#রঙিন_দূত – ১০,১১
লাবিবা ওয়াহিদ
১০
—————————
–“শকে আছেন হৃধি? শকে থেকে লাভ নেই। মাহিন যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন আপনি ভিন্ন ভিন্ন শকে পরবেন। এখন ছাড়ুন এসব। আসুন না, একসাথে রিকশায় চড়ে নিজ নীড়ে পৌঁছাই? ভাড়া কিন্তু আমি দিবো!”
–“যা সম্ভব না তা নিয়ে কেন স্বপ্ন দেখেন মাহিন?”
–“স্বপ্ন দেখা অসম্ভব কিছু না। আমি আপনাকে বাস্তবটাই দেখাবো একদিন, ইনশাল্লাহ!”
হৃধি কথা বাড়ায় না। ত্বোহার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। উত্তাপময় দুপুর। ফুটপাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে হৃধি এবং মাহিন। গাছের পাতাগুলো অবাধ্য ভাবে উড়ছে। সেই হাওয়া দু’জনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সকালের দিকে শীত শীত অনুভূতি হলেও এখন বেশ গরম। মাহিন হৃধির থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আওড়ালো,
–“হাঁটতেও বেশ লাগছে হৃধি। আমার রিকশা ভাড়ার টাকাটা বেঁচে গেলো। ওটা দিয়ে আপনায় বাদাম খাওয়াবো ভাবছি!”
–“এই ভরদুপুরে আপনার জন্যে কেউ বাদাম নিয়ে বসে নেই! প্লিজ দূরত্ব বজায় রাখুন, বাবার পরিচিতরা দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।”
–“কেন ভয় পাচ্ছেন?”
–“হ্যাঁ পাই ভয়! একটা মেয়ের প্রতি পরিবারের বিশ্বাস উঠে গেলে তার জীবনটা মরিচিকার মতো কাটে।”
মাহিন চুপচাপ শুনে গেলো। হৃধি নিজের মুখে ওড়না জড়িয়ে এদিকে ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। মাহিন অবশ্য বেশ দূরত্ব রেখেছে৷ বোঝার উপায় নেই দু’জন দুজনের পূর্বপরিচিত। তাও আমরা বাঙালি! দু’জন মেয়ে ছেলে একসাথে থাকা মানেই তারা গার্লফ্রেন্ড – বয়ফ্রেন্ড! মাহিন অবশ্য সেই চেষ্টাতেই আছে। মাহিনের নিস্তব্ধতা ক্ষণিকের জন্যেই ছিলো। সে মুখে মাস্ক পরে বলতে লাগে,
–“যান, আমিও মাস্ক পরে নিলাম। আপনাকে একটা নিকাব কিনে দিবো!”
–“কেন?”
–“যাতে কেউ আপনাকে চিনতে না পারে। প্রেমিক হিসেবে আমি আপনার পাশাপাশি থাকবোই, এতে এলাকার মানুষদের তো দুনিয়ার সমস্যা। তাই ওটা ধরে নিন একটা সেফটি!”
–“প্রয়োজন নেই এবং আপনি আমার প্রেমিকও নন!”
–“আচ্ছা, হলাম না প্রেমিক। প্রেমময়ী পুরুষ তো হতেই পারি হৃধি?”
হৃধি এবারও নিরুত্তর। আজ কেন যেন ত্যাড়া জবাব দিতে পারছে না। জোর খাটিয়ে এটাও বলতে পারছে না চলে যেতে। মাহিন বেশ উপভোগ করতে হৃধির নিস্তব্ধতা। নিশ্চয়ই হৃধি অল্প অল্প করে মানতে শুরু করেছে তাকে। মাহিনের বক্ষঃস্থলে সুখের জোয়ার। কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে গেলো। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হৃধি বলে ওঠে,
–“ক্লাস ছিলো না আপনার?”
–“ছিলো তো!”
–“তাহলে ক্লাস ফেলে মারামারি করতে গেছিলেন কেন? গুন্ডাগিরি করার সখ হয়েছে নাকি?”
–“ওম্মা! যার জন্যে করলাম চুরি সেই বলছে চোর। তওবা তওবা! আপনি খুশি না হয়ে আমায় গুন্ডা উপাধি দিলেন?”
