#রঙিন_দূত – ৩১,৩২
লাবিবা ওয়াহিদ
————————–
রাত এখন প্রায় সাড়ে তিনটা। হৃধির নির্জীব প্রাণীর ন্যায় বসে আছে। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা গড়িয়ে পরছে অবিরত। সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি এভাবে গভীর রাতে তার বিয়ে হয়ে যাবে। কম্পিত হাতের কলমটা সেই কখন থেকেই মেঝেতে পরে আছে। হৃধির সম্পূর্ণ শরীর যেন মৃদু মৃদু কাঁপছে। তার বিপক্ষেই মাহিন বসে আছে তবে দূরত্ব বজায় রেখে। এ রুমে হৃধি এবং মাহিন ব্যতীত বর্তমানে কেউ নেই। বিয়ে শেষ হতেই রাফিদ, সিফাত কাজীকে নিয়ে গেছে। কাজীর ব্যবস্থা করেছে সাব্বির। যেহেতু সে বর্তমানে রাজনীতি করে সেহেতু তার জন্যে কাজী ঠিক করা কোনো ব্যাপার-ই না। মাহিন যেন আঁটঘাঁট বেঁধেই মাঠে নেমেছে। হৃধির কান্না দেখতে দেখতে মাহিন তার নিরবতা ভাঙলো। চওড়া কন্ঠে বলে ওঠে,
–“কী ভেবেছেন আপনি? আপনাকে এতো ভালোবাসার পর হাত-পা গুটিয়ে আপনাকে অন্যের হতে দেখবো? এত সহজ? এতদিন মাহিনের ভদ্র রূপ দেখেছেন, এখন নাহয় অভদ্র হয়ে দেখালাম। আরও অভদ্র হলে কী খুব বেশি শান্তি লাগবে আপনার? দিনশেষে নিজ দেহে যে আমার-ই সিলমোহর মে/রে নিলেন!”
হৃধি একপলক মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের চোখে – মুখে রাগি ভাব স্পষ্ট। হৃধি হাসলো, তাচ্ছিল্যের হাসি! বেশ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
–“এত মাস যে আমার খবর নেয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি, একবার দেখা করার প্রয়োজন বোধ করেনি সে আমায় ভদ্র, অভদ্র শিখাচ্ছে! কোথায় ছিলো এতদিন আপনার এই ভালোবাসা? আপনার মতো বড়ো মাপের মানুষের কাছে কী আদৌ অতীতের ভালোবাসার দাম আছে? আমার দাম ছিলো? দাম থাকলে তো একবারের জন্যেও আমার খোঁজ নিতেন, দেখা করতেন। যতবার আপনাকে কল দিয়েছিলাম, ব্যস্ত বলতো। এতো ব্যস্ত মানুষের অবহেলা আমার পক্ষে নেয়া সম্ভব না। তাই আমি বিয়ের ডিসিশন নিয়েছি, ঠিক করেছি। আপনি কেন আসলেন এখানে? আপনাকে বলেছি? আমি তো আপনায় চিরদিনের মতো মুক্তি দিয়েছিলাম। তাহলে? আপনার তো আজকাল অনেক মেয়েদের সাথে..”
হৃধি আর বলতে পারলো না। মাহিন তাকে ঝাপটে ধরেছে। হৃধির কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিলো। হৃধির সর্বাঙ্গ যেন কেঁপে উঠলো। দম যেন গলায় আটকে গেলো তার। মস্তিষ্কশূণ্য হয়ে সেভাবেই রইলো কিছুক্ষণ। সম্বিৎ ফিরতেই হৃধির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে মাহিনকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মাহিনকে ধাক্কা দিলেও মাহিনকে এক চুল নাড়াতে পারলো না। হৃধির হাত-পা অবশ হয়ে এলো। ওষ্ঠ্যদ্বয় থরথর করে কাঁপছে। এ কেমন অনুভূতি? হৃধির যে দম আটকে আসছে। মনে হচ্ছে এখনই যেন সে মরে যাবে। পরমুহূর্তে হৃধির কোমড়ে মাহিনের শীতল স্পর্শ পেলো। হৃধি আরেক দফা কম্পিত হয়ে মাহিনের কাঁধের শার্টের অংশ খামচে ধরলো। হৃধি বেশ বেসামাল স্বরে বললো,
–“ছা…ছাড়ুন। ছ..ছাড়ুন মাহিন! কী করছেন!?”
