#রঙিন_দূত – ০৮,০৯
লাবিবা ওয়াহিদ
০৮
————————–
আঁধারে নিমজ্জিত সমস্ত নগরী। প্রকৃতিতে ঝড়ের প্রস্তুতি চলছে। ঝড়ো হাওয়ায় পর্দা অবিন্যস্ত ভাবে উড়ছে। মেঘেদের আনা-গোনা ভালো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব! ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ছুঁইছুঁই। হৃধির আপাতত প্রকৃতির অস্বাভাবিক অবস্থা খেয়াল নেই। সে একমনে কলম কামড়াতে ব্যস্ত। দৃষ্টি তার মুঠোফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। মধ্যাহ্নে মাহিনকে কথা শুনানোর কথা ভাবলেও রাতে এসে তার সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। সে যাবে না ভাবলো। কী দরকার, মাহিনের মুখোমুখি হওয়ার? তাই মাহিনের বিষয়ে তোয়াক্কা না করে সে পড়ায় ধ্যান দিয়েছিলো। কিন্তু ঠিক সাড়ে এগারোটায় মাহিনের মেসেজ আসে।
–“আপনি কী আসবেন না হৃধি?”
আবারও মেসেজ এসেছে ঠিক পনেরো মিনিট পর।
–“আপনি না আসলে আমি সারা রাত একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো।”
তখনো উত্তর দেয় না হৃধি। পনেরো মিনিট ভাবনায় লাগিয়ে দিলো। দোটানায় আছে হৃধি। হঠাৎ তার বাহিরে নজর গেলো। বৃষ্টি গুড়িগুড়ি পরা শুরু হয়েছে। মাহিন কী তাহলে সত্যি-ই এখনো ছাদে জেদ ধরে দাঁড়িয়ে? মাহিনকে যতটুকু চিনেছে মাহিন ভীষণ জেদী এবং একরোখা। নয়তো এতো বলার পরেও কেন হৃধিকে ছাড়েনি? নাহ হৃধি আর ভাবতে পারছে না।
—————
মাহিন বৃষ্টিতে ভিঁজে একাকার। মিনিট সাতেক হলো বৃষ্টি নেমেছে। পিটপিট করে অদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে মাহিন। কতদিন পর প্রশান্তি দিচ্ছে তাকে এই স্নিগ্ধময় বৃষ্টি। প্রিয় নারীটি পাশে থাকলে মন্দ হতো না। চাপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো মাহিন। অম্বরের বুকে দৃষ্টি বুলিয়ে কাতর স্বরে বলে,
–“আপনি কী আসবেন না হৃধি?”
তখনই পেছন হতে চিরচেনা কন্ঠস্বর শ্রবণ হয়। কতো মাধুর্য, মাদকতা মিশে আছে এই কন্ঠে। মুহূর্তেই মাহিনের বক্ষে চেপে রাখা পাথরটি নেমে গেলো। আবেশে মাহিনের আঁখিযুগল বুজে আসলো।
–“কী হলো মাহিন? শুনতে পাননি? ছাতার নিচে আসুন। এভাবে অসময়ের বৃষ্টিতে ভিঁজতে নেই!”
মাহিন পিছে ফিরে দাঁড়ালো। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি হৃধির ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকানো আঁখিযুগলে নিবদ্ধ। মাহিনের চোখে-মুখে দেখা গেলো তাচ্ছিল্যতা! তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
–“আপনি তো আমায় আগুনে ফেলে দিয়েছেন হৃধি, বর্ষণ তো আমার দেহের আগুন নিভাতে ব্যস্ত। সে কী করে অসময়ের হয় বলুন তো? খুব ভালো লাগছে আপনার, আমার দূর্বস্থা দেখতে?”