–“ভার্সিটি কী ওসব করার জায়গা?”
হাসলো মাহিন। নিঃশব্দে হেসে হাত দু’টো টানটান করে অস্ফুট স্বরে বলে,
–“আপনি আমার জীবনে আসার আগে এগুলো-ই বেশি করতাম আমি। আমার মুখের চাইতে হাত চলে বেশি! আপনার ক্ষেত্রে কিন্তু আমার মুখটাই চলে!”
–“রাজনীতির সাথে যুক্ত আপনি?”
–“আরে না, না! রাজনীতি করলে সিঙ্গার হবে কে?”
থমকে দাঁড়ালো হৃধি। মাহিনও থামলো। হৃধির অবাক চাহনি দেখে মাহিন আবারও বললো,
–“আমার এইম সিঙ্গার হওয়া হৃধি। আমিও জানেন আপনার মতোই ভাবি, এতোই যেহেতু আমার হাত চলে তাহলে রাজনীতিতে নাম লেখালে মন্দ হতো না।”
হৃধি আবার হাঁটতে লাগলো। মাহিন হৃধির পিছু নেয়।
–“তো ক্লাস কখন করেন আপনি? পরীক্ষায় কী দেন?”
–“পরীক্ষার জন্য পরীক্ষার আগের রাত-ই যথেষ্ট হৃধি। সারা বছর পড়ে যদি পরীক্ষার হলে সব ভুলে যাই তাহলে আমার বছরটা বৃথা গেলো। এন্ড ইউ নো হোয়াট, আমার সিক্সথ সেন্স বেশ প্রখর। কোনটা আসার চান্স আছে বা নেই সেটা রোপ করে ফেলি!”
–“আর ক্লাসের নোটগুলো? সেগুলো ব্যতীত নিশ্চয়ই আপনার পড়ার প্রতি আইডিয়া আসে না?”
–“ওটা মেনেজ হয়ে যায়। ক্লাসে গেলেও কী না গেলেও কী! আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আছে, সুমাইয়া। মেয়েটা লাইক করে আমাকে, মেয়েটার থেকেই অল নোট’স কালেক্ট করি!”
আবারও পা থমকে যায় হৃধির। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। গলাটাও অদ্ভুতভাবে কাঁপছে। মেয়েটার কথা শুনে এমন লাগছে কেন? মাহিন থেমে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
–“কী হলো হৃধি?”
–“কি..ছু না!”
মাহিন ভ্রু কুচকে তাকালো হৃধির দিকে। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বললো,
–“এনি হাউ, আপনি জেলাস হৃধি?”
থতমত খেয়ে যায় হৃধি। মাহিনের দু’চোখ তখন সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে হৃধির চোখ দু’টোতে। হৃধি ঘনঘন পলক ফেলে মাহিনের পাশ কাটিয়ে আবারও হাঁটতে লাগলো। মাহিন হাসলো। হেসে আবারও হৃধির দিকে ছুটলো।
–“গরমে কষ্ট লাগছে হৃধি? আপনার ব্যাগটি দিন, আমি বহন করছি!”
————————
আজ হৃধির কোচিং নেই। হৃধি সোফায় বসে টিভি দেখছিলো তৎক্ষনাৎ বিকট শব্দে বেজে ওঠে বিরক্তিকর কলিংবেল। হৃধির ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে গেলো। মাথায় ওড়না দিতে দিতে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হলো। দরজা খুলতেই রিনাকে দেখতে পেলো। রিনা সুড়সুড় করে ঢুকে পরলো। চোখ-মুখ থেকে বোঝা যাচ্ছে অনেক কষ্টে কথা চেপে আছে সে। ভেতরে ঢুকতেই রিনা তার জবান আর থামাতে পারে না। গড়গড় করে বলতে লাগে,
–“জানেন আপা! আইজ কী হইছে? কাশেম আমারে ফুল দিছে!”
মুহূর্তে-ই চোখে-মুখে তার লাল আভা ফুটে ওঠে। হৃধি কুচকানো ভ্রুযুগল আরও কুচকে গেলো।
–“তুমি না বিবাহিত রিনা?”
