চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ ছয়

0
474

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ ছয়
#মম_সাহা

(১৩)

ভাদ্র মাসে প্রকৃতি বোধহয় একটু বেশিই উত্তপ্ত থাকে। বাহিরের প্রকৃতি রোদে পুড়ে যেন ছারখার হয়ে যাচ্ছে। হসপিটালের ভেতরে অবশ্য কৃত্রিম শীতলতার আবরণ। হসপিটাল টা বেশ শুনশান। কোনো অহেতুক শব্দ নেই, কথাবার্তা নেই। সেই শুনশান পরিবেশে গা কাঁপানো উত্তেজনা নিয়ে একটি বিধ্বস্ত পরিবার দাঁড়িয়ে আছে। অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে তাদের পরিবারের দু দু’টো উড়ন্ত পাখি ডানা হারিয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছে। তন্মধ্যেই তাদের কুটুম বাড়ির ছেলের এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাও যেন ভীষণ অবাক এবং স্তব্ধ করেছে। নুরুল সওদাগর তার ফর্মাল পোশাকটা নিয়েই দেয়ালের সাথে লাগানো চারপায়ার উপর চিন্তিত মুখে বসে আছে। তার যেন মনে হচ্ছে, যে রহস্যের গর্ত সে খুঁড়েছে তা এত সহজে সমাধান করা যাবে না। খুব গভীরে হয়তো যেতে হবে।

নিরবতার জাল কাটলো। আফজাল সওদাগর গুরু গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এখন তো আমাদের একটু ও বাড়িতেও যাওয়া উচিত। অথচ মেয়ে দুটোরই জীবন-মরণ অবস্থা। কি যে করবো বুঝে উঠতে পারছি না।”

“ভাইজান, মহিনের লা*শ পোস্টমর্টেম করাতে নেওয়া হয়েছে। খুব সম্ভবত আজ দেওয়া হবে না। কাল লা*শ আসবে। তাই আজ না গেলেও সমস্যা নেই। তাছাড়া চাঁদনী আর মাহতাব তো গিয়েছেই।”

নুরুল সওদাগরের কথা শেষ হতেই বার কয়েক মাথা নাড়ালো আফজাল সওদাগর। খুব মনযোগ দিয়ে কি যেন ভাবলেনও। কতক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নুরুল সওদাগরকেই প্রশ্ন করলেন,
“আচ্ছা, তুমিও তো গিয়েছিলে আজ মহিনদের বাড়িতে তাই না? ঠিক কী কী দেখেছিলে? বা হয়েছে?”

“হ্যাঁ আমি আর আমার কয়েকজন কনস্টেবল গিয়েছিলেম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। যেহেতু সেদিন একটা বিরাট কান্ড ঘটেছিলো, সেহেতু আমাদের সন্দেহের তালিকায় সবার আগে নামটা মহিনেরই ছিলো। আর যেহেতু চিত্রার কলেজের সামনে আরেকটা কান্ড ঘটেছে তাই দ্বিতীয় সন্দেহ করেছি ও ছেলেকে। কিন্তু ছেলের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিলো যার ফলস্বরূপ সে পালিয়েছে। এখন আমরা এটা ভাবতে পারি যে, সে যেহেতু পালিয়েছে, আসল দোষী সে। কিন্তু তা না-ও হতে পারে। কারণ বাঙালিরা দোষ থেকে বাঁচতে গিয়ে অপরাধ না করেও অপরাধী হয়ে যায়। যেমন ধরেন ছেলেটা, সে হয়তো ভয়ে পালিয়েছে কিন্তু আমরা চাইলেই তাকে অপরাধী হিসেবে গন্য করতে পারি। আবার হয়তো সে-ই অপরাধী। ছেলেটাকে হাতছাড়া করার পর নিশানা ছুঁড়লাম মহিনের দিকে। তাই আজই চলে গেলাম ওদের বাসায়। দেখি চাঁদনীর শাশুড়ি দরজা খুলেছে। মহিনের কথা জিজ্ঞেস করায় মহিলা প্রথম কতক্ষণ হৈচৈ করেছে পরে নিজেই মহিনের রুম দেখিয়ে দিয়ে বলছে মহিন নাকি উঠে নি, এখনো ঘুমে। আমরা কয়েকবার মহিনকে ডাকলাম, সাড়াশব্দ না পেয়ে অবশেষে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলাম। দরজা ভেঙে উদ্ধার করলাম মহিনের মৃ*ত দেহ যা ঝুলে ছিলো সিলিং ফ্যানের সাথে। মহিনের মা সাথে সাথে ই জ্ঞান হারান। আমরাও ভীষণ অবাক হলাম। কি ভেবেছি আর হলো কি।”

