রঙিন_দূত – ২৬,২৭

0
383

#রঙিন_দূত – ২৬,২৭
লাবিবা ওয়াহিদ
২৬
——————————-
সেদিন বৃষ্টিতে ভেঁজার পর হৃধির হাড় কাঁপিয়ে জ্বর ওঠে। জ্বরে দু’দিন ছিলো শয্যাশায়ী। তীব্র জ্বরে অনেক দুঃস্বপ্নও তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। রাবেয়া খাতুন তো মেয়ের পাশ থেকে একদমই নড়তেন না৷ মেয়ে ঘুমিয়ে গেলে রান্না সারতেন। রাতে করিম উল্লাহ ফিরলে মেয়ের পাশেই বসে থাকতেন। মেয়ের এমন অসুস্থতায় তিনি বড্ড চিন্তিত। হৃধি ঘুম থেকে উঠলে নিজের মাকে পাশে এবং বাবাকে মাথার কাছে ঘুমিয়ে থাকতে দেখতো। এতো যত্ন-আত্তি দেখলে হৃধির নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে হতো। করিম উল্লাহ তার করা ভুলের পর থেকে মেয়েকে বর্তমানে চোখে হারান। আগের মতো কড়া শাসন হৃধির উপর খাটানো তো দূর উল্টো “মামুণি” ব্যতীত বাবার মুখে কিছু শুনেনি হৃধি। প্রথম কয়েকদিন মেয়ের জন্যে রাবেয়া খাতুন করিম উল্লাহ’র সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেও মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে তিনি স্বাভাবিক হন। রাবেয়া খাতুন মেয়েকে যতোই মারুক, বকুক না কেন, হৃধি তার একমাত্র সন্তান। এই এক সন্তানের জন্য কতো রাত এক করে সিজদাহে কেঁদে ভাসিয়েছে সেটা একমাত্র উনি-ই জানেন।

হৃধির শরীরটা এখন বেশ হালকা লাগছে। জ্বরের প্রকোপ নেই বললেই চলে। ঘাম ঝড়েনি, যেহেতু শীতকাল। মাথায় ঘোমটা দিয়ে গায়ে শালটা নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিলো। অগ্রসর হয় প্রাণপ্রিয় বেলকনির উদ্দেশ্যে। বেলকনি অবহেলায় কেমন প্রাণহীন লাগছে। যত্ন নেই, এলোমেলো, অগোছালো। যদি রাজ্যের বাদশাহ অসুস্থ থাকে তাহলে প্রজাদের কে খেদমত করবে? হৃধি ব্যতীত কেউ-ই তার বেলকনির যত্ন করে না। বলা বাহুল্য কারো খেয়াল থাকে না। তারা কম তো ছুটেনি হৃধির পিছে। হৃধি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বেলকনি আগামীকাল-ই পরিষ্কার করবে ভেবে নিলো। এখন দেহ বড্ড দুর্বল। নিজেকে সতেজ করতে দমকা হাওয়ায় চোখ বদ্ধ অবস্থায় কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেললো। মুহূর্তে-ই বক্ষঃস্থলের তিক্ততা সরে প্রশান্তি’রা ভীড় করলো। এই প্রশান্তির অপেক্ষাতেই যেন ছিলো হৃধি। হঠাৎ বাহিরে কোলাহল শুনতে পেলো। চেঁচামেচি করতে করতে হাঁটছে। অনেকের হাতে আঁতশবাজিও দেখা যায়। হৃধি বুঝলো না এসবের কারণ। ভেবে-চিন্তে ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে পরলো, আজ তো থার্টি ফার্স্ট নাইট! অর্থাৎ হ্যাপি নিউ ইয়ার! অসুস্থতার কারণে হৃধির মাথা থেকেই যেন বিষয়টি বেরিয়ে গেছিলো।