–“কী কন, এডি আফা? জামাইরে তো কবেই তিন তালাক দিছি। বেডায় পুরা গা’ঞ্জা’খু’র! মুখের সামনে আসতেই মুখ থেকে গড়গড় করে দুর্গন্ধ আসে। ওয়াক, থুঁ! কী বুইজ্জা যে আম্মায় এই বেডারে আমার গলায় ঝুলাইসিলো!”
হৃধি চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইলো রিনার দিকে। রিনা তার থেকেও ছোট হবে অবশ্য। তাও এই মেয়ের মুখ যেন মুখ না! আস্ত রেডিও। রিনা আবারও বলে ওঠে,
–“আমাগোও তো সখ হয় আফা, আমারে কেউ ফুল দিবো, ভালোবাসি কইবো। আর ওই বেডায় কী করলো? জুয়া আর গা’ঞ্জা নিয়া বইয়া থাকতো! রাইতে নেশা কইরা ফিরা খালি এইটুকুই কইতো ‘বউ কাছে আও’!!”
–“রিনা, থামো। অন্য টপিক বলো।”
–“ক্যান গো আফা, লজ্জা করে? লজ্জা কইরা তো লাভ নাই, আজ বাদে কাইল আপনার বিয়া হইয়া গেলে তো এইডি-ই হুনবেন। তাই আপনাকে আগে থেইকা টপস দিয়া দিলাম!”
–“রিনা!! বললাম না অন্য টপিক বলো, আর টপস কী?”
রিনা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
–“ওইযে একজন আরেকজন রে কয় না! ধুর, পেডে আছে মুখে নাই!”
–“টিপস বলতে চাইছো?”
–“হ, হ! ওইডাই! আরেকটা মজার কথা জানেন আফা? আমার পাশের ঘরের যে চা’মেলী আছে না, ওয় নাকি কোন বেডার লগে ভাগসিলো। পরে ওই বেডায় নাকি লাথি উষ্টা দিয়া পাঠায় দিসে। আমি তো শুনেই হাত দুলাইয়া দুলাইয়া নাচছি! হাহ্! আমার সাথে লাগা? এহন বুঝ মজা!”
–“হয়েছে, এখন যাও নিজের কাজ করো!”
রিনা গুনগুন করে গাইতে গাইতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। হৃধির কানে রিনার সেই একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আচ্ছা সে জায়গায় মাহিন থাকলে কী হতো?
হৃধি মুহূর্তে-ই দু’গালে কয়েক চড় মেরে নিজেকে শান্ত করলো। ছিঃ, কিসব আজেবাজে চিন্তা করছে সে? এই রিনাটাও না, মাথা পুরো খারাপ করে দেয়!
———————-
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এলাকার ছেলেরা মিলে ক্রিকেট খেলার আয়োজন করেছে। দল কীভাবে ভাগ হয়েছে হৃধির জানা নেই। তাঁরা আপু সকালেই বলে গেছিলো যেন তার সাথে খেলা দেখতে যায়। সেখানে নাকি বসার বেশ জায়গাও আছে। তবে সমস্যা একটাই, আজ হৃধির বাবা করিম উল্লাহ বাড়িতে আছে। তাই হৃধির কিঞ্চিৎ ইচ্ছে থাকলেও তা আপাতত মাটিচাপা দিয়ে রেখেছে।
জুম্মার নামাজের সময় করিম উল্লাহ বেরিয়ে গেলো মসজিদের উদ্দেশ্যে। মাইকে প্রতিধ্বনিত বয়ান চারপাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে। এই ভরদুপুরে হৃধির চা খাওয়ার ইচ্ছে হয়। তাই সে নিজ উদ্যোগে চা বানিয়ে প্রাণপ্রিয় বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। চায়ে চুমুক দিয়ে পথের দিকে তাকাতেই কিছুটা চমকালো। মাহিন পুরো