#রঙিন_দূত – ০৬,০৭
লাবিবা ওয়াহিদ
০৬
————————-
নিস্তব্ধ রজনী৷ ব্যস্ত শহর এখন শব্দহীন, ভয়ংকর নিস্তব্ধতায় আবৃত। নিকষ কৃষ্ণ এই রজনীতে কেউ গভীর তন্দ্রায় মগ্ন, কেউ-বা এক কাপ চা হাতে রাত্রী বিলাসে মগ্ন, কেউ-বা কানে ফোন লাগিয়ে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে প্রেমালাপে ব্যস্ত। হৃধি এই তিন শ্রেণির কোনো একটিতেও পরে না। আজ পড়া খুব তাড়াতাড়ি-ই শেষ করে ফেলেছে, খাবারও খেয়ে নিয়েছে। এখন সে ফোন নিয়ে বসেছে লাইভ শুনার জন্যে। পেজে ঢুকে দেখলো অলরেডি দু’ঘন্টা আগে লাইভ শেষ হয়েছে। হৃধি সেটাই দেখলো৷ কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হলো মাহিন ক্যামেরার সামনে আসেনি৷ সে ক্যামেরার আড়ালে গান শুনিয়েছে। তিনটা গান শুনিয়েছে৷ গানের সাথে বেজেছিলো গিটারের টোন। এর মানে কী ছেলেটা গিটারেও পারদর্শী?
মাহিনের একেকটা সুরে কোনো এক অজানায় হারিয়ে গেছিলো হৃধি। একেকটা সুর যেন হৃদয়ে সুঁচের মতো বিঁধছে। সাথে মনে হয়, হৃধিকে উদ্দেশ্য করেই তার প্রতিটি গান, প্রতিটি লাইন। এসব ঠুনকো ভাবনা হলেও ঘুরেফিরে সেসব লাইনে হৃধি নিজেকে খুঁজে পায়। এতো আবেগমিশ্রিত গানগুলো। হৃধি যখন মাহিনের গানে হারিয়ে গেছে তখন-ই ফোনকলে হৃধির ধ্যান ভাঙলো। মাহিন কল করেছে তাও এতো রাতে? হৃধি চট করে উঠে বসলো। কাঁপা হাতে রিসিভ করলো। হৃধি জানে না কেন মাহিন মেসেজ অথবা ফোন দিলেই সে অস্বস্তিতে পরে যায়। কেন তার এতো এতো অস্বস্তি মাহিনকে ঘিরে? এই অস্বস্তির তাড়নায় এখনো হৃধি মাহিনকে কড়া কথা শুনাতে পারেনি। হৃধি যে সেরকম মেয়েও নয়।
তার আচার-ব্যবহারে কেউ কখনো কষ্ট পায়নি। এছাড়াও সে বেশ ভদ্র, কোলাহল একদম অপছন্দ তার। এরকম সাধা-সিধে মেয়ের পেছনেই পরেছে মাহিন নামক ধনী পরিবারের ছেলে। হৃধি তটস্থ হয়ে বলে,
–“হ্যালো!”
–“ব্যালকনিতে আসবেন হৃধি? আপনায় দেখতে ইচ্ছে করছে!”
মাথা ভনভন করে উঠলো হৃধি। কিছু ছিলো মাহিনের কন্ঠে, সম্মোহনী কন্ঠস্বর তার। এই সম্মোহনী কন্ঠস্বরকে কিছুতেই অবজ্ঞা করতে পারে না হৃধি। বিছানা ছেড়ে নেমে ত্রস্ত পায়ে ব্যালকনির দিকে এগোলো। ফোন কানে দিয়ে ব্যালকনির রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ায়। দৃষ্টি রাস্তায় পরতেই দৃষ্টি আটকালো বিকালের পাঞ্জাবি পরিহিত সেই যুবকটির দিকে। ক্লান্তি’রা তার মুখমন্ডলে ভর করেছে। পরিপাটি চুলগুলোও কেমন এলোমেলো। হয়তো মাত্র ফিরেছে রেডিও অফিস হতে। মাহিন বেশ কিছুক্ষণ নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় প্রেমময়ীর নিকট। কিয়ৎক্ষণ পর মাহিন বলে ওঠে,
–“আজ ঘোমটা দেননি হৃধি?”