মাহিন নিরুত্তর, সেভাবেই রইলো। একসময় ভয়ানক কান্ড ঘটালো সে। হৃধির গলায় নিজ ওষ্ঠ্যদ্বয় ছুঁলো। হৃধি যেন এই স্পর্শে নিস্তেজ হয়ে গেলো। নিজের ভার মাহিনের উপর ছেড়ে দিলো। অনুভব করলো হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি ক্রমাগত বাড়ছে। ঢিপঢিপ শব্দ শ্রবণ হচ্ছে তার৷ মাহিন হৃধির কানের সামনে মুখে নিয়ে কাতর স্বরে বলে ওঠে,
–“আমার এক প্রতিজ্ঞার জন্যে আমি চাইলেও আপনার কাছে আসতে পারতাম না হৃধি। বাবার সাথে ঝামেলা শুধু আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ছিলো না, আপনাকে নিয়েও অনেক সমস্যা হয়েছে। বাবা জানতে পেরেছিলো আপনার আমার সম্পর্কের কথা। এজন্য বাবা আরও ক্ষুব্ধ ছিলো এই ভেবে যে আমার মতো বেকার, স্টুডেন্ট কী করে ঘরে বউ আনবে? এ নিয়ে সমাজের মানুষজন কী বলবে? এসব নিয়ে বাবার সমস্যার শেষ ছিলো না। আমি ঠিক এজন্যই আরও জেদ ধরি যে যেদিন আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারবো সেদিন-ই বাড়ি ফিরবো। আর ঠিক সেদিনই যেন তার মিলে আপনার বাসায় প্রস্তাব দিতে যাবে। আপনার জন্যে আমি অনেক সংগ্রাম করেছি হৃধি, শুধু আপনি তা বুঝতে পারেননি। সারাজীবনের জন্যে অবুঝ-ই রয়ে গেলেন। আপনাকে সামনা-সামনি না দেখলেও রাফিদ প্রতিদিন আপনার আপডেট দিতো, ছবি তুলে পাঠাতো। আর আপনি আজ আমার ভালোবাসাকে ঠুনকো প্রমাণ করলেন! সাথে আরেক জনকে বিয়ে করার কথাও মুখে তুললেন। আপনার কী মনে হচ্ছে না আপনার সাহস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে? এখন আপনি আমার বউ, তাই নিষিদ্ধ কাজ হালালে পরিণত হয়েছে। যেখানে আমার সামান্য ছোঁয়া সহ্য করতে পারেন না সেখানে আমার সাথেই সাহস দেখান? নিজেকে শুধরে নিন, নয়তো আমি আরও অ’ভ’দ্র হবো, শুধু আপনারই জন্য!”
মাহিন থামতেই হৃধির কানের লতিতে অধর ছুঁলো। হৃধি এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে মাহিনের বক্ষে মাথা মাথা রাখলো। হৃধির হঠাৎ এরূপ কর্মে মাহিন চমকে উঠলো। পরম যত্নে হৃধির চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে আওড়ায়,
–“কী হয়েছে হৃধি? কাঁদছেন কেন?”
–“আপনার কথা যদি সত্যি-ই হয়ে থাকে তাহলে কেন একটিবারের জন্যে ফোন দিয়ে দু’মিনিট কথা বললেন না? একটু কথা বললে কী পাপ হগে যেত? এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে এসব কী? আপনাকে কেন আরেকজন মেয়ের সাথে জড়াচ্ছে? সেই মেয়ে কে? আমি আপনাদের দু’জনকে পাশাপাশি সহ্য করতে পারি না যে!”
মাহিন নিশ্চুপ রইলো। একসময় থেমে প্রশ্ন করলো,
–“আমাকে ভালোবাসেন?”
–“_________”
–“চুপ কেন বলুন?”
–“সব কথা মুখে জানতে নেই, অনুভব করেই নাহয় উত্তরটি জেনে নিন!”
