পরলো। হৃধি নড়াচড়া করলে মাহিন তাকে থামিয়ে দিলো,
–“একদম শান্ত হয়ে ঘুমান। আমি ঘুমাবো, আমার ঘুমে আপনার সঙ্গ প্রয়োজন। একদম ছটফট করবেন না।”

সায়াহ্নের পূর্বে হৃধির তন্দ্রা কেটে গেলো দরজায় কড়াঘাতের শব্দে। পিটপিট করে চোখে মেলে তাকাতেই মাহিনের উম্মুক্ত বক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করলো। মুহূর্তে-ই হৃধি ঘোরে চলে গেলো। একরাশ লজ্জা তাকে ঘিরে ধরলো। মাহিন তখনো হৃধির কোমড় জড়িয়ে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো ঘুমাচ্ছে। হৃধি আনমনে মাহিনের গালে স্পর্শ করতেই পুণরায় কড়াঘাতের শব্দ শ্রবণ হয়। হৃধির সম্বিৎ ফিরতেই মাহিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শাড়ি ঠিক করে নিলো। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতে-ই রাবেয়া খাতুনের হাসি-মুখ দেখতে পেলো।
–“ঘুম হলো?”

ফোলা মুখশ্রীতে হৃধির হাসিমুখ ফুটে ওঠে। লাজুক হেসে বলে,
–“জ্বী আম্মু!”
–“আচ্ছা, তাঁরা এসেছে। আয় দেখা করে যা!”

—————–
–“একচুয়ালি হৃধি, তোমাকে কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। তবে আমি মাহিনকে ভালোবাসি। তুমি যেহেতু মাহিনের বউ তাই আমি তোমাকে না জানিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তবে আমি নিজেকে শুধরে নিতে শুরু করেছি। তোমাদের বিবাহিত জীবনে কাঁটা হবো না, কথা দিচ্ছি। দোয়া করি তোমরা সুখে থাকো।”

হৃধির মস্তিষ্কে তাঁরার কথাগুলো এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। অদ্ভুত চিন্তায় মশগুল সে। মাহিন একটু বেরিয়েছে। তাই হৃধি তার প্রিয় বেলকনিতেই একাকী সময় কাটাচ্ছে। হঠাৎ…

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here