অপ্রস্তুত হয় হৃধি৷ তড়িঘড়ি করে মাথায় ওড়না দেয়ার পূর্বেই মাহিন আবারও বলে ওঠে,
–“রুমে যান হৃধি, আমার তৃষ্ণা মিটেছে!”
কল কাটার শব্দে হৃধি কান থেকে ফোন নামিয়ে নিলো। হৃধি রুমে আসলে মাহিনও নিজের বাসায় চলে যায়। হৃধির আজ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এই ছেলেটার মতিগতি একদমই বুঝে না সে।
———————-
মাহিন ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো শাফীন ডাইনিং এ বসে খাচ্ছে। শাফীন মাহিনের ছোট ভাই। শাফীন সবে ইন্টার প্রথম বর্ষে উঠেছে। মাহিন ভ্রু কুচকে শাফীনের দিকে তাকায় এবং বলে,
–“ঘড়ির কাঁটা একটার কোঠায় আর তুই এই অসময়ে খাচ্ছিস?”
–“আমি ডিনার করেছি আটটায় ভাই! তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আবার খুদা পেয়েছে। তুমি তো জানোই, আমি খুদা সহ্য করতে পারি না!”
–“তা নাহয় বুঝলাম, তো আমার জন্য অপেক্ষা করার কারণ?”
–“এই ভাই, চোখ রাঙাবা না! দাঁড়াও খেয়ে নিই, তারপর কারণের এ টু জেট সব জানাচ্ছি!”
বলেই গপগপ করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। মাহিন শাফীনকে তোয়াক্কা না করে রুমে চলে গেলো। পাঞ্জাবি খুলে ফ্রেশ হয়ে আসতেই দরজায় কড়াঘাতের শব্দ পেলো, সাথে শাফীনের পকপকও! মাহিন ক্লান্তি নিয়ে বলে,
–“শাফীন, বিরক্ত করিস না! প্লিজ যা!”
–“এটা চিটিং ভাইয়া। তোমায় বললাম আমি অপেক্ষা করতে আর তুমি আমায় পাত্তা না দিয়ে চলে আসলা? তোমায় না বললে আমার রাত জাগা বৃথা যাবে ভাই!”
–“শাফীন! আমি অপেক্ষা করার মুডে নেই। আমি তোকে বলিওনি আমার জন্যে অপেক্ষা করতে। রুমে গিয়ে ঘুমা আর আমায়ও ঘুমাতে দে, আই নিড টু স্লিপ!”
বলেই মাহিন ধপ করে শুয়ে পরলো। এসির শীতলতা বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে চোখ বুজে রইলো। শাফীন তখন মাহিনকে বকতে বকতে নিজ রুমের দিকে পা বাড়ায়।
———————-
আজ ভার্সিটি, কোচিং দু’টোই অফ। সরকারি ছুটি আজ। বেশ দেরী করেই ঘুম ভেঙ্গেছে হৃধির। ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসতেই দেখলো খাবার সাজানো। খেতে খেতে হৃধি মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“বাবা কোথায়, মা?”
–“অফিস গিয়েছে, কী নাকি কাজ পরে আছে!”
রাবেয়া হাতে লাল মরিচের ডালা নিয়ে আসতে আসতে বললো। হৃধি ছোট করে “ওহ” বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। হৃধি খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলো রাবেয়া হাতে মরিচের ডালা নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে হৃধি বললো,
–“এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
–“ছাদে এগুলো শুকাতে দিয়ে আসবি!”
জলটুকু গলায় আটকালো হৃধির। কাশতে কাশতে বললো,
–“বেলা সাড়ে এগারোটা বাজছে মা। তুমি না গেলেও রিনা আসলে ওকে দিয়ে পাঠিও। প্লিজ মা, আমাকে বলো না!”
রাবেয়া খাতুন কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো হৃধির পানে। কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলো,
–“কেন? নাস্তা সেরে কোন মহাকাজটা করবি যে আমায় নাকোচ করিস? দেখ হৃধি, আমি তোর থেকে জিজ্ঞেস করিনি। এখন রোদের তেজ ভালো। যতো তাড়াতাড়ি রোদে দেয়া যাবে ততো ভালো। দ্রুত খাওয়া শেষ করে ছাদে দিয়ে আসবি ব্যাস!”
করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো হৃধি। রোদের তেজের মতো বিরক্তিকর কিছু আছে বলে তার মনে হয় না। রোদে গেলে মনে হয় তার শ্যাম ত্বক আরও কালো হয়ে গেছে। এখন মাকে এই কথা বললে রূপচর্চার ভান্ডার নিয়ে বসবে। কিসব মাখাবে যেগুলা তার ত্বক নষ্ট করতে বাধ্য। তাই হৃধি সাড়া শব্দ না করে খেয়ে নিলো। রুমে গিয়ে মাথায় ভালো মতোন ওড়না জড়িয়ে আবার বেরিয়ে আসে। এবার যেন রাবেয়ার বুলিতে খই ফুটেছে। মরিচের ডালাটা হৃধির হাতে দিয়ে শীতল কন্ঠে বলে ওঠে,
–“যা মা। আমার লক্ষী মা!”
রাবেয়ার বুলিতে হৃধির কোনো ভাবান্তর দেখা দিলো না। সে নিশ্চুপ হয়ে ছাদে চলে গেলো। কী কড়া রোদ’রে বাবা! এ যেন গ্রীষ্মকাল! অথচ চলছে অগ্রাহায়ণের অন্তিম ভাগ। হৃধি মরিচ ছাদের মেঝের এক কাপড়ে ফেলে হাত দিয়ে একত্রে করে নিলো। অতঃপর ডালাটা একপাশে রেখে হৃধি চলে আসলো। বাসায় আসতেই হৃধি তাঁরাকে দেখতে পেলো সাথে আরেকজন অচেনা ছেলে। হৃধিকে দেখতেই যেন দু’জনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
–“হৃধি! কেমন আছো?”
হৃধি একবার তাঁরার প্বার্শে বসা ছেলেটিকে লক্ষ্য করলো। অতঃপর অধরে হাসির রেখা টেনে বলে,
–“জ্বী আপু, ভালো। তুমি কেমন আছো?”
–“এইতো আছি। হৃধি ওর সাথে পরিচিত হও! ও হচ্ছে শাফীন। আমার ছাত্র!”
শাফীন হাত নাড়িয়ে “হাই” দিলো। হৃধি সৌজন্যমূলক হাসি দিলেও খুব একটা কথা বললো না। তাঁরা হৃধির দু’বছরের সিনিয়র। শাফীন তাঁরা আপুর কাছে নাইন থেকে এসএসসি পর্যন্ত নাকি পড়েছে। কিছু সময়ের মধ্যে সখ্যতা সখ্যতা গড়ে ওঠে হৃধি এবং শাফীনের। তাঁরা তখনই এক প্রস্তাব রাখলো,
–“আজ শপিং এ যাবো। তোমাকেও সাথে নিতে চাই হৃধি। প্লিজ না করবে না!”
–“কিন্তু আপু..”
–“প্লিজ হৃধি! না করবে না। প্রমিস তুমি সেফলি বাসায় ফিরবে।”
–“মা মানবে না আপু!” মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো হৃধি!
তাঁরা এবার গিয়ে ধরলো রাবেয়া খাতুনকে। অনেক বলার পর রাবেয়া খাতুন রাজি হলেন। হৃধিকে নিজের নিকট ডেকে পাঠালেন। হৃধি মায়ের কাছে এসে আধো কন্ঠে বলে উঠলো,
–“বাবা জানলে রাগ করবে মা!”
রাবেয়া রাঁধতে রাঁধতে বললো,
–“তোর বাবাকে আমি সামলে নিবো। যা গিয়ে মজা কর, মেয়েটা এতো করে বললো।”
বক্ষঃস্থল হতে যেন এক বড় পাথর সরে গেলো হৃধির। হৃধি হাসার চেষ্টা করে লিভিংরুমে চলে গেলো। সেখানেই তাঁরা এবং শাফীন বসে। হৃধি তাঁরার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“অপেক্ষা করো, রেডি হয়ে আসছি!”
–“তুই রেডি হ, আমি বরং বাসায় যাই। যাওয়ার সময় তোকে নিয়ে যাবো!”