মাহিন হাসলো। এই অনুভব সে হৃধি বলার আরও অনেক আগেই করতে পেরেছে। হৃধিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে জিন্সের পকেট থেকে ফোন বের করলো। অতঃপর একটা ভিডিও ক্লিপ ওপেন করলো। সেখানে দেখাচ্ছে একটা শুট হচ্ছে। সেই শুটে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাহিনের সাথে দেখা মেয়েটিকেও দেখা যায়। সেখানে ক্যামেরা, গান সবই আছে। গানের সাথে মেয়েটি সুর মিলাতে গিয়ে বারবার হেসে ফেলছে। মাহিনও দূরে হাতে গিটার নিয়ে সুর তুলছে আর হাসছে। হৃধি একটু বুঝতে পারলেও মাহিন তাকে ভালো করে বুঝাতে বললো,
–“আপকামিং একটা কভার গান আসছে। সেটার-ই শুট এটা। এখনো পাবলিকলি কাউজে জানানো হয়নি। কাজের সূত্রে মেয়েটির সাথে আমার নানান জায়গায় যেতে হয়। এর মাঝে কোন হারা***জা** ছবি তুলে আজেবাজে নিউজ ছড়িয়েছে। আর তুমি আমার ঘরের মানুষ হয়ে এভাবে জেলাস হলে? ভেবেই নিলে মেয়েটার সাথে আমার রিলেশন বা কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে? কাম অন হৃধি! আমি মাহিন, আপনার ব্যক্তিগত মাহিন। আপনি ব্যতীত আমার এই জীবনে দ্বিতীয় কোনো নারীর না অস্তিত্ব ছিলো আর না আছে!”
—————————-
সকাল সাতটা বেজে বিশ মিনিট। করিম উল্লাহ লিভিংরুমে পায়চারি করছে। রাবেয়া খাতুন মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছে৷ চোখে-মুখে তার চিন্তার আভাস! করিম উল্লাহ কিছুক্ষণ আগেই মেয়ের ঘরে চেক দিতে গেছিলো, এটা তার রোজকার অভ্যাস! মেয়েকে রুমে দেখতে না পেয়ে দ্রুত বাহিরে বেরিয়ে আসেন তিনি। যখন সদর দরজার দিকে নজর গেলো তখন দেখলো সদর দরজাও খোলা। করিম উল্লাহ’র বুঝতে বাকি নেই মেয়ে বাহিরে বেরিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেছে কেউ-ই ধারণা করতে পারছে না। ফোনটাও বিছানায় ফেলে গেছে৷ যখন ঠিক পঁচিশ মিনিটে কাঁটা বিচরণ করছে তখনই হৃধি তিস্তার সাথে কথা বলতে বলতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো। তিস্তা হৃধিদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। মাহিনের পরিবার মাসখানেক হয়েছে তাদের নিজেদের বাড়িতে উঠেছে। তারা চলে যেতেই তিস্তা উঠেছে। এখানে তিস্তা এবং তার স্বামী থাকে। এছাড়া কেউ থাকে না। সেজন্য তিস্তা সময় কাটানোর জন্যে হৃধির বাসাতে অথবা হৃধিকে তার বাসায় নিজের সাথে রাখে। এছাড়াও তিস্তা গর্ভবতী। তাই তার যত্ন বেশি করতে হয়।
করিম উল্লাহ এবং রাবেয়া খাতুনের মেয়ের দিকে দৃষ্টি পরতেই তারা তড়িৎ ছুটে এলেন মেয়ের কাছে। হৃধি এখন পরলো বিব্রতকর অবস্থায়। ভয়ে তিস্তার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। করিম উল্লাহ মেয়েকে বকতে নিলে তিস্তার দিকে তার নজর যায়। তিস্তা ব্যস্ত হয়ে বললো,
–“প্লিজ আঙ্কেল ওকে কিছু বলবেন না। আসলে আমার হাসবেন্ড গতকাল রাতে অফিসের কাজে শহরের বাইরে গিয়েছে। আমার ভয় লাগছিলো বিধায় ওকে রাতে কল করে নিজের কাছে এনে রাখি। আপনারা ঘুমোচ্ছিলেন দেখে হৃধিও আর জাগায়নি।”
তিস্তার এরূপ কথা শুনে করিম উল্লাহ যেন দমলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বললো,
–“আচ্ছা, তাহলে মামুণি যাও! ফ্রেশ হয়ে আসো!”