পবিত্রভাবে মসজিদের দিকে ছুটছে। হাঁটার গতিবেগ কিছুটা দ্রুত, চারপাশে কোনো খেয়ালই নেই যেন। নিশ্চয়ই দেরী করে ফেলেছে, তাইতো এভাবে কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটছে। হৃধি অপলক নয়নে মাহিনকে দেখছে। নীল পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা, মাথায় কালো টুপি। কী অসাধারণ লাগছে। বাতাসে মাহিনের কড়া আতরের সুগন্ধিটা হৃধির নাকে এসে লাগলো। কী সুন্দর দেখাচ্ছে মাহিনকে। যেন সে একজন ম্যাচিওর, গম্ভীর ছেলে। অথচ হৃধির সামনে তার ব্যবহার দেখো, যেন কয়েক বছরের বাচ্চা! হৃধি আপনমনেই আওড়ালো,
–“মাহশাল্লাহ।”
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
#রঙিন_দূত – ১১
লাবিবা ওয়াহিদ
—————————
বিকালে করিম উল্লাহ হৃধির রুমে আসলেন। হৃধি তখন বারান্দায় বসে পথের দিকে তাকিয়ে। নামাজ পড়ে সবে বসেছে সে। রাস্তা দিয়ে সকলে বড় মাঠের দিকেই যাচ্ছে। হৃধি বেজার মুখে দেখছে সবটা। করিম উল্লাহ হৃধিকে রুমে না পেয়ে বারান্দায় আসলেন। মেয়ের দৃষ্টি পথের দিকে দেখে তার বুঝতে বাকি রইলো না মেয়ে কী চাইছে। করিম উল্লাহ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মেয়ের কাধে হাত রাখলেন। হৃধি চমকে তড়িৎ মাথা ঘুরায়। করিম উল্লাহ দাঁড়িয়ে। হৃধি হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“বাবা, তুমি?”
–“ক্রিকেট দেখতে যাবি?”
হৃধির চোখ-মুখে যেন খুশির ঝিলিক দেখা গেলো। হৃধি অধরে আনন্দের আভা ফুটিয়ে বলে,
–“সত্যি বাবা?”
করিম উল্লাহ মুচকি হেসে মেয়েকে আশ্বাস দিলেন। অতঃপর হৃধির উদ্দেশ্যে বলে,
–“তুই তৈরি হয়ে আয়, আমি নিচে টঙে গিয়ে বসছি!”
–“আচ্ছা বাবা!”
করিম উল্লাহ চলে গেলো। হৃধি আনন্দ সহিত নতুন এক কামিজ সেট পরে মাথায় হিজাব বেঁধে নেয়। সন্ধ্যার দিকে কিছুটা শীত শীত অনুভূত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাই হৃধি হিজাব-ই বাঁধলো। বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পূর্বে রাবেয়া খাতুনের থেকে বিদায় নিয়ে আসলো। বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা। হৃধি মুখে হাত দিয়ে টঙের কাছাকাছি আসতেই করিম উল্লাহ বসা থেকে উঠে দাঁড়ান এবং বেরিয়ে আসেন। সেই ছোটবেলার মতো হৃধির এক হাত ধরে হাঁটতে লাগলো৷ এ যে কী নরম অনুভূতি তা হয়তো প্রকাশ করা অসম্ভব। হৃধির অধরে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। হৃধি যেন ছোটবেলায় ফিরে গেছে। করিম উল্লাহ হাঁটতে হাঁটতে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
–“মনে আছে তোমার মামুনি? তুমি আমার হাত ছেড়ে তোমার মায়ের হাত ধরতে না। হাত ছাড়লেই তোমার সে কী জেদ!”