মার্কেটে মাহিনকে দেখে হৃধির চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। এই ছেলে অসময়ে মার্কেট কী করছে? হঠাৎ -ই মাহিনের নজর হৃধির উপর পরলো। মাহিনের চাহনিতে হৃধির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। তড়িৎ হৃধি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এই ছেলের দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না সে। কিয়ৎক্ষণ পর হৃধি কোণা দৃষ্টিতে মাহিনকে দেখলো৷ একি, মাহিন হৃধির দিকেই আসছে! আতঙ্কে হৃধির হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। তাঁরা আপু আছে সাথে শাফীনও। তারা কী ভাববে? এসব ভাবতেই ললাটে তড়তড় করে ঘাম ছুটছে। তাঁরা যদি আজেবাজে ভেবে বাবা-মার কানে লাগিয়ে দেয়? তখন?
—————————–
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
#রঙিন_দূত – ০৭
লাবিবা ওয়াহিদ
——————–
মাহিন হৃধিদের নিকট এসে হৃধিকে অবাক করে দিয়ে শাফীনের কান মলে দিলো৷ শাফীন উত্তেজিত হয়ে বললো,
–“আহ! ভাইয়া, কী করছো? কান ছাড়ো!”
–“তোকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি আর তুই শপিংমল ঘুরে বেড়াস? মা কতো খুঁজছিলো তোকে জানিস?”
–“মায়ের সাথে আমি কথা বলেছি! আমি নিয়ে যাবো, গজ কাপড়! এখন তো ছাড়ো ভাই, প্রেস্টিজ তো আর কিছু রাখলে না!”
শাফীনের কান ছেড়ে দিলো মাহিন। শাফীন কানে হাত বুলাচ্ছে। মুখশ্রী পেঁচার মতোন করে রেখেছে। মাহিন শার্টের কলার ঠিক করতে করতে আড়চোখে হৃধিকে দেখলো। অতঃপর থমথমে গলায় তাঁরার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“কী অবস্থা তাঁরা?”
–“ভালো ভাইয়া। আপনি হঠাৎ শপিংমলে?”
–“মায়ের কাজে এসেছিলাম!”
বলে আবারও হৃধির দিকে দৃষ্টি দিলো। হৃধি তখনো বড়ো বড়ো চোখ করে রেখেছে। শাফীনই তাহলে মাহিনের ছোট ভাই। হৃধি মাহিনের দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই অন্যদিকে ফিরে গেলো।
———————–
–“হৃধির খবর তুই পেলি কই?”
শাফীন তার শুভ্র দাঁতগুলো বের করে এক গাল হাসলো। অতঃপর চালাকীর স্বরে বললো,
–“তোমার লাইফস্টাইল যদি ধরতে পারি তাহলে ভাবীর হুদিশ পাওয়া কোনো ব্যাপারই না! সত্যি বলবো?”
–“কী?”
–“ভাবী আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। একদম ফাস্ট ক্লাস!”
হাসলো মাহিন। শাফীন মাহিনকে খুঁচিয়ে বললো,
–“ভাবীর জন্যে হাসি ফুটে আর আমার কপালে মাইর জুটে! ভাবীকে বলে দিবো কিন্তু!”
সঙ্গে সঙ্গে শাফীনের মাথায় গাট্টা পরলো। শাফীন ধীর কন্ঠে আর্তনাদ করলো। মাহিন কিছু একটা ভেবে শাফীনের উদ্দেশ্যে বলে,
–“হৃধির সাথে টাইম স্পেন্ডের একটা সুযোগ বের কর তো!”
–“করে দিলে আমি কিছুই পাবো না, আমি জানি!”
–“কী চাস?”
–“আগামী সপ্তাহে এলাকায় ক্রিকেট ম্যাচ আছে। আমায় জার্সি আর ব্যাট কিনে দিবা। আগের ব্যাটটা খেলার অযোগ্য!”
–“এতো টাকা কই পাবো আমি?”
–“একদম কথা এড়ানোর চেষ্টা করবা না। আমি জানি রেডিওতে পারফর্ম করে তুমি টাকা পাইছো!”
–“টাকার পরিমাণ কম! এসব কেনার মতো টাকা নাই আমার!”
–“মা অথবা বাবার থেকে নিবা। আমি কিছু জানি না!”