হৃদপিন্ডটা কেমন ধ্বক করে উঠলো হৃধির৷ অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মাহিনের মুখশ্রীতে। আবছা আলোয় সতেজ মুখটি কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখের নিচটাও গাঢ় আঁধার দখল করে নিয়েছে। কী আছে এই মাহিনে? কেন এই মাহিনের প্রতি তার হৃদয় পাথর হতে পারে না? তার চোখের সামনে এতো এতো ঘটনা ঘটার পরেও কেন এই ছেলেকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে? কেন মাহিন নামক নিষিদ্ধ মানুষকে নিয়ে চিন্তা করে? কেন? এই কেন-র উত্তর আপাতত হৃধি পেলো না। হৃধি নিজেকে সামলে বললো,
–“বাচ্চামো করবেন না মাহিন। প্লিজ ছাতার নিচে আসুন, এবং বাড়ি যান।”
–“বাচ্চামো? আপনি আমার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেননি, এটা বাচ্চামো নয়? আপনার জন্যে আমার কষ্ট পাওয়া আপনার কাছে বাচ্চামো? কী দারুণ উক্তি বললেন হৃধি!”
–“দেখুন মাহিন। প্লিজ আপনি আমার জীবন থেকে দূরে সরে যান। আপনি আমার জন্য নিষিদ্ধ। আপনার সাথে কোনো সম্পর্ক জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কেন পাগলামি করছেন? আপনি বেস্ট কাউকে ডিজার্ভ করেন!”
মুহূর্তে-ই মাহিনের অধরে দেখা মিললো হাসিদের সমোরোহ। এরকম সিরিয়াস একটি মুহূর্তে মাহিনের এরূপ হাসি হৃধি প্রত্যাশা করেনি, একদমই করেনি। সে তার বোকা চাহনি নিক্ষেপ করে রইলো মাহিনের নিকট! মাহিন হৃধির নাকে আঙুল ছুঁয়ে বলে,
–“আরে রে আমার বোকারাণী! আমার কোনো ডায়মন্ড লাগবে না, আপনার মতো সরি, একান্ত আপনি নামক হিরেটাকেই প্রয়োজন। আই ডিজার্ভ ইউ এন্ড ইউ ডিজার্ভ মি!”
পুণরায় বোকা বনে গেলো হৃধি। ডায়মন্ড আর হিরের মধ্যে পার্থক্য কী? হৃধি সীমান্তহীন বিষ্ময় নিয়ে বলে,
–“ডায়মন্ড আর হিরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?”
আবারও হাসলো মাহিন। যেন হৃধি তাকে কৌতুক শুনিয়েছে। মাহিন চট করে হৃধির সাথে ছাতার নিচে চলে আসলো। অতঃপর ছাতায় রাখা হৃধির হাতের উপরে নিজের হাত রাখলো।
–“ডায়মন্ডটি হচ্ছে ইংরেজী শব্দ আর হিরে হচ্ছে বাংলা শব্দ। বাংলা শব্দে যতটা মাধুর্য এবং অনুভূতির গভীরতা মিশে আছে ততটা আপনি চাইলেও অন্য ভাষায় খুঁজে পাবেন না। তেমনই আপনি আমার হিরে, একদম অরিজিনাল হিরে। আমার আশেপাশে অনেক ডায়মন্ড ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু আপনার মতো হিরের মতো অনুভূতি আমি কোথাও পাই না হৃধি!”
কিয়ৎক্ষণের জন্যে থমকে যায় হৃধি। কথার মানে বুঝতে কিছুটা সময় লাগলেও তার হৃদয়টা আজ ভালোভাবেই নাড়িয়ে দিয়েছে মাহিন। কথার জাদু আছে ছেলেটার, যাকে বলে মারাত্মক রকম। তার এই বুলি দ্বারা যে কাউকে খুন করতে সক্ষম সে। যেমনটা খুন হচ্ছে হৃধি স্বয়ং। তার খেয়াল-ই নেই মাহিন কখন ছাতা সরিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। চোখে বৃষ্টির ছিঁটা পরতেই হৃধির ধ্যান ভাঙ্গে। হৃধি পিটপিট করে মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“এটা কী ধরণের অসভ্যতামি মাহিন? ছাতা কোথায়? ভিঁজে যাচ্ছি তো!”
–“ভিঁজুন না হৃধি। বৃষ্টি যে ভেঁজাতেই আসে, আমরা ভিঁজলে ক্ষতি কী?”