হৃধি স্মিত হাসলো। হৃধি ছোটবেলায় ভিষণ জেদী এবং বাবা পাগল ছিলো। বুঝ হওয়ার পর থেকে-ই কোমল এবং শান্তশিষ্ট হয়েছে। বুঝটা হয়েছেও তার দেরীতে। বাবা-মায়ের অতি আদরের একমাত্র ছেলে-মেয়ে নাকি বাঁদরে পরিণত হয়। এই বাক্যটি হৃধি কখনোই নিজের সাথে মেলাতে সক্ষম হয়নি। তবে আদরের হলেও বেশ শাসনও করে৷ এসএসসি দেয়া অবধি রাবেয়া খাতুন প্রতিদিন হৃধিকে নিয়ে যেতেন এবং ফিরতেন। এক মুহূর্তের জন্যেও হৃধিকে তারা একা ছাড়তেন না। কলেজ জীবনে অল্প স্বাধীনতা পেয়েছিলো হৃধি। ভার্সিটি জীবনে এসেই হৃধি পুরোপুরি স্বাধীনতা পেয়েছে। করিম উল্লাহ মেয়ের সাথে ছোটবেলার স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে মাঠে এসে পৌঁছালেন। মাঠে প্রবেশ করার গেটেই নানান ফেরিওয়ালার ভীড় জমেছে। কেউ বাদাম বিক্রি করছে, কেউ ভাঁজাপোড়া, কেউ চা বা কফি, আবার কেউ মুরুলি নিয়ে। এক জায়গায় হৃধি দেখলো চুড়ির ফেরিওয়ালাও এসেছে। হৃধি কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে রয়। করিম উল্লাহ মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
–“ভেতরে চলো মামুনি!”
হৃধির ধ্যান ভাঙ্গে। নিজেকে সামলে মুচকি হেসে বাবার সাথে ভেতরে চলে গেলো। মাঠের পাশ দিয়ে বেশ কিছু বেঞ্চ রাখা হয়েছে। মুরব্বিরা ছাড়াও, ছোট ছেলেরা, যুবতী, কিশোরীদের ভীড় জমেছে। করিম উল্লাহ এই ভীড়ে মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে সিট খুঁজে চলেছেন। হৃধিও এদিক সেদিক খালি বেঞ্চ খুঁজে চলেছে। হঠাৎ হৃধি দেখলো মাহিনের দু’জন বন্ধুকে। সেই বন্ধু’রা হৃধিকে বেশ ভালো করেই চিনে। হৃধি ওদের দেখতেই যেন তার মাথায় বাজ পরলো। হে মাবুদ, এরা যদি উল্টো পাল্টা কান্ড ঘটিয়ে ফেলে? হৃধি ওদের থেকে নিজেকে আড়াল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু এতকিছুর পরেও ওরা ঠিকই হৃধিকে চিনে ফেলে। একজন আবেগে আপ্লুত হয়ে ‘ভাবী’ বলে চিৎকার দেয়ার পূর্বেই পাশেরজন তার মুখ চেপে ধরলো। পাশেরজন ছেলেটার কানে ফিসফিস করে হৃধির বাবা অর্থাৎ করিম উল্লাহ’র দিকে ইশারা করলো। ছেলেটা বুঝতে পেরে চুপ মেরে গেলো। করিম উল্লাহ এবং হৃধি ওদের ক্রস করতেই বন্ধু দু’জন উঠে দাঁড়ায় এবং হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“আঙ্কেল, আপনি চাইলে বসতে পারেন, আমাদের সিটে!”
করিম উল্লাহ ভ্রু কুচকে তাকালেন। দুই বান্দাই মুখে ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে রেখেছে। করিম উল্লাহ ওদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বললো,
–“প্রয়োজন নেই। সাধার জন্য ধন্যবাদ!”
পাশেরজন বলে ওঠে,
–“আমরা সাধছি না আঙ্কেল, আমরা বাহিরে যাচ্ছিলাম তো! আমাদের আর বসার প্রয়োজন নেই। আপনি বসতে পারেন। সিফাত, চল!”
বলেই দু’জন কেটে পরে৷ করিম উল্লাহ ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মেয়েকে নিয়ে ওখানেই বসলো। করিম উল্লাহ কিছুটা হেলান দিয়ে বলে,
–“যাক, এতক্ষণে বসতে পারলাম৷ ছেলেগুলোর আক্কেল আছে বলতে হবে!”
হৃধি নিজের জামা দু’হাতে খামচে ধরে মিনমিন করে বলে,
–“এর পেছনের কাহিনী জানলে তুমি সর্বপ্রথম জু’ তা মারতা!”