কী একটা ভেবে হৃধি বেলকনি থেকে ফিরে আসলো। উদ্দেশ্য এখন ছাদ। অন্যান্য সময়ে ছাদ ফাঁকা থাকলে এখন ছাদ ভর্তি মানুষ থাকবে, সে বিষয়ে হৃধি নিশ্চিত। হৃধি মাথায় ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে গায়ে প্রথমে একটি লেডি জ্যাকেট জড়িয়ে নেয়। অতঃপর জ্যাকেটের উপর শাল। ছাদে এই মাঝরাতে বেশ শীত-ই অনুভূত হবে। হৃধি রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। রাবেয়া খাতুন এবং করিম উল্লাহ তাদের নিজেদের ঘরে ঘুমোচ্ছেন। আজ মেয়ের শারীরিক অবস্থার উন্নতি দেখে দু’জনই নিজেদের ঘরে ঘুমোতে যান। হৃধি বাবা-মা কাউকে না জানিয়ে আলতো করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি ওঠা-নামার ধুপধাপ শব্দ কানে আসছে। হৃধি ধীর পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। বাচ্চাদের ক্ষীণ চেঁচামেচিও শ্রবণ হয়। ছাদে আসতেই যেন ঠান্ডা হাওয়া হুড়মুড় করে হৃধিকে ছুঁয়ে যায়। তবে শীত খুব একটা অনুভূতি হলো না। সে যে পূর্বেই উষ্ণ কাপড় গ্রহণ করেছে।

হৃধি ঘনবসতির দিকে না গিয়ে বড় গাজী টাংকির পিছে গিয়ে বসলো। এখানে তাকে কেউ দেখবে না, চিনবে না। হৃধি নিশ্চুপ হয়ে আকাশের বুকে আঁতশবাজি এবং ফানুস উড়ানো দেখবে। নিজের দুর্বল চাহনিতে একরাশ মুগ্ধতা এনে সেসব উপভোগ করবে। বারোটা বাজতে এখনও মিনিট দশেক বাকি। হৃধি সেভাবেই বসে বিশাল আঁধারে গ্রাস করা আসমানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলো। পরমুহূর্তে নিজের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেলো। আগন্তুকটি ঠিক তার পাশেই বসলো। হৃধি চমকে পাশে দৃষ্টি দিলো। মাহিন নির্বিকার ভাবে তার পাশেই বসে। হৃধি মাহিনের দিকে তাকাতেই মাহিন হৃধির দিকে তাকালো। ক্ষণিকের মধ্যে দু’জোড়া চোখ, দু’জোড়া আত্মার পরিচয় ঘটলো। আবছা আলোয় মাহিনের সেই দৃষ্টিতে অধিক ব্যাকুলতা দেখতে পেলো হৃধি। আজ প্রায় তিন দিন হলো মাহিন তার অদেখা। কথাও হয়নি, অসুস্থতার কারণে। হৃধির এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো তার মধ্যকার অজানা শূণ্যতা মুহূর্তে-ই বিলুপ্ত হয়ে যায়। মাহিন পলকহীন দৃষ্টি হৃধির সেই দুর্বলতায় মাখা আঁখি জোড়ার দিকে দিয়ে মাদক মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
–“অনুভব করতে পারছেন? আমার এই বক্ষের শূণ্যতা? আপনাকে দেখে আমার বক্ষঃস্থল যেন পুণরায় পূর্ণতায় ভরে গেলো। অসুস্থতা এত পাজি কেন? তার এতো দুঃসাহস, মাহিনের থেকে তার বোকারাণীকে দূরে রেখেছে!”

শেষোক্ত বাক্যে যেন মাহিনের একরাশ অভিযোগ ফুটলো। হৃধি দৃষ্টি নামিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলো। কিছক্ষণের মাঝে মাহিন হুট করে হৃধির থুঁতনি ধরে হৃধির মুখশ্রী নিজের দিকে ফেরালো। হৃধি তখন অতি বিষ্ময়ের সাথে মাহিনের দিকে গোল গোল চোখে তাকালো। মাহিন সন্তর্পণে হৃধির কপালে নিজের হাতের উল্টোপিঠ ছুঁয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। অতঃপর কী একটা ভেবে হাত হাত সরিয়ে নেয়।
–“যাক, জ্বর খুব একটা নেই। এখন কেমন লাগছে? এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসলেন যে?”
–“ভালো লাগছিলো না।” হৃধির সহজ স্বীকারোক্তি!
–“ভালো লাগছিলো না নাকি আমাকে দেখার জন্যে ব্যাকুল ছিলেন? একটা মেসেজ করতেন একসাথেই ছাদে আসতাম!”
মাহিনের দুষ্টি কন্ঠস্বর। হৃধি পুণরায় চমকে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের অধরে এঁটে থাকা হাসিটা হৃধির বুঝতে অসুবিধা হলো না। হৃধি চোখ রাঙানোর চেষ্টা করে আওড়ায়,
–“মোটেও না!”
–“আচ্ছা বুঝলাম। সময় তো বেশি নেই, চলুন একসাথে ফানুস উড়াই, আমার কাছে দুটো আছে!”