হৃধি তাও শুনলো না। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পর হৃধির দিকে মাহিনের চোখ যেতেই মাহিন অন্যদিকে ফিরে ছাতাটা এগিয়ে দেয়। অতঃপর থমথমে গলায় বলে,
–“বাসায় যান হৃধি, আপনাকে ভালো দেখাচ্ছে না। ভেঁজার প্রয়োজন নেই!”
হৃধি চরম অবাক মাহিনের এরূপ উক্তিতে। সে নিজের দিকে তাকালো। মুহূর্তে-ই গাল জোড়া গরম করে এলো তার। ছাতা নিয়ে এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। দ্রুত ছুটে দরজার দিকে চলে গেলো। মাহিন হাসলো, হৃধির বাচ্চামোতে। আপনমনেই আওড়ালো,
–“লজ্জাবতী আমার!”
———————
ভার্সিটির ক্যান্টিনে মাহিন এবং ত্বোহাকে একসাথে বসে থাকতে দেখে হৃধির বিষ্ময়ের অন্ত নেই। আঁখিযুগল ইয়া বড় বড় করে তাকিয়ে আছে বিপরীতে বসা দু’জন নারী পুরুষের দিকে। কারণ দু’টো। এক মাহিন ত্বোহার সঙ্গে কথা বলছে। দুই, মাহিনদের ক্লাস শুরু হয় আনুমানিক সাড়ে দশটায়। এখন ঘড়িতে ন’টা সাতাশ। মাহিন কখনোই এতো জলদি ভার্সিটি আসে না। মাহিনের থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সাব্বির এবং রাফিদ। তারা মাহিনের সবসময়ের সঙ্গী। মাহিন হৃধিকে দেখতেই ত্বোহার উদ্দেশ্যে বললো,
–“আমি যা বললাম ভেবে দেখো। তোমার ভাবার সময় ব্রেক টাইম অবধি। ব্রেক টাইমে আমি আবার আসবো তোমাদের সাথে মিট করতে।”
বলেই উঠতে উঠতে হৃধির দিকে তাকিয়ে সকলের আড়ালে চোখ টিপ দিলো। হৃধি তৎক্ষনাৎ চোখ রাঙালো মাহিনের উদ্দেশ্যে। মাহিন হেসে কপালে পরা চুলগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে তার সঙ্গী দু’জনকে নিয়ে প্রস্থান করলো। হৃধি ত্বোহাকে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই বেল বাজলো। ত্বোহা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“চল, হৃধি। ক্লাসে যেতে হবে!”
ত্বোহাকে এতোটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না হৃধি। গত পরশুও তো কেঁদে দুনিয়া ভাসাচ্ছিলো, এতো ইমোশনাল মেয়ে এক দিনের মধ্যে কী করে চেঞ্জ হলো? অবিশ্বাস্য!
ব্রেকটাইম আসতেই ঠিক মাহিন চলে আসলো। মাহিনের সাথে রয়েছে সাব্বির, রাফিদসহ আরও কিছু অচেনা ছেলে যাদের সাথে হৃধি পরিচিত নয়। তবে অবাক করার বিষয় হলো, ওদের কয়েকজনের হাতে ক্রিকেট ব্যাট! আর দু’তিনজনের হাতে হকিস্টিক! হৃধি এবার সত্যি-ই বেকুব বনে গেলো। ওদের কাজ-কর্ম কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না হৃধি। সারা ক্লাসে কৌতুহলের তাড়নায় ক্লাসেও মনোযোগী হতে পারেনি। ত্বোহাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই ত্বোহা এড়িয়ে যেত। হৃধির ভাবনায় ছেদ ঘটালো মাহিন।
–“কী ত্বোহা? পজিটিভ নাকি নেগেটিভ?”
ত্বোহা একবার হৃধির দিকে তাকালো। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে চরম রেগে উঠলো। ত্বোহার হঠাৎ ভয়ংকরী রূপ দেখে হৃধি পুণরায় চমকালো। আজ যেন হৃধির চমকানোর দিন। ত্বোহা নাক কুচকে বলে,
–“কই ওই জা” নো” য়া” র?”
সাব্বির মুখ টিপে হেসে বলে,
–“আমাদের ভবনের পেছনের দিকে মেয়ের হাত ধরে ঘুরছে!”