হৃধি যেখানে বসেছে তার ঠিক উল্টো দিকেই মাহিনদের টিমের চেয়ার। ওখানে প্লেয়ারদের জন্যে চেয়ার পাতা হয়েছে। মোটকথা, মাঠের উত্তর দিকে হৃধি বসে আর দক্ষিণ দিকে মাহিন। মাহিন সবেই টিমের সাথে মিলিয়ে জার্সি এবং টাউজার পরে এক চেয়ারে বসেছে। মাইকিং এ ডাকলে সব প্লেয়ার একত্রিত হয়ে মাঠে নামবে। টিমের ক্যাপ্টেন গিয়েছে টস করতে। মাহিন দুই ঢক পানি খেয়ে বোতলের মুখটা লাগাতেই হৃধিকে দেখতে পায়। হৃধি হাসছে, প্রাণখুলে হাসছে। মাহিন যেন সেই হাসিতেই মাতাল হলো। সম্মোহনী দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। হৃধিকে একদমই আশা করেনি মাহিন। মাহিনে বাম পাশে বসেছে শাফীন এবং ডানপাশে রাফিদ, সাব্বির। ওরা চারজন একই দলে। মাহিন যখন হৃধিকে দেখতে ব্যস্ত তখনই দুই বন্ধু ভীড় ঠেলতে ঠেলতে মাহিনের কাছে এসে পৌঁছালো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–“দেখ বন্ধু, ভাবী আর তোর শ্বশুড়ের জন্যে আমাদের বসার জায়গা ফেলে আসছি। এখন কী পুরা ম্যাচ দাঁড়িয়েই দেখবো?”
–“দেখ সমস্যা কোথায়? ভাবীর জন্যে এটুকু তো সেক্রিফাইজ কর!” সাব্বির বলে ওঠে।
–“এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা আদৌ সম্ভব?”
মাহিনের ধ্যানে ব্যঘাত ঘটায় চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে বিরক্তির স্বরে বলে,
–“তোরা কোনো মহারাজাও না যে সিংহাসনে বসে খেলা দেখতে হবে। দাঁড়িয়ে থাকতে যখন এতোই সমস্যা মাটিতে বসে দেখ। মাটিতে বসার জন্যে এনাফ স্পেস আছে!”
মাহিনের এরূপ উক্তিতে দুই বন্ধু মুখ বাঁকালো। মিনমিন করে বললো,
–“এই কষ্টের ফল কী দিবি না?”
–“দোয়া দিবো, যাতে শীঘ্রই তোদের কোলবালিশের পাশে বউ চলে আসে!”
বলেই মাহিন উঠে দাঁড়ালো। শাফীন, রাফিদ, সাব্বির তো ফিক করে হেসে উঠলো। অবশেষে খেলা শুরু হলো। মাহিনদের টিম ব্যাটিং এ নেমেছে। হৃধি এদিক ওদিক তাকিয়ে মাহিনকে খুঁজতে ব্যস্ত। কিন্তু যা ভীড়, দম আটকে যাবার মতোন অবস্থা। খেলা জমজমাট চলছে। হৃধির খোঁজাখুঁজির মাঝেই তার ফোন টুং শব্দ করে উঠলো। হৃধি ফোনে তাকালো। মাহিনের এসএমএস!! হৃধি তড়িৎ তার বাবাকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। করিম উল্লাহ এখন খেলা দেখতে ব্যস্ত। হৃধি চট করে মেসেজটা ওপেন করলো,
–“মিস করছেন বুঝি? সামনে তাকান, আমি আপনার বরাবরই আছি!”
হৃধি তড়িৎ সেদিকে তাকালো। মাহিন এক হাতে ফোন নিয়ে হৃধির দিকেই তাকিয়ে। মাঝে বিরাট দূরত্ব থাকলেও হৃধি বেশ বুঝতে পারলো। হৃধি সিন করে রেখে দেয় এবং খেলা দেখতে মনোযোগী হয়। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। দুই’জন ইতিমধ্যেই আউট হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ হৃধির ফোনে পুণরায় মেসেজ টোন বেজে ওঠে। হৃধি চেক করলো,
–“চা খাবেন হৃধি?”
করিম উল্লাহ পাশ থেকে বলে ওঠে,
–“কিছু খাবে মামুনী?”