হৃধি মাহিনের আবদারে ঠাই বসে থাকতে পারলো না। উঠে যেতেই ওড়নায় টান খেলো। সেই টানের তাল সামলাতে না পেরে হৃধি গিয়ে পরলো মাহিনের কোলে। মাহিনও অপ্রস্তুত ভাবে হৃধির কোমড় জড়িয়ে ধরলো। মাহিনও বুঝতে পারেনি তার এই টানটা এতো জোড়ালো হয়ে যাবে। আর হৃধিও বুঝতে পারেনি এভাবে সে মাহিনের আলিঙ্গনে লিপ্ত হবে। কোমড়ে শীতল স্পর্শ পেতেই হৃধির সবার্ঙ্গ অসম্ভব রকম কাঁপতে থাকলো। একপ্রকার হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেললো সে। ফ্যালফ্যাল করে মাহিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মাহিনের দৃষ্টিতেও অস্থিরতা, চমক স্পষ্ট। দু’জন হতবুদ্ধি হারিয়ে সেভাবেই রইলো কিছুক্ষণ। মাহিনের হুঁশ আসলো হৃধির থরথর করে কম্পিত অধর জোড়ার দিকে চেয়ে। মাহিনের এই নিষিদ্ধ চাহনিতে হৃধিরও ধ্যান ভাঙলো। সে একপ্রকার লাফিয়ে দূরে সরে আসলো। নিঃশ্বাস প্রচন্ড ভার হয়ে এসেছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে অবিরত। মনে হচ্ছে যেন দমটা এখনই আটকে যাবে হৃধির। লজ্জায় গাল, মাথা ভার হয়ে আসছে। মাথা চক্করও দিয়েছে কয়েকবার। এ কেমন অনুভূতি?

মাহিন চটজলদি উঠে বিচলিত ভঙ্গিতে হৃধির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“স্যরি, স্যরি! টানটা এতো জোড়ালো হয়ে যাবে আমি সত্যি বুঝতে পারিনি!”

হৃধি কিছু বলার পূর্বেই চেঁচামেঁচির শব্দ সহ আঁতবাজির শব্দ শোনা গেলো। এর মানে নতুন বছরের আগমন ঘটেছে? দু’জনই টাংকির পেছন থেকে বেরিয়ে আসলো। হৃধি তো সব ভুলে মুগ্ধতার সাথে আকাশের বুকে আঁতশবাজির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। এর মাজে শাফীন ভিডিও করতে করতে মাহিনের কাছে আসলো,
–“কী রে ভাইয়া! ফানুস উড়াবি না? ভাবী যেহেতু আছে একসাথেই উড়া!”

শাফীনের মুখে “ভাবী” সম্বোধন শুনে হৃধির সর্বাঙ্গ পুণরায় শিউরে উঠলো। ভাবী ডাকটি যেন হৃধির হৃদয়ে গভীর ভাবে দাগ কাটলো। এ অজানা অনুভূতির সঙ্গে হৃধি পূর্ব পরিচিত নয়। মাহিন তো হৃধির মুখশ্রী দেখে তার ভাব-ভঙ্গি বুঝতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পূর্বে যা কান্ড ঘটলো হৃধি কী রাজি হবে? মাহিনের ইচ্ছে হলো নিজের গালে ঠা’টি’য়ে এক চড় মারতে। কী করে এমন ভুল করতে পারলো সে?

দুজনের মধ্যে কারো কোনো ভাবান্তর না দেখে শাফীন নিজেই ফানুসে আগুন জ্বালিয়ে মাহিন এবং হৃধিকে একপ্রকার জোর করে ধরিয়ে দিলো। এবার হৃধির অস্বস্তি, জড়তা যেন হাজার গুণে বেড়ে গেলো। জীবনে প্রথম ফানুস উড়াবে তাও মাহিনের সাথে? হৃধি উপলব্ধি করলো তার হাঁটু জোড়া অসম্ভব কাঁপছে। হৃধি এই কাঁপাকাঁপি নিয়েই মাহিনের সাথে বিশাল আকাশে ফানুসটি উড়িয়ে দিলো। ফানুসে লাগানো আগুনের স্নিগ্ধ আলোয় হৃধির স্নিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে মাহিন পুরোটা সমিয় তাকিয়ে রইলো। এক পলকের জন্যেও যেন চোখ ফেরাতে পারলো না সে। হৃধি এবং মাহিনের অজান্তেই শাফীন তাদের এই মুহূর্ত গুলো ক্যামেরা বন্দি করে ফেললো।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