–“আচ্ছা, বেশ! এখন যা বলেছি তা কর। আগে কাজ পরে বেতন।”
ফিচেল হাসি দিলো শাফীন। অতঃপর মাহিনের কাছ থেকে শুড়শুড় করে কসমেটিকস এর দোকানটাতে ঢুকলো। সেখানে তাঁরা এবং হৃধি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কসমেটিকস দেখছে। শাফীন পাশ থেকে তাঁরাকে কিছু বলে কোথায় যেন নিয়ে গেলো!
——
হৃধি তাঁরাকে কিছু বলতে পাশ ফিরতেই মাহিনকে দেখলো। বেসালাম হয়ে যায় হৃধি। দু’কদম পিছে ফেলে আমতা আমতা করে বললো,
–“তা..তাঁরা আপু কোথায়?”
–“আমি কীভাবে জানবো?”
–“মানে? তাহলে আপনি এখানে কী করছেন?”
–“প্রেমিক-প্রেমিকা তো পাশাপাশি থাকে হৃধি। তাঁরা মেবি বুঝেছিলো। তাইতো আমাদের প্রাইভেসি দিয়ে গেছে!”
মাহিনের কথাটা দোকানের ছেলেটা শুনে ফেললো। ছেলেটা মিটমিট করে হাসছে। হৃধির সেদিকে নজর যেতে চোখ রাঙালো। মাহিন সেই চোখ রাঙানো নজরটা দেখে মুগ্ধতার সঙ্গে হেসে বললো,
–“আপনার রাঙ্গা দৃষ্টি অন্তরে তীরের মতো লাগছে হৃধি!”
–“ঢং কম করেন! সব জায়গায় “আপনি” আপনি করেন কেন আপনি? আমার সম্মান খুয়াতে চাচ্ছেন?”
হৃধির বচনে মুখ ঘুচে গেলো মাহিনের। মিনমিন করে বললো,
–“আমি নিয়্যত করেছি! যেদিন আপনাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবো সেদিনই “আপনি” থেকে “তুমি” -তে আসবো! নয়তো দেখা যাবে, আগের মতোন রাস্তা-ঘাটে বেশরম বলে অপমান করছেন!”
চাপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হৃধি।
–“তাহলে মাঝেমধ্যে আপনি, তুমি’র সংমিশ্রণ করেন যে? আপনি বললে আবার তুমি ঢুকান কেন?”
–“ওটা তো রাগের মাথায় বলে ফেলি। মস্তিষ্ক ঠান্ডা হলে আবার ঠিক হয়ে যাই তো!”
পুরোই আধ পাগল এই ছেলে। এর সাথে কথা বলাই বেকার। হৃধি আর কথা বাড়ায় না। নিশ্চুপ হয়ে রয়। মাহিন মুচকি হেসে হৃধির কিছুটা নিকটে মুখ নিয়ে এসে মিনমিন করে বলে,
–“তবে যাই বলুন, আমি কিন্তু আপনিতেই অভ্যস্ত!”
হৃধির সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে গেলো। ছেলেটা আসলেই কথা জানে ভালো। তবে হৃধি একবারও মাথা উঁচু করে প্বার্শে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে তাকায় না। সে জানে, কথায় কথা বাড়ে। হৃধি একজোড়া নূপুর দেখছিলো। ভিষণ ভালো লেগেছে হৃধির। পাশ থেকে মাহিন বলে ওঠে,
–“এটা আপনার পছন্দ হৃধি?”
হৃধিকে অপ্রস্তুত দেখালো। হৃধি তড়িৎ দৃষ্টি ঘুরালো মাহিনের দিকে। মাহিন উৎসুক নজরে তার পানেই তাকিয়ে। হৃধি আমতা আমতা করে বললো,
–“কিছুটা!”
–“তাহলে আমি কিনে দেই?”
চোখ বড় হয়ে যায় হৃধির। নিজেকে সামলে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
–“একদম না মাহিন। আমার এটা পছন্দ হয়নি!”
বলেই হৃধি দ্রুত কেটে পরে। আর যাইহোক, হৃধি কখনো-ই মাহিনের দেয়া জিনিস নিতে পারবে না। কখনোই না! মাহিন হৃধির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। অতঃপর দোকানের ছেলেটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। মাহিনের হাসি দেখে ছেলেটার বুঝতে বাকি রইলো না মাহিন কী চায়!