মাহিন হৃধিকে চোখ টিপ মেরে বাঁকা হেসে বলে,
–“আজ জম্মের মতোন ওর মেয়ে বাজি ছুটাবো! ত্বোহা, আর ইউ রেডি?”
ত্বোহা আত্মবিশ্বাসের সাথে মাথা নাড়ায়।
—————————
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
#রঙিন_দূত – ০৯
লাবিবা ওয়াহিদ
————————–
মাস্টার্স ভবনের পিছেই আকাশকে পাওয়া গেলো। আপাতত একটা মেয়ের হাতে হাত ধরে প্রেমালাপে ব্যস্ত। মাহিন অধর বাঁকিয়ে প্রথমে ত্বোহার দিকে তাকালো। ত্বোহার হাত জোড়া মুঠিবদ্ধ, হয়তো নিজেকে সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। হৃধির তো আকাশকে দেখেই মুখ ঘুচে এলো। চোখ রাঙিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে। হৃধির পাশেই মাহিন। হৃধির কানে ফিসফিস করে মাহিন বললো,
–“দৃষ্টি নামান হৃধি, আমার হিংসে হচ্ছে!”
হৃধি তড়িৎ দৃষ্টি ঘোরালো মাহিনের দিকে। মাহিন পুণরায় চোখ টিপ দিলো। হৃধি অপ্রস্তুত হলো এবং দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মাহিন স্মিত হেসে ত্বোহার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“থেমে কেন ত্বোহা? স্টার্ট!”
ত্বোহা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো আকাশের দিকে। মাহিন হৃধির কানে পুণরায় ফিসফিস করে বলে,
–“আপনাকে আজ ভিষণ সুন্দর ড্রামা দেখাবো আজ। ক্রেডিট কিন্তু আপনার এই লাভারের!”
ত্বোহা প্রথমেই আকাশকে গিয়ে এক চড় লাগালো। চড়টা এতোই শক্ত ছিলো যে আকাশের গাল লাল হয়ে গেছে। আকাশ এবং তার পাশের মেয়েটা দু’জনেই উপস্থিত ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়! একপ্রকার বেক্কলের মতোন তাকিয়ে আছে দু’জন। আকাশ কিছু বলার পূর্বেই ত্বোহা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
–“নি”**ম্ন” খ্রা’ ম, হা’ রা’ম জা**, আমায় ঠকিয়ে তুই অন্য মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াস? ওইদিনও তো অন্য মেয়ে দেখলাম! আজকাল আবহাওয়া চেঞ্জের মতো মেয়ে চেঞ্জ করিস নাকি? বা’ ন্দ’ র, কু””আ, তোরে এই মুহূর্তে আমি জবাই দিবো!”
আকাশের পাশের মেয়েটা চোখ গরম করে তাকালো আকাশের দিকে। আকাশ তখন তো রেগে-মেগে বোম! প্রতিটা কাজে সবসময় এই মেয়েটা তাকে বাঁধা দেয়। আজ এরে ভালো মতোন-ই টাইট দেয়া লাগবে যাতে সমাজে মুখ দেখাতে না পারে! আকাশ বিশ্রী কিছু কথা শুনিয়ে বলে,
–“অনেক ছাড়সি তোরে, আজ তোর মুখে কালি না লাগাতে পারি তো আমার নাম আকাশ না! এক রাতের জন্যে কতো চা’স, যে আমার ভালোবাসায় বাঁধা দেস প্রতিবার?”
পাশের মেয়েটা ঘৃণায় চলে গেলো। এবার আকাশকে পায় কে? আকাশ ত্বোহার হাত ধরার পূর্বেই মাহিন তার হকিস্টিক হাতে সামনে চলে আসলো। মাহিন মুখে হিংস্রতা নিয়ে বলে,
–“আগে তো নিজে বাঁচ, তারপর নাহয় আজকের রাতের কথা চিন্তা করিস!”