#রঙিন_দূত – ২৭
লাবিবা ওয়াহিদ

—————-
কেটে যায় প্রায় মাস খানেক। সেই ঘটনার পর হৃধি প্রথম দিকে মাহিনকে বেশি ইগনোর করে চলতো। বলা বাহুল্য সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হৃধির মস্তিষ্কে বাজে ভাবে গেঁথে গেছে। যখনই সে অনিচ্ছাকৃত মাহিনের সামনে পরতো তার মস্তিষ্কে তখন চাড়া দিতো সেই ঘটনা। এতে হৃধি পারতো না লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে পরতে। মাহিন তার সামনে অবস্থান করলেও বিনা-বাক্যে তার হৃদপিন্ড অসম্ভব বেগে চলতে শুরু করে। যার ফলে হৃধি অপ্রস্তুত, বিচলিত ভঙ্গিমায় মাহিনকে এড়িয়ে চলতো। হৃধির সেই আঁখিযুগলে স্পষ্ট অস্বস্তি, জড়তা উপলব্ধি করতো মাহিন। তাই দিন কয়েকের জন্যে তাকে স্পেস দিয়েছিলো। কিন্তু মাহিন তো মাহিন-ই! সে কতদিন দূরে থাকবে তার বোকারাণীর থেকে? তাইতো পুণরায় হৃধিকে ধমকিয়ে আবারও নিকাব পরানো শুরু করে। হৃধি মাহিনকে ভার্সিটি টাইমে না দেখলেও কোচিং থেকে ফেরার সময় মানুষটিকে ঠিকই দেখে। রোজ হৃধি বাসে করে তার সাথেই ফিরে। হৃধি এখন তাকে আর মেজাজ দেখায় না। হৃধি যেন মাহিনের এই সঙ্গ নিবিড়ভাবে উপভোগ করে।
তবে আজকাল মাহিনের মুখশ্রীতে আগে চঞ্চলতা প্রকাশ পেলেও এখন প্রকাশ পায় একরাশ ক্লান্তি। হৃধি জানে না তার এই ক্লান্তির কারণ। হৃধি আন্দাজ করতে পারে না, আবার মাহিনকেও জিজ্ঞেস করতে পারে না। এক মহা দোটানায় ঝাপ দিয়েছে যেন। এছাড়া মাহিনও তাকে নিজ থেকে কিছু বলেনি। তাইতো হৃধির মন-গহ্বরে এতো খুঁচখুঁচে!
আজ হৃধি কোচিং এর সামনে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছিলো মাহিনের। মাহিন এলো এক রিকশা করে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে হৃধির সামনে এসে দাঁড়ালো। হৃধি তো মাহিনের দর্শন পেতেই নিকাবের আড়ালে এক গাল হাসলো। এখন কেন যেন মাহিনের জন্যে তার অপেক্ষা করতেও ভালো লাগে। মআহিন হৃধির সামনে এসে এক কান ধরে বেশ দুষ্টু কন্ঠস্বর নিয়ে আওড়ায়,
–“সরি, বেশি দেরী করে ফেললাম না তো?”

হৃধি পুণরায় হাসলো। নিঃশব্দে হাসলো। হৃধির ইচ্ছে করছে মাহিনের এলোমেলো চুলগুলোকে হাত দ্বারা আরও এলোমেলো করে দিতে। লাল হওয়া নাকটা টেনে দিতে! হৃধি মাথা উঁচু করে শুধু মাহিনকেই দেখছে। মাহিনও ততক্ষণে কান ছেড়ে হৃধির দৃষ্টি জোড়ার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রয়। সেই দৃষ্টি জোড়া যে হাসছে, তা মাহিনের বুঝতে বাকি নেই। নিজের সামনের চুলগুলো হাতের সাহায্যে পেছনে নিয়ে হুট করে হৃধির চোখের পাশে নিকাব ঠিক করে দিলো। এতে হৃধি চমকালো, ভড়কালো। মাহিনের উষ্ণ স্পর্শে তার হাত-পা যেন বরফের ন্যায় জমে উঠলো। হৃধি শক্ত করে আঁখিযুগল বন্ধ করে ফেললো। মাহিন ফিক করে হেসে ফেললো হৃধির এমন কাঁপা-কাঁপিতে। সামান্য ছুঁতেই মেয়েটা কেমন লজ্জাবতীর মতো নুইয়ে পরছে। মাহিনের হাসির শব্দে হৃধি চট করে চোখ মেলে তাকালো। ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টা করলো মাহিন কেন হাসছে। মাহিন তার হাসি থামিয়ে ফেললেও অধরে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে আওড়ায়,
–“চলুন, আজ রিকশায় চড়ে ঘুরবো, টঙে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চা পান করবো। সব খরচ আমার তরফ থেকে। মোটকথা, আজকের দিনটায় আপনাকে বিশেষ ভাবে চাই হৃধি!”