চিত্রাদের পরিবারে উপস্থিত প্রত্যেকটা সদস্য ধ্যান দিয়ে সবটা ঘটনা শুনলেন। নুরুল সওদাগরের কথা শেষ হতেই আনমনেই সবার বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হাসিখুশি পরিবারটায় যেন হুট করেই দুর্যোগ নেমে এলো।

দীর্ঘ দু’ঘন্টার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তন্মধ্যে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলো অভিজ্ঞ ডাক্তাররা। বিচলিত, শঙ্কিত প্রাণ গুলোর হৃদয় মাঝের লুকায়িত ভীতি যেন আরও বাড়লো। তাদের অস্বাভাবিক ভাবে দৌড়াতে থাকা হৃদপিণ্ডকে শান্ত করে ডাক্তার বললেন,
“আপনাদের বড় মেয়ের হাতের সার্জারী করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আশাকরা যায় কোনো একদিন সে আবার আগের মতন দু হাতে ভর দিয়ে দুনিয়া জয় করতে পারবেন।”

উপস্থিত প্রাণ গুলোতে পানি এলো। ঝলমলে হাসির চিলিক দেখা দিলো ঠোঁট জুড়ে। সৃষ্টিকর্তার দরবারে লক্ষ কোটি শুকরিয়ায় ভরিয়ে দিলো। এ যেন উৎসব মুখোর পরিবেশে রূপান্তরিত হলো।

সেই আনন্দকে ছাপিয়ে নুরুল সওদাগর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“চেরির কী খবর? বাচ্চাটা ভালো আছে তো?”

উৎসবে আবার ভাঁটা পড়লো। সত্যিই তো, একজনের হালচাল শুনেই সবাই এত খুশি হয়ে গেলো, অথচ আরেকটা বাচ্চাও তো লড়াই করছে মৃত্যুর সাথে।

নুরুল সওদাগরের প্রশ্নে মুখ ছোটো হয়ে এলো ধবধবে ফর্সা ডাক্তারের। মুখ কালো করে বললো,
“চেরির কোনো পজিটিভ খবর আমরা দিতে পারছি না। ছোটো মানুষের চামড়া ভীষণ কোমল থাকে। আর সে চামড়া যদি এমন ভয়ানক একটা পানীয়ের স্বীকার হয়, তাহলে তো বুঝতেই পারছেন। সে যে এতক্ষণ অব্দি শ্বাস নিচ্ছে, সেটাই মীরাক্কেল। সবটাই সম্ভব হয়েছে এসিডের পর সে স্থানে পানি ঢালার কারণে। নাহয় বাচ্চাটার শ্বাসনালিও একবারে পুড়ে যেতো। আমি অবশ্য একটা সাজেশন দিতে পারি, এ*সিডের তত উন্নত চিকিৎসা এখনও বাংলাদেশে প্রচলন হয় নি। আপনারা উন্নত কোনো রাষ্ট্রে যদি ওকে নিয়ে যেতে পারেন তবে হয়তো বাচ্চাটাকে আবার একটা জীবন দিতে পারবেন।”

ডাক্তারের কথা থামতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো চেরির মা অবনী বেগম। মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন চাঁদনীর মা খাদিজা বেগমও। আফজাল সওদাগর বুক চেপে পাথরের ন্যায় বসে রইলেন। সব কেমন যেন বিশ্রী রকমের এলোমেলো লাগছে। মিনমিন করে সে বললো,
“সব পাপের ফল, পাপের ফল।”

(১৪)

আজ সারাটা দিন বাহারের ছায়ার দেখাও পায় নি কেউ। সে তার ব্যাক্তিগত কাজ, পড়াশোনা, টিউশন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলো। এ নিয়ে চিত্রা রানীর ভীষণ অভিমান জমেছে। অথচ দিনরাত সে জপে যায় বাহারকে তার পছন্দ না। মেয়ে জাত সবসময় অতিরিক্ত বুঝদার হওয়ার পরও নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে খুব একটা অবগত তারা থাকে না। আবার কখনো কখনো অনুভূতির বিপরীতে কথা বলে নিজেদের প্রমাণ করতে গিয়ে আরও জড়িয়ে পরে অনুভূতির শিকলে। চিত্রাও তার বহির্ভূত নয়। তার উপর আবার টিনএজার। বয়ঃসন্ধির অনুভূতি একটু বেশিই হয়। আকর্ষণ ক্ষমতা তাদের বেশি কাজ করে। চোখ তো নয় যেন রঙিন চশমা।

রাত তখন দেড়টা। হসপিটালের করিডোর জনমানবহীন। চিত্রাদের পরিবারের বেশিরভাগ মানুষ বাসায় চলে গিয়েছে। কেবল অহি থেকে গেছে চেরির সাথে। আর তুহিন এবং চিত্রার মা নিচে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