মাহিনের হাতের হকিস্টিক দেখে আকাশের আত্মা কেঁপে উঠলো। আকাশ চারপাশে চোখ বুলালো। তাকে চারপাশে মাহিনের বন্ধু’রা ঘিরে ধরেছে। পালানোর জন্য এক সুতো পরিমাণ জায়গাও ছাড়ে নাই। আতঙ্কে শুকনো ঢোঁক গিলে। মাহিন ত্বোহাকে নিয়ে হৃধির কাছে চলে আসলো৷ ওদের কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে হৃধির উদ্দেশ্যে বলে,
–“ওর ব্যাপারটা আমরা দেখছি আপনি শান্ত থাকুন। মা’ই’র দেখে ভয় লাগলে চোখে হাত দিয়ে রাখবেন হৃধি, আজ আমার মা’ই’ র কিন্তু থামবে না!”
রাগী অবস্থায় শীতল কন্ঠস্বর। হৃধি চোখ পাকিয়ে মাহিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। হৃধির ভেতরটা কেমন আতঙ্কে ভরে উঠলো। ওরা মারছে মারুক মাহিন কেন মারবে? এই ছেলে কী মারধর ছাড়া কিছু পারে না নাকি? হৃধি মাহিনকে আটকাতে চেয়েও পারে না। মাহিন চলে যায়। ততক্ষণে মা’ ই’ র শুরু হয়ে গেছে। ত্বোহা ওদের মারধরের সিনটা বেশ এঞ্জয় করছে। একেক মার দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে বলছে,
–“বেশ হয়েছে ঠিক হয়েছে, আমায় খারাপ প্রস্তাব করার সাজা এরকম-ই হবে! আমার মাহিন ভাই থাকতে কিসের ভয়, লে ছক্কা!”
হৃধি চোখ পাকিয়ে ত্বোহার দিকে তাকিয়ে। এ আবার কেমন রিলেশনে ছিলো? দু’দিন আগেও যে কেঁদে ভাসিয়েছে সে আজ এতো চেঞ্জ! এ যেন গিরগিটির জলজ্যান্ত উদাহরণ। হৃধিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ত্বোহা বলে ওঠে,
–“জানিস, আকাশ বিচ্ছুরে চড় এবং গা’লি-গা’লাজ করে আমার আসমানে উড়তে ইচ্ছে করছে। উফফ, মাহিন ভাই গ্রেট!”
হৃধি ওদিকে তাকাতেই দেখলো মাহিন আকাশের মেইন পয়েন্টে দু-চারটা হকিস্টিকের ঘাঁ লাগিয়ে দিয়েছে। একেকটা দেয়ার আগে বলছে,
–“ভার্সিটিতে মেয়ে বাজি করতে আসো তাই না বন্ধু? কী ভেবেছো, আমাদের মতোন সিনিয়র’রা হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবো? ভাগ্যিস তুমি আমারটার দিকে নজর দেও নাই, নয়তো এই জিহবা আর তোমার চোখ, দুটোই আমি টেনে উঠায় নিতাম।”
মাহিনের এরূপ উক্তিতে ত্বোহা হুট করে বলে উঠলো,
–“মাহিন ভাইকে বিশ্বাস করতে পারিস, হৃধি!”
হৃধি তড়িৎ ত্বোহার দিকে তাকালো। ত্বোহা এখন স্বাভাবিক, আগের মতোন উত্তেজিত ভাবটা নেই। কেমন যেন আনমনে হয়ে আছে। ত্বোহা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হৃধির উদ্দেশ্যে বলে,
–“ভালোবেসে সকলে ঠকে না রে! হাতের পাঁচ আঙুলও যেমন সোজা হয় না তেমন-ই পুরুষ জাতিটা ভালো-খারাপ মিলিয়েই। মাহিন ভাইয়ের চোখে তোর জন্যে যে ভালোবাসা দেখেছি তা আমি আকাশের চোখে দেখিনি, ঠকে গেছি। কিন্তু এই পৃথিবীতে কিছু লাকি পিপল থাকে যারা পবিত্র ভালোবাসাই পায়। তুই ভাইয়াকে ইগনোর করছিলি দেখে ভাইয়া আমার কাছে ছুটে এসেছিলো, সে কী পাগল অবস্থা। আমি যেহেতু তোর বেস্টফ্রেন্ড তাই আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না তুই কোন জিনিসটাকে বেশি ভয় পাস। তাই আমি মাহিন ভাইয়াকে বলে দিয়েছি সব, আমার ভেতরের ক্ষতগুলাও। ভাইয়া-ই আমায় দু’দিন মেন্টালি সাপোর্ট দিয়েছে এবং এই দুর্লভ কাজের মূল ক্রেডিট-টা মাহিন ভাইয়ারই। তুই কী করে এই অমূল্য মানুষটাকে পেয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিস?!”