মাহিনের চোখে-মুখে আবদারের গভীর ছায়া নেমেছে। আকুতিভরা আঁখিযুগল তাকে বারংবার রাজি হতে বলছে। হৃধি কী করে পারে ছেলেটার আবদারে তাকে বারণ করে দিতে? হৃধির যে সেই কলিজাটুকু নেই৷ আগে বুকে সাহস ছিলো, তাইতো মাহিনের মুখের উপরই অমত জানাতো। কিন্তু আজ যে বক্ষঃস্থলে অনুভূতি আছে। এই অনুভূতি-ই যে তাকে মাহিনের প্রতি সহজ করেছে৷ চাইলেও পারবে না সে, কঠিন হতে! হৃধি মাথা নুইয়ে হাত কচলাচ্ছে। মাহিন তার দিকে এক বুক আশা নিয়ে তাকিয়ে। হৃধি এদিক সেদিক তাকিয়ে আপনমনে বলে ওঠে,
–“এখন এদিকে রিকশা কোথায় পাবেন শুনি? আমি তো দেখছি না!”

হৃধির ঘুরানো পেঁচানো কথায় হৃধি মতামত মাহিন নিজেই বুঝে নিলো। ভেতর থেকে এক সহস্র প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেলো। এ যে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান। মাহিন বুঝে নিলো তার বোকারাণীর অপেক্ষা শীঘ্রই ঘুচবে। কিন্তু মাঝে যে আরেক সমস্যা দাঁড়িয়ে। মাহিন এ মুহূর্তে কোনো সমস্যার চিন্তা মাথায় আনতে চাইলো না। সময়টি একান্ত তার এবং হৃধির।

———————-
পাশাপাশি হাঁটতে দুজন কপোত-কপোতী। ফুটপাত ধরে অবলীলায় হেঁটে চলেছে দু’জন। এখান অন্য শহরে বিচরণ করছে দু’জন। তাইতো পাশাপাশি হাঁটার মতো ভয় নেই, সংশয় নেই, ভাবনা নেই। রিকশা পাচ্ছে না দেখে হাঁটা শুরু করে। ফুটপাতের সারি সারি গাছ ছায়া দিয়ে পথটিকে আরও স্নিগ্ধ এবং শীতল করেছে। দু’জনের মনেই চলছে উথাল-পাথাল ঝড়। সেই ঝড় অনুভূতির, সেই ঝড় পাশাপাশি হাঁটার ব্যাকুলতা। দু’জনের মাঝে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা চলছে। মাহিন তো বেশ কয়েকবার ঘাড় বাঁকিয়ে তার বোকারাণীকে দেখে নিয়েছে। হৃধি মাহিনের চাহনি উপলব্ধি করলেও একবারের জন্যেও লজ্জার মাথা খেয়ে তাকাতে পারলো না। আপাতত ওই দু’টি চোখে তাকে খুন করার বিষ আছে। সেই বিষে সে কিছুতেই মরতে চায় না।
হাঁটার মধ্যে নিরবতা ভাঙলো মাহিন।
–“আচ্ছা হৃধি? আপনার ভ্যালেন্টাইন পছন্দ নাকি বসন্ত?”

হৃধি তড়িৎ ঘাড় বাঁকিয়ে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের দৃষ্টি সোজা পথে। হৃধি পুণরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মিনমিন স্বরে বলে,
–“বসন্ত। কেন?”

মাহিন উত্তর দিলো না, শুধু হাসলো। মাহিনের নিরবতা হৃধি পছন্দ না করলেও সে নিশ্চুপ থাকলো। আরও মিনিটখানেক হাঁটার পর ওরা টঙ দেখতে পেলো। মাহিন হৃধিকে নিয়ে সেখানেই গেলো৷ টঙে বসা লোকটি স্মিত হেসে বললো,
–“চা খাবা নাকি রুটি?”
–“আপাতত দু’কাপ চা দিন। এই চা-তে যেন আলাদা অনুভূতি পাই!”