চিত্রার চোখে ঘুম নেই। সারাদিন শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ তার অবশ হয়ে আসছে যেন। অহি আপা কিছুক্ষণ পর পর এসে দেখে যাচ্ছে আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আবার ছুটে যাচ্ছে চেরির কাছে। চেরির আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। আর চিত্রার মাও তো দু’দিন যাবত এ হসপিটালেই পরে আছেন। তাই তাকে নিয়ে তার বড় ছেলে নিচে গিয়েছে একটু বিশ্রাম করানোর জন্য।

চিত্রা যখন ঘুমানোর চেষ্টায় সবে চোখ বন্ধ করলো রুমে কারো বিচরণ অনুভব করলো। বন্ধ করে রাখা চোখের পাতা নিমিষেই খুলে ফেললো সে। তার সামনে অনাকাঙ্খিত সময়ে কাঙ্খিত মানুষটাকে দেখে কিঞ্চিৎ ভড়কেও গেলো।

চিত্রাকে সজাগ দেখে ভ্রু কুঁচকালো বাহার। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“আজও ঘুমাও নি!”

“আজও যদি বলি, আপনি আসবেন বলে ঘুমাই নি।”

বাহার হাসলো। পড়নের টি-শার্ট টা ঝাড়তে ঝাড়তে চিত্রার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠাট্টার স্বরে বললো,
“ইশ, তাহলে তো আসা উচিৎ হয় নি। তোমার ছোট্টো মনটাকে একটু ভেঙে দেওয়া উচিত ছিলো।”

“সারাদিনে যা ভেঙেছেন, তাও বা কম কিসে?”

চিত্রার ঠোঁট ফুলানো গাড়ো অভিমানী বাক্যে বাহার তেমন একটা পাত্তা দিলো না। বরং বেশ গা ছাড়া ভাবে বললো,
“নিজ ইচ্ছায় পাগলও নিজের ক্ষতি করে না, অথচ তুমি নিজেকে ভাঙার জন্য উঠে পরে লেগেছো। তার দায়ভার তো আর আমি নিবো না, তাই না?”

বাহারের কথায় কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো চিত্রা। ভুল জায়গায় ভুল অনুভূতি ব্যাপ্ত করাও এক ধরণের লজ্জার বিষয়।

চিত্রার মুখের লজ্জার আভাস যেন বাহারের বুঝতে বাকি রইলো না। তাই বাহার কথা ঘুরিয়ে বললো,
“তা মেয়ে, আজ কেমন আছো?”

“ভালোই আছি। আপনি?”

“তুমি জানো না মেয়ে, কাউকে এ প্রশ্নটা করা উচিৎ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো এটা। আর বেশিরভাগ মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মিথ্যা বলে। একজনকে দিয়ে মিথ্যা বলানো টাও কিন্তু পাপ।”

বাহারের হেয়ালি পূর্ণ কথায় বিরক্ত হলো চিত্রা। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“তো, আপনি কেনো করছেন? সেধে সেধে পাপ কামাতে আসছেন কেনো?”

“আমি সবসময়েরই পাপী বান্দা। পাপ করা যার নিয়ম। তুমি তো পবিত্র, তোমার কী পাপ করা সাজে?”

বাহারের কথা বলার ভঙ্গিতে মুখ বাঁকালো চিত্রা। বাহার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। বুক হাত দিয়ে চিত্রাকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“উফ্, এখানে লেগেছে মেয়ে।”

বাহারের ভঙ্গিতে চিত্রার বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। পরক্ষণেই খিলখিল করে হেসে উঠলো সে। বাহার কিছুক্ষণ অপলক সে হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর সিগারেট বের ঠোঁটের ভাজে চেপে ধরলো। বুকপকেট থেকে দিয়াশলাইয়ের বাক্সটা বের করতে করতে বললো,
“মেয়ে জাতির যেন স্বভাবই এটা, হেসে দিয়ে পাহাড় ভাঙে। অথচ আমি নষ্ট পুরুষ।”

চিত্রা ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকাতেই বাহার দরজার বাহিরে চলে গেলো। চিত্রা কেবল তাকিয়ে রইলো হা করে। লোকটা কী যেন বলে, তা অর্ধেকই চিত্রার মাথার উপর দিয়ে যায়।

(১৫)

নতুন একটা সকাল, আহাজারিতে পরিপূর্ণ। মহিনের কাটাছেঁড়া লাশটা পড়ে আছে তাদের বাড়ির সামনে রাস্তাটায়। মহিনের মা ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাচ্ছে। চিত্রার বড় চাচা, চাচী, তুহিন, বাহার সবাই ই এসেছে। মহিনের জন্য সবারই খারাপ লাগছে।

নুরুল সওদাগরও ততক্ষণে উপস্থিত হয়েছেন, হাতে তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। রিপোর্টের মৃত্যুর কারণ দেখে সে হতভম্ব।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here