হৃধি ফোনে টাইপ করতে করতে বলে,
–“চা খাবো বাবা!”
–“বেশ!”
করিম উল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। হৃধির পাশে একটা মেয়েকে বসতে বলে তিনি ভীড় ঠেলে চলে গেলেন। হৃধির ততক্ষণে সম্বিৎ ফেরে। কী বললো সে তার বাবাকে? হৃধি নিজ কপালে চাপড় মারলো। মাহিনের কল এলো। হৃধি মাথা উঁচু করে মাহিনকে লক্ষ্য করতেই কলটা রিসিভ করলো,
–“আপনার কারণে আমি বাবাকে ভুলভাল বলেছি!”
–“কী বলেছেন? আর আমি-ই বা কী করলাম? আমি তো দূরত্বেই বসে!”
–“কিছু না, বাদ দিন!”
–“আপনাকে সামনা-সামনি দেখতে ইচ্ছে করছে হৃধি!”
–“দেখছেন-ই তো!”
–“শ্বশুর মশাই কোথায় গেলো হৃধি? আপনি একা বসে কেন?”
–“এমন ভাবে বলছেন যেন আমায় কেউ চুরি করবে?”
হাসলো মাহিন। সেই হাসি অপরপাশের হৃধিও শুনতে পায়। মাহিন কোমল স্বরে বলে,
–“আপনি মানুষটাই এমন, যে কোনো সময় চুরি হয়ে যেতে পারেন। তাইতো আমার এতো সাবধানতা অবলম্বন করা।”
মাহিনের এরূপ উক্তিতে হৃধির গাল জোড়া কেমন গরম হয়ে গেলো। দৃষ্টি নত করে ফেললো হৃধি। অজানা অনুভূতিতে তার সবার্ঙ্গ শিহরণে দোল খাচ্ছে!
–“লজ্জা পাচ্ছেন হৃধি?”
–“ক..কই?”
–“আমার মনোদৃ্ষ্টি যে তাই বললাও হৃধি। আপনার লাল হওয়া মুখটাই যে আমার কল্পনার পর্দায় ভেসে উঠলো!”
–“আশেপাশে কেউ নেই আপনার? এসব বলে লজ্জার মাথা খাচ্ছেন কেন?”
–“আমার ধরনীর বুকে আপনি আছেন হৃধি, আশেপাশের মানুষের কী দরকার? আমি যে চারপাশে শুধু একজন আপনি কেই দেখি!”
হৃধি খট করে কল কেটে দিলো। হৃদপিন্ড ক্রমাগত ঢিপঢিপ শব্দ করেই চলেছে, থামার নাম নেই। হৃধি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। তখনই উইকেট পরলো। এবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাহিন নামলো ব্যাটিং এ। হৃধির সম্পূর্ণ দৃষ্টি তখন মাহিনেই। হৃধির ভাবনায় ছেদ ঘটালো মাহিনের সেই বন্ধুদের মধ্যে একজন। হৃধি সেদিকে তাকালো। ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাতে একটা কফি এর ওয়ানটাইম কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে। হৃধির দিকে তাকিয়ে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“আপনার অর্ডারকৃত কফি, ম্যাডাম!”
হৃধি আশেপাশে তাকালো। কয়েকজন মেয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে। হৃধি কিছুটা অস্বস্তিতে পরলো। অস্বস্তির সাথে কফিটা নিলো। তখনই আরেক মেয়ে বলে ওঠে,
–“ভাইয়া, আমায় এক কাপ কফি দিন তো!”
ছেলেটা কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেয়েটির দিকে। তাকে কোন আক্কেলে কফি বিক্রেতা মনে হয়? সিফাত এক ধমক দিয়ে বলে,
–“স্বাধ লাগলে বাইরে থেকে কিনে এনে খান! আমি আপনার গোলাম না!”
বলেই আবারও ভীড় ঠেলতে ঠেলতে চলে গেলো। মেয়েটা বেক্কলের মতো সিফাতের যাওয়া দেখলো। হৃধিও সমানভাবে অবাক। নিশ্চয়ই এসব মাহিনের কর্ম?
~চলবে, ইনশাল্লাহ।