চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ চার

0
500

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ চার
#মম_সাহা

নিরব রাস্তা তুমুল চিৎকারে সরব হলো। আশেপাশের মানুষ গুলো আকষ্মিক ঘটনার হতভম্বতা কাটিয়ে ছুটে আসলো মেয়ে গুলোর কাছে। বাহারও থমকে দাঁড়ানো নিশ্চল পা গুলো কোনোমতে টেনে নিয়ে এসে দাঁড়ালো মাটিতে লুটিয়ে পড়া চেরির পানে। ছোট্টো মেয়েটা কেমন করে যন্ত্রণায় হামাগুড়ি দিচ্ছে! পাশেই চিত্রা তার বা’হাত ধরে লাফাচ্ছে। মেয়েটার বা’হাতটাও বিধ্বস্ত প্রায়। অহি কাকে জড়িয়ে ধরবে ভেবে পেলো না। ছোট্টো চেরি গাল ধরে চিৎকার করে কাঁদছে, চিত্রা নিজের বা’হাত ধরে লাফাচ্ছে, হুট করে সুন্দর মুহূর্তটা কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো! এলাকার মানুষ খবর পাঠালো চিত্রাদের বাড়ি। চিত্রা নিজের জ্ব*লন্ত হাতটা নিয়েই নিচে বসে পড়লো। চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা চেরিকে ডান হাত দিয়ে অনবরত ধাক্কানো শুরু করলো। সাথে তার তুমুল আহাজারি। ছোট্টো চেরি নিবিড়, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলো।

চিত্রা কিংবা চেরি কাউকে ধরলো না অহি। বরং ছুটে গেলো তার থেকে পাঁচ হাত দূরের বিশাল দোকানটার দিকে। তার ছুটে যাওয়াটা যেন এ মুহূর্তে আরেক অপ্রত্যাশিত কাজ। বাহার চেরিকে কোলে তোলে নিলো আর চিত্রার হাত ধরে টেনে তুললো। লোকটা বোধহয় এ প্রথম এতটা হতভম্ব হয়েছে। মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছে না। কোনো মতে চিত্রাকে ধমকে বললো,
“উঠো তো, এখানে বসে থাকলে কোনো সমাধান হবে না, উঠো দ্রুত। তুমি না অনেক সাহসী? উঠো। চেরির অবস্থা কিন্তু খারাপ।”

চিত্রার বা’হাতটা কেমন যেন অবশ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। তবুও মস্তিষ্ক তার সচল। চেরির কথা সেই সচল মস্তিষ্কের নিউরনে ঝড় তুললো। চিত্রাও উঠে দাঁড়ালো। ক্রন্দনরত মুখ খানা নিয়ে অসহায়ের মতন প্রশ্ন করলো বাহারকে,
“আমার চেরি ঠিক হয়ে যাবে তো, বাহার ভাই?”

বাহার কেবল ক্রন্দনরত মেয়েটার মুখের দিকে তাকালো। চিত্রাদের বাড়িতে এসেছে পুরো বারোমাস সম্পন্ন হলো কিন্তু এভাবে মেয়েটাকে বোধহয় দেখা হয় নি। কখনো তাকানোর প্রয়োজনই বোধ করে নি। আজ কিঞ্চিৎ মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য। নিজেরও পুরোটা হাত ঝলসে গেছে, তবুও মেয়েটার চিন্তা সব ছোটো বোনের জন্য। হয়তো এই আচরণটার জন্য ই এত মায়া লাগছে।

তন্মধ্যেই ছুটে এলো অহি। হাতে তার বড় বড় দু’টি পানির বোতল। সে ব্যতিব্যস্ত হাতে একটা পানির বোতল বাহারের দিকে এগিয়ে দিয়ে কোনো মতে বললো,
“বাহার ভাই, চেরির মুখে হসপিটাল না যাওয়া অব্দি পানিটা ঢালতে থাকবেন। আমি চিত্রাকে নিয়ে পরের রিকশায় আসছি। পানি ঢালা থামাবেন না কোনো মতে।”