হৃধি একপলক তিস্তার দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো। তিস্তা বাসায় চলে যেতে চাইলে রাবেয়া খাতুন জোর করে বসিয়ে রাখলেন। তিস্তাকে নাস্তা আজ এখানেই করতে হবে। হৃধি ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়ে সর্বপ্রথম বেলকনিতে চলে গেলো। মস্তিষ্কে বিচরণ করছে বারংবার বিয়ের কথা। হৃধি প্রথম প্রথম বিয়েটা মানতে না পারলেও এখন তার অনেকটা হালকা লাগছে। মস্তিষ্ক শুধু একটা কথাই জানান দিচ্ছে “মাহিন শুধু তোর” তাকে নিয়ে চিন্তা কিসের? ইসলামিক শরিয়ত অনুযায়ী তো তোরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেছিস। এছাড়া মাহিন তো তোর সব অভিমান এক চুটকিতেই ভ্যানিশ করে দিলো।
হৃধি আপনমনে ক্ষীণ হাসলো। পরমুহূর্তে বাসায় ঠিক হওয়া বিয়ের কথা মনে পরলো। হৃধির মনে পরে গেলো রক্তিমের সাথে বলা কথাগুলো। সেদিন রক্তিম তাকে বলেছিলো,
–“তুমি যদি আমায় বিয়ে না করো, তাহলে তোমার সাথে ওই ছেলের মেলামেশা, কান্ড-কারখানা সব ফুপার কানে চলে যাবে। বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত। শুনেছি ছেলেটা তোমায় আগেই ছেড়ে চলে গেছে! এখন কী বলো, তোমার নিরবতা হ্যাঁ ধরবো নাকি না?”
হৃধি সেদিন ভিষণ চমকে গেছিলো রক্তিমের এরকম চিন্তা-ভাবনায়। তার চেনা রক্তিম তো এ নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন এই রক্তিম। তবে সেদিন তার মনে ভয় ঢুকলেও এক ফন্দি আঁটে একপলক মাহিনকে দেখার জন্যে। তাই সে তার মিথ্যে মতামত দেয় অর্থাৎ “হ্যাঁ!”
সেদিনের ওই মতামত যে হাওয়ার ন্যায় মাহিনের গায়ে লাগবে তাহলে হৃধি আরও আগে এই ফন্দি আঁটতো। তবে মাহিন যে একবারে বিয়েই করে ফেলবে কে জানতো? এর থেকে প্রমাণ হয় হৃধিকে নিয়ে সে কতটা ভয় করে।
করিম উল্লাহ একবার মেয়েকে দেখে নিজের রুমে চলে গেলেন। আজ ছুটির দিন, তাই মেয়ে চোখের সামনেই থাকবে। তার চেয়েও বড়ো কথা হৃধি, মাহিনের বিয়েটা হয়েছে তিস্তার বাসাতেই। তিস্তা আগে এসব সম্পর্কে জানতো না, সিফাতই তাকে জানিয়েছে। তিস্তা হচ্ছে সিফাতের বড়ো বোন। যেটা হৃধি নিজেই জেনেছে কিছুদিন আগে।
—————————-
রক্তিম হাতে একটি জামার প্যাকেট নিয়ে হাসি-মুখে সামনে এগোতেই তার পথ আটকে দাঁড়ায় মাহিন এবং তার দলবল। মাহিনের মুখে ছিলো মাস্ক এবং কালো সানগ্লাস। বেশ এটিটিউডের সাথে দু’পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। রক্তিম মাহিনকে চিনলো না। তাই সে ভ্রু কুচকে বললো,
–“এটা পাবলিক প্লেস, রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছেন কেন? সরে দাঁড়ান!”