হৃধি তড়িৎ মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের দৃষ্টি হৃধির উম্মুক্ত চোখ-দুটোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। হঠাৎ হৃধি লজ্জা পেলো, ভিষণ লজ্জা। লোকটি কী বুঝে হেসে দিলো। অতঃপর সম্মতি জানিয়ে বললো,
–“অপেক্ষা করো, বানাই দিতাছি!”

হৃধি ভিষণ অস্বস্তি এবং লজ্জা নিয়ে তার পেছনে অবস্থিত কাঠের বেঞ্চিটির উপর বসে পরলো। গালদুটোর চামড়ায় যেন কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। যার কারণে গাল এমন ভার লাগছে, উষ্ণ হয়ে আছে। নিকাবের ভেতরে হাত নিয়ে গালে হাত রাখলো সে। হ্যাঁ, প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। এতো লজ্জা তার আসে কোথা থেকে? কেন মাহিনের কথাবার্তায় তার হৃদপিন্ড অসম্ভব রকম শব্দ করে বিট করে? হৃধির জানা নেই।

মাহিন হৃধির চোখের সামনে ধোঁয়া ওঠা কাপটি ধরতেই হৃধির ভাবনায় ছেদ ঘটলো। ধ্যান ভেঙ্গে কাপ ধরা মানবটির দিকে মাথা উঁচু করে তাকালো। মাহিন চোখ টিপ মেরে বলে ওঠে,
–“চা টা খেয়ে নিন। দেখবেন লজ্জা’রা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে!”

হৃধিকে যেন আরও লজ্জা ঘিরে ধরলো। তটস্থ হয়ে কাপটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। মাহিন তাকে নিয়ে টঙের বাহিরে এসে দাঁড়ালো। অতঃপর হৃধিকে পাশে নিয়ে মাহিন চায়ে চুমুক দিলো। সেই এক চুমুকে যেন মাহিনের ক্লান্তি-ভাব দূর হয়ে গেলো। আবেশে চোখ বুজে চায়ের স্বাধ টুকু যেন নিবিড়ভাবে অনুভব করছে। হৃধি একপলকে মাহিনের ভাব-ভঙ্গি খেয়াল করে নিকাবটা খুলে ফেলে। অতঃপর হৃধিও ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিলো। আসলেই এক ভিন্ন স্বাধ মিশে আছে এই চাতে। সাধারণ টঙ এর চা তে যতটা স্নিগ্ধতা আছে তা দামী রেস্টুরেন্টে নেই। প্রতিটি টঙ যেন নিজ স্থান হতে সেই বড়ো রেস্টুরেন্ট গুলোকেও হারিয়ে দিবে৷

দু’জন যেমন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জনকে অনুভব করছে তেমনই এই চায়ের স্নিগ্ধতাকেও অনুভব করছে। হৃধির ভাষ্যমতে এই অনুভূতি সে কখনোই প্রকাশ করে বোঝাতে পারবে না। দিনটি তার স্মৃতির পাতায় সানন্দে জায়গা করে নিলো। এই অনুভবের দিনটি সে কখনোই ভুলতে পারবে না।
মাহিন বিল মিটিয়ে আসতেই রিকশা পেলো। ইতস্ততা নিয়ে হৃধি প্রথমে উঠে বসলো। অতঃপর মাহিন। মাহিনের বাহুর সাথে নিজের কাঁধের স্পর্শ উপলব্ধি করতেই হৃধির সর্বাঙ্গে শিহরণের ঢেউ খেলে গেলো। এ কেমন বিষাক্ত অনুভূতি? যেই অনুভূতিতে ভালো লাগা এবং মরে যাওয়ার অনুভূতির সংমিশ্রণ। হৃধি যেন গলায় দম আটকে রোবটের ন্যায় বসে রইলো। রিকশা তাদের গলির কাছাকাছি আসতেই মাহিন হৃধির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“আজ আমার জম্মদিন ছিলো হৃধি। ধন্যবাদ, এতো সুন্দর এক জম্মদিন উপহার দেয়ার জন্য। এই বিশেষ দিনে আমায় সঙ্গ দিয়ে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য। আপনি আমার জীবনের অমূল্য উপহার হৃধি!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here