——————
দু’দিন ধরে হৃধি সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলছে মাহিন। হৃধির এমন এড়িয়ে চলা বেশ পোড়াচ্ছে মাহিনকে। মাহিন বেশ কয়েকবার হৃধির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু হৃধি নানা ছুঁতোয় তার হাতের ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেছে। মাহিন এবার ভীষণ রেগে আছে হৃধির উপর। হৃধির এমন ইগনোরেন্স সে একদমই মানতে পারছে না। হৃধি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাহিরটা দেখতে ব্যস্ত। রাস্তায় মাহিন দাঁড়িয়ে আছে সেটা লক্ষ্য করলেও না দেখার ভান ধরে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। অভ্যন্তরে বলে উঠলো,
–“আপনাকে বেশি লাই দিয়ে ফেলেছিলাম মাহিন! এই ইগনোরটা আমার প্রথমেই করার উচিত ছিলো। বাস্তবে আমি কখনোই আপনায় ভালোবাসতে পারবো না মাহিন! শুধু শুধু আমার পিছে ছুটে কাজ নেই। আপনার পরিকল্পনা বোঝার মতোন ক্ষমতা আমার নেই!”
তখনই ফোনে কল আসলো। ত্বোহা কল করেছে। হৃধি বিনা-বাক্যে কল রিসিভ করলো। যা ভেবেছিলো ঠিক তাই! ত্বোহা এখনো কাঁদছে। গত দুইদিন পূর্বে ত্বোহার বয়ফ্রেন্ড আকাশ তার সাথে কঠিন প্রতারণা করেছে। ওদের সম্পর্কের ন’মাস চলছিলো। একটা মেয়ে তার ভালোবাসার মানুষের পাশে নিজের ছায়াকেও সহ্য করতে পারে না। সেখানে ত্বোহার বয়ফ্রেন্ড আকাশকে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মেয়েকে দেখা গিয়েছিলো। আকাশ এতোটাই ভরসা জুগিয়ে নিয়েছিলো নিজের প্রতি যে ত্বোহা কারো কথা বিশ্বাস করেনি। সেদিন রাস্তায় নাকি একসাথে একটা মেয়ের সাথে ত্বোহা স্ব-চক্ষে দেখেছে। ত্বোহা আকাশকে হাতে-নাতে ধরতেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছিলো ত্বোহাকে। এ কথা ভাবতেই হৃধির গা গুলিয়ে আসে। সে নিজে দেখেছিলো আকাশকে। আচার-ব্যবহার এমন যেন সাক্ষাৎ ফেরেশতা। কিন্তু অভ্যন্তরে সে নর্দমার আবর্জনা।
তাই হৃধি কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারে না। এর আগেও এরকম দেখেছে। কিন্তু এবার নিজের বেস্টফ্রেন্ডের সাথে ঘটেছে। ভাবতেই গা জ্বলে অসাড় হয়ে আসছে তার। ত্বোহা কাঁদতে নিলেই হৃধি এক ধমকে ত্বোহাকে থামিয়ে দেয়!
–“যে ভালোবাসার যোগ্য না তার জন্যে মুক্তোর দানা ছড়াতে নেই। নেক্সট টাইম নিজেকে শক্ত করে আমার সামনে আসবি!”
বলেই খট করে কল কেটে দেয় হৃধি। তখনই একটা মেসেজ আসে! মাহিনের মেসেজ। হৃধির বিরক্তিতে ললাটে ভাঁজ পরলো। কিন্তু ভুলবশত মেসেজে স্পর্শ করে ফেলে হৃধি।
–“রাতে আপনি ছাদে আসবেন হৃধি!”
–“আপনাকে মানতে বাধ্য নই!”
–“আপনি আসবেন!”
–“না আসলে কী করবেন শুনি?”
–“আপনি তখন জানার সময় পাবেন না, হৃধি! শুধু নিশ্চুপ হয়ে দেখবেন!”
হৃধি ভীতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মাহিনের শেষ মেসেজটির দিকে। নাহ! এবার সহ্য সীমানার বাহিরে চলে গেছে সব! কিছু একটা করতে-ই হবে। কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবে? তাহলে তাই হোক! ইচ্ছে মতো কথা শুনাবে আজ। হৃধি অন্তরে কড়া গুলো সাজিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো!
———————–
~চলবে, ইনশাল্লাহ।