মাহিন তখনই মুখের মাস্ক এবং ব্ল্যাক সানগ্লাসটি চোখ থেকে খুললো। এদিকটা নির্জন তাই মানুষের যাতায়াত খুব একটা নেই। মাহিনকে দেখে রক্তিমের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে ধপ করে পরলো। বছরখানেক আগে দেখেছিলো এখন আবার তার সম্মুখে। মাহিন তার সানগ্লাস ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
–“কী বাপ? আগের বার কে/ লা/ নী/ র হাত থেকে বেঁচে ফিরসো বলে প্রতিবার বাঁচবা এমন তো না! আগের কথা মনে নাই? কোন সাহস হৃধিকে বিয়ে করার স্পর্ধা দেখাও!”
রক্তিম নিজের মুখে রাগি ভাব ফুটিয়ে তুললো। ভাব এমন মাহিনকে সে ভয় পায় না।
–“আমার স্পর্ধা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই ওকে? হৃধি এখন আমার বাগদত্তা! তাই এসব না বলে নিজের চরজায় তেল দাও। ইউজলেস একটা!”
মাহিন কোনো কথা ছাড়াই রক্তিমের মেইন পয়েন্টে এক লা’ থি দিলো। রক্তিম আর্তনাদ করে ধপ করে বসে পরলো। মাহিন বাঁকা হেসে হাঁটু ভেঙ্গে বসলো। অধরের পাশে বৃদ্ধাঙ্গুলের বিচরণ চালিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
–“কষ্ট হচ্ছে বুঝি? এখন বুঝ, ইউজলেস কে? তুই না আমি! শরম – লজ্জা থাকলে কেউ তার বোন সমান কাজিনকে বিয়ে করতে আসে না। তোর তো শরমের গায়ে আ’গু’ন লাগছে। হৃধি তোর বাগদত্তা কোনো কালেই ছিলো না বিকজ, শি ইজ মাই গার্ল!”
রক্তিম এই কঠিন ব্যথা নিয়েও মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। রক্তিম হেসে হেসে বললো,
–“ফল খেয়ে শেষ করে আবার আরেকজনের ফলের দিকে কুনজর দেয়!”
মাহিন এবার রক্তিমের নাক বরাবর এক ঘু’ ষি দেয়। অতঃপর বাঁকা হেসে বলে,
–“বলেছিলাম না, আমার মুখের থেকে হাত-পা বেশি চলে? এখন আমি মুখে কিছু বলবো না। নিজেই দেখ!”
বলেই রক্তিমের হাতে জোর করে কাবিননামা তুলে দিলো। রক্তিম যন্ত্রণায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে একবার সেটায় নজর বুলালো। সবকিছু বুঝতে বেশি সময় লাগে না তার। হৃধি তাহলে মাহিনের বউ? রক্তিম শুকনো ঢোঁক গিললো।
—————————
হৃধি আজ বেশ সাহস জুগিয়ে করিম উল্লাহ’র নিকট আসলো। করিম উল্লাহ তখন তার ঘরের বারান্দায় চোখে চশমা লাগিয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন। হৃধি নিঃশব্দে করিম উল্লাহ’র পায়ের কাছে বসলো। করিম উল্লাহ পত্রিকা থেকে নজর ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েকে দেখে মুচকি হেসে পত্রিকাটা ভাঁজ করে পাশে রাখলেন। অতঃপর চশমাটি খুলে বুক পকেটে রেখে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
–“আজ হঠাৎ বাবাকে মনে পরলো যে?”
হৃধি নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“তোমার কাছে কিছু চাইতে এসেছিলাম বাবা!”
–“আমার মামুণি আমার কাছে মুখ ফুটে কিছু চাইছে আর আমি না দিয়ে পারি?”
হৃধি দৃষ্টি নুইয়ে চুপ করে বসে রয়। দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। অশ্রুগুলো বাঁধা ভাঙ্গার পূর্বেই হৃধি ভাঙ্গা গলায় আওড়ায়,
–“আমি রক্তিম ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারবো না বাবা। রক্তিম ভাইকে আমি সবসময় ভাই ভেবে এসেছি। আমার বড়ো ভাইয়ের শূণ্য স্থানে তাকে বসিয়েছি। আমি কখনো ভাবিনি ভাইয়া আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসবে। আমার সেদিনের মতামত মিথ্যে ছিলো বাবা। ভেবেছিলাম মেনে নিতে পারবো, কিন্তু এটা কখনোই সম্ভব না। আমার মতে আমি আমার ভাইয়ের সম্পর্কটাকে বিরাট অপমান করে ফেলবো। সারাজীবন এই অপরাধ আমায় কুড়ে কুড়ে খাবে! প্লিজ বাবা, আমি কখনো তোমার কাছে মুখ ফুটে কিছু চাইনি! আজ চাইছি, দিবে?”