হৃধি নিশ্চুপ হয়ে শুনে গেলো। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, হৃধির মধ্যে। হৃধির কোনো পতিক্রিয়া না দেখে ত্বোহা হতাশ হলো এবং এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হৃধির অভ্যন্তরের তুফানটা যে তার বাবাকে ঘিরে। মাহিনের প্রতি তার অবিশ্বাসটা কেন যেন আসে না। নিজের অবাধ্য মনকে বোঝাতে পারতো না তাইতো “সব ছেলে’রাই এক” ভেবে নিজের মনকে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালাতো। কিন্তু আদৌ কী এই অশান্ত হৃদয় শান্ত হওয়ার পাত্র?
মাহিন সকলকে থামিয়ে দেয়, যথেষ্ট হয়েছে। সাব্বির এবং আরেকটা বন্ধু আকাশকে মাটি থেকে তুলতে সাহায্য করলো। মাহিন রাফিদের উদ্দেশ্যে বললো,
–“রাফিদ, প্ল্যান বি রেডি?”
–“হ, মাম্মা! ওই মেয়ে আর স্যার দু’জনেই রেডি!”
–“তাহলে চল, প্রিন্সিপালের কাছে!”
আকাশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,
–“হ্যাঁ, চল! আজ তোদের এই ভার্সিটি থেকে বের করিয়েই ছাড়বো। খুব আসছো দাদাগিরি দেখাতে!”
মাহিন চট করে এক চড় লাগালো আকাশের গালে। আকাশ আর্তনাদ করে উঠলো।
–“ভার্সিটি তোর বা’পের নাকি প্রিন্সিপাল তোর বা’প! কে বের হয় আর কে বের করে দেয় সেটা সময়-ই ঠিক করবে! ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না আবার আমাদের ধমকায়! তোর পা কেটে গলায় ঝুলায় দিবো!”
মাহিনের এমন উক্তিতে আকাশ হাঁসফাঁস করতে লাগলো শুধু। এই মাহিন একদম-ই সুবিধার পাত্র নয়।
প্রিন্সিপালের নিকট গিয়ে আশ্চর্যরকম ঘটনা ঘটলো৷ সেখানে একটা মেয়েকে কাঁদতে দেখা গেলো। মাহিনদের কথোপকথনে বোঝা গেলো একসময় এই মেয়েটিকেও চরম ডিস্টার্ব করতো আকাশ। আকাশ নাকি মেয়েটির ওড়না ধরে টেনে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করেছিলো, যার ফলে মাহিনরা আকাশ’রা এমন মেরেছে। এরূপ শুনে হৃধি হতভম্ব হয়ে গেলো। এ তো পুরোই বানোয়াট কাহিনী। প্রিন্সিপালের কেবিনে অবস্থিত সেই শিক্ষক যেন প্রিন্সিপালের কান আরও ভার করে তুললো আকাশের বিপক্ষে। সব শুনে প্রিন্সিপাল তৎক্ষনাৎ আকাশের টিসির ব্যবস্থা করতে এবং তার পরিবারকে ডাকার নির্দেশ দিলো।
হৃধি যেন এখনো কোনো এক ঘোরে আছে। মাহিন হুট করে কোথা থেকে এসে হৃধির সামনে চুটকি বাজালো এবং বললো,
–“শকে আছেন হৃধি? শকে থেকে লাভ নেই। মাহিন যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন আপনি ভিন্ন ভিন্ন শকে পরবেন। এখন ছাড়ুন এসব। আসুন না, একসাথে রিকশায় চড়ে নিজ নীড়ে পৌঁছাই? ভাড়া কিন্তু আমি দিবো!”
~চলবে।