এই মুহুর্তে এসে অহির চিত্রার প্রতি এতটা ভালোবাসায় বাহার মুগ্ধ। মুগ্ধতা কাটিয়ে বাহার পানির বোতলটা নিয়ে ধপ করে উঠে বসলো রিকশায়। অহি চিত্রাকে সাবধানে টেনে পরের রিকশায় উঠলো। নিজের হাতে থাকা দ্বিতীয় বোতলটার মুখের ঢাকনাটা খুলেই চিত্রার হাতে অনবরত পানি ঢালতে লাগলো। দু’টো রিকশাই গন্তব্য ধরলো হসপিটালের। অহি চিত্রার হাতে পানি ঢালছে আর স্বান্তনার স্বরে বলছে,
“কিছু হবে না তোর, ভয় পাচ্ছিস না তো? এই যে অহি আপা আছি তো তোর সাথে। কোনো ভয় নেই তোর।”

আহ্লাদে আর যন্ত্রণায় চিত্রার কান্নারা আরও শব্দ তুললো। অহি কেবল ব্যাথাতুর চোখে ছলছল তাকিয়ে রইলো। বোন গুলো যে তার প্রাণ। এভাবে সুন্দর ফুল গুলোর মূর্ছে যাওয়া টা যে সে মানতে পারছে না।

(৯)

হসপিটালের করিডোরে কত মানুষের আনাগোনা! সরকারি হসপিটালে তুলনামূলক ভাবে ভিড়টা একটু বেশিই থাকে। হৈ চৈ, ভিড়ে পরিপূর্ণ করিডোরে একটা আতঙ্কিত পরিবার দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভিতর তাদের ঝড়ের তীব্রতায় হাহাকার করে উঠছে। একেকটা মানুষ যেন পাথর হওয়ার উপক্রম। চেরির মা কাঁদতে কাঁদতে দিশাহারা প্রায়, বড় চাচীও কাঁদছে। কেবল কাঁদছেন না চিত্রার মা। মুখ-চোখ তার শক্ত, কঠিন। মা জাতির মুখ-চোখ এতটা কঠিন সচারাচর হয় না তবে এই ভদ্রমহিলার হয়েছে। বরাবরই সে একটু শক্ত প্রজাতির মানুষ। খুব সহজে সে নেতিয়ে যান না। নারীজাতি স্বভাবসুলভ কোমল হয় কিন্তু চিত্রার মা ঠিক উল্টো। সে বার বার ধমকে ধমকে ছোটো জা’কে চুপ থাকতে বলছেন। এমন করলে যে অসুস্থ হয়ে যাবে।

তৃষাণ আর দিহান ও কাঁদছে। বোনদের তারা খুব বেশিই ভালোবাসে। তুহিন ছোট ভাইদের স্বান্তনার স্থল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ঔষুধের জন্য যে তুমুল ছোটাছুটি হচ্ছে সেটা করছে বাহার। চেরির বাবা প্রবাসী, তিনি বছরের এক-দু’বার ছুটিতে আসেন। উনাকে এখনো কিছু জানানো হয় নি। চিত্রার বাবা ডিউটিতে ছিলেন, তাকে জানানো হয়েছে সে আসছেন। আফজাল সওদাগর শহরের বাহিরে গিয়েছিলেন ব্যবসায়িক কাজে। আর তুহিন যেহেতু সবাইকে ভরসা দিচ্ছে তাই এই ঔষুধের দায়িত্ব টা পড়লো বাহারের কাঁধে। বাহার কোনো রূপ অবহেলা না করে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

চেরিকে আর চিত্রাকে আলাদা আলাদা থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। ওদের অবস্থা ভীষণ গুরুতর। তবে অহিকে সিফট করা হয়েছে একটা কেবিনে কারণ ভয়ানক এই পানীয়ের কিঞ্চিৎ ছিঁটে অহির ডান হাতের কিছু কিছু জায়গায় পড়েছে। তখন বোনদের জন্য অনুভব ততটা না করলেও হসপিটালে আসার পর জ্বলে যাচ্ছিলো। অতঃপর তারও চিকিৎসা শুরু হলো।

প্রায় ঘন্টা খানেক পেরুতেই ছুটে এলো নুরুল সওদাগর। চোখেমুখে লেপ্টে থাকা উৎকণ্ঠা। শরীরে জড়ানো আইনের পোশাক। এসেই প্রথম দফায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“চেরি, অহি কেমন আছে? ঠিক আছে ওরা?”

ঠিক এই মুহূর্তে প্রশ্নটা স্বাভাবিক হলেও বাহারের ভীষণ ভাবে কানে লাগলো। প্রশ্নটা কেমন যেন খচখচ শব্দ তুললো সন্দেহের ঝুড়ি খানায়।

“ওদের খবর জানায় নি এখনো। বাবা, চিত্রারও বা’হাতটার বেশ বাজে অবস্থা।”

বাবার প্রশ্নের উত্তরটা তুহিন বেশ বুদ্ধিমানের মতন দিলো। বাবাকে যেন স্মরণ করিয়ে দিলো চিত্রাও ভুক্তভোগী। নুরুল সওদাগর কিছুটা বিব্রত হলেন। অতঃপর প্রহর গুনলেন কিছু ভালো খবরের।

বাড়ি থেকে চাঁদনীর অনবরত ফোন আসছে। ফুপুকে তার কাছে রেখে আসা হয়েছে। মেয়েটারও তো এখন প্রায় গর্ভকালীন শেষ সময়। এতটা চাপ হয়তো ওর শরীরও নিতে পারবে না।

অবশেষে টান টান উত্তেজনা এবং অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বেরিয়ে এলো ডাক্তার। সব হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালো। ডাক্তারের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, তবে প্রশ্ন করার সাহস হলো না কারো। মনের মাঝে ভয় গুলো আকাশ ছুঁয়েছে।

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে প্রশ্নটা প্রথম বাহারই করলো,
“ওদের কী অবস্থা? কতটুকু ক্ষতি হয়েছে?”

হাতের গ্লাবস খুলতে খুলতে বয়স্ক ডাক্তার ভয়ে মুখিয়ে থাকা পরিবারটার দিকে দৃষ্টি দিলেন। খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“আমরা প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা দিয়ে ফেলেছি। কেমিক্যাল টা পরার পর আপনারা পানি দেওয়াতে অনেকটা রক্ষা হয়েছে। এ*সি*ড পরার পর একমাত্র পানি দিলেই এটার প্রকোপ অনেকটা কমে যায়। তবে,ছোটো বাচ্চাটার শ্বাসনালী আর ডান গালটার অবস্থা ভালো না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। লাইফ সাপোর্টে রাখা আছে। আর যে মেয়েটার বা’হাত পুড়েছে ওর এতক্ষণ জ্ঞান না থাকলেও এখন জ্ঞান ফিরেছে। ওর হাতের অবস্থাও ভালো না। আপনাদের সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। অবস্থা বলা যায় তত সুবিধার না। আর যার ছিঁটকে এসে অল্প স্বল্প লেগেছে তাকে পুরো চিকিৎসায় দেওয়া হয়েছে। সে এখন ঘুমের ইনজেকশনের কারণে ঘুমিয়ে আছে।”

চেরির মায়ের হাউমাউ করে কান্না বাড়লো। প্রতিটি প্রাণ যেন এমন একটা খবরে আহত হলো। চেরি আর চিত্রাই ঐ বাড়ির প্রাণ, তাদের অস্বাভাবিক এমন ঘটনায় সবারই প্রাণ ঝরে যাওয়ার উপক্রম।

নুরুল সওদাগর ততক্ষণে তার পুলিশ টিমকে খবর জানিয়ে দিয়েছে। এমন একটা ঘটনা যে-ই করেছে, তাকে বাঁচতে দেওয়া হবে না।

চেরির মা কাঁদতে কাঁদতে যখন ক্লান্ত প্রায় মুনিয়া বেগম ছুটে গেলেন নিজের মেয়ের কাছে। ডাক্তার তো বলেছে মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে, কথা বলতে চায়। মেয়েটাকে অবশ্যই সাহস দিতে হবে।

মুনিয়া বেগমের পিছে পিছে তুহিন,দিশান,তৃষাণ সবাই ই গেলো। এমনকি এতক্ষণের কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হওয়া চেরির মা অবনী বেগমও গেলেন নিজের বড় জা’য়ের হাত ধরে। সওদাগর বাড়িটা এমনই, এখানে আমি তুমি বলে কিছু নেই, এখানে সবাই মিলে আমরা। নারী মহলে কথা কাটাকাটি, কিঞ্চিৎ রেষারেষি থাকলেও বাড়ির বাচ্চাদের প্রতি সবাই সহনশীল, নমনীয়। এক রকমের ভালোবাসা প্রতিটা সন্তানের জন্য।

চিত্রার অনবরত শ্বাস নেওয়ার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে মেয়েটা কতটা অসহনীয় ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। মুনিয়া বেগম এসেই মেয়ের ডান হাতটা চেপে ধরলেন। এতক্ষণের শক্ত, দৃঢ় মানবী মেয়ের অসহায়ত্ব দেখে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন। মুঠোয় রাখা মেয়ের হাতটা পরম স্নেহে কতক্ষণ আদর করে দিলো। খুব যত্নে চুমু এঁকে দিলো।

চিত্রা কোনোরকমে উচ্চারণ করলো,
“আমার চেরি কেমন আছে, আম্মু?”

অবনী বেগম এগিয়ে এলেন। এতক্ষণ তার মুখে যে ভয়াবহ কান্নাটা ছিলো, এখন সেটা গিলে ফেলেছে। চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“সবাই ভালো আছে। তুই চিন্তা করিস না। সুস্থ হয়ে উঠ।”

চিত্রা ছোট চাচীর দিকে তাকালো। ঠোঁট ভেঙে তার কান্না এলো। ছোট চাচী যে খুব সাবধানে মিথ্যে কথা বলার প্রয়াস চালিয়েছে সেটা বুঝতে তার বাকি রইলো না।

তন্মধ্যেই চিত্রার কক্ষে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো চিত্রার বাবা নুরুল সওদাগর। এসেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার কলেজের সামনে নাকি কোন বখাটে ছেলের সাথে আজ ঝামেলা করেছো? এটা কি সত্যি!”

এমন ভয়াবহ সময়ে এই প্রশ্নটা যেন নেহাৎ ই বেমানান মনে হলো। চিত্রা কেবল ফ্যালফ্যাল করে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তটাতে বোধহয় সে বাবার স্নেহ ছাড়া কিছুই প্রত্যাশা করে নি।

নুরুল সওদাগর স্থান,কাল, পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে উঠলো। ধমকে বললো,
“তুমি নিজেই যেচে বিপদ ডেকেছো, তোমার সাথে ভুক্তভোগী ঐ নিষ্পাপ দুটি মেয়েও। তোমাকে বার বার বলেছি সাবধান হও নি। সব জায়গায় দেখিয়ে গেছো নিজের দস্যিপনা। খুব সম্ভবত আজ সকালে যে ছেলের সাথে ঝামেলা করেছো সে-ই এ কাজটা করেছে। নিজে যেচে বিপদ এনেছো এবার ভুগতে থাকো। আমার তো আফসোস হচ্ছে ঐ মেয়ে দু’টির জন্য। পুড়লে তুমি একাই পুড়তে, ওদের তো দোষ ছিলো না।”

কক্ষে অবস্থানরত প্রতিটি মানুষ অবাক হয়ে নুরুল সওদাগরকে দেখে গেলো। বাবার এমন উক্তি আদৌও সাজে! তাও মেয়ের এ অবস্থায়?

নিরবতাকে আরেক ধাপ অবাক করে কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বাহার ভাই বলে উঠলো,
“এমন বাবার মেয়ের কেবল পুড়ে যাওয়া না, মরে যাওয়া উচিৎ।”

বাহারের কথায় মিষ্টি হাসলো চিত্রা। বা’চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুবিন্দু। কাঁপা কণ্ঠ, মুখে হাসি নিয়ে সে বললো,
“আমিন।”

নিরবতা বাড়লো। বিষাদ বাড়লো। চিত্রা অনুভব করলো, শরীরে পরা এ*সি*ডও বোধহয় এত জ্বালায় নি যতটা বাবার কথা জ্বালিয়েছে। চামড়া পু*ড়ে যাওয়ার জ্বালার চেয়ে হৃদয় পু*ড়ে যাওয়ার ব্যাথা বেশি। চামড়ায় প্রলেপ লাগানো যায়, হৃদয়ের গতি কী? কেবল ক্ষত বয়ে বেড়ানো ছাড়া!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here