করিম উল্লাহ সব শুনে চুপসে গেলেন। মেয়ের কথায় কী বলবে বুঝে পেলো না। মেয়ের প্রতিটি কথাতেই যে যুক্তি আছে। এছাড়া হৃধি বিয়ে করবে, সে-ই জীবন কাটাবে। এখানে যদি তার মেয়ে সুখী না হয় তাহলে কী দরকার এতসব আয়োজনের? করিম উল্লাহ এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। না বুঝেই মেয়ের ঘাড়ে এক বোঝা চাপাতে চেয়েছিলো সে। মেয়েটাও কেমন বাবার কথার উপর না গিয়ে রাজি হয়ে গেছিলো। এখানে যে সে কতটা অপরাধী বুঝতে দ্বিধা হলো না। করিম উল্লাহ অধরজোড়া প্রসারিত করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–“তুমি যা বলবে তাই হবে মামুণি। তোমার সিদ্ধান্ত ছাড়া আমি আর কিছু বলবো না! আমি এখনই তোমার মামাকে কল করছি।”
————————
হৃধি এবং মাহিনের বিয়ের মাসখানেক কেটে যায়। মাহিন সেদিন রক্তিমকে থ্রেট দিয়ে নিজ গন্তব্যে চলে গেছিলো। আর ফিরেনি। তবে আগের মতো ভুল করেনি সে এবার। রোজ হৃধিকে দু’বেলা ফোন সে দেবেই। ওদের সম্পর্কটা এখন যেন বিয়ের পরের প্রেম! মাহিন যেন এরকম এক মুহূর্তের-ই অপেক্ষায় ছিলো। মাহিনের কথামতো তার কিছুদিন পরেই সেই মেয়েটার সাথে তার নতুন গান আপলোড হয়। যার ফলে মেয়েটিকে নিয়ে মাতামাতি করা জনগণ হৃধির মতোই চুপসে যায়। রক্তিমের সাথে হৃধির বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। এর পর থেকে হৃধির বাসায় আর কোনো সম্বন্ধ আসেনি। আসেনি বলতে মাহিন আসতে দেয়নি। তার হৃধিদের এপার্টমেন্টে প্রবেশ করার পূর্বেই কৌশলে মাহিনের সাঙ্গপাঙ্গ’রা তাদের ভাগিয়ে দেয়। এসব অবশ্য মাহিনেরই কাড়শাজি!
–“কবে ফিরবেন আপনি মাহিন?”
–“আরেকটা শুট আছে, সেটা শেষ করেই ফিরবো ইনশাল্লাহ। আশা রাখছি সেই শুটের মাধ্যমেই আমি আমার সাফল্যের আরও উচ্চতে পৌঁছাবো। আমি আমার কথা রাখবো হৃধি।”
হৃধি চুপ করে রইলো। মাহিনও নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে মাহিন নেশালো স্বরে বলে ওঠে,
–“আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো সাফল্য কী জানেন হৃধি? আপনাকে বিয়ে করা। সেদিন যদি আপনাকে বিয়ে না করতাম তাহলে এই দিনগুলো মিস করে যেতাম। চাইলেও এখন আপনার সভ্যতা ফেলে অ’স”ভ্য হতে পারি। আপনার সাথে হালাল প্রেম করতে পারি। অনুভূতিগুলোও কেমন গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে!”
হৃধি লজ্জা পেলো, ভিষণ লজ্জা পেলো। অপরপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা যায়!
–“লজ্জা পাচ্ছেন হৃধি?”
–“কেন এতো ভালোবাসেন আমায়?”
–“ভালোবাসা সুন্দর, তাই ভালোবেসে যাই!”
——————————
~চলবে, ইনশাল